ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের গুরুত্ব, সময় ও হুকুম এবং বিশুদ্ধ নিয়ম

➤ভুমিকা: পবিত্র মাহে রামাদান একটি ঈমানী পাঠশালা, সারা বছরের পাথেয় উপার্জন, সারা জীবনের মাকসাদ বা লক্ষ্য অর্জনকে শানিত করার জন্যে এটি একটি রূহানি ময়দান। যেখানে স্বচ্ছতা পায় অন্তরাত্মা। মানসিক প্রশান্তিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠে মুমিন নারী-পুরুষের হৃদয়। আমল, শরী‘আত পরিপন্থী আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করে চরিত্র সংশোধন করে নিতে পারে। এর পরই আসে ঈদুল ফিতর, যেদিন ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা আর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মুসলিম জাহান। পারস্পরিক শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তি-বিভেদ ভুলে সকলেই সমবেত হয় ঈদগাহে।ঈদের খুশীর প্রধান অঙ্গ হলো, ঈদের সালাত।
.
◾➤ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের সময়:
.
ঈদের সলাতের সময়, সূর্যের এক বর্শা পরিমাণ উঁচু হওয়া থেকে সূর্য ঢলে যাওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ সূর্য উদিত হলে আনুমানিক ১৫ মিনিটি পর ঈদের সালাতের সময় শুরু হয় এবং সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত এর সময় বাকী থাকে। এটাই জমহূর আলেমের মত।ইমাম ইবনে বাত্ত্বাল বলেন, ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত যে- ঈদের সালাত সূর্য উদয় হওয়ার পূর্বে এবং উদয় হওয়ার সময়ে পড়া যাবে না। বরং যখন নফল নামায পড়া বৈধ হয়, তখনই তা পড়া বৈধ। অর্থাৎ নিষিদ্ধ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই ঈদের নামায পড়া চলে। (ফাতহুল বারী ২/৫৩০; আওনুল মা‘বূদ শরহ সুনানে আবু দাউদ ৩/৪৮৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৮ পৃঃ)
.
আব্দুল্লাহ ইবনে বসর (রাঃ) একদা লোকদের সাথে ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহার সালাতে গেলেন এবং ইমামের দেরী করে সালাত আদায় করাকে অপছন্দ করলেন। অতঃপর বললেন, নিশ্চয়ই আমরা এ সময়ে সালাত আদায় শেষ করতাম। আর সালাত আদায়ের সময় হচ্ছে সূর্য উদিত হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পর। (ইবনু মাজাহ হা/১৩১৭; আবুদাঊদ হা/১১৩৫, সনদ সহীহ)। আহালুল আলেমগণ বলেন, ঈদুল আযহার সালাতকে সকাল সকাল এবং ঈদুল ফিততের সালাতকে একটু দেরী করে পড়া উত্তম। কারণ, প্রত্যেক ঈদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যস্তকারী কর্ম রয়েছে। ঈদুল আযহার কর্ম হল কুরবানী; আর তার সময় হল নামাযের পর। পক্ষান্তরে ঈদুল ফিতরের কর্ম হল ফিতরা বণ্টন; আর তার সময় হল নামাযের আগে।
.
◾➤ঈদের সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত:
.
ঈদায়েন হ’ল মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ নির্ধারিত বার্ষিক দু’টি আনন্দ উৎসবের দিন। ঈদায়নের উৎসব হবে পবিত্রতাময় ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ। প্রাক ইসলামী যুগে আরব দেশে অন্যদের অনুকরণে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। রাসূল (ﷺ) মদ্বীনায় হিজরত করার পরে দেখলেন যে,মদ্বীনাবাসীগণ বছরে দু’দিন খেলাধূলা ও আনন্দ-উৎসব করে। ঈদের সালাতের মহা ফজিলত রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ঈদের সালাত পরিত্যাগ করেননি; এমনকি মহিলা, একান্তে বাসকারিনী ও ঋতুস্রাব ওয়ালী মহিলাদেরকেও ঈদের জামাতে শরীক হতে নির্দেশ দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর পর সাহাবায়ে কেরাম কখনােই এই সুন্নত ত্যাগ করেননি। এ থেকেই ঈদের সালাতের গুরুত্ব ও ফযিলতের বিষয়টি অনুমান করা যায়। তাছাড়া এতে আল্লাহ তাআলার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা হয়, আল্লাহর বিধি-বিধানকে প্রকাশ ও সম্মান করা হয় এবং কল্যাণ কাজে মুসলমানদের সম্মিলিত অংশগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তবে ঈদের সালাতের ফযিলতের ব্যাপারে বিশেষ কোন প্রতিদানের কথা এসেছে মর্মে আমরা জানি না। বরং ঈদের সালাতের প্রতিদান সাধারণ দলিলগুলো ও অন্যান্য দলিলগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
.
◾➤ ঈদের সালাত আদায়ের হুকুম:

ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজিব নাকি সুন্নাত এটি নিয়ে আহালুল আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে অধিক বিশুদ্ধ মতে ঈদের সালাত সুন্নাতে মুআক্কাদা। অনেক ওলামাদের মতে ওয়াজিব। যেমন; ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল কাইয়্যেম, ইমাম শওকানী, সিদ্দীক হাসান খান সৌদি আরবের স্থায়ী কমিটি প্রভৃতিগণের মতে এই সালাত ওয়াজিব। তাই কোন সক্ষম মুসলিমের জন্য তা ত্যাগ করা বা আদায় করতে অবহেলা করা উচিত নয়। শিশুদেরকেও এই সালাতে উপস্থিত হতে উদ্বুদ্ধ করবে। সৌন্দর্য প্রকাশ না হলে, পর্দার রীতি থাকলে এবং পথে ও ঈদগাহে নারী-পুরুষে মিলা-মিশার ভয় না থাকলে মহিলারা জামাআতে শামিল হবে। বরং পর্দার ব্যবস্থা করে ঈদগাহে মহিলাদেরকে উপস্থিত হয়ে সালাত পড়ার বন্দোবস্ত করা জরুরী। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৩১ সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দুই ঈদের সালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭; মির‘আত ২/৩৩১; ঐ, ৫/৩১ গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ৮/২৮৪)। যাতে ঋতুবতী মহিলারাও সালাতে না হলেও দুআ ও খুশীতে শরীক হবে। এ ছাড়া পৃথকভাবে কেবল মেয়েদের জন্য কোন বাড়িতে বা মসজিদে ঈদের নামাযের কথা শরীয়তে উল্লেখিত নেই।
.
◾➤ঈদের সালাত আদায়ের সঠিক নিয়মাবলী:
.
ঈদের সালাতের পদ্ধতি অন্যান্য (ফজরের) সালাতের মতই। অবশ্য এ সালাতে অতিরিক্ত কিছু তাকবীর রয়েছে। ঈদায়নের সালাতে আযান বা এক্বামত নেই (সহীহ মুসলিম, ১৪৭০)। ইমাম সাহেব নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে প্রথমে জামা‘আতের সাথে ১২ তাকবীরে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবেন। (জেনে রাখা ভাল ৬ তাকবীর রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়)। সাহাবিদের আমল থেকে পাওয়া যায়। তাই ৬ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় করা জায়েজ হলেও উত্তম নয়। উত্তম হল ১২ তাকবীরে আদায় করা। কেননা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈ ছাড়া ১২ তাকবীরের পক্ষে অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সরাসরি রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীগণ থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক শুধু সহীহ হাদীসই বর্ণিত হয়েছে। (আবু দাঊদ, হা/১১৫১ ও ১১৫২, সনদ সহীহ। ইবনু মাজাহ, হা/১২৮০; আবু দাঊদ, হা/১১৪৯, সনদ সহীহ)। সুতরাং ইমাম সাহেবের উচিত ১২ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় করা। ১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা ও সানা পাঠের পর ধীরস্থিরভাবে স্বল্প বিরতি সহ পরপর সাত তাকবীর দিবে। অতঃপর আঊযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ সহ ইমাম সরবে সূরায়ে ফাতিহা ও সূরা ক্বাফ পড়বেন এবং মুক্তাদীগণ তাকবীর দিয়ে চুপে চুপে শুধুমাত্র সূরায়ে ফাতিহা পড়বে এভাবে প্রথম রাকআত শেষে অনুরূপভাবে….।
.
২য় রাক‘আতে দাঁড়িয়ে ধীরস্থিরভাবে পরপর পাঁচটি তাকবীর দিয়ে কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ সহ সূরায়ে ফাতিহা ও সূরা গাশিয়াহ পড়বে। এ সময় মুক্তাদীগণ চুপে চুপে কেবল সূরা ফাতিহা পড়বে। ঈদের সালাতে প্রথম রাক‘আতে সূরায়ে ক্বাফ অথবা সূরা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরায়ে ক্বামার অথবা সূরা গা-শিয়াহ পড়া সুন্নাহ। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/৮৪০-৪১)। তবে কারো উপরোক্ত সূরা গুলো মুখস্ত না থাকলে সূরা ফাতেহার সাথে অন্য যে কোন সূরা দিয়েও পড়া যাবে। (আবু দাঊদ হা/৮১৮, ৮২০, ৮৫৯)। প্রতি তাকবীরে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও বাম হাতের উপর ডান হাত বুকের উপর বাঁধবে। ইবনু উমার (রা:) নবী করীম রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাত অনুসরণের ক্ষেত্রে অধিক অগ্রগামী ছিলেন। তিনি প্রত্যেক তাকবীরের সাথে দু’হাত উঠাতেন এবং পরে আবার হাত বাঁধতেন। (যাদুল মা‘আদ, ১/৪৪১)।ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) তাকবীরের সাথে হাত উঠাতেন। (আলবানী ইরওয়া হা/৬৪১)। মালেক ইবনে আনাস (রাঃ) বলতেন, তোমরা অতিরিক্ত তাকবীর সমূহে হাত তোল। (আলবানী ইরওয়া ৩/১১৩ পৃঃ)। অতিরিক্ত তাকবীর সমূহ বলতে ভুলে গেলে বা গণনায় ভুল হলে তা পুনরায় বলতে হয় না বা ‘সিজদায়ে সাহু’ দিতে হবেনা। (মির‘আত হা/১৪৫৭, ২/৩৪১ পৃঃ; ঐ; হা/১৪৫৫-এর আলোচনা ৫/৫৩-৫৪; ইরওয়া ৩/১১৩)। সালাত শেষে ইমাম সাহেব একটি খুৎবা দিবেন। খুৎবার সময় হাতে লাঠি রাখবেন। (আবুদাঊদ হা/১১৪৫, সনদ হাসান মিশকাত হা/১৪৪৪; মির‘আত ৫/৫)
.
ঈদের সালাতে একটি খুত্ববাহ দেয়াই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈদায়নের সালাত শেষে দাঁড়িয়ে একটি খুত্ববাহ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হা/৯৭৮, ইফাবা হা/৯২৭, ২/২১৮-১৯;সহীহ মুসলিম, হা/৮৮৫; মিশকাত, হা/১৪২৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১৩৪৫, ৩/২১০ পৃ.)। উল্লেখ্য, ইমাম নাসাঈ জুমু‘আর দুই খুত্ববার হাদীস ঈদ অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। (নাসাঈ, হা/১৫৮৩ ও ১৫৮৪ ও হা/১৪১৭-১৮)। আর তার আলোকেই অনেকে মনে করেন যে, ঈদের খুত্ববাহ দু’টি। অথচ উক্ত হাদীস কোন মুহাদ্দিস ঈদ অধ্যায়ে বর্ণনা করেননি। ঐ হাদীস সকলেই জুমু‘আর অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হা/৮৬২; নাসাঈ, হা/১৪১৭-১৮, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়)। সুতরাং এই হাদীস দিয়ে ঈদের দুই খুত্ববার দলীল পেশ করা ঠিক হবে না। শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘নিশ্চয় এটা জুমু‘আর খুত্ববার বিষয়।’ (তাহক্বীক্ব ইবনু মাজাহ, হা/১২৮৯)। উল্লেখ্য যে, ঈদায়নের দুই খুত্ববার পক্ষে ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, বাযযার প্রভৃতি গ্রন্থে যে হাদীসগুলো এসেছে, তা সবই যঈফ। (ইবনু মাজাহ, হা/১২৮৯; বিস্তারিত দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ, হা/৫৭৮৯)। অমনিভাবে হাফেয ইবনু হাযম ও ইবনু কুদামা প্রমুখ বিদ্বান সহীহ দলীল ছাড়াই ঈদায়নের দুই খুত্ববার পক্ষে যে মত প্রকাশ করেছেন, সহীহ হাদীসের বিপরীতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব ঈদায়নের জন্য একটি খুত্ববাহই সুন্নাত সম্মত।
.
মহিলাদের উপর ঈদের সালাত ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নাত। তবুও ঈদায়নের জামা‘আতে পুরুষদের পিছনে পর্দার মধ্যে মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে আবৃত হয়ে যোগদান করবেন। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সেই নির্দেশ দিয়েছে। (সহীহ বুখারী ১/৯৩; সহিহ মুসলিম হা/৮৯০)। প্রয়োজনে একজনের চাদরে দু’জন আসবেন। খত্বীব সাহেব নারী-পুরুষ সকলকে উদ্দেশ্য করে তাদের বোধগম্য ভাষায় কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যাসহ খুৎবা দিবেন। ঋতুবতী মহিলাগণ কেবল খুৎবা শ্রবণ করবেন ও দো‘আয় শরীক হবেন। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন যে, উক্ত হাদীসের শেষে বর্ণিত دَعْوَةُ الْمُسْلِمِيْنَ কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুৎবা, নসিহত ও দো‘আ বুঝানো হয়েছে। কেননা ঈদায়নের সালাতের পরে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিত দো‘আর প্রমাণে রাসূল (ﷺ) থেকে কোন সহীহ হাদীস বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল বর্ণিত হয়নি। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৩১ ‘সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দুই ঈদের সালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭; মির‘আত ২/৩৩১; ঐ, ৫/৩১]

◾➤ঈদের সালাত পুরো অথবা কিছু অংশ ছুটে গেলে:
_____________________________________
ঈদের সালাতে ইমামের তাকবীর পড়তে শুরু করার পর কেউ জামাআতে শামিল হলে, সে প্রথমে তাহরীমার তাকবীর দিবে। অতঃপর বাকী তাকবীরে ইমামের অনুসরণ করবে এবং ছুটে যাওয়া আগের তকবীরগুলো মাফ হয়ে যাবে। (ইবনে উষাইমীন আসইলাতুন অআজবিবাতুন ফী সবলাতিল ঈদাঈন ৭পৃঃ)। ইমামকে রুকু অবস্থায় পেলে তাহরীমার তাকবীর দিয়ে (সময় আছে বুঝলে রুকুর তকবীর দিয়ে) রুকুতে যাবে। যেহেতু তকবীরগুলো শেষ হওয়ার পর সে শামিল হয়েছে এবং তার যথাস্থানও ছুটে গেছে, তাই তা আর কাযা করতে হবে না। (ইবনে উষাইমীন আসইলাতুন অআজবিবাতুন ফী সবলাতিল ঈদাঈন ১১পৃঃ)। পক্ষান্তরে যদি কেউ কওমায় বা তার পরে জামাআতে শামিল হয়, তাহলে ইমামের দ্বিতীয় রাকআত তার প্রথম ধরে ইমাম সালাম ফিরিয়ে দিলে উঠে সে নিজের দ্বিতীয় রাকআত পূরণ করে নেবে এবং ইমাম দ্বিতীয় রাকআতে যেভাবে সালাত পড়েছেন, ঠিক সেভাবেই ঐ রাকআত কাযা করবে। (ইবনে আবী শাইবাহ; ৫৮১২)। কেউ তাশাহহুদে এসে জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথে তাশাহহুদ পড়ে তাঁর সালাম ফিরার পর উঠে যথা নিয়মে সমস্ত তকবীর সহ ২ রাকআত সালাত আদায় করে নেবে। (ইবনে কুদামাহ আল মুগনী; ৩/২৮৫)

◾➤ঈদের সালাত সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো জেনে রাখা ভাল:
_______________________________________
➤(১). ঈদের সালাত আদায় করে বাড়ীতে এসে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করা সুন্নাহ। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়ীতে ফিরে দুই রাক‘আত সালাত পড়তেন। (ইবনু মাজাহ, হা/১০৭৬, ইরওয়াউল গালীল, হা/৩৯৯ সনদ হাসান)

(২). প্রথমেই বলেছি ঈদের সালাতের জন্য কোন আযান কিংবা ইক্বামত নেই। আযান ইকামত ছাড়াই উক্ত সালাত আদায় করতে হয়। (সহীহ বুখারী, হা/৯৬০;সহীহ মুসলিম, হা/৮৮৬)। ঈদের সালাতের জন্য মানুষকে ডাকাডাকি করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৫৩৩)

➤(৩). একই ঈদগাহে একাধিক জামা‘আত করা যাবে না। জায়গা সংকুলান না হলে ঈদের মাঠ বড় করে অথবা অন্য কোন খোলা ময়দানে ঐক্যবদ্ধভাবে সালাত আদায় করবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম একই মাঠে একাধিক বার ঈদের জামা‘আত করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। (শায়খ বিন বায, নুরুন আলাদ দারব, ১৩ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৮)। তাছাড়া এক মাঠে একাধিক জামা‘আত হলে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো দেখা দিবে:

(১). যারা পরে পড়বে তারা সঠিক সময়ে পড়তে পারবে না। অথচ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্য উঠার পরপরই সালাত আদায় করতেন। (ইবনু মাজাহ, হা/১৩১৭; আবু দাঊদ, হা/১০৪০, সনদ সহীহ)।

(২). জামা‘আত চলাকালীন পরের জামা‘আতের আশায় দাঁড়িয়ে থাকবে, যা সুন্নাতের বরখেলাফ।

(৩). বড় জামা‘আতের নেকী হতে বঞ্চিত হবে।

(৪). আগে ও পরে পড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব হবে।

(৫). সুন্নাত অনুযায়ী দীর্ঘ খুতবা দেয়ার সুযোগ হবে না। (প্রশ্নোত্তরে আরকানুল ইসলাম, সালাত অধ্যায়; প্রশ্ন নং-৯৭৭)।

➤(৪). একাধিক সহীহ হাদীসের দৃষ্টিতে ঈদের সালাত ১২ তাকবীরে পড়া উত্তম। কিন্তু ১২ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় হয় এমন ঈদগাহ না পেলে, ৬ তাকবীর আদায়কারী ইমামের পিছনে ঈসালা পড়া যাবে। এটিও জায়েজ কিন্তু উত্তম নয়। (আবু দাউদ ইবনু মাজাহ, হা/১২৮০)

➤(৫). ঈদের সালাতে মুক্তাদী ইমামের অনুসরণ করে নিঃশব্দে তাকবীর বলবে; সশব্দে নয়। কারণ, মুক্তাদীর সশব্দে তাকবীর বলা আহালুল আলেমগনের মতে বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৩২পৃঃ)

➤(৬). ঈদের সালাতে অতিরিক্ত এই তকবীরগুলো বলা কিন্তু সুন্নাত। কেউ বললে তার সওয়াব পাবে এবং না বললে বা ভুলে গেলে তার কোন পাপ হবে না। সাহু সিজদাও লাগবে না। অবশ্য এ ব্যপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তা ত্যাগ করা উচিত নয়। যাতে অন্যান্য সালাত থেকে ঈদের সালাত পৃথক বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত হয়। (আল-মুগনী ৩/২৭৫, নাইলুল আওতার, ইমাম শওকানী ৩/৩০০,)

➤(৭). ঈদের সালাত খোলা ময়দানে আদায় করা সুন্নাহ। রাসূল (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা ঈদের সালাত খোলা ময়দানে আদায় করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৯৫৬; সহীহ মুসলিম, হা/৮৮৯)। মসজিদ মর্যাদাপূর্ণ স্থান হওয়ার পরও ঈদগাহে গিয়ে ঈদের সালাত পড়ার ব্যাপারে মুসলিমদের ইজমা রয়েছে। (আল মুগনি ২/২৭৬)। কিন্তু বৃষ্টি কিংবা ভীতির কারণে ময়দানে যাওয়া অসম্ভব বিবেচিত হলে মসজিদে ঈদের জামা‘আত করা যাবে। (আল-মুগনী, ২/২৩৫; সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৮ আলবানী, সালাতুল ঈদায়েন ফিল মুছল্লা, পৃঃ ৩৫)। তবে বায়তুল্লাহ ব্যতীত বড় মসজিদের দোহাই দিয়ে বিনা কারণে ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করা সুন্নাত বিরোধী কাজ।

➤(৮). ঋতুবতী মহিলারাও পরিপূর্ণ পর্দা করে ঈদের মাঠে যাবেন। কেননা এটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) নির্দেশ তবে ঋতুবতী হলে তারা কেবল খুতবা শ্রবণ করবে ও দো‘আয় শরীক হবে, সালাত আদায় করবেনা। প্রখ্যাত সাহাবি উম্মে আতিয়া, নুসাইবা বিনতে কা’ব রা. থেকে হাদীস রয়েছে। (সহীহ বুখারি: ৩৫১ মুসলিম: ৮৯০ মিশকাত: ১৪৩১)। দুঃখজনক হলেও সত্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহটি পালন করা হলেও বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল ব্যতীত সব জায়গায় এটি অবহেলিত, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

➤(৯). যে ব্যক্তি ঈদের সালাত আদায় করার জন্য ঈদগাহে এসেছেন তিনি সরাসরি বসে যাবেন। তিনি বসার আগে দুই রাকাআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদের সালাত পড়বেন না। কেননা ঈদগাহে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ আদায় করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আমলের বিপরীত। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের জন্য বসে আছেন তিনি বেশি বেশি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’, ‘আল্লাহু আকবার’ পড়বেন। কেননা এটি হচ্ছে সেই দিনের শ্লোগান। ঈদের খুতবা শেষ হওয়া অবধি মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে অবস্থানকারী সবার জন্য এটি সুন্নাহ্। আর কেউ যদি কুরআন তেলাওয়াতে সময় কাটান তাতেও কোন অসুবিধা নেই। (বিন বায মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাত মুতানাউয়্যিআ, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১৩ ও ফাতওয়া আল-লাজনাদ দায়িমা খন্ড:৭ পৃষ্ঠা:২৭৪)

➤(১০). শরঈ ওজর থাকলে অর্থাৎ বৃষ্টি বা কোন সমস্যার কারনে ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করা হলে সালাতের পূর্বে দু’রাক‘আত তাহ্ইয়াতুল মসজিদ সালাত আদায় করা মুস্তাহাব, এমনকি নিষিদ্ধ সময়ও। এটি মসজিদের সাথে সম্পর্কিত সুন্নাত, ঈদের সালাতের সাথে নয়। রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, সে যেন দু’রাক‘আত সালাত আদায় না করে না বসে। (সহীহ বুখারী হা/৪৪৪; সহীহ মুসলিম হা/৭১৪; মিশকাত হা/৭০৪ মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনু বায ১৩/১৫,)
.
➤(১১). জামা‘আত ছুটে গেলে একাকী অথবা জামা‘আত সহকারে ঈদের ন্যায় তাকবীর সহ দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে নিবে। তবে একাকী সালাতে খুতবা দিবে না। আর জামা‘আতের সাথে আদায় করলে এবং খুতবা দেওয়ার উপযুক্ত কেউ থাকলে তিনি খুতবা দিবেন। (ফাতহুল বারী ২/৪৭৪ মির‘আত ৫/৬৪-৬৫)

➤(১২). পৃথকভাবে মহিলার ইমামতিতে মহিলারা ঈদের জামা‘আত করতে পারবে না। বাড়িতেও তাদের একাকী পড়ার কোন দলিল নেই শরীয়তে। তবে ঈদগাহে জায়গা না থাকলে মহিলারা পর্দার সাথে পৃথক ঈদের জামা‘আত করতে পারবে। তখন একজন পুরুষ ব্যক্তি তাদের সালাত পড়িয়ে দিবে। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ‘যাবিরা’ নামক স্থানে তাঁর আযাদকৃত গোলাম ইবনু আবু উতবাকে এ আদেশ করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর পরিবারবর্গ ও সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে শহরের অধিবাসীদের ন্যায় তাকবীরসহ সালাত আদায় করেন। (সহীহ বুখারী, ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৫)

➤(১৩). জুম‘আ ও ঈদ একই দিনে হলে রাসূল (ﷺ) ইমাম হিসাবে দু’টিই পড়েছেন। অন্যদের মধ্যে যারা ঈদ পড়েছেন, তাদের জন্য জুম‘আ অপরিহার্য করেননি। অর্থাৎ ঈদের সালাত আদায় করলে জুমা না পড়লেও চলবে। তবে অবশ্যই জুমআর পরিবর্তে যোহর পড়তে হবে। এটি মাফ নেই। পাশাপাশি ইমামের উচিত জুমার জামাআতের আয়োজন করা যেন যারা জুমা পড়তে চায় তারা যেন পড়তে পারে। (আবু দাঊদ হা/১০৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৬; ঐ, ১/২৩৬; নায়লুল আওত্বার ৪/২৩১)। অবশ্য ঈদের সালাত এবং জুমআ দু’টিই আদায় করা যে অধিক সওয়াবের কারণ, এতে কোন সন্দেহ নেই।

➤(১৪). ঈদের খুতবাহ শোনা সুন্নাত কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। এটির প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা উচিৎ নয়। কেননা, খুতবার মধ্যে মুসলিম জাতির কল্যাণের জন্য দুয়া করা হয়, ওয়ায-নসিহত করা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা পেশ করা হয়। মুমিনের জন্য উচিত এই যে, প্রত্যেক মঙ্গলের প্রতি সে আগ্রহী হবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য উপকারী বিষয়ের প্রতি যত্নবান হবে। আর খুতবা শোনা নিশ্চয় বড় উপকারী বিষয়। (সহীহ আবু দাঊদ হা/১০২৪; মুস্তাদরাক হাকিম, হা/১০৪৩)

➤(১৫). ঈদের সালাত আদায়ের পর একাধিক ব্যক্তি খুতবা দিতে পারবেন না। বরং একজন ব্যক্তিই একটি খুতবা দিবেন। এটাই রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত। (সহীহ মুসলিম হা/৮৮৫, মিশকাত হা/১৪৪৬)। তবে ওযরবশতঃ কাউকে মাঝপথে খুতবা পরিত্যাগ করতে হলে অপরজন প্রথম থেকে খুতবা শুরু করবেন। (উসাইমীন শারহুল মুমতে‘ ৫/৫৮)।

➤(১৬). ঈদের জামা‘আতে একবার শরীক হয়ে পরে কারণবশতঃ অন্য স্থানে এসে জামা‘আত হতে দেখলে চাইলে তাতেও অংশগ্রহণ করা যাবে। এক্ষেত্রে প্রথমটি সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ হিসাবে এবং পরেরটি নফল হিসাবে। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-এর পিছনে জামা‘আতের সাথে এশার সালাত পড়তেন এবং নিজ সম্প্রদায়ে গিয়ে আবার তাদের ইমামতি করতেন। (সহীহ বুখারী হা/৭১১, মুসলিম হা/৪৬৫)।

➤(১৭). ঈদের মাঠ পাকা করা, আলোক সজ্জা করা , ঈদগাহের মেঝে পাকা করা, ছায়ার জন্য সামিয়ানা টাঙানো বা ছাদ করা কোনটাই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বা খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে প্রমাণিত নয়। তাই এসব থেকে বিরত থাকাই উত্তম। তবে অতি প্রয়োজনে গরমের জন্য উপরে সামিয়ানা টাঙানো দোষের নয়। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭, মির‘আত ৫/২২ পৃঃ)

➤(১৮). দান-সাদাক্বা করা ঈদের দিনের অন্যতম নফল ইবাদত। এদিনে দান-সাদাক্বার গুরুত্ব এত বেশি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই খুৎবা শেষ করে বেলাল (রা:)-কে নিয়ে মহিলাদের সমাবেশে গেলেন ও তাদেরকে দান-সাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। মহিলারা নেকীর উদ্দেশ্যে নিজেদের গয়না খুলে বেলাল (রা:)-এর হাতে দান করলেন। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/১৪২৯)
.
পরিশেষে, এ কথা মনে রাখতে হবে যে- ঈদের খুশি যেন শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে না থাকে, এটি যেন সকল শ্রেণীর লোক উপলব্ধি করতে পারে। ধন্য হোক ঈদের দিন। উৎসবে মুখরিত হোক মুসলিম উম্মাহর এ দিনের খুশি। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।