মোবাইল থেকে কিংবা মুখস্থ কুরআন তেলোয়াত করলে কি সওয়াব কম হবে

প্রশ্ন: কেউ যদি মোবাইল থেকে কিংবা মুসহাফ না দেখে মুখস্থ কুরআন তেলোয়াত করে তাহলে কি সওয়াব কম হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহর কালাম, যা সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর নাযিল করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের হক্ব আদায় করা ছাড়া কারো পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জীবনের শুরুতেই কুরআন শিখতে হবে, সম্মানের সাথে নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে, বুঝার চেষ্টা করতে হবে এবং আসমানী সংবিধান হিসাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে।মহান আল্লাহ বলেন, আমরা আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, সবকিছুর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে এবং মুসলিমদের জন্য হেদায়াত, রহমত ও সুসংবাদ স্বরূপ’ (সূরা নাহল ৮৯, ১০২)। এজন্য কুরআনের প্রত্যেকটি অক্ষর, শব্দ, বাক্য, আয়াত ও সূরা রহমত, বরকত, হেদায়াত, প্রশান্তি ও নেকীতে পরিপূর্ণ। যখনই আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করা হয়, তখনই এগুলো নাযিল হয়। এতে মুমিন ব্যক্তির ঈমানও বৃদ্ধি পায়। কারণ কুরআন বরকতপূর্ণ। যে অন্তর কুরআন মুখস্থ করেছে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না।(দারেমী, হা/৩৩১৯, সনদ সহীহ)। কুরআন তেলাওয়াতে প্রত্যেক হরফের বিনিময়ে রয়েছে দশ নেকী (মুসতাদরাক হাকিম, হা/২০৮০, সনদ ছহীহ)। এ কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তার পাঠকদের জন্য সুপারিশকারীরূপে আসবে (ছহীহ মুসলিম, হা/৮০৪)।
.
কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে- যেভাবে পড়লে ব্যক্তির একাগ্রতা বাড়ে সেভাবে তেলাওয়াত করা। যদি মুখস্থ থেকে পড়লে একাগ্রতা বাড়ে তাহলে সেটাই উত্তম। আর যদি মুসহাফ থেকে পড়লে কিংবা মোবাইল থেকে পড়লে একাগ্রতা বাড়ে তাহলে সেটা করা উত্তম। কিন্তু মুসহাফ দেখে দেখে কুরআন তেলোয়াত করলে বেশি নেকি হবে আর মুখাস্ত পড়লে কম নেকি হবে এমনটি নয়।কেননা এই মর্মে কুরআন হাদীসে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই,বরং কুরআন দেখে পড়া হোক বা মুখস্থ পড়া হোক প্রতি হরফে কমপক্ষে দশটি করে নেকী হবে, আর যারা কষ্টদায়ক হওয়া সত্ত্বেও থেমে থেমে পড়ে তাদের জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে ইনশাআল্লাহ।অপরদিকে মুসহাফে দৃষ্টি দেয়ার ফযিলত সম্পর্কে যা কিছু বর্নিত হয়েছে সবই জাল জয়ীফ যেগুলো দিয়ে দলিল দেয়ার উপযুক্ত নয়। যেমন: রাসূল ﷺ)বলেন,আমার উম্মতের সর্বোত্তম আমল হল কুরআন দেখে পড়া মর্মে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা সহীহ নয়।(যঈফুল জামে‘ হা/১০৪৮ ও ৩৯৮০)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

” قراءة القرآن من المصحف أفضل من القراءة من حفظه ، هكذا قال أصحابنا ، وهو مشهور عن السلف رضي الله عنهم ، وهذا ليس على إطلاقه ، بل إن كان القارئ من حفظه يحصل له من التدبر والتفكر وجمع القلب والبصر أكثر مما يحصل من المصحف فالقراءة من الحفظ أفضل ، وإن استويا فمن المصحف أفضل ، وهذا مراد السلف ”

“মুসহাফ থেকে কুরআন পড়া মুখস্থ থেকে পড়ার চেয়ে উত্তম। আমাদের মাযহাবের আলেমগণ এমনটি বলেছেন। সালফে সালেহীনদের থেকেও এটাই প্রসিদ্ধ অভিমত। তবে, এটি সর্বক্ষেত্রে নয়। বরঞ্চ মুখস্থ থেকে তেলাওয়াতকারীর তাদাব্বুর, তাফাক্কুর, মন ও দৃষ্টির উপস্থিতি এভাবে একত্রিত হয় যা মুসহাফ থেকে তেলাওয়াতকারীর হয় না। অতএব, মুখস্থ থেকে তেলাওয়াত করাই উত্তম। আর যদি উভয় প্রকারের পড়া সম-মানের হয় তাহলে মুসহাফ থেকে পড়াই উত্তম। সলফে সালেহীনদের এটাই উদ্দেশ্য।(ইমাম নববী ‘আল-আযকার পৃষ্ঠা- ৯০-৯১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: মুসহাফ থেকে কুরআন পড়া কিংবা মুখস্থ থেকে কুরআন পড়ার মধ্যে সওয়াবের মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? যখন মুসহাফ থেকে কুরআন পড়া হয় তখন কি দুই চোখ দিয়ে পড়াই যথেষ্ট; নাকি ঠোঁট নাড়তে হবে? নাকি শব্দও বের করতে হবে?

জবাবে তিনি বলেন:

“لا أعلم دليلا يفرق بين القراءة في المصحف أو القراءة عن ظهر قلب، وإنما المشروع التدبر وإحضار القلب، سواء قرأ من المصحف أو عن ظهر قلب، وإنما تكون قراءة إذا سمعها. ولا يكفي نظر العينين ولا استحضار القراءة من غير تلفظ. والسنة للقارئ أن يتلفظ ويتدبر، كما قال الله عز وجل: ( كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ) وقال عز وجل: ( أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا ) وإذا كانت القراءة عن ظهر قلب أخشع لقلبه وأقرب إلى تدبر القرآن ، فهي أفضل ، وإن كانت القراءة من المصحف أخشع لقلبه ، وأكمل في تدبره كانت أفضل ، والله ولي التوفيق ”

আমি এমন কোন দলিল জানি না যাতে মুসহাফ থেকে কুরআন পড়া বা মুখস্থ থেকে কুরআন পড়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। তবে, শরিয়তের বিধান হচ্ছে- তাদাব্বুর ও মনোযোগ দিয়ে পড়া। সেটা মুসহাফ থেকে হোক কিংবা মুখস্থ থেকে হোক। পাঠকারী যদি নিজে শুনে তখন এটাকে পড়া বলা হবে। শুধু চোখ দিয়ে দেখা যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে উচ্চারণ না করে মনে মনে পড়াও যথেষ্ট নয়। সুন্নত হচ্ছে- তেলাওয়াতকারী উচ্চারণ করবে এবং তাদাব্বুর করবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন: “এক মুবারক কিতাব, আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে তাদাব্বুর করে (গভীরভাবে চিন্তা করে) এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।”[সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯] তিনি আরও বলেন: তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?”[সূরা মুহাম্মদ ৪৭: ২৪] সুতরাং মুখস্থ থেকে পড়া যদি অন্তরের একাগ্রতা ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করার অধিক উপযুক্ত হয় তাহলে সেটাই উত্তম। আর যদি মুসহাফ থেকে পড়া অন্তরের একাগ্রতা ও গভীর চিন্তা-ভাবনার অধিক উপযুক্ত হয় তাহলে সেটাই উত্তম। আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা।(বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/২৪; পৃষ্ঠা: ৩৫২)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আপনি যদি একাগ্র চিত্তে ও গভীর চিন্তা-ভাবনাসহ মোবাইল থেকে কুরআন দেখে পড়েন আর মুখস্থ পড়েন ইনশাআল্লাহ্‌ আপনার সওয়াবে কমতি হবে না। কারণ মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- অন্তরের উপস্থিতি ও কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হওয়া। (বিস্তারিত জানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৯১৯৮)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।