কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা সন্মানিত আলেমদেরকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার বিধান

প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা সন্মানিত আলেমদেরকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া অথবা ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল, ডলারখোর ইত্যাদি বলে অপবাদ দেওয়ার বিধান কী??
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আরবি (بَهته) বুহতান শব্দের অর্থ- অপবাদ, দুর্নাম, মিথ্যারোপ ইত্যাদি। অপবাদের সংজ্ঞা হচ্ছে, কোন ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কিছু মিথ্যা বলা যা ঐ ব্যাক্তি করেনি, কিন্তু আপনি বলেছেন সে করেছে। রাসূল (ﷺ) এর হাদিসের ভাষায়, মিথ্যা অপবাদের সংজ্ঞা হলো কারো ব্যাপারে অন্যের নিকটে এমন কথা বলা যা তার মাঝে নেই। মিথ্যা অপবাদ একটি জঘন্য পাপ। কারণ, কারো উপর মিথ্যা অপবাদ/সাক্ষ্য দিয়ে প্রচার করা সবচেয়ে বড় তিনটি কাবীরা গুনাহের মধ্যে অন্যতম। আবু বাকরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; আমি কি তোমাদের সব থেকে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললাম; অবশ্যই সতর্ক করবেন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন; আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার গণ্য করা, পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসলেন এবং বললেন; মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, দু’বার করে বললেন এবং ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না। (সহীহ বুখারী হা/৫৯৭৬; সহীহ মুসলিম হা/৮৭)। অপর বর্ননায় নবী (ﷺ) আরো এরশাদ করেছেন, إِنَّ أَعْظَمَ النَّاسِ فِرْيَةً لَرَجُلٌ هَاجَى رَجُلاً فَهَجَا الْقَبِيلَةَ بِأَسْرِهَا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ আরোপকারী সে ব্যক্তি, যে কারো কুৎসা রটনা করার সময় পুরো গোত্রের কুৎসা রটনা করে। (ইবনু মাজাহ হা/৩৭৬১; সহীহুল জামে হা/১৫৬৯)। আরেক বর্ননায় এসেছে, إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا اسْتِطَالَةَ الْمَرْءِ فِي عِرْضِ أَخِيهِ. ‘সবচেয়ে বড় সূদ হলো অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের মানহানি করা।(আবু দাউদ হা/৪৮৭৬; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৪৩৩, ৩৯৫০; সহীহুল জামে হা/২২০৩, ২৫৩১; সহীহুত তারগীব হা/২৮৩৩)
.
সুতরাং সুস্পষ্ট সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া কোন মুসলিমকে অপবাদ দেওয়া কিংবা “ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল” বলা এক প্রকার তাকফির যা দলিল বিহীন মিথ্যা হলে যিনি অপবাদ দিচ্ছেন তার ওপর কার্যকর হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে কতিপয় পথভ্রষ্ট দাঈ বিদআতি, শী‘আ এবং খা|রেজী মানহাজে বিশ্বাসী হয়ে বিশ্ববরেণ্য সালাফী আলেমগন সম্পর্কে চরম ঘৃণা প্রদর্শন করে বলে সালাফিরা/আহলে হাদীসরা বাদশার গোলাম, রিয়ালের বিনিময়ে শরীআত বিক্রেতা, তারা জিহা-দকে অবজ্ঞা করে ইত্যাদি। সঊদী আরবের শাসকগোষ্ঠীকে মুনাফিক, ইহুদী-খ্রিস্টানদের দালাল বলে কটাক্ষ করে থাকে। ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, শাইখ আলবানী প্রমুখ আপোষহীন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক এবং মুহাদ্দিস উলামায়ে কেরামকে সহ্যই করতে পারে না। ইরান-ইয়ামানের শী‘আরা যখন সঊদী আরবে হামলা চালায়, তখন তারা আনন্দ উল্লাস করে। শী‘আরা যখন সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, বাহরাইন, ইয়ামানের সুন্নি মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে, সালাফী বিদ্বানদের পুড়িয়ে মারে, তখন তাদের হৃদয়ে এতটুকুও দাগ কাটে না। কিন্তু সঊদী জোট যখন পাল্টা হামলা চালায়, তখন তাদের বুক ফেটে যায়, মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় তুলে। যদিও তারাই আবার সঊদী আরবের টাকা নিয়ে এসে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল তৈরি করে ধর্মের নামে জমজমাট ব্যবসা করছে। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজার জ্ঞান অর্জনের খবর নেই অথচ বড় বড় চেয়ার দখল করে আছে। তারা ধারণার বশবর্তী হয়ে অপর মুসলিম দ্বীনি ভাইকে জঘন্য মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। অথচ এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে একটুও চিন্তা করে না। মহান আল্লাহ বলেন; হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু। (সূরা হুজুরাত; ৪৯/১২)। এখানে মানব স্বভাবের তিনটি মারাত্মক ত্রুটি বর্ণনা করা হয়েছে। যা সমাজের শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট করে। প্রথমটি হলো ‘অহেতুক ধারণা’ (بَعْضَ الظَّنِّ) এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘ছিদ্রান্বেষণ’ (وَلاَ تَجَسَّسُوا)। তৃতীয়টি হলো ‘গীবত’ (وَلا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضاً)।
.
তাছাড়া মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। যারা এই পৃথিবীতে ইচ্ছাকৃতভাবে বান্দার হক বিনষ্ট করবে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না ঐ বান্দা তাকে ক্ষমা করে। যারা দুনিয়ায় বান্দার হক বিনষ্ট করবে তারা ক্বিয়ামতের দিন সর্বাধিক অসহায় ও নিঃস্ব হিসাবে গণ্য হবে। তাদের সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত কবুল হবে। তবে তার ইবাদতগুলোর সওয়াব যেসব মানুষের অধিকার নষ্ট করেছে তাদেরকে দিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার কারণে দুনিয়াতেও শাসক/বিচারক চাইলে অপবাদকারীকে শাস্তি দিতে পারেন। সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন; قذف المسلم لأخيه لا يجوز ، وهو كبيرة من الكبائر ، يجب التوبة من ذلك ، وطلب العفو من المقذوف ، ومن حقه إذا لم يعف أن يطالبه شرعا بحقه একজন মুসলমানের জন্য তার ভাইকে অপবাদ দেওয়া জায়েজ নয় এবং এটি একটি বড় গুনাহ; তাকে অবশ্যই তা থেকে অনুতপ্ত হতে হবে এবং যাকে অপবাদ দিয়েছেন তার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে; যদি পরবর্তী ব্যক্তি (যার নামে অপবাদ দেওয়া হয়েছে) তাকে (অপবাদকারীকে) ক্ষমা না করে, তবে শরীয়ত অনুযায়ী তার অধিকার দাবি করার অধিকার রয়েছে।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ২২ পৃষ্ঠা: ৭৮)
.
বান্দার হক নষ্ট করা ব্যক্তিদের পরকালীন অবস্থা সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করেছে সে যেন তা থেকে আজই মাফ চেয়ে নেয়, তার ভাইয়ের জন্য তার কাছ থেকে নেকী কর্তন করে নেওয়ার পূর্বে। কেননা সেখানে (হাশরের ময়দানে) কোন দীনার বা দেরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি নেকী না থাকে তবে তার (মযলূম) ভাইয়ের গোনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা/৬৫৩৪)। তিনি বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়া থেকে সালাত-সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে এবং সাথে ঐসব লোকেরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কারো উপরে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল গ্রাস করেছে, কাউকে হত্যা করেছে বা কাউকে প্রহার করেছে। তখন ঐসব পাওনাদারকে ঐ ব্যক্তির নেকী থেকে পরিশোধ করা হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন ঐসব লোকদের পাপসমূহ এই ব্যক্তির উপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭)। জাবের (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, কোন জান্নাতবাসী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ তার উপর কোন জাহান্নামবাসীর দাবী অবশিষ্ট থাকবে। আর কোন জাহান্নামবাসীও জাহান্নামে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ তার উপর কোন জান্নাতবাসীর দাবী অবশিষ্ট থাকবে। আমি বললাম, সে দাবী কিভাবে মিটমাট করবে, যেখানে আমরা সকলে উত্থিত হব আল্লাহর সমীপে সহায়-সম্বলহীনভাবে? তিনি বলেন, নেকী ও গোনাহ দ্বারা। (আহমাদ হা/১৬০৪২; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৭০; সহীহুত তারগীব হা/৩৬০৮)
.
পরিশেষে, মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করছি- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উপর বিশেষ রহমত নাযিল করুন, সিরাতে মুস্তাক্বীমে চলা সহজ করে দিন, সালফে-সালেহীনের মানহাজ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং তাঁদের সাথে জান্নাতে একত্রিত করুন,অপরদিকে যারা সালাফি আলেমদের ওপর মিথ্যারোপ করে তাদেরকে হেদায়েত দান করুন,,আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।