কোন মুসলিম ব্যক্তি গুনাহ করে ফেলার পর বাম কাঁধের ফেরেশতা ছয় ঘণ্টা গুনাহ লেখা থেকে কলম উঠিয়ে রাখেন

প্রশ্ন: কোন মুসলিম ব্যক্তি গুনাহ করে ফেলার পর বাম কাঁধের ফেরেশতা ছয় ঘণ্টা গুনাহ লেখা থেকে কলম উঠিয়ে রাখেন (অর্থাৎ গুনাহ লেখে না)। হাদীসটি কী সহীহ?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম হচ্ছে ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান; আর কুরআন সুন্নাহর দলিলগুলো যা ইঙ্গিত করে তা হচ্ছে,ফেরেশতারা মানুষের ভাল কাজ এবং খারাপ কাজ সবই লিপুবদ্ধ করেন, যেমনটি কুরআন হাদীসে বিস্তারিতভাবে বর্নিত হয়েছে।যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ (১০) كِرَامًا كَاتِبِينَ (১১) يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ
“অবশ্যই তোমাদের উপর নিযুক্ত আছে তত্ত্বাবধায়কগণ; সম্মানিত লেখকবৃন্দ।(যারা লিপিবদ্ধ করছে তোমাদের কার্যকলাপ) তারা জানে, যা তোমরা কর”।(সূরা ইনফিতর: ৮২/ ১০-১২) আর এই ফেরেশতারা সমস্ত পরিস্থিতিতে মানুষের সাথে থাকেন, মানুষের ভাল-মন্ধ কথা এবং কাজ সবকিছুই লিখে রাখেন,যেমনটি আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন, اِذۡ یَتَلَقَّی الۡمُتَلَقِّیٰنِ عَنِ الۡیَمِیۡنِ وَ عَنِ الشِّمَالِ قَعِیۡدٌ,مَا یَلۡفِظُ مِنۡ قَوۡلٍ اِلَّا لَدَیۡهِ رَقِیۡبٌ عَتِیۡدٌ “যখন তার ডানে ও বামে বসা দু’জন ফেরেশতা পরস্পর (তার আমল লিখার জন্য) গ্ৰহণ করে,সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে”।(সূরা কাফ: ৫০ আয়াত:১৭-১৮)
.
হাদীসেও এসেছে,ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً “যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করল, কিন্তু তা বাস্তবে পরিণত করল না, আল্লাহ্ তাঁর কাছে তার জন্য পূর্ণ সওয়াব লিখবেন। আর যদি সে মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর বাস্তবেও তা করে, তবে তার জন্য আল্লাহ্ মাত্র একটা গুনাহ লিখেন।(সহীহ বুখারী হা/৬৪৯১; ই:ফা: হা/৬০৪৭) অপর বর্ননায় আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا هَمَّ عَبْدِي بِسَيِّئَةٍ فَلاَ تَكْتُبُوهَا عَلَيْهِ فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا سَيِّئَةً وَإِذَا هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا فَاكْتُبُوهَا حَسَنَةً فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا عَشْرًا .‏ “আল্লাহ তা’আলা (ফেরেশতাদেরকে) বলেন, আমার বান্দা কোন পাপ কর্মের কথা ভাবলেই তা লিখবে না বরং সে যদি তা করে তবে একটি পাপ লিখবে। আর যদি সে কোন নেক কাজের নিয়্যাত করে কিন্তু সে যদি তা না করে, তাহলেও এর প্রতিদানে তার জন্য একটি সাওয়াব লিখবে। আর তা সম্পাদন করলে লিখবে দশটি সাওয়াব”।(সহিহ মুসলিম: হা/ ২৩২; ই.ফা. ২৩৪; ই.সে. ২৪২)
.
সহীহ মুসলিমের আরেক বর্ননায় এসেছে, রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেনঃ
قَالَتِ الْملَائِكَةُ: رَبِّ، ذَاكَ عَبْدُكَ يُرِيدُ أَنْ يَعْمَلَ سَيِّئَةً، وَهُوَ أَبْصَرُ بِهِ، فَقَالَ: ارْقُبُوهُ فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ بِمِثْلِهَا، وَإِنْ تَرَكَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً، إِنَّمَا تَرَكَهَا مِنْ جَرَّايَ
“ফেরেশতারা বলেন, হে প্রভূ! তোমার অমুক বান্দা একটি মন্দ কাজ করার ইচ্ছা করেছে অথচ তিনি স্বচক্ষে তা দেখেন, তখন তিনি তাদেরকে (ফেরেশতাদেরকে) বলেনঃ তাকে পাহারা দাও।(অর্থাৎ দেখ সে কি করে)। যদি সে এ কাজটি করে, তা হলে একটি গুনাহ লিখ। কেননা সে আমার ভয়েই তা বর্জন করেছে।(সহিহ মুসলিম হা/২৩৪;ই.ফা. ২৩৬; ই.সে. ২৪৪) উপরোক্ত হাদীসগুলোর আপাত অর্থ হল, মানুষের খারাপ কাজগুলি করার সাথে সাথেই লিখে ফেলা হয়,যেমনটি উক্ত হাদীসে আল্লাহর বানী থেকে প্রমাণিত হয়,যেখানে তিনি বলেছেন,”যদি সে এ (খারাপ) কাজটি করে, তা হলে একটি গুনাহ লিখ”
.
▪️দ্বিতীয়ত: একটি হাদীসের আলোকে বলা হয় মানুষের দ্বারা পাপ হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেউ যদি কৃত পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে ফেরেশতারা ঐ পাপ লেখেন না, বরং ছেড়ে দেন। হাদীসটি হচ্ছে, আবূ উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ صَاحِبَ الشِّمَالِ لِيَرْفَعُ الْقَلَمَ سِتَّ سَاعَاتٍ عَنِ الْعَبْدِ الْمُسْلِمِ الْمُخْطِئِ أَوِ الْمُسِيءِ، فَإِنْ نَدِمَ وَاسْتَغْفَرَ اللهَ مِنْهَا أَلْقَاهَا، وَإِلا كُتِبَتْ وَاحِدَة
“নিশ্চয় বামের ফিরিশতা পাপী বা অপরাধী মুসলিমের উপর থেকে ছয় ঘন্টা কলম তুলে রাখেন। অতঃপর সে যদি পাপে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহলে তা উপেক্ষা করেন। নচেৎ একটি পাপ লেখা হয়।(ত্বাবারানীর কাবীর হা/ ৭৬৬৭, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান হা/ ৭০৫১,আলবানী সহীহুল জামে’ হা/ ২০৯৭, সিলসিলা সহীহাহ হা/১২০৯)
.
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ জয়ীফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। হাদীসটির আলেদা আলেদা প্রত্যেকটি সনদ ইমাম আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) সহ প্রায় সকল মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন। তবে একাধিক শাহেদ থাকার কারনে ইমাম আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি হাসান বলেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ কথা হল এই হাদিসটিও দুর্বল। কারণ হাদিসের সনদে উরওয়া বিন রুওয়াইয়িম রয়েছে; তিনি মূলত অনেক হাদিস মুরসাল করে বর্ণনা করেছেন। এমনকি কাসেম বিন আব্দুর রহমান থেকে তার হাদিস শোনার বিষয়টি জানা যায় না। তাছাড়া এই হাদীসটির মূল কেন্দ্র হল কাসেম বিন আব্দুর রহমান আশ-শামী। তার সম্পর্কে ইমাম ইবনুল মুনযির বলেন:والقاسم -هذا- اختلف الناس فيه، فمنهم من يُضعف روايته، ومنهم من يوثقها”কাসেমের ব্যাপারে আলেমগন মতভেদ করেছেন। ফলে তাদের কেউ কেউ তার বর্ণনাকে দুর্বল বলেছেন। আবার অন্যরা তার বর্ণনাকে মজবুত তথা শক্তিশালী বলেছেন।(মুখতাসার সুনানে আবু দাউদ: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা:৩৬৭)। অন্য জায়গায় তিনি আরো বলেছেন: “وثقه يحيى بن معين وغيره، وتكلم فيه غير واحد”ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন ও অন্যান্য ব্যক্তি প্রমুখ তাকে মজবুত বলেছেন এবং এর ব্যাপারে একাধিক ব্যক্তি আলোচনা করেছেন (মুখতাসার সুনানে আবু দাউদ: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪২৬)।
.
ইমাম হাফেয যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন: القاسم بن عبد الرحمن أبو عبد الرحمن الدمشقي مولى آل معاوية، قال أحمد بن حنبل: روى عنه علي بن يزيد أعاجيب، وما أراها إلا من قبل القاسم، وقال ابن حبان: يروي عن أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم المعضلا”কাশেম বিন আব্দুর রহমান আবু আব্দুর রহমান আদ-দিমাশক্বী হলেন মুয়াবিয়া পরিবারের নিম্নতম পুরুষ আব্দুর রহমান বিন খালেদের আযাদকৃত দাস। আহমাদ বিন হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ বলেন: আলী বিন ইয়াজিদ তার থেকে আশ্চর্যজনক বিষয় বর্ননা করেন। যা আমি কাসিমের কাছ ছাড়া অন্য কারো কাছে দেখিনি।ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন: তিনি মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সাহাবীদের থেকে বেশ কিছু المعضلات তথা [সনদের মধ্য থেকে পরপর দুই বা ততোধিক বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে এমন হাদীস বর্ণনা করেন। (আল-মুগনী ফিয-যু’আফা: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৫১৯)।
.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তার সম্পর্কে বলেন:
“منكر الحديث، ما أرى البلاء إلا من قبل القاسم”
সে ব্যক্তি মুনকিরুল হাদিস তথা হাদীস অস্বীকারকারী। আমি কোন বিপদ দেখিনি কেবলমাত্র কাসিমের পক্ষ থেকে ছাড়া।(আল-মাজরুহিন লি ইবনে হিব্বান: ২/২১২)।

আর হাফেজ ইবনে হাজার তার তাক্বরীব গ্রন্থ বলেন:
صدوقٌ يُغْرِب كثيرًا”. وينظر:
“তিনি সত্যবাদী তবে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে আপত্তিকর।(তাহযিবুল কামাল ফি আসমায়ির রিজাল: ২৩/৩৮৬, তাহযিবুত তাহযীব: ৮/২৯০)।

হাফেজ ইবনে হাজার তার তাক্বরীব গ্রন্থে তার সম্পর্কে বলেন:صدوقٌ يُرْسِلُ كثيرًا.কাশেমের থেকে তার শোনার ব্যাপারে ত্রুটি ও সন্দেহ রয়েছে। কখনো কখনো ইমাম মিয্যি কাসিম বিন আব্দুর রহমানের থেকে তার রেওয়ায়েত সাব্যস্ত করাকে দুর্বল বলেছেন।(তাহযিবুল কামাল:৮/২০)। আসিম বিন রেজা বিন হায়ওয়া সম্পর্কে ইসহাক বিন মানসুর ইবনে মাঈন থেকে বলেন,সহীহ, আর আবু জুর’আ বলেন,এবং ইবনে হিব্বান সিক্বাহ তথা যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তাকে উল্লেখ করেছেন।(তাহযিবুত তাহযীব:৫/৩৭)।
.
ইমাম দারাকুৎনি তার ই’লাল গ্রন্থে তার সম্পর্কে বলেন, সে দুর্বল। (৩/১৫৩)।এই হাদিস সম্পর্কে আবু নুআইম বলেছেন: : “غريب من حديث عاصم وعروة، لم نكتبه إلا من حديث إسماعيل بن عياش”আসেম এবং উরওয়া থেকে হাদিসটি গরীব। আমরা এই হাদিসটিকে‌ ইসমাইল ইবনে আইয়াশ ছাড়া কারো কাছ থেকে লিখিনি।(হিলইয়াতুল আওলিয়া ৬/১২৪) এই হাদিস সম্পর্কে ইরাকি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: أخرجه البيهقي في الشعب من حديث أبي أمامة بسند فيه لين، باللفظ الأول، ورواه أيضا أطول منه وفيه: (إن صاحب اليمين أميرٌ على صاحب الشمال)، وليس فيه: أنه يأمر صاحب الشمال بإلقاء السيئة حتى يلقي من حسناته واحدة، ولم أجد لذلك أصلاً”এই হাদিসটি ইমাম বায়হাকি “শুয়াব” গ্রন্থে আবু উমামার হাদিস থেকে বর্ণনা করেন। এই হাদিসের মাঝে শৈথিল্য রয়েছে। তিনি এটিকে এর চেয়ে দীর্ঘ করে বর্ণনা করেছেন, তাতে রয়েছে: “ডান দিকওয়ালা বামদিক ওয়ালাদের উপর নেতা হবে” তবে এর মধ্যে নাই যে বামদিক ওয়ালাদেরকে খারাপ কাজের সাক্ষাৎ করার সাথে যতক্ষণ পর্যন্ত ভালো কাজ না করবে এটা আদেশ দেওয়া হয়নি এজন্য এর মূল ভিত্তি পাওয়া যায়নি।(মুগনী পৃষ্ঠা: ১৪৯৫)
.
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, কুরআন হাদিসের দলিল এবং মহাদ্দিসগনের তাহক্বীক থেকে একথাই প্রমাণিত যে, বাম কাঁধের ফিরিশতা পাপী মুসলিমের উপর থেকে ছয় ঘন্টা কলম তুলে রাখেন মর্মে বর্নিত হাদীসটি রাসূল (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্র প্রমাণিত হয়নি। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।