রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বের কথা ও কর্ম কী শরীয়তের দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হবে

উত্তর: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের পূর্বের কর্মগুলোর ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো সেগুলো শারঈ সুন্নাহ হতে বহির্ভূত। কারন রাসূল (ﷺ) তখন অন্যসব মানুষের মতোই রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ ছিলেন, তবে তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মহা মানব। শৈশব থেকেই মহান আল্লাহ তাকে অন্যসব মানুষ থেকে আলাদা ভাবে গড়ে তুলেছেন এবং তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কিন্তু ওহীর বিধিনিষেধ পৌছানোর দায়িত্ব তখন তার ছিলনা কেননা রাসূল (ﷺ)-এর নবুওত এর পূর্বের কর্মগুলো তার উম্মতের জন্য অনুসরণীয় দলিল হওয়ার পক্ষে কুরআন হাদিসে বিশুদ্ধ কোন বর্ননা আসেনি। সুতরাং নবুয়তের পূর্বে রাসূল (ﷺ) যা করেছেন সেই কর্মগুলোর ক্ষেত্রে তার অনুসরণ করা কিংবা তাঁকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া আমাদের জন্য আবশ্যক তথা ফরজ নয়। তবে নবুয়তের পরে শারঈভাবে যেগুলি শরীয়ত হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।অর্থাৎ নবুয়তের পরবর্তী ২৩ বছরের যাবতীয় হুকুম আহকামের অনুসরণ করা আবশ্যক আর তা ওয়াজিবের দিক দিয়ে হোক কিংবা মুস্তাহাবের দিক দিয়ে হোক। যেমন ওয়াদা পূর্ণ করা, দুঃখ ভারাক্রান্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করা, মেহমানদের সম্মান করা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সহায়তা করা অনুরূপ আরো যা কিছু রয়েছে ইত্যাদি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তার অনুকরণ করা আমাদের জন্য আবশ্যক। আর তা এজন্য যে, রাসূল (ﷺ)-এর নবুয়তের পর এগুলো আমাদের জন্য শরীয়ত হয়ে গিয়েছে।সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে,তিনি তার নবুওয়াতী মিশন শুরু করার আগে যেসকল কাজ করেছেন তা আমরা অনুসরণ করতে বাধ্য নই,কারণ হয় সেগুলো আমাদের জন্য শরীয়ত হিসেবে সাব্যস্ত হয় নি। আর না হয় সেগুলো মানসূখ/রহিত হয়ে গেছে নবুয়তের পরে যা তার বিপরীত এমন বিষয় বর্ণিত হওয়ার জন্য।
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:قُلۡ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیۡ رَسُوۡلُ اللّٰهِ اِلَیۡکُمۡ جَمِیۡعَۨا الَّذِیۡ لَهٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۪ فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهِ النَّبِیِّ الۡاُمِّیِّ الَّذِیۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰهِ وَ کَلِمٰتِهٖ وَ اتَّبِعُوۡهُ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ )হে নবী আপনি) বলুন, হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই; তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূল উম্মী নবীর প্রতি যিনি আল্লাহ ও তার বাণীসমূহে ঈমান রাখেন। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।(সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮) এই আয়াতও মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর রিসালাত সার্বজনীন রিসালাত প্রমাণিত হওয়ার জন্য স্পষ্ট। এতে মহান আল্লাহ নবী (ﷺ)-কে আদেশ করেছেন, যেন তিনি ঘোষণা করে দেন যে, ‘হে বিশ্বের মানুষ! আমি তোমাদের সকলের প্রতি রসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ এভাবে তিনি বিশ্বের সকল মানব জাতির জন্য ত্রাণকর্তা ও রসূল। আয়াতের সারমর্ম এই যে, এ আয়াতের দ্বারা বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য, প্রত্যেক দেশ ও ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জন্য এবং প্রত্যেকটি জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপকভাবে রাসূল হওয়া প্রমাণিত হয়েছে। সাথে সাথে একথাও সাব্যস্ত হয়ে গেছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবী হিসেবে আবির্ভাবের পর যে লোক তার প্রতি ঈমান আনবে না, সে লোক কোন পূর্ববর্তী শরীআত ও কিতাবের কিংবা অন্য কোন ধর্ম ও মতের পরিপূর্ণ আনুগত্য একান্ত নিষ্ঠাপরায়ণভাবে করতে থাকা সত্বেও কস্মিনকালেও মুক্তি পাবে না। হাদীসে এসেছে আবু মূসা আশ’আর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে উদ্ধৃত বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লোক আমার আবির্ভাব সম্পর্কে শুনবে, তা সে আমার উম্মতদের মধ্যে হোক কিংবা ইয়াহুদী নাসারা হোক, যদি সে আমার উপর ঈমান না আনে, তাহলে জাহান্নামে যাবে’। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩৫০] সুতরাং এগুলো সবই নবুওত লাভের পরবর্তী সময়ের সাথে সম্পৃক্ত পূর্বের সাথে নয়।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,

(والأمور التي جرت قبل النبوة لا تذكر للأخذ والتشريع كفعله بعد النبوة , لأن المسلمين أجمعوا على أن الذي فرض على العباد من الإيمان به صلى الله عليه وسلم ، والعمل بما جاء به ، إنما ذلك لما كان بعد النبوة .ولهذا كان عندهم : من ترك الجمعة والجماعة ، وتخلى في الغيران والكهوف والجبال ، حيث لا جمعة ولا جماعة ، وزعم أنه يقتدي بالنبي صلى الله عليه لكونه كان متحنثا في غار حراء قبل النبوة ، فترك ما شرع له من العبادات الشرعية التي أمر الله بها ورسوله ، واقتدى بما كان يفعل قبل النبوة ـ كان مخطئا ؛ فإن النبي صلى الله عليه وسلم بعد أن أكرمه الله بالنبوة ، لم يكن يفعل ما فعله قبل ذلك ، من حيث التحنث في غار حراء أو نحو ذلك .ولم يكن أحد من أصحابه صلوات الله عليه من بعده ، يأتي لغار حراء، ولا يتخلفون عن الجمعة والجماعة في الأماكن المنقطعة ، ولا عمل أحد منهم خلوة أربعينية ، كما يفعله بعض المتأخرين ، بل كانوا يعبدون الله بالعبادات الشرعية التي شرعها لهم النبي صلى الله عليه وآله وسلم ”

“নবুওয়াতের পূর্বে যে বিষয়গুলো ঘটেছিল সেগুলোকে অনুসরণীয় বা শারঈ দলিল হিসেবে উল্লেখ করা করা হয়নি, যেমনটি নবুওয়াতের পরের কর্মগুলো গ্রহণযোগ্য। কারণ মুসলিমরা সর্বসম্মতভাবে একমত যে, তাঁর (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনা এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনা ফরজ। মূলত এটি নবুয়তের পরে (নবী হওয়ার পর) যা ঘটেছিল তার সাথে সম্পর্কযুক্ত পূর্বের সাথে নয়। তাই যে ব্যক্তি জুমা ও জামাআত পরিত্যাগ করবে এবং পাহাড় ও পর্বতে নির্জনতা অবলম্বন করবে,এমনকি কোন জুমা ও জামাআতে সালাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে, আর সে ধারণা করবে যে, সে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর অনুসরণ করছে। কারণ তিনি নবুয়তের পূর্বে হেরা পর্বতে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। এইভাবে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত ও নির্দেশিত শারঈ ইবাদতগুলো পরিত্যাগ করবে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের পূর্বের কর্মগুলো অনুকরণ ও অনুসরণ করবে। তাহলে সে অবশ্যই ভুল করবে। কারণ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলা তাকে নবুওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করার পর তিনি এর পূর্বে যা করেছেন যেমন: হেরা গুহায় একাকী নির্জনতা অবলম্বন করা অথবা অনুরূপ ইত্যাদি আর করেননি। এমনকি রাসূল (ﷺ)-এর পরে তাঁর সাহাবাদের কেউ হেরা গুহায় যাননি এবং তারা বিচ্ছিন্ন স্থানে জুমু‘আর নামায আদায় করা কিংবা জামাআতে নামায আদায় করা থেকে বিরত থাকেননি। এমনকি তাদের কেউই চল্লিশ দিন ধ্যানে মগ্ন থাকেননি,যেমনটি পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ করে থাকেন, বরং তারা (সাহাবীরা) রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশিত শারঈ পদ্ধতিতেই আল্লাহর ইবাদত করতেন”(ইবনে তাইমিয়া; মাজমু আল-ফাতাওয়া খন্ড: ১৮ পৃষ্ঠা: ১০)
.
উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিসগণ তথা হাদীসের ইমামগন সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর প্রতি তারা গুরুত্ব দিতেন। যদিও সেগুলো নবুয়তের পূর্বের হয়,আর সেগুলো মুহাদ্দিসগণের সংজ্ঞা অনুসারে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত,যারা মুহাম্মদ (ﷺ) থেকে বর্ণিত প্রত্যেকটি বিষয় সুন্নাত মনে করতেন।ফলে তারা এর উপর ভিত্তি করে তাদের কিতাবাদিতে তা বর্ণনা করতেন। এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: হুকুম আহকামের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর কর্ম ও তার প্রমাণাদি। লেখক: ডক্টর মুহাম্মদ আরুসী, পৃষ্ঠা: ১৪৯। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।