চামড়ার মোজা বা সূতী কাপড়ের মোজার উপর মাসেহ করার বিধান

প্রশ্ন: চামড়ার মোজা বা সূতী কাপড়ের মোজার উপর মাসেহ করার বিধান কী? মোজার উপর মাসেহ করার সঠিক পদ্ধতি এবং শর্তসমুহ কী কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মোজা দুই প্রকার। যথা- (১)- اَلْخُفُّ [খুফ] অর্থাৎ চামড়ার তৈরী মোজা। (২)- اَلْجَوْرَبُ [জাওরাব] অর্থাৎ কাপড়ের তৈরী মোজা। এই দুই প্রকার মোজার মধ্যে চামড়ার তৈরি মোজার উপর মাসেহ করা জায়েজ; এ বিষয়ে কোন মতানৈক্য নেই। অর্থাৎ সর্ব সম্মতিক্রমে তা বৈধ। তবে সুতার তৈরি মোজার উপর মাসেহ করা বৈধ কি না- এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে, এই মাসালায় দুটি প্রসিদ্ধ মত পাওয়া যায়।
.
(১). চামড়ার মোজা কিংবা সূতী কাপড়ের মোজা উভয়ের উপরই মাসেহ করা জায়েজ। এটি ইমাম নববী, ইবনে হাযম ও শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার সুস্পষ্ট অভিমত। আর এ মতকেই ইমাম মুবারকপুরি, ইমাম উসাইমীন ও ইমাম শানক্বীতী, ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) পছন্দ করেছেন। (দেখুন, ইবনে হাযম আল-মুহাল্লাহ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৮৬ আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ,পৃষ্ঠা: ৫৮ ইবনে তাইমিয়া মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া, খন্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ১৮৪, উসাইমীন আশ শারহুল মুমতি, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯০, আযওয়াউল বায়ান, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ১৮-১৯, তুহফাতুল আহওয়াযী, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৮৫, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৯৫৪)
.
(২). অপর একদল আলেমগণের অভিমত হচ্ছে—স্বচ্ছ মোজার ওপর মাসেহ করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ মোজাটি যদি এমন পাতলা হয় যে, মোজার নীচের চামড়া দেখা যায় তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী, এমন মোজার ওপর মাসেহ করা যাবে না।মোজার ওপর মাসেহ করার বৈধতা মোজা মোটা হওয়ার শর্তযুক্ত।(কাসানী, বাদাইউস সানাই’য় খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১০, আল-ইনসাফ, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৭০: ইমাম ইব্রাহিম ফাতওয়া ওয়া রাসায়িল খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৬৬, ফাতওয়া লাজনাহ আদ দাইমাহ খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ১০১)
.
তবে মাসালায় মতানৈক্য থাকলেও কুরআন-সুন্নাহর দলিল এবং সালাফদের বক্তব্য অনুযায়ী সুতার তৈরি মোজার উপরও মাসাহ করা জায়েয। মোটকথা উভয় প্রকার মোজার উপর মাসেহ জায়েজ চাই তা চামড়ার তৈরি হোক বা সুতার তৈরি হোক। কেননা মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ হওয়ার জন্য হাদীসে কোন প্রকার বিশেষ মোজাকে শর্ত করা হয়নি। তাছাড়া সাহাবীগণ অনেকেই কাপড়ের তৈরি মোজা পরিধান করতেন আর তার উপর মাসেহ করতেন। এমনকি মোজা যদি খুব পাতলা হয় তবুও তার উপর মাসেহ করা জায়েজ;(বিস্তারিত দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৯৫৪)
.
শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ليس في قلبي من المسح شيء، فيه أربعون حديثا عن النبي صلى الله عليه وسلم. মোজার উপরে মাসাহ করা জায়েয, এতে আমার অন্তরে সামান্যতম সন্দেহ নেই। এ সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) থেকে ৪০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।(ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৬০)
.
(১). রাসূল (ﷺ)চামড়ার তৈরী মোজার উপরে মাসাহ করেছেন।
.
মুগীরাহ্ ইবনু শু‘বাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন। তিনি কপালের চুলের উপর, পাগড়ীর উপর এবং মোজার উপর মাসাহ করলেন। (সহীহ বুখারী হা/২০২; মুসলিম হা/২৭৪; মিশকাত হা/৩৯৯)।
.
(২). তিনি কাপড়ের তৈরী মোজার উপরেও মাসাহ করেছেন।
.
মুগীরাহ ইবনু শুবাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করেন এবং সুতি মোজাদ্বয় ও জুতা জোড়ার উপর মাসহ করেন।(আবু দাউদ হা/১৫৯; তিরমিযী হা/৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৫৫৯; মিশকাত হা/৫২৩)
.
সাহাবীগণ অনেকেই কাপড়ের তৈরি মোজা পরিধান করতেন আর তার উপর মাসেহ করতেন। এই মর্মে ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) বলেন, وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ وَابْنُ مَسْعُودٍ وَالْبَرَاءُ بْنُ عَازِبٍ وَأَنَسُ بْنُ مَالِكٍ وَأَبُو أُمَامَةَ وَسَهْلُ بْنُ سَعْدٍ وَعَمْرُو بْنُ حُرَيْثٍ وَرُوِيَ ذَلِكَ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَابْنِ عَبَّاسٍ ‏.‏ অবশ্য আলী ইবনু আবী তালিব, ইবনু মাসউদ, আল-বারাআ ইবনু আযিব, আনাস ইবনু মালিক, আবু উমামাহ, সাহল ইবনু সা’দ ও আমর ইবনু হুরাইস (রাঃ) প্রমূখ সাহাবীগণ তাঁদের উভয় জাওরাবের উপর মাসাহ্ করেছেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এবং ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রেও তা বর্ণিত আছে। (আবু দাউদ হা/১৫৯ টীকা)
.
▪️মোজার উপর মাসেহ করার সঠিক পদ্ধতি:
_____________________________________
মাসেহ করার সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, ওযু করে মোজা পরতে হবে। অতঃপর নতুন ওযুর সময় দুই হাতের ভেজা আঙ্গুলগুলো দুই পায়ের আঙ্গুলের ওপর রাখবে। এরপর হাত দুইটি পায়ের গোছার দিকে টেনে আনবে। ডান পা ডান হাত দিয়ে মাসেহ করবে; বাম পা বাম হাত দিয়ে মাসেহ করবে। মাসেহ করার সময় হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে রাখবে। একাধিকবার মাসেহ করবে না। (দেখুন, শাইখ ফাউযানের আল- মুলাখখাস আল-ফিকহি, খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৩, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১২৭৭৯)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)
বলেন,
يعني أن الذي يمسح هو أعلى الخف، فيُمرّ يده من عند أصابع الرجل إلى الساق فقط، ويكون المسح باليدين جميعاً على الرجلين جميعاً، يعني اليد اليمنى تمسح الرجل اليمنى، واليد اليسرى تمسح الرجل اليسرى في نفس اللحظة، كما تمسح الأذنان، لأن هذا هو ظاهر السنة، لقول المغيرة بن شعبة رضي الله عنه: “فمسح عليهما”، ولم يقل بدأ باليمنى بل قال: مسح عليهما، فظاهر السنة هو هذا. نعم لو فرض أن إحدى يديه لا يعمل بها فيبدأ باليمنى قبل اليسرى، وكثير من الناس يمسح بكلتا يديه على اليمنى وكلتا يديه على اليسرى، وهذا لا أصل له فيما أعلم….وعلى أي صفة مسح أعلى الخف فإنه يجزئ لكن كلامنا هذا في الأفضل.

“অর্থাৎ মোজার যে অংশ মাসেহ করা হবে সেটা উপরের অংশ। শুধু পায়ের আঙ্গুলের দিক থেকে পায়ের গোছার দিকে হাত টেনে আনবে। একত্রে দুই হাত দিয়ে দুই পা মাসেহ করবে। অর্থাৎ ডান হাত দিয়ে ডান পা মাসেহ করবে এবং একই সময়ে বাম হাত দিয়ে বাম পা মাসেহ করবে। যেমনটি দুই কান মাসেহ করার ক্ষেত্রেও করা হয়। কেননা সুন্নাহ থেকে বাহ্যিকভাবে এটাই জানা যায়। দলিল হলো মুগিরা বিন শুবা (রাঃ) এর উক্তি: “তিনি দুই পায়ের ওপর মাসেহ করেছেন।” তিনি এ কথা বলেননি যে, ডান পা দিয়ে শুরু করেছেন। বরং বলেছেন; “দুই পায়ের ওপর মাসেহ করেছেন।” এ কারণে সুন্নাহ থেকে বাহ্যিকভাবে এটাই জানা যায়। হ্যাঁ, যদি এমন হয় যে, তার এক হাত কাজ করে না সেক্ষেত্রে সে বাম পায়ের আগে ডান পা মাসেহ করে তাহলে ঠিক আছে। অনেক মানুষ দুই হাত দিয়ে ডান পা মাসেহ করে এবং দুই হাত দিয়ে বাম পা মাসেহ করে— এর কোন ভিত্তি নেই। তবে ব্যক্তি মোজার উপরের অংশ যেভাবেই মাসেহ করুক না কেন সেটা জায়েয হবে। আমরা এখানে যেটা আলোচনা করেছি সেটা হচ্ছে উত্তম যে পদ্ধতিটি সেটি সম্পর্কে। (উসাইমীন ফাতাওয়াল মারআ আল-মুসলিম, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৫০)
.
মোজার দুই পার্শ্ব কিংবা পেছনের অংশ মাসেহ করবে না। যেহেতু এ বিষয়ে কোন দলিল নেই। এই মর্মে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)
বলেন; وقد يقول قائل : إن ظاهر الأمر قد يكون باطن الخف أولى بالمسح لأنه هو الذي باشر التراب والأوساخ ، لكن عند التأمل نجد أن مسح أعلى الخف هو الأعلى والذي يدل عليه العقل ، لأن هذا المسح لا يراد به التنظيف والتنقية ، وإنما يراد به التعبد ، ولو أننا مسحنا أسفل الخف لكان ذلك تلويثاً له কেউ হয়ত বলতে পারে যে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে মোজার ওপরের অংশ মাসেহ করার চেয়ে নীচের অংশ মাসেহ করা অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ নীচের অংশে মাটি ও ময়লা লাগে। কিন্তু, আমরা চিন্তাভাবনা করে পেয়েছি মোজার ওপরের অংশ মাসেহ করা অধিক যুক্তিযুক্ত এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্মত। কারণ এ মাসেহ দ্বারা পরিষ্কার করা বা নির্মল করা উদ্দেশ্য নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ইবাদত পালন করা। যদি আমরা মোজার নীচের অংশ মাসেহ করতাম তাহলে তো মোজা আরও বেশি ময়লা হয়ে যেত। আল্লাহই ভাল জানেন। (উসাইমীন আল-শারহুল মুমতি, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২১৩)
.
পায়ের তলাতে ধুলো-বালি থাকলেও তার নিচে মাসাহ্‌ করা বিধেয় নয়। আলী (রাঃ) বলেন, ‘দ্বীনে যদি রায় ও বিবেকের স্থান থাকত, তাহলে মোজার উপরের অংশ অপেক্ষা নিচের অংশই অধিক মাসাহ্‌যোগ্য হত। কিন্তু আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে তাঁর মোজার উপরের অংশে মাসাহ্‌ করতে দেখেছি। (আবু দাঊদ, হা/১৬২
দারাকুত্বনী হা/ ৭৮৩; মিশকাত ৫২৫)।

মোজার উপর মাসেহ করার শর্তসমুহ কী কী?
_____________________________________
মোজার উপর মাসেহ করার জন্য শর্ত চারটি:

প্রথম শর্ত: পবিত্র অবস্থায় মোজাদ্বয় পরিধান করা। দলিল হচ্ছে মুগিরা বিন শু’বা (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “মোজাদ্বয়কে রেখে দাও; কারণ আমি সে দুটো পবিত্র অবস্থায় পরিধান করেছি।” (সহীহ বুখারী হা/২০৬, সহীহ মুসলিম হা/৭৯, ২৭৪)
.
ইমাম নববী বলেন; এ হাদিসে দলিল রয়েছে যে, যদি পরিপূর্ণ পবিত্র অবস্থায় মোজা-জোড়া পরিধান করা না হয় তাহলে মোজা-জোড়ার ওপর মাসেহ করা জায়েয হবে না। ইবনে কুদামা বলেন; মাসেহ করা বৈধ হওয়ার জন্য পবিত্রতা পূর্বশর্ত— এ ব্যাপারে কোন মতভেদ আছে বলে আমাদের জানা নেই। (ইবনে কুদামা ‘আল-মুগনি’; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৭৪)
.
দ্বিতীয় শর্ত: মোজাদ্বয় সেটা চামড়ার হোক কিংবা কাপড়ের হোক পবিত্র হতে হবে। নাপাক মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয নেই। দলিল হচ্ছে- আবু সাঈদ খুদরি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত হাদীস। যেখানে বলা হয়েছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে জুতা পায়ে দিয়ে নামায আদায় করছিলেন। নামায আদায়কালে তিনি জুতাজোড়া খুলে ফেলেন এবং জানালেন যে, জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে অবহিত করেছেন যে, জুতাদ্বয়ে নাপাকি আছে। (মুসনাদে আহমেদ হা/১১১৫৯; আবু দাঊদ হা/৬৫০)। এই হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নাপাক জিনিস নিয়ে নামায পড়া নাজায়েয। আর নাপাক জিনিস মাসেহ করতে গেলে যেটা দিয়ে মাসেহ করা হবে সেটাতে নাপাকি লেগে সেটাও নাপাক হয়ে যাবে। তাই সেটা নাপাক জিনিসকে পবিত্র করবে না।
.
তৃতীয় শর্ত: মোজাদ্বয় মাসেহ করা যায় ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করার ক্ষেত্রে। জানাবাত বা যে কারণে গোসল ফরয হয় সে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে মাসেহ করা যায় না। দলিল হচ্ছে সাফওয়ান বিন আস্‌সালের (রাঃ) হাদিস; “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যখন সফরে থাকি তখন আমরা যেন তিনদিন তিনরাত জানাবাত ব্যতীত আমাদের মোজা না খুলি। অর্থাৎ পায়খানা, পেশাব বা ঘুমের কারণে যেন মোজা না খুলি।” (মুসনাদে আহমেদ হা/১৭৬২৩, তিরমিজি হা/৯৬, ইবনু মাজাহ হা/৪৭৮ সনদ হাসান)। এই হাদিসের দলিল থেকে জানা গেল ছোট অপবিত্রতার ক্ষেত্রে মাসেহ চলে; বড় অপবিত্রতার ক্ষেত্রে নয়।
.
চতুর্থ শর্ত: শরীয়ত নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মাসেহ করতে হবে। সে সময়সীমা মুকীমের জন্য একদিন এক রাত। আর মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিনরাত। দলিল হচ্ছে আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) এর হাদিস তিনি বলেন; “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুকীমের জন্য একদিন একরাত ও মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিনরাত নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ মোজার উপর মাসেহ করার সময়কাল।” (সহিহ মুসলিম হা/২৭৬; ইবনু মাজাহ হা/ ৫৫২, মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৫১৭, ৫২০)। হাদীসে বর্ণিত এ সময়কাল শুরু হবে ওযু ভঙ্গ হওয়ার পর প্রথমবার মাসেহ করা থেকে এবং শেষ হবে মুকীমের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা পর। আর মুসাফিরের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পর। যদি আমরা ধরে নিই যে, এক লোক মঙ্গলবার ফজরের সময় ওযু করে ঐ দিন এশার নামায আদায় করা পর্যন্ত এ ওযুর উপর ছিল। রাতে ঘুমিয়েছে। বুধবার ভোরে ফজরের নামাযের জন্য উঠে ঠিক ভোর পাঁচটায় মোজার উপর মাসেহ করেছে। এক্ষেত্রে তার মোজা মাসেহ করার সময়কাল শুরু হবে বুধবার ভোর পাঁচটা এবং শেষ হবে বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটা। যদি ধরা হয় যে, বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার আগে সে ব্যক্তি মোজার উপর মাসেহ করেছে তাহলে সে ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত পবিত্রতার উপর থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ওযু দিয়ে ফজরের নামায ও অন্যান্য নামায পড়া তার জন্য জায়েয। কেননা আলেমদের অগ্রগণ্য মতানুযায়ী, মাসেহ করার সময় পূর্ণ হয়ে গেলেও তার ওযু ভাঙ্গবে না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্রতার জন্য কোন সময় নির্ধারণ করেননি। তিনি মাসেহ করার সময় নির্ধারণ করেছেন। মাসেহ করার সময় পূর্ণ হয়ে গেলে আর মাসেহ করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি মাসেহ এর সময়কাল পূর্ণ হওয়ার সময় ওযু অবস্থায় থাকে তাহলে তার এ পবিত্রতা অব্যাহত থাকবে; নষ্ট হবে না। কারণ এ পবিত্রতা একটি শরয়ী দলিলের ভিত্তিতে সাব্যস্ত হয়েছে। আর যা শরয়ী দলিলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় সেটা অন্য কোন শরয়ী দলিল ছাড়া রহিত হবে না। অথচ মোজার উপর মাসেহ করার সময়কাল পূর্ণ হয়ে গেলে ওযু ভেঙ্গে যাওয়ার পক্ষে কোন দলিল নেই। যে কোন কিছু এর মূল বিধানের উপর অটুট থাকে যতক্ষণ না মূল বিধান দূর হয়ে যাওয়ার পক্ষে কোন দলিল পাওয়া যায়। (বিস্তারিত দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৬৪০) অতএব এগুলো হচ্ছে মোজার উপর মাসেহ করার শর্ত। কোন কোন আলেম আরও কিছু শর্ত উল্লেখ করে থাকেন। তবে, সেসব শর্তের কোন কোনটি আপত্তিকর।
.
▪️মোজার উপর মাসেহ ভঙ্গের কারণ সমূহ: ____________________________________
(ক). গোসল ফরয হলে: অর্থাৎ মোজার উপরে মাসাহ করার পরে স্ত্রী মিলন করলে অথবা স্বপ্নদোষ হলে তা ভঙ্গ হয়ে যাবে। সাফওয়ান ইবনু আস্সাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেেন, অর্থাৎ আমরা যখন সফরে থাকতাম তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, আমরা যেন আমাদের মোযা না খুলি তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।(তিরমিযী হা/৯৬, নাছিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, ইরওয়াউল গালীল, হা/১০৪)
.
(খ). মোযা খুলে ফেললে মাসেহ ভঙ্গ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পবিত্র অবস্থায় মোযা পরিধান করার পরে তা খুলে পুনরায় পরিধান করলে উক্ত মোযার উপরে মাসাহ করা বৈধ নয়।
.
(গ). নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে: ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পরে মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। আর তা হলো, মুক্বীমের জন্য এক দিন ও এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন ও তিন রাত। (মুসলিম হা/৬৬১; মিশকাত, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৮২)
.
◾সফর অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই মুক্বীম হলে তার হুকুম: _____________________________________
সফর অবস্থায় মোযার উপর তিন দিন,তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। কিন্তু সফরকারী এক দিন অথবা দুই দিন পরে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসলে সে মুক্বীম হয়ে গেল। এ অবস্থায় তার জন্য এক দিন,এক রাতের বেশী মাসাহ করা বৈধ নয়। এমতাবস্থায় তার করণীয় হ’ল,সে মুক্বীমের হুকুম পালন করবে। অর্থাৎ যদি এক দিন,এক রাত অতিক্রম হয়ে থাকে তাহ’লে মাসাহ ত্যাগ করবে। আর যদি এক দিন,এক রাতের কিছু অংশ বাকী থাকে তাহ’লে তা পূর্ণ করবে।(উসাইমীন, আশ শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ২৫১)
.
◾মুক্বীম অবস্থায় মোজার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই সফরে বের হ’লে তার হুকুম:

কেউ মুক্বীম অবস্থায় মোজার উপর মাসাহ করে এক দিন অতিক্রম হলে এবং এক রাত বাকী থাকতেই সফরে বের হল। এখন যেহেতু সে মুসাফির সেহেতু তার জন্য তিন দিন, তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। এমতাবস্থায় তার করণীয় হলো, সে মুক্বীমের হুকুম বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ সে তার মুক্বীম অবস্থার বাকী এক রাত মাসাহ করে মাসাহ ত্যাগ করবে। কেননা এক্ষেত্রে মুসাফিরের হুকুম পালন করলে মাসাহ সহীহ হবে কি-না এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। অতএব যে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে তা থেকে দূরে থাকাই উচিত। (উসাইমীন, আশ শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫২)। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যা তোমার কাছে সন্দেহযুক্ত মনে হয়, তা পরিত্যাগ করে সন্দেহমুক্ত কাজ কর। (সুনানে তিরমিযী হা: ২৫১৮)
.
মোজার উপর মাসেহ করার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর কতটুকু সময় পবিত্রতা অটুট থাকবে?
.
এই প্রশ্নটি ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জবাবে শাইখ বলেন,
.
সঠিক মতানুযায়ী মাসেহ করার মেয়াদ শেষ হলেও ওজু ভাঙ্গবে না। অর্থাৎ যদি মাসেহ করার মেয়াদ দুপুর ১২ টায় শেষ হয়ে যায়; কিন্তু রাত পর্যন্ত আপনার পবিত্রতা ভঙ্গ না হয় তাহলে আপনি পবিত্রতার উপর রয়েছেন। কেননা মাসেহ করার সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওজু ভেঙ্গে যায় এই মর্মে কোন দলিল নেই। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসেহ করার সময়কাল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; কিন্তু তিনি পবিত্রতার সময়কাল নির্দিষ্ট করে দেননি। তালিবুল ইলমের উচিত এ নিয়মটি খেয়াল রাখা; সেটা হচ্ছে– যে জিনিস কোন শরয়ি দলিলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে সেটা শরয়ী দলিল ছাড়া রহিত হবে না। কেননা মূলনীতি হচ্ছে– যেটা যে অবস্থায় আছে সেটা সে অবস্থায় অটুট থাকা। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১৭০৫)
.
▪️জুতার ওপর মাসেহ করার বিধি-বিধান:
______________________________
.
যদি কোন জুতা পায়ের টাখনু পর্যন্ত ঢেকে রাখে তাহলে সে জুতার উপর মাসেহ করা জায়েয আছে। কেননা সেটা চামড়ার মোজার সমতুল্য। তবে, পায়ের যতটুকু স্থান ধৌত করা ফরয জুতা যদি ততটুকু স্থান আচ্ছাদিত না করে, সে স্থানটুকু হচ্ছে- পায়ের টাখনুসহ সম্পূর্ণ পায়ের পাতাদ্বয়; সেক্ষেত্রে জমহুর আলেমের মতে, মাসেহ করা জায়েয হবে না। [দেখুন: আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়্যা (৩৭/২৬৪)এটি শাইখ বিন বায ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির মনোনীত অভিমত।

ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: চামড়ার মোজা ও কাপড়ের মোজার ওপর মাসেহ করার শর্ত হচ্ছে– যতটুকু স্থান ধোয়া ফরয ততটুকু স্থানকে ঢাকতে হবে। (বিন বায মাজমুউ ফাতাওয়, খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ১১১, ফাতাওয়াল লাজনা আদ-দায়িমা, খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ৩৯৬)

▪️দুই: যদি কেউ যতটুকু স্থান ধৌত করা ফরজ ততটুকু স্থান আচ্ছাদিত করে এমন জুতার উপর মাসেহ করে, এরপর পবিত্র অবস্থায় জুতা খুলে ফেলে সেক্ষেত্রে আলেমগণের সঠিক মতানুযায়ী তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ খুলে ফেলার মাধ্যমে মাসেহ করার যে রুখসত (শিথিলতা) সেটা শেষ হয়ে যাবে। যদি সে দ্বিতীয়বার জুতা পরে ওজু করার ইচ্ছা করে তাহলে তার কর্তব্য হবে জুতা ও মোজা খুলে ফেলা এবং পায়দ্বয় ধৌত করা।

▪️তিন: যদি সে মোজা পরে মোজার উপর খাটো জুতা পরে -যে জুতা টাখনু ঢাকে না- সেটার তিনটি অবস্থা হতে পারে:

(১)। শুধু জুতার ওপর মাসেহ করা; ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটা জায়েয নেই।

(২)। শুধু মোজাদ্বয়ের ওপর মাসেহ করা। অর্থাৎ জুতা খুলে মোজাদ্বয়ের ওপর হাতদ্বয় দিয়ে মাসেহ করা। এরপর পুনরায় জুতা পরা। এটা জায়েয; এতে কোন অসুবিধা নেই। এ অবস্থায় তিনি জুতা খুলে ফেললেও তার ওজু ভাঙ্গবে না।

(৩)। জুতা ও মোজা উভয়টির ওপরে মাসেহ করা। এটাও জায়েয।

কেউ যদি খাটো জুতার ওপর মাসেহ করে অবশিষ্ট মাসেহ মোজাদ্বয়ের ওপর করার মাধ্যমে মাসেহ পরিপূর্ণ করে সেক্ষেত্রে এ দুটো জিনিসের সাথে বিধান সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। যার ফলে সে ব্যক্তি যদি শুধু জুতা খুলে ফেলে কিংবা মোজাদ্বয়ের সাথে জুতা খুলে ফেলে তার পবিত্রতা ভঙ্গ হবে না; তার জন্য নামায পড়া জায়েয হবে। কিন্তু পরবর্তীতে পাদ্বয় ধৌত করে পরিপূর্ণ ওজু করা ছাড়া জুতা বা মোজার ওপর মাসেহ করা জায়েয হবে না।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেন, অযুকারী শুধু মোজার ওপরে মাসেহ করতে পারেন এবং শুধু বুট জুতার ওপরেও মাসেহ করতে পারেন; যদি বুট জুতা টাখনুদ্বয়কে আচ্ছাদন করে এবং পায়ের পাতার চামড়া দেখা না যায়। আর যদি টাখনুদ্বয় আচ্ছাদন না করে কিন্তু টাখনু ঢেকে রেখেছে এমন মোজা পায়ে থাকে সেক্ষেত্রে ধৌত করার স্থান পর্যন্ত মোজাদ্বয়ের ওপরেও মাসেহ করে তাহলে এ জুতা ও মোজা পরে নামায পরতে পারবে। (ফাতওয়া লাজনাদ দায়মাহ খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ৩৯৬)
.
ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,যদি বুট জুতা সেন্ডেলের মত টাখনুসহ পায়ের পাতা না ঢাকে তখন কেউ যদি মোজাসহ বুটের উপর মাসেহ করে সেক্ষেত্রে এ দুটো জিনিসের সাথে হুকুম সম্পৃক্ত হয়ে যাবে…। সে যদি শুধু মোজার ওপর মাসেহ করত তাহলে সেটাই তার জন্য যথেষ্ট হত, তার যখন ইচ্ছা তখন বুট জুতা খুলে ফেলাও জায়েয হত, কিন্তু তার পবিত্রতা অব্যাহত থাকত। যেহেতু মাসেহ করার হুকুম শুধু মোজা এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। (মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায, খন্ড: ২৯ পৃষ্ঠা: ৭৩; আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২৮৫১৫) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।