ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কুরবানী দেওয়ার বিধান এবং অন্যের থেকে ঋণ নিয়ে কুরবানী দেওয়া যাবে কি

কুরআন-সুন্নাহ এবং জমহুর ইমামগনের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কুরবানী দেওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। অপরদিকে যারা কুরবানী ওয়াজিব বলেছেন তারা সবাই একমত যে, একজন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে- সামর্থ্য থাকা। সামর্থ্যের একটি দিক হচ্ছে- আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। সুতরাং,যে ব্যক্তি আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান নয় তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তাই কারো যদি ঋণ থাকে এবং ঐ ঋণ যদি তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করা আবশ্যক হয় তাহলে কুরবানীর উপর সে ঋণকে প্রাধান্য দেয়া হবে; যেহেতু ঋণ পরিশোধ করা ওয়াজিব। অপরদিকে কুরবানী দেওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। যদি ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে কোন কিছু না থাকে তাহলে আল্লাহ্‌ তাকে সম্পদশালী করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর যদি নিয়মতান্ত্রিক মেয়াদী ঋণ হয় এবং ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, ঋণ পরিশোধের সময় হলে সে পরিশোধ করতে পারবে এবং এ ঋণ কুরবানী দেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না; এক্ষেত্রে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কুরবানী দিতে পারে।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] বলেন, ঋণদাতা যদি পরিশোধের তাগাদা না দেয় তাহলে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কুরবানী দিতে পারে। আর সাময়িক অসচ্ছল ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা রাখেন, তাহলে তিনিও ঋণ করে কুরবানী দিতে পারেন। তবে পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকলেও ঋণ করে কোরবানি না করাই উত্তম। কেননা এটা আবশ্যক নয় যে, তাকে কোরবানি করতেই হবে। (ইবনে তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৬/৩০৫)
.
🔹অন্যের থেকে ঋণ নিয়ে কুরবানী দেওয়া যাবে কি?
_______________________________________
কুরআন-সুন্নাহর দলিল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ঐক্যমতে ঋণ দেওয়া এবং নেওয়া জায়েজ যতক্ষণ না শরীয়ত বিরোধী কোনো শর্ত থাকে। সুতরাং, একজন ব্যক্তি যদি নিশ্চিত থাকে দে ঋণ গ্রহণ করলে সেটা যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারবে যেমন একজন ব্যক্তি যিনি চাকরি করেন এবং মাস শেষে বেতন পান, আর যেহেতু কুরবানী প্রতি বছরে একবারই আসে তাই তিনি কুরবানী দিতে চাচ্ছেন তাহলে ঋণ নিয়ে তিনি কুরবানী দিতে পারেন। কিন্তু যদি ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করার কোন নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে ঋণ গ্রহন না করাই উত্তম। কারণ ঋণ করে কুরবানী দেওয়া তার ওপর আবশ্যক নয়।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) কে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে কুরবানী দিতে সক্ষম নয়- তার কি ঋণ নেওয়া উচিত? তিনি জবাবে বলেন: যদি সে পরিশোধ করতে পারে এবং সে ঋণ নেয় যাতে সে কুরবানী দিতে পারে, তবে তা উত্তম, কিন্তু সে তা করতে বাধ্য নয় (মাজমু’আল-ফাতাওয়া, খন্ড: ২৬, পৃষ্ঠা:৩০৫, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪১৬৯৬)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যার সামর্থ্য নেই তার জন্য কি কুরবানী ওয়াজিব? একজন ব্যক্তি তার বেতন না পাওয়া পর্যন্ত কুরবানীর পশু ক্রয় করা কি জায়েয? তিনি জবাবে বলেন; “কুরবানী দেওয়া সুন্নাত, ওয়াজিব নয়… কুরবানী করার জন্য কোন মুসলমান ঋণ নিলে কোন পাপ নেই যদি সে তা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। (ফাতাওয়া ইবনে বায, খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৩৭)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে কুরবানি দেওয়ার জন্য অভাবী ব্যক্তির ঋণ করা শরিয়তসম্মত?” কিনা জিজ্ঞেস করা হলে, জবাবে শাইখ বলেন; “ইদুল আজহার সময় যে অভাবী ব্যক্তির কাছে অর্থকড়ি থাকে না, কিন্তু সে ঋণ পরিশোধের আশা রাখে। যেমন কোনো ব্যক্তি মাসিক বেতন পায়, তবে ইদের দিনে তার কাছে অর্থ নেই। কিন্তু সে তার সঙ্গীর কাছ থেকে অর্থ ধার করে পরবর্তীতে বেতনের টাকা থেকে দেনা পরিশোধ করে দেয়। এ ব্যক্তিকে আমরা বলব, ‘তাহলে তুমি ধার করে কুরবানি দাও, পরে ধার পরিশোধ করে দিয়ো।’ পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধের আশা রাখে না, সে ব্যক্তির ঋণ করে কুরবানি দেওয়াকে আমরা মুস্তাহাব বলি না। কেননা এর ফলে ঋণের চুক্তি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া এবং মানুষের অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী হওয়া তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সে জানে না যে, আদৌ সে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারবে, না কি পারবে না।” (ইমাম উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১০৯-১১০; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি. ১ম প্রকাশ)
·
ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরেকটি ফাতওয়ায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, وأما من لا يأمل الحصول على قيمتها من قرب فلا ينبغي أن يستدين للأضحية “যে ব্যক্তি নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে বলে মনে করে না, তার জন্য কুরবানির পশু ক্রয় করার নিমিত্তে ঋণ করা বাঞ্ছনীয় নয়।” (প্রাগুক্ত; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১১০ অনুবাদক; আব্দুল্লাহ মৃধা ভাই)।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি এবং ভবিষ্যতে পরিশোধ করবে এমন শর্তে ঋণ নিয়ে কোন ব্যক্তি কুরবানী দিতে বাধ্য নয়। তবে তিনি যদি যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন সেক্ষেত্রে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কুরবানী দিতে পারেন।জান্নাত পিয়াসী মুমিন মুত্তাকী পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো ঋণের ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা যরূরী। কারন রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির মৃত্যু হবে অহংকার, খিয়ানত এবং ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ অর্থাৎ ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (তিরমিযী হা/১৫৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৪১২; সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৯২; মিশকাত হা/২৯২১,সনদ সহীহ)। তাছাড়া রাসূল (ﷺ) মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টনের পূর্বে মৃতের ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে জোর তাকীদ দিয়েছেন। কারণ, আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া ব্যক্তিও তার ঋণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হয়। (দেখুন, আহমাদ হা/১৭২২৭; মিশকাত হা/২৯২৮, আহমাদ হা/২২৪৯৩; মুস্তাদরাক হাকেম হা/২২১২; সহীহুত তারগীব হা/১৮০৪; মিশকাত হা/২৯২৯, সনদ সহীহ)। মহান আল্লাহ সবাইকে কুরআন-সুন্নাহর যথাযথ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।