ঈদ অর্থ কি এবং ঈদুল ফিতরের ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং ঈদুল ফিতরের দিনে করণীয়-বর্জনীয় কাজ

➤ভূমিকা: মুসলিম উম্মাহর জন্য বছরে শরীআত সম্মত দু’টি ঈদ রয়েছে। তা হল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদ (عيد) শব্দটি আরবী, যা ‘আউদুন’ (عود) মাসদার থেকে এসেছে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো— উৎসব, পর্ব, ঋতু, মৌসুম, প্রত্যাবর্তন, প্রত্যাগমন ইত্যাদি। প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে বলে একে ‘ঈদ’ বলা হয়। অপরদিকে ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ হলো সিয়াম ভঙ্গকরণ, ইফতার ইত্যাদি। ‘ঈদুল ফিতর’ অর্থ হচ্ছে- সিয়াম ভঙ্গকরণের আনন্দ বা রামাযান পরবর্তী খুশির মুহুর্ত। (আল-মু‘জামুল ওয়াফী, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান পৃষ্ঠা. ৭২৬। আল ফিক্বহুল মানহাজী, ১/২২২)
.
➤ ঈদুল ফিতর-এর প্রচলন:
.
২য় হিজরী সনে রমাদানের সিয়াম ফরয হওয়ার সাথে সাথে ‘ঈদুল ফিতর’-এর প্রচলন হয়। (আর রাহীকুল মাখতূম পৃ. ২৩১-৩২)। তবে এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক পেক্ষাপট। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ২য় হিজরী সনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করার পরে দেখলেন যে, মদীনাবাসী বছরে উক্ত দু’দিন খেলাধুলা ও আনন্দ করে থাকে। তখন তিনি তাদেরকে উক্ত দু’দিন উৎসব পালন করতে নিষেধ করেন এবং ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহা’-কে মুসলিমদের জন্য আনন্দের দিন নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন,আল্লাহ তোমাদের ঐ দু’দিনের বদলে দু’টি মহান খুশির দিন প্রদান করেছেন ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।(আবু দাঊদ, হা/১১৩৪; নাসাঈ, হা/১৫৫৬; মিশকাত হা/১৪৩৯)
.
➤ ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
.
ঈদকে ‘ঈদ’ হিসেবে রাসূল (ﷺ) এ নামকরণ করেছেন। ‘ঈদুল ফিতর’ মুসলিম উম্মাহর নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য হল:

(১). ঈদুল ফিতর মুসলিমদের অন্তরে ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রশিক্ষণী চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। (২). এ দিন ছোট-বড়, ধনী-গরীব, শত্রু-মিত্র, ইয়াতীম-নিঃস্ব, রাজা-প্রজা সর্বোপরি সকলের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সুদৃঢ়করণের দিন।

(৩). গরীব-দুঃখীর দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণ এবং নিজেকে ও নিজের অর্থ-সম্পদকে কলুষমুক্ত ও পূত-পবিত্র করণের জন্য মানুষ রামাযান মাসে যে ‘যাকাত’ ও ‘সাদাক্বাতুল ফিতর’ প্রদান করে তারই আত্মিক তৃপ্তি অর্জন ও আনন্দ প্রকাশের দিন ঈদুল ফিতর।

(৪). এ দিন ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর সামান্য ইবাদতের বিনিময়ে হাযার হাযার রজনীর ইবাদতের সমতুল্য নেকী প্রদানের কারণে দু’রাক‘আত সালাত আদায়ের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার প্রতি শুকরিয়া প্রকাশের দিন।
.
▪️একনজরে ঈদের দিনের করণীয়সমূহ:
_____________________________________

➤(১). ঈদের দিন গোসল করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া:
.
ঈদের দিন ভোরে ওযু ও গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অর্জন করে ঈদগাহে গমন করা মুস্তাহাব। পুরুষগণ ঈদুল ফিতরের দিন সকালে মিসওয়াক ও ওযু-গোসল করে, তৈল-সুগন্ধি ব্যবহার ও সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করে সুসজ্জিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করতে করতে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। (সহীহ বুখারী হা/৮৮৬; মিশকাত, হা/১৩৮১।) এক বর্ননায় এসেছে- নাফে থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ঈদুল ফিতরের দিন ভোরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুওয়াত্তা মালেক, হা/৬০৯; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫৭৫৪)
.
➤(২). সর্বোত্তম পোশাক পরিধান ও সাজসজ্জা গ্রহণ করা:
.
পুরুষরা ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করে সুসজ্জিত হয়ে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এমন একটি রেশমী জুব্বা নিয়ে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটি ক্রয় করে নিন। ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন।’(সহীহ বুখারী হা/৯৪৮)। এই হাদীস থেকে বুঝা যায় ঈদের দিন সুসজ্জিত হওয়া যায়। (হাশিয়ায়ে সিন্দী লিন নাসাঈ, ৩য় খ-, পৃ. ১৮১)। আল্লামা ইবনু কাইয়িম (রহ.) তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ যাদুল মা‘আদে লিখেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর এক জোড়া পোশাক ছিল যা দুই ঈদ ও জুমু‘আর দিন পরিধান করতেন। অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দার উপর তার প্রদত্ত নি‘আমাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। (তিরমিযী হা/ ২৮১৯ রিয়াদুস সালেহীন হা/ ৮০৭)
.
➤(৩). মহিলারা অভ্যন্তরীণভাবে সুসজ্জিত হবে এবং ঈদের জামা‘আতে অংশগ্রহণ করবে:
.
নারী-পুরুষ সকলের জন্য ঈদের সালাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষের পাশাপাশি স্বীয় উম্মাতের সকল মুসলিম মহিলাকে, এমনকি ঋতুবতী মহিলাদেরকেও ঈদের মাঠে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর ঋতুবতীদেরকে শুধু খুৎবা শ্রবণ এবং মুখে তাকবীর, তাহলীল, আমীন বলার পরামর্শ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩৫১; মিশকাত, হা/১৪৩১)। তবে মহিলারা সুগন্ধি মেখে ও বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে বের হবে না। তারা বড় ওড়না বা চাদরে আবৃত হয়ে পর্দা সহকারে বের হবে। কারো ওড়না বা চাদর না থাকলে অন্য কোন বোনের ওড়নায় বা চাদরে শামিল হয়ে বের হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لِتُلْبِسْهَا صَاحِبَتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا ‘তার সাথী তাকে নিজের চাদর দ্বারা আবৃত করে নিয়ে যাবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩২৪; সহীহ মুসলিম হা/৮৯০)। নারীরা উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করবে না। (তিরমিযী হা/২৭৮৭; নাসাঈ, হা/৫১১৭-১৮; মিশকাত, হা/৪৪৪৩, সনদ সহীহ)। মোটকথা মহিলাগণ প্রত্যেকে পর্দার বিধান মেনে পুরুষদের পিছনে ঈদের জামাআতে শরীক হবে। ঋতুবতী মহিলারা কাতার থেকে সরে ঈদগাহের এক পার্শ্বে অবস্থান করবে। তারা কেবলমাত্র খুৎবা শ্রবণ এবং দু‘আয় অংশ গ্রহণ করবেন। (সহীহ বুখারী, হা/৯৭১; সহীহ মুসলিম, হা/৮৯০ মিশকাত, হা/১৪৩১)। এখানে দু‘আ বলতে সম্মিলিত দু‘আ বুঝানো হয়নি। যেমনটা মাজহাবীরা মনে করে।
.
➤(৪). সকাল সকাল ঈদের মাঠে যাওয়া:
.
ঈদের দিন ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিৎ। যাতে ইমাম সাহেবের কাছাকাছি বসা যায় এবং প্রথম কাতারে সালাত আদায় করা যায়। তাছাড়া সালাতের জন্য অপেক্ষা করা; এসব অতীব সওয়াবের কাজ। (আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৭)
.
➤(৫). পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যানবাহনে করে গমন না করা:

ঈদের একটি সুন্নাত হল পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন ও প্রত্যাবর্তন করতেন। (ইবনু মাজাহ, হা/১২৯৫; সনদ হাসান)। তাই ঈদগাহ যদি নিকটবর্তী হয়,তাহলে পায়ে হেঁটে গমন করা সুন্নাহ। তবে ঈদগাহ যদি অনেক দূরবর্তী হয় সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে যানবাহনে করে গমন করাতে কোন সমস্যা নেই। আল্লাহই অধিক অবগত। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬০৫)
.
➤(৬). সাদাক্বাতুল ফিতর প্রদান করা:

ঈদুল ফিতরের দিনে অন্যতম প্রধান কাজ হল, ফিতরা প্রদান করা। ছোট-বড়, নর-নারী, স্বাধীন-পরাধীন (গোলাম) প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির পক্ষ থেকে এক ‘সা‘ (প্রায় ৩ কেজি পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ফিতরা হিসাবে আদায় করা ফরয। আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে এক সা‘ খাদ্য দ্রব্য ফিতরা হিসাবে প্রদান করতাম। আর আমাদের খাদ্য দ্রব্য ছিল যব, কিশমিশ, পনীর এবং খেজুর। (সহীহ বুখারী, হা/১৫১১; সহীহ বুখারী, হা/১৫১০, ১৫০৯)। উল্লেখ্য যে, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই ফিতরা আদায় করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের মাঠে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৫০৯,সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৬)। তবে ফিতরা ওজর থাকলে ২/১ দিন পূর্বেও প্রদান করা বৈধ। (সহীহ বুখারী, হা/১৫১১) ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে অর্থাৎ ঈদের সালাতের পর আদায় করলে ফিতরা আদায় হবেনা। বরং সাধারন দান হিসেবে গণ্য হবে। (আবূদাঊদ হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ হা/১৮২৭)
.
➤(৭). কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া:
.
ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সালাতের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে বিজোড় সংখ্যক খেজুর কিংবা অন্য কিছু খেয়ে বের হওয়া সুন্নাত। পক্ষান্তরে ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে বের হওয়া সুন্নাত। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন (বাড়ি থেকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হতেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি বিজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৯৫৩)
.
➤(৮). ঈদের দিনের তাকবীর এবং তা পড়ার নিয়ম:
.
ঈদের আগের দিন সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে ঈদের সালাত আদায় করা পর্যন্ত তাকবীর তথা ‘‘আল্লাহু আকবর’’ বলতে থাকা। এ হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা। তাকবীর বলা শুরু হবে ঈদের রাতের সূর্য ডোবা থেকে; যদি সূর্য ডোবার আগেই জানা যায় যে, শাওয়াল মাস প্রবেশ করেছে; সেটা এভাবে যে, মানুষ যদি মাসের ত্রিশদিন পূর্ণ করে। কিংবা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার মাধ্যমে। আর তাকবীর দেওয়া শেষ হবে ঈদের নামায আদায় করার মাধ্যমে। অর্থাৎ মানুষ যখন ঈদের নামায শুরু করবে তখন তাকবীর দেওয়ার সময় শেষ। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন; ১৬/২৬৯-২৭২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন; ‘‘আর যাতে তোমরা সংখ্যাপূর্ণ কর এবং তিনি যে তোমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন তার জন্য ‘আল্লাহ মহান’ বলে ঘোষণা দাও এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’’ (সূরা আল- বাকারাহ; ১৮৫)। যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে পৌঁছে সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর বলতেন। যখন সালাত আদায় করতেন, তারপর আর তাকবীর বলতেন না।’ (মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭১)। শাইখ আলবানী বলেন, যদিও হাদীসটি মুরসাল কিন্তু এর অনেকগুলো শাহেদ হাদীস থাকার কারণে এটি সহীহ। তাকবীরের শব্দগুলো হল: الله أكبر ، الله أكبر ، لا إله إلا الله ، والله أكبر ، الله أكبر ، ولله الحمد

উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়াল্লাহু আকবার,ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’

কিংবা আপনি তিনবার করে এভাবেও বলতে পারেন:الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله . والله أكبر ، الله أكبر ، ولله الحمد

উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।

দুটাই জায়েজ। জমহুর আলেমের নিকট এই তাকবীর দেওয়া সুন্নত। এই তাকবীর পুরুষরা মসজিদে, বাজারে ও ঘরে এ তাকবীর ধ্বনি জোরে দিতে থাকবে। আর মহিলারা তাকবীর বলবে আস্তে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হা/৫৬৯৭; সনদ সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৫ তাফসীরে কুরতুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৭, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২-৪; বায়হাক্বী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩১৬ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৮৯৬৯)
.
➤(৯). ঈদগাহে গমনাগমনে পথ পরিবর্তন করা:
.
ঈদগাহে পায়ে হেঁটে এক পথে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা সুন্নাত। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের দিনে এক পথ দিয়ে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে ফিরে আসতেন।’ (তিরমিযী, হা/৫৪১; মিশকাত হা/১৪৪৭, সনদ সহীহ)
.
➤(১০). উন্মুক্ত ময়দানে সালাত আদায় করা:
.
উন্মুক্ত ময়দানে ঈদের সালাত জামা‘আত সহকারে আদায় করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা ঈদের সালাত উন্মুক্ত ময়দানে আদায় করতেন। তাঁদের ঈদের ময়দানটি ছিল মদীনার মসজিদে নববীর পূর্ব দরজা বরাবর মাত্র পাঁচশ’ গজ (الف ذراع) দূরে ‘বাত্বহান’ সমতল ভূমিতে অবস্থিত। (ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ২৩৭-৩৮; মির‘আতুল মাফাতীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৭; ঐ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২২)। মসজিদে নববীতে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার গুণ বেশি নেকী এবং অতি নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কখনো মসজিদে নববীতে ঈদের সালাত আদায় করেননি। একটি ‘যঈফ’ বর্ণনায় আছে যে, তিনি একবার মাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে নববীতে ঈদের সালাত আদায় করেছিলেন। (আবুদাঊদ, হা/১১৬০; মিশকাত, হা/১৪৪৮; সনদ যঈফ)তবে ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোন সমস্যা হলে ভিন্ন কথা।
.
➤(১১). পরস্পরে কুশল বিনিময় করা:
.
ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরামের পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’। অর্থাৎ ‘আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ হতে কবুল করুন!’ (তামামুল মিন্নাহ, ১/৩৫৪, সনদ হাসান)। উল্লেখ্য যে, ঈদ মাঠে বা ঈদের দিন পরস্পর সুন্নাত মনে করে কোলাকুলি শরী‘আত সম্মত নয়। তবে সফর থেকে বা বাইর থেকে আগন্তুকের সাথে কোলাকুলি করা যায়। (মুসনাদে আহমাদ হা/১৩০৬৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৬০)
.
➤(১২). দান-সাদাক্বাহ করা:
.
দান-সাদাক্বা করা ঈদের দিনের অন্যতম নফল ইবাদত। এদিনে দান-সাদাক্বার গুরুত্ব এত বেশি যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই খুৎবা শেষ করে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নিয়ে মহিলাদের সমাবেশে গেলেন ও তাদেরকে দান-সাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। মহিলারা নেকীর উদ্দেশ্যে নিজেদের গয়না খুলে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাতে দান করলেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম মিশকাত, হা/১৪২৯)
.
⛔➤ঈদের দিন যাবতীয় বর্জনীন কাজ:
_____________________________________
(১). মক্কা বা সৌদি আরবের অনুকরণে ঈদ পালন:
.
পৃথিবীর সর্বত্র একই দিনে সিয়াম ও ঈদ পালনে একশ্রেণীর মানুষ অতি উৎসাহী। অথচ এটা অযৌক্তিক দাবী। শরী‘আতের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযান) মাস পাবে, সে যেন এ মাসের সিয়াম রাখে।’ (সূরাহ আল-বাক্বারা; ১৮৫)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম রাখ ও চাঁদ দেখে সিয়াম ছাড়।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮১; মিশকাত, হা/১৯৭০)। উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসসহ অন্যান্য হাদীস এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, সারা দুনিয়ার মানুষ একই দিনে ও একই সময়ে চাঁদ দেখতে পায় না। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ কোন দেশে যখন ফজরের সময় হয় অন্য দেশে তখন গভীর রাত থাকে, আবার কোন দেশে যখন সন্ধ্যা হয় অন্য দেশে তখন মধ্যরাত হয়। তাইতো মক্কা বা সঊদী আরবে যখন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায়, ঢাকায় তখন সন্ধ্যা অতিবাহিত হয়ে ৩ঘণ্টা রাত হয়। তখন ঢাকার লোকদের এ কথা বলা যায় না যে, তোমরা চাঁদ না দেখেও সিয়াম রাখ বা ঈদ কর। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার সিয়াম ও ঈদ, মক্কা বা সঊদী আরবের একদিন পরে চাঁদ দেখে হবে। কেননা যোহরের সালাত যেমন ফজরের সময় আদায় করা যায় না, তেমনি মক্কা বা সঊদী আরবের সঙ্গে ঢাকা মিলাতে গিয়ে একদিন পরের সিয়াম ও ঈদ একদিন আগে করা যায় না। এটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশের স্পষ্ট লংঘন।( সারা বিশ্বে একই সাথে সিয়াম এবং ঈদ সম্পর্কে আমার আলেদা একটি পর্ব রয়েছে আইডি থেকে পড়তে পারেন ইনশাআল্লাহ)
.
➤(২). ঈদের খুতবা শেষান্তে সম্মিলিত মুনাজাত:
.
ঈদের সালাতের খুতবা শেষান্তে ইমাম-মুসল্লী সকলে মিলে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করার যে বিধান চালু রয়েছে, তা বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ধরনের আমলের কোন ভিত্তি ছিল না এবং এর প্রমাণে তাদের থেকে কোন দলীলও নেই। উল্লেখ্য যে, ‘তারা যেন মুসলিমদের জামা‘আত ও দু‘আয় শরীক হতে পারে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৫১; মিশকাত, হা/১৪৩১); এই হাদীস থেকে সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণ করতে চান। অথচ এটা অপব্যাখ্যা। মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসের শেষে বর্ণিত دعوة المسلمين কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুতবা ও ওয়ায-নসিহত শ্রবণে শরীক হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে।
.
➤(৩). ঈদগাহে জলদি আসার জন্য মাইকে আহ্বান করা:
.
বর্তমানে বিভিন্ন সমাজে এমনকি বলা যায় সর্বমহলে ঈদের দিন সকাল হতে না হতেই মসজিদ, মক্তব ও ঈদগাহে মাইক বা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে তাকবীর পাঠ, ইসলামী জাগরণী বা সঙ্গীত পরিবেশন, দিক নির্দেশনা মূলক কথা-বার্তা এবং মুসল্লীদেরকে জলদি বা তাড়াতাড়ি আসার জন্য বারবার আহ্বান করা হয়। কিন্তু ঈদগাহে বের হওয়ার সময় উচ্চকণ্ঠে তাকবীর এবং পৌঁছানোর পরেও তাকবীরধ্বনি ব্যতীত কাউকে এভাবে আহ্বান করা ঠিক নয়। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন- ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন ইমাম বের হয় তখন সালাতের জন্য কোন আযান নেই, এক্বামত নেই, আহ্বান নেই, এবং অন্যকিছুই (যায়েয) নেই। মোটকথা, সে দিন নিদা বা আহবান,এক্বামত কিছুই নেই। (সহীহ মুসলিম, হা/৮৮৬; মিশকাত, হা/১৪৫১)
.
➤(৪). ঈদের দিনকে কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা:
.
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈদের দিন কবর জিয়ারত নির্দিষ্ট করে নেওয়া এবং কবরে গিয়ে দলবদ্ধভাবে দু’হাত তুলে মুনাজাত করা শরী‘আত সম্মত নয়। কেননা এই মর্মে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই। তবে নির্দিষ্ট না করে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে যেকোন দিন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে নিজে নিজে দো‘আ পড়বে। এক্ষণে কারো যদি ঈদের দিন বা জুম‘আর দিন ব্যতীত অন্য দিন কবর যিয়ারতের সময় না হয়, তবে সেক্ষেত্রে তিনি করতে পারেন। জানা আবশ্যক যে, জুম‘আর দিন কবর যিয়ারতের বিশেষ কোন ফযীলত নেই। (বিন বায,মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/৩৩৬; উসাইমীন, আল-লিক্বাউশ শাহরী খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ২)।
.
➤(৫). ঈদের দিন সিয়াম পালন করা:
.
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উভয় ঈদের দিন সিয়াম পালন করা নিষিদ্ধ- হারাম। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত; রাসূল (ﷺ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/১৯৯১, মুসলিম হা/১১৩৭, মিশকাত হা/২০৪৮)।
.
➤(৬). অমুসলিমদের অনুকরণ ও অনুসরণ:
.
ঈদের দিন অথবা যেকোন সময় অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করা ও আচার-আচরণ করা নিষিদ্ধ। কারন প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন- যে কেউ অন্য জাতির অনুসরণ করবে সে সেই কওমের (বা ধর্মের) লোক বলে বিবেচিত হবে।’’ (আবু দাউদ হা/৪০৩১)
.
➤(৭). নারী-পুরুষ একে অন্যের বেশ ধারন করা:
.
ছেলেরা মেয়েদের এবং মেয়েরা ছেলেদের বেশ ধারণ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। কারণ, এ ধরনের ছেলে ও মেয়েদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/ ৫৮৮৪)। এমনকি বেগানা নারী-পুরুষ একত্রে দেখা সাক্ষাৎ করাও নিষিদ্ধ। (তিরমিযী হা/২১৬৫; মিশকাত হা/৩১১৮)।
.
➤(৮). শরী‘আত বিরোধী অনুষ্ঠানাদি বর্জন করা:
.
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদের আনন্দে আত্মহারা হয়ে আজকের যুবসমাজ সিনেমা-নাটক পটকাবাজি, আতশবাজি, ক্যাসেটবাজি, গান-বাজনা, বেহায়াপনা, নগ্নতা চরিত্র বিধ্বংসী ভিডিও-সিডি এবং সিনেমা প্রদর্শনীতে লিপ্ত হয়। অথচ দফ ব্যতীত সকল গান-বাজনাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানী বাদ্যযন্ত্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, اَلْجَرَسُ مَزَامِيْرُ الشَّيْطَانِ ‘বাজনা, ঘণ্টা বা ঝুমঝুমি হলো শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।’ (সহীহ মুসলিম, হা/২১১৪; মিশকাত, হা/৩৮৯৫)। আবার শহর-বন্দর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে যাত্রা, নাটক, গোল্লাছুট, ঘোড়াছুট, নৌকাবায়েজ ও লটারীসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কারও বিতরণ করা হয়। ইসলাম এগুলোকে এক কথায় ‘জুয়া’ আখ্যায়িত করে সবগুলোকে হারাম ঘোষণা করেছে। (সূরা আল- মায়েদাহ; ৯০)।
.
পরিশেষে, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করছি। হে আল্লাহ! ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝে সবাইকে উৎসবটি পালন করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন! (মাসিক আল ইখলাস থেকে কিছু দলিল সংকলিত) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।