যেসকল আমলের মাধ্যমে সিয়ামের ন্যায় ফযিলত পাওয়া সম্ভব

ভূমিকা: ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের অন্যতম রুকন হলো সিয়াম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তাআলার রাসূল’ এই সাক্ষ্য প্রদান করা,সালাত ক্বায়েম করা, যাকাত আদায় করা, হজ্জ করা ও রামাযানের সিয়াম রাখা। (সহীহ বুখারী, হা/৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৯-২২)। সিয়াম আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের অতুলনীয় একটি মাধ্যম। মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীর উপরে রামাযানের মাসব্যাপী সিয়ামকে ফরয করেছেন। পাশাপাশি বছরের অন্যান্য মাসগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের নফল সিয়াম বিধিবদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে মাসিক, সাপ্তাহিক ও বিশেষ দিনের সিয়াম। জান্নাত পিয়াসী বান্দাগণ এসব সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর রেযামন্দী হাছিল করতে পারে। সেই সাথে আল্লাহ বান্দাদের এমন কিছু বিশেষ আমলের সুসংবাদ দিয়েছেন, যা সম্পাদনের মাধ্যমে সিয়াম পালন না করেও সিয়ামের ন্যায় ফযীলত লাভ করা যায়। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা এই বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

(১). বিবাদ মীমাংসা করা: মুসলমানদের পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার মাধ্যমে একজন বান্দা একই সাথে সিয়াম, ক্বিয়াম ও দান-সাদাক্বার নেকী লাভ করতে পারে। আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,‘আমি কি তোমাদেরকে সালাত,সিয়াম ও সাদাক্বার চেয়ে উত্তম আমলের ব্যাপারে অবহিত করব না? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার অর্থ হলো মুন্ডনকারী। তিনি বলেন, এটা মুন্ডনকারী বলতে আমি বলছি না যে, তা মাথা মুড়িয়ে দেয়, বরং তা দ্বীনকে মুন্ডন করে দেয় (বিনাশ করে)।’ (তিরমিযী হা/২৫০৯; আবূদাঊদ হা/৪৯১৯; মিশকাত হা/৫০৩৮, সনদ সহীহ)। আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ বলেন, এই হাদীসে ‘ফাসাদ দ্বীনকে বিনষ্ট করে’ বলার মাধ্যমে ঝগড়া-বিবাদের ভয়াবহতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিবাদ মীমাংসা করাকে মর্যাদার দিক দিয়ে সিয়াম, ক্বিয়াম ও সাদাক্বার চেয়েও উত্তম আমল গণ্য করা হয়েছে। (আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ, শারহু সুনান আবীদাঊদ ২৮/২০৩)

(২). মিসকীন ও বিধবা মহিলাকে সহযোগিতা করা: সহায়-সম্বলহীন ইয়াতীম, মিসকীন ও অসহায় বিধবা মহিলাদের সহযোগিতার মাধ্যমে একজন মুসলিম সিয়াম পালনকারী, তাহাজ্জুদ আদায় অথবা আল্লাহর পথে সংগ্রামরত মুজাহিদের মত মর্যাদা লাভ করতে পারে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,বিধবা ও মিসকীনদের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ অথবা সারাদিন সিয়াম পালনকারী ও রাতের বেলা (তাহাজ্জুদ) সালাত আদায়কারীর সমান সওয়াবের অধিকারী।(তিরমিযী হা/১৯৬৯; নাসাঈ হা/২৫৭৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৪০, সনদ সহীহ)। অপর বর্ণনায় এসেছে, كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ، ‘(তার মর্যাদা হলো) সেই তাহাজ্জুদগুযারের মত, যে কখনো অলস হয় না এবং সেই সিয়াম পালনকারীর মত, যে কখনো সিয়াম ভাঙ্গে না।’ (সহীহ বুখারী হা/৬০০৭; মুসলিম হা/২৯৮২)। শায়খ উসায়মীন (রহঃ) বলেন, বিধবা ও ইয়াতীম-মিসকীনকে সহযোগিতা করার অর্থ হলো তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা, তাদের উপকার করা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো দেখভাল করা। (উসায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৩/১০০)

(৩). সচ্চরিত্রবান হওয়া: সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিরা তাদের সদাচরণের মাধ্যমে সায়েম ও তাহাজ্জুদগুযারের মর্যাদা লাভ করতে পারে। মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেছেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَاتِ قَائِمِ اللَّيْلِ صَائِمِ النَّهَارِ، ‘নিশ্চয়ই মুমিন বান্দা তার সদাচরণের মাধ্যমে রাতে ক্বিয়ামকারী দিনে সিয়াম পালনকারীর মর্যাদা লাভ করে থাকে।’ (আবু দাঊদ হা/৪৭৯৮; মিশকাত হা/ ৫০৮২, সনদ সহীহ)। শুধু তাই নয় ক্বিয়ামতের দিন মীযানে (পাল্লাতে) সবচেয়ে ভারী বস্ত্ত হবে সদাচরণ। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘মীযানে (পাল্লাতে) যা কিছু রাখা হবে, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভারী বস্ত্ত হবে সচ্চরিত্র। একজন সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সদাচারের মাধ্যমে (নফল) সিয়াম পালনকারী ও রাতের (নফল) সালাত আদায়কারীর মর্যাদায় উপনীত হয়। (তিরমিযী হা/২০০৩; আবু দাঊদ হা/ ৪৭৯৯, সনদ সহীহ)। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, মানুষের সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে তিনটি উপায়ে সচ্চরিত্রবান হওয়া যায়। (১) উপকার ও সহযোগিতার মাধ্যমে মানুষের কষ্ট দূর করা (২) শ্রম ও অর্থের মাধ্যমে দানশীল হওয়া এবং (৩) হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কথা বলা। (ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ, ২/২১৬ পৃঃ)

(৪). পানাহারের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা: আল্লাহর প্রতিটি অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি অন্যতম বড় নেয়ামত হলো খানাপিনা। মহান আল্লাহ খানাপিনার ব্যাপারে শুকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক।’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। আল্লাহর এই নির্দেশকে মান্য করে যারা খানাপিনার পরে শুকরিয়া আদায় করে, তিনি তাদেরকে সায়েমের মর্যাদা দান করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ بِمَنْزِلَةِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ، ‘কৃতজ্ঞ আহারকারী ধৈর্যশীল সিয়াম পালনকারীর সমান মর্যাদাশীল।’ (তিরমিযী হা/২৪৮৬; ইবনু মাজাহ হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৪২০৫, সনদ সহীহ)। উল্লেখ্য যে, শুকরিয়া আদায়ের অর্থ হলো হৃদয় দিয়ে আল্লাহর নেয়ামতকে উপলব্ধি করা, যবান দিয়ে এর প্রশংসা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে নেয়ামতদাতার আনুগত্য করা। সুতরাং শুধু মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাই কেবল শুকরিয়া নয়; বরং তা শুকরিয়া আদায়ের একটি অংশ মাত্র। (ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকিন ২/২৪৬ পৃঃ)

(৫). জুম‘আর দিনের আদব রক্ষা করা: জুম‘আ মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। জুম‘আর দিনের আমলের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদের যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তন্মধ্যে পাঁচটি আমল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, (১) যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন অন্যকে গোসল করাল এবং নিজে গোসল করল। (২) (মসজিদে) আগে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিল এবং নিজেও আগেভাগে মসজিদে গেল। (৩) পায়ে হেঁটে গেল এবং কোন কিছুতে (যানবাহনে) আরোহণ করল না। (৪) অতঃপর ইমামের নিকটবর্তী হয়ে মনোযোগ সহকারে খুৎবা শ্রবণ করল এবং (৫) কোন অনর্থক কাজ করল না। তাহলে তার জন্য প্রতি কদমে এক বছরের (নফল) সিয়াম ও (রাত্রিকালীন) ক্বিয়ামের নেকী রয়েছে।’ (আবু দাঊদ হা/৩৪৫; তিরমিযী হা/৪৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১০৮৭; সহীহুল জামে হা/৬৪০৫, সনদ সহীহ)। সিন্ধী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হল: সেই ব্যক্তি তার প্রতি পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বছর নিয়মিত সিয়াম ও তাহাজ্জুদ আদায়ের মর্যাদা লাভ করবে।’ (ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/৪৭২)। সুতরাং কারো বাড়ী থেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য যদি ১০০ কদম হাঁটতে হয়, আর সে যদি জুম‘আর দিনের উল্লেখিত পাঁচটি আদব রক্ষা করতে পারে, তাহলে তার আমলনামায় ১০০ বছরের নফল সিয়াম ও রাতে তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের সওয়াব লিখে দেওয়া হবে।

(৬). মুসলিম ভূখন্ডের সীমান্ত পাহারা দেওয়া: আল্লাহর পথে পাহারা দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে বান্দা অশেষ নেকী হাছিল করার পাশাপাশি সিয়াম পালন করার নেকী লাভ করে। সালমান ফারেসী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেছেন, رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ، وَأُجْرِيَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ، وَأَمِنَ الْفُتَّانَ، ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া একমাস সিয়াম পালন এবং ইবাদতে রাত জাগার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আর যদি এ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে, তাহলে তার আমলের সওয়াব জারী থাকবে, তার জন্য (শহীদদের মত) রিযিক অব্যাহত রাখা হবে এবং সে (কবরের) ফেতনা সমূহ থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (সহীহ বুখারী হা/২৮৯২; মুসলিম হা/১৯১৩)। অর্থাৎ একদিন-একরাত সীমান্ত পাহারা দেওয়ার মাধ্যমে টানা একমাস তাহাজ্জুদ ও নফল সিয়াম পালন করার নেকী পাওয়া যায়।

(৭). সর্বাবস্থায় তাক্বওয়া অবলম্বন করা: সকল ইবাদতের মূল উৎস হলো তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ইবাদত একনিষ্ঠভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) যখন জিহাদের জন্য কোন বাহিনী প্রেরণ করতেন, তাদের উপদেশ দিয়ে বলতেন, لا تصوموا فإن التقوى على الجهاد أفضل من الصوم، ‘তোমরা (জিহাদরত অবস্থায়) সিয়াম রাখবে না। কেননা জিহাদে তাক্বওয়া অবলম্বন করা সিয়াম পালন করার চেয়েও উত্তম।’ (ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃঃ ১২৫)। অনুরূপভাবে সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে-গোপনে আল্লাহভীতির মাধ্যমে বান্দা সায়েমের মর্যাদা পেতে পারে। যেমন: আয়-রোযগারের ক্ষেত্রে হারাম বর্জন করে হালাল পন্থায় রোযগার করার চেষ্টা করা। হালাল উপার্জনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাযী আবূ ইয়ালা মাওছীলী (রহঃ) বলেন, هُوَ أَفْضَلُ مِنْ التَّفَرُّغِ إلَى طَلَبِ الْعِبَادَةِ مِنْ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ وَالْحَجِّ، ‘এটা (আল্লাহর ভয়ে হালাল উপার্জন করা) সিয়াম, সালাত ও হজ্জের মত ইবাদত সম্পাদনের প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেয়ে উত্তম।'(আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ ৩/২৬৭)। এখানে সিয়াম, সালাত ও হজ্জের মাধ্যমে তিনি নফল ইবাদতকে বুঝিয়েছেন।

(৮). জ্ঞান অর্জন করা ও তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা: দ্বীনের বিধি-বিধান পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।(ইবনে মাজাহ,২২৪)। আল্লাহ বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، ‘অতএব তুমি জান যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই।’ (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। এখানে প্রতিটি ইবাদতের পূর্বে জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাইতো মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেছেন অন্তরগুলোকে মূর্খতা থেকে পুনর্জীবিত করে এবং আঁধার কাটিয়ে দূরদর্শিতার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। জ্ঞানের মাধ্যমেই বান্দা উত্তমদের স্তরে উপনীত হয় এবং দুনিয়া-আখেরাতে সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হয়। ইলম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা সিয়াম সমতুল্য এবং তার পঠন-পাঠন ক্বিয়ামুল লায়লের মত। জ্ঞানের মাধ্যমেই আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যায় এবং এর মাধ্যমেই হালাল ও হারাম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। জ্ঞান হলো আমলের নেতা এবং আমল জ্ঞানের অনুগামী।’ (মাদরিজুস সালেকীন ৩/২৪৬পৃঃ)। ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞানই দ্বীনের মূল স্তম্ভ এবং সর্বোচ্চ আলো। কখনো কখনো জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে বইয়ের পাতাগুলো উল্টানো নফল সিয়াম, সালাত, হজ্জ এবং জিহাদ অপেক্ষা উত্তম হয়ে থাকে। এমন কিছু মানুষ আছে, যে ইলম থেকে বিমুখ থাকার কারণে নিজের ইবাদতে প্রবৃত্তির অনুসরণে ডুবে থাকে। সে নফল ইবাদত করতে গিয়ে অনেক অকাট্য ফরয ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়। স্পষ্ট ওয়াজিবকে ত্যাগ করে তার ধারণাপ্রসূত উত্তম কাজ করে। (অথচ শরীআতে সেটা উত্তম কাজ নয়)। হায়! যদি তার নিকটে সঠিক জ্ঞানের একটি আলোকবর্তিকা থাকত, তাহলে অবশ্যই সে সঠিক পথ পেত।’ (ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের, পৃঃ ১১৩)

(৯). সায়েমদের খেদমত করা: সিয়ামের ন্যায় নেকী লাভ করার অন্যতম একটি উপায় হলো সায়েমদের খেদমত করা। আনাস (রাঃ) বলেন,আমরা একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে একটি সফরে ছিলাম। আমাদের কেউ সিয়াম পালন করেছেন, আবার কেউ ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর প্রচন্ড গরমের সময় আমরা এক প্রান্তরে অবতরণ করলাম। চাদর বিশিষ্ট লোকেরাই আমাদের মধ্যে সর্বাধিক ছায়া লাভ করতে সক্ষম হলো। আমাদের কেউ কেউ নিজ হাত দ্বারা সূর্যের কিরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করছিলেন। অবশেষে সায়েমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং সিয়াম ত্যাগকারীরা সুস্থ থাকল। ফলে তারা তাঁবু খাটালো এবং উটকে পানি পান করাল, কিন্তু সায়েমরা কোন কাজ করল না। (সহীহ বুখারী)। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ذَهَبَ الْمُفْطِرُونَ الْيَوْمَ بِالْأَجْرِ، ‘আজকে তো সিয়াম পরিত্যাগকারীরা সব নেকী অর্জন করে নিল।’ (সহীহ বুখারী হা/২৮৯০; মুসলিম হা/১১১৯)। মূলত সায়েমদের খেদমত করার কারণে রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে এই কথাটি বলেছেন। যার মর্ম হলো খেদমতকারীরা একই সাথে সেবা করার এবং সিয়াম পালন করার সওয়াব হাছিল করল। (ফাৎহুল বারী ৪/১৮৪)

(১০). সায়েমদের ইফতার করানো: সিয়াম না রেখেও সিয়ামের মর্যাদা হাছিলের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো সায়েমদের ইফতার করানো। যায়েদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنَّهُ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا، ‘যে ব্যক্তি কোন সায়েমকে ইফতার করায়, সেই ব্যক্তির জন্যেও সায়েমের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এর ফলে সায়েমের নেকী থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।’ (তিরমিযী হা/৮০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬, সনদ সহীহ)

পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! নেক আমল মানুষের মূল সম্বল। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের মূল পাথেয়। যে ব্যক্তি যত বেশী পাথেয় সঞ্চয় করবে, তার আখেরাতের জীবন তত বেশী সমৃদ্ধ হবে। আর যে পাথেয় সংগ্রহের ব্যাপারে গাফেল থাকবে, তার আখেরাত হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই বুদ্ধিমান মুমিনের কর্তব্য হল সওয়াব অর্জনের সুযোগগুলো কখনো হাতছাড়া না করা এবং সাধ্যানুযায়ী নেক আমলের চেষ্টা করা। আর কোন আমলের দ্বিগুণ নেকী পাওয়ার অন্যতম উপায় হলো অন্যকে সেই আমলের দাওয়াত দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ، ‘যে ব্যক্তি অন্য কোন মানুষকে কোন নেক কাজের পথ দেখায়, সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমান সওয়াব পায়।’ (সহীহ মুসলিম হা/১৮৯৩; আবূদাঊদ হা/৫১২৯; তিরমিযী হা/২৬১৭; মিশকাত হা/২০৯)। সুতরাং কেউ যদি উল্লেখিত আমলগুলোর দাওয়াত অন্যদেরকে দেয় এবং তারা যদি সেই আমলগুলো করে, তাহলে শিক্ষাদানকারীও সমান সওয়াব লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত আমলগুলো সম্পাদন করে সিয়ামের নেকী লাভের সুযোগ দান করুন এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আখেরাতের প্রস্ত্ততি গ্রহণের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।