কোন কোন খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে এবং যাকাতুল ফিতরের প্রকৃত হকদার কারা

প্রশ্ন: কোন কোন খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে? যাকাতুল ফিতরের প্রকৃত হকদার কারা? ফিতরা সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে রাখা ভালো। (পোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নের উত্তর রয়েছে)
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামী শরীআতের বিধান গ্রহণ করতে হবে ইসলামের মূল উৎস থেকে। আর শরীয়তের মূল উৎস দু’টি হল:

(১). মহান আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন। (সূরা আ‘রাফ; ৭/৩)

(২). রাসূল (ﷺ)-এর সহীহ হাদীস। (আবু দাঊদ হা/৪৬০৪)
.
শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ফিতরা আদায় করতে হবে খাদ্যবস্ত্ত দ্বারা; টাকা-পয়সা দিয়ে নয়। কারণ রাসূল (ﷺ) ফিতরা হিসেবে খাদ্যদ্রব্য দিতে বলেছেন। এ ব্যাপারে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসগুলোতে স্রেফ খাদ্যদ্রব্যের কথা এসেছে, খাদ্যমূল্য বা অর্থের কথা আসেনি। এ মর্মে বহু হাদীস বিদ্যমান আছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) প্রত্যেক মুসলিম ক্রীতদাস ও স্বাধীন ব্যক্তি, নর-নারী, ছোট ও বড়দের উপর যাকাতুল ফিতর এক ‘সা’ খেজুর কিংবা এক ‘সা’ যব ফরয করেছেন। আর তিনি লোকেরা ঈদের সালাতে যাবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩-৫, ইফাবা হা/১৪১৫-১৭, ৩/৬২-৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪; মিশকাত, হা/১৮১৫, ১৮১৬)। অপর বর্ণনায় আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা আল্লাহ’র রাসূল (ﷺ)-এর যুগে ঈদের দিন এক সা‘ পরিমাণ খাদ্য ফিতরা হিসেবে আদায় করতাম। আবু সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তখন ‘‘আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছিল: যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর’।” (সহীহ বুখারী, হা/১৫১০)। উপরোক্ত হাদীসে আবু সাঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরের কথার মৌলিক বা সরল অর্থ হলো যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতরা হিসেবে এক সা’ খাবার প্রদান করা ফরয করেছেন। যেসব খাবার সাহাবীগণের প্রধান খাদ্য ছিল তাঁরা সেটা দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, আহালুল আলেমগনের একটি অংশ এই হাদীসে ব্যবহৃত ‘খাদ্যদ্রব্য’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, তা হলো গম। অপরদিকে জমহুর আলেমগণ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, যে এর উদ্দেশ্য হল সে দেশের অধিবাসীগণ যা খায় তা গম, ভুট্টা, পার্ল মিলেট (pearl millet) বা এছাড়া অন্য যাই হোক না কেন। মোটকথা হাদীসের সঠিক মর্ম হলো নিজ নিজে দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে আর এটাই সঠিক মত। কারণ ফিতরা হচ্ছে- দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের সহানুভূতি। স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য হিসেব বিবেচিত নয় এমন কিছু দিয়ে হকদারের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করা কোন মুসলিমের উপর ওয়াজিব নয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে চাউল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য, উত্তম ও মূল্যবান খাদ্য। চাউল যবের চেয়ে উত্তম; যে যব দিয়ে ফিতরা দেয়া জায়েয মর্মে হাদীসের ভাষ্যে সরাসরি উল্লেখ আছে। এর থেকে জানা গেল যে, চাউল দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করাতে কোন দোষ নেই। সুতরাং উক্ত হাদীসের আলোকে আহালুল আলেমগণ বলেছেন, মানুষ যে যে প্রকারের খাবারকে তাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেসব খাবার দিয়ে ফিতরা প্রদান করা যায়। যেমন- গম, ভুট্টা, চাল, সীমের বিচি, ডাল, ছোলা, ফুল (একজাতীয় ডাল), নুডলস, গোশত ইত্যাদি। (কিছুটা পরিমার্জিত ভাবে মাজমু ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায খন্ড:১৪ পৃষ্ঠা: ২০০ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৯৭৯৩)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, “মদিনাতে এগুলো ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। পক্ষান্তরে, কোনো দেশের কিংবা এলাকার প্রধান খাদ্য যদি অন্য কিছু হয়; তাহলে তাদের উপর তাদের খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা ফরয। যেমন- যাদের খাদ্য ভুট্টা কিংবা ভাত কিংবা ত্বীন কিংবা অন্য কোন শস্যদানা (তারা সেটা দিয়ে ফিতরা দিবে)। আর তাদের খাদ্য যদি শস্যদানা না হয়ে অন্য কিছু হয়; যেমন- দুধ, গোশত, কিংবা মাছ ইত্যাদি তাহলে তারা তাদের প্রকৃতিগত খাদ্য দিয়ে ফিতরা দিবে সেটা যেমনি হোক না কেন। এটা জমহুর আলেমের অভিমত। এটাই সঠিক মত; অন্য মত প্রকাশ করার সুযোগ নেই। কারণ ফিতরা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে- ঈদের দিন মিসকীনের প্রয়োজন পূরণ করা এবং সবাই যেমন খাবার খায় সে জাতীয় খাবার দিয়ে তাদের সহমর্মী হওয়া। এর আলোকে বলা যায় আটা বা ময়দা দিয়ে ফিতরা দেয়া জায়েয হবে; যদিও কোন সহিহ হাদিসে এর কথা আসেনি। (মুওয়াক্কিয়ীন’ খন্ড:৩ পৃষ্ঠা:১২)।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] বলেন, “উল্লেখিত খাদ্যসমূহের কোনটি যদি কোন এলাকার মানুষের প্রধান খাদ্য হয়ে থাকে তাহলে সন্দেহাতীতভাবে সে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা জায়েয। প্রশ্ন হচ্ছে- তারা অন্য যেসব খাদ্য গ্রহণ করে থাকে সেটা দিয়ে কি ফিতরা দেয়া যাবে? যেমন কারো প্রধান খাদ্য যদি হয় ভাত কিংবা ভূট্টা তারা গম কিংবা যব দিয়ে কি ফিতরা আদায় করতে পারবে? নাকি চাউল বা ভূট্টা দিতে হবে? এ বিষয়ে বিশাল মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে শুদ্ধ অভিমত হচ্ছে- হাদিসে উল্লেখিত শ্রেণীর মধ্যে না থাকলেও যেটা তাদের খাদ্য সেটা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে পারবে। এটি অধিকাংশ আলেমের অভিমত, যেমন- ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য আলেম। কারণ, ফিতরা ফরয করা হয়েছে দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতাস্বরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন: “মধ্যম মানের খাদ্য যা তোমরা তোমাদের স্ত্রী-পরিবারকে খাইয়ে থাক।” (সূরা মায়িদা, আয়াত: ৮৯)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে এক স্বা’ খেজুর কিংবা এক স্বা’ যব ফরয করেছেন। কারণ তখন এগুলো ছিল মদিনাবাসীর খাদ্য। যদি এগুলো তাদের খাদ্য না হয়ে অন্য কিছু হতো; তাহলে তাদেরকে তাদের খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ফিতরা আদায় করার দায়িত্ব দিতেন না; যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা কাফফারার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেননি। (কিছুটা পরিমার্জিত ভাবে মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, খন্ড:২৫ পৃষ্ঠা:৬৮)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন: সঠিক মতানুযায়ী, যেটা খাদ্য হিসেবে প্রচলিত সেটা শস্যদানা হোক, ফল-ফলাদি হোক কিংবা গোশত হোক সেটা দিয়ে ফিতরা দেয়া জায়েয। (আশ-শারহুল মুমতি’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:১৮৩) সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে নিজ দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা সুন্নতসম্মত।

.
▪️যাকাতুল ফিতরের প্রকৃত হকদার কারা?
.
যাকাতুল ফিতর পাওয়ার প্রকৃত হকদার কারা
এ মাসয়ালায় আহালুল আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। মতামতগুলো পর্যালোচনা করলে প্রসিদ্ধ দুটি মত পাওয়া যায় যথা:

(১). ইমাম শাফেঈ, ইমাম ইবনু কুদামা, ইমাম কারখী, হাফেয ইবনু হাযম আর হানাফী মাযহাবের বিদ্বানগণের উক্তি এবং শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভীর (রাহিমাহুল্লাহ) এর সাক্ষ্য অনুসারে চার মাযহাবের প্রকাশ্য ফাতওয়া সূত্রে ফিতরার যাকাত সম্পদের যাকাতের নিয়মানুযায়ী বণ্টন করতে হবে। তাদের দলিল সূরা আত-তওবায় বর্ণিত যাকাতের হক্বদার আট শ্রেণির সকলেই ফিত্বরা পাওয়ার হক্ব রাখে। (ইমাম শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম, ২/৫৯; আল-মুহাল্লা, ৬/১৪৪; দুররে বহিইয়া (রওযাসহ), পৃ. ১৪২; আল-বাহরুর রায়েক, ২/২৭৫; উমদাতুর রিআয়া, ১/২২৭; শরহে সিফরুস সাআদা, পৃ. ৩৬৯; মুগনী, পৃ. ৭৮।
.
(২). ইমামু আহলিস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইমাম ইবনু তায়মিয়্যা, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম, ইমাম শাওকানী, আল্লামা শামসুল হক্ব আযীমাবাদী, শাইখ বিন বায, ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ আলেমদের মতে সাদাক্বাতুল ফিতর বা ফিতরা পাওয়ার হক্বদার কেবল ফকীর ও মিসকীন। সূরা আত-তওবায় বর্ণিত অন্য ছয় শ্রেণি ফিতরার হক্বদার নয়। (মাসায়েলে ইমাম আহমদ, পৃ. ৮৬; মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৫/৭৩; যাদুল মাআদ, ২/২২; নায়লুল আওত্বার, ৩-৪/৬৫৭; আওনুল মা‘বূদ, ৫-৬/৩;আসনাল মাতালিব খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৪০২ উসাইমীন শারহুল মুমতে, ৬/১৮৪)
.
তবে ফিতরা প্রাপ্তির হক্বদার সম্পর্কিত উপরোক্ত দুটি মতের মধ্যে দ্বিতীয় মতটি অধিক বিশুদ্ধ। অর্থাৎ ফিতরার হকদার ফকির-মিসকিন। কেননা এ মতের পক্ষে স্পষ্ট দলীল বিদ্যমান। হাদীসে এসেছে- ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল (ﷺ) সাদাক্বাতুল ফিত্বর ফরয করেছেন অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হতে (রামাদানের) সওমকে পবিত্র করতে এবং মিসকীনদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য। (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, ‘যাকাত’ অধ্যায়, হা/১৮২৭; দারাকুত্বনী, হাকেম, ১/৪০৯; ইরওয়াউল গালীল, হা/৮৪৩; ইমাম হাকেম বলেন, বুখারীর শর্তে সহীহ। ইমাম যাহাবী তার সাথে একমত হয়েছেন)।
.
‘হাশিয়াতুদ দুসুকী’ গ্রন্থে এসেছে- ফিতরা দেওয়া যাবে স্বাধীন, মুসলিম, দরিদ্র এবং হাশেমী বংশধর নয় এমন ব্যক্তিকে। ফিতরা আদায়কারী, ইসলামের প্রতি হৃদয় আকৃষ্ট, দাস ও ঋণগ্রস্তকে দেওয়া যাবে না। মুজাহিদ ও মুসাফিরকে দেশে পৌঁছার জন্য দেওয়া যাবে; বরং গরীব হিসেবে…(‘হাশিয়াতুদ দুসুকী’ খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৫০৮) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন; “দলিলের দিক থেকে এ অভিমতটি মজবুত। (মাজমুউ ফাতাওয়া খন্ড:২৫ পৃষ্ঠা:৭১)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল এ সাদকাটা মিসকীনদেরকে দেওয়া। তিনি মুটে মুটে আট শ্রেণীর মাঝে ভাগ করতেন না এবং সে নির্দেশও দেননি। এবং কোন সাহাবীও এমন কাজ করেননি। সাহাবীদের পরেও কেউ করেননি। বরং আমাদের কাছে দুটো অভিমতের একটি হচ্ছে: মিসকীন ছাড়া অন্যদের মাঝে ফিতরা বণ্টন করা নাজায়েয। এ অভিমতটি আট শ্রেণীর মাঝে ভাগ করে দেওয়ার অভিমতের চেয়ে অগ্রগণ্য।” (ইবনুল যাদুল মাআদ খন্ড:২ পৃষ্ঠা:২২)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; ফিতরা বণ্টনের খাত হচ্ছে গরীব, মিসকীন। যেহেতু ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতরা ফরয করেছেন অনর্থক কথা-কাজ ও যৌনালাপ থেকে রোযাদারকে পবিত্র করাস্বরূপ এবং মিসকীনদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থাস্বরূপ। (ইমাম বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড:১৪ পৃষ্ঠা:২০২)
.
▪️ফিতরা সম্পর্কে যে বিষয়গুলো জেনে রাখা ভাল:
_______________________________________
🔹প্রশ্ন: সাদাক্বাতুল ফিত্বরের উপকারিতা:

উত্তর: ফিতরা প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হল:
১. ঈদের দিনগুলোতে দরিদ্র ব্যক্তিরা ধনীদের ন্যায় স্বচ্ছলতা বোধ করে। ফলে ধনী-গরীব সবার জন্য ঈদ আনন্দদায়ক হয়।

(২). সাদাক্বাতুল ফিততের মাধ্যমে সিয়াম অবস্থায় ঘটে যাওয়া ত্রুটিগুলোর কাফফারা হয়ে যায়।

(৩). সাদাক্বাতুল ফিতর দ্বারা আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়।

(৪). সাদাক্বাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে গরীবরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কারণে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ পায়। দরিদ্রদের একদিনের জন্য হলেও অভাব মোচন হয়। এতে তাদের ঈদের খুশিতে অংশগ্রহণের পথ সুগম করতে সহায়তা করে। সাদাক্বাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে দাতা ব্যক্তির অন্তর প্রশস্ত হয়, আত্মা নির্মল ও পবিত্র হয়।আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। আর আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি হল সেই ব্যক্তি, যে তাঁর পরিবাবের প্রতি অনুগ্রহ করে। (শুআবুল ঈমান, হা/৭০৪৮)
.
🔹প্রশ্ন: ফিতরার পরিমাণ কতটুকু? অর্ধ ‘সা‘ ফিতরা দেয়া যাবে কি?
.
উত্তর: পরিবারের প্রত্যেকে সদস্যের মাথাপিছু এক “সা” পরিমাণ খাদ্যবস্তু দ্বারা ফিতরা আদায় করতে হবে। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক সা‘ খেজুর, যব ইত্যাদির ফিতরা ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে জমা করার নির্দেশ দান করেছেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩-৫, ইফাবা হা/১৪১৫-১৭, ৩/৬২-৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪; মিশকাত, হা/১৮১৫, ১৮১৬)। আর এক “সা” কতটুকু এটি নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। সবচেয়ে নিরাপদ মত হলো দেশের প্রধান খাদ্য অর্থাৎ ভালো মানের চাউল দিলে ৩ কেজি পরিমান অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল দিবেন। (আওনুল মা‘বূদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৯৫; ফাতাওয়া শায়খ বিন বায, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ২০১১)। আর গম দ্বারা অর্ধ “সা” ফিতরা দেয়ার যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা যঈফ (যঈফ আবূ দাঊদ, হা/১৬১৭)। সুতরাং এটি আমলযোগ্য নয়। আরো বিস্তারিত জানতে আমার পূর্বের পোস্টে পড়ুন।
.
🔹প্রশ্ন: দুটি ভিন্নজাতের খাদ্য দিয়ে ফিতরা দেওয়া যাবে কি?
.
উত্তর: দুই বা ততোধিক প্রকারের খাদ্য মিশ্রিত করে এক সা’ ফিতরা পরিশোধ করার হুকুম নিয়ে ফিকাহবিদ আলেমগণ দ্বিমত করেছেন। তবে দলিলের আলোকে গ্রহনযোগ্য মত হলো: এটি জায়েজ নয়; কারণ এটাই সুন্নাহ্‌র বাহ্যিক অনুসরণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা ফরয করেছেন এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর। আর সাহাবায়ে কেরাম এভাবেই ফিতরা পরিশোধ করতেন। সুতরাং, যে ব্যক্তি দুইজাতের এক সা’ খাদ্য দিয়েছে সে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নির্দেশ দিয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করেনি। (বিস্তারিত দেখুন- ইমাম নববী “আল-মাজমু” খন্ড:৬ পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯) । ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; এক সা’–এর কিছু অংশ যব ও কিছু অংশ খেজুর দিলে পরিশোধ হবে না। মূল্য দিলে মূলতঃই পরিশোধ হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা ফরয করেছেন এগুলো সেটা নয়। (ইবনে হাযম আল-মুহাল্লা খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা:২৫৯)
.
🔹প্রশ্ন: আগেভাগে ফিতরার খাদ্য কিনে রাখা এবং পরে বিতরণ করা যাবে?
.
উত্তর: প্রশ্নটি ইমাম উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি জবাবে বলেন, ইসলামিক সেন্টার আগেভাগেই খাদ্য কিনে রেখে পরবর্তীতে সেটা ফিতরা পরিশোধে আগ্রহী লোকদের কাছে বিক্রি করতে এবং শরিয়ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বণ্টন করতে কোন অসুবিধা নেই। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭১৭৫)
.
🔹প্রশ্ন: গরীব ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে যাকাত গ্রহণ করার জন্য যাকাতদাতাকে প্রতিনিধি বানানো কি জায়েয আছে?
.
উত্তর: গরীব ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে যাকাত গ্রহণ করার জন্য ধনী ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বানানো জায়েয। ধনী ব্যক্তি যাকাতটি গ্রহণ করে তার কাছে রেখে দিবেন; যাতে করে গরীব লোকটি যখন চায় তখন এসে নিয়ে যেতে পারে। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৩৯০৭৫)
.
🔹প্রশ্ন: অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে কি?
.
উত্তর: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি মুসলমানদের উপর এক সা’ খাদ্য ফিতরা দেয়া ফরয করেছেন; টাকা নয়। সুতরাং টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েজ নয়। তাছাড়া জমহুর (অধিকাংশ) মাযহাবের আলেমদের মতে, অর্থ দিয়ে পরিশোধ করা জায়েয হবে না। দলিলের বিবেচনায় এ অভিমতটি অধিক শুদ্ধ। বরং খাদ্য দিয়ে আদায় করা ওয়াজিব। যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গ এবং উম্মতের অধিকাংশ ব্যক্তিবর্গ আদায় করেছেন। আল্লাহ্‌র কাছেই প্রার্থনা তিনি যেন, আমাদেরকে এবং সকল মুসলিমকে দ্বীনিজ্ঞানে প্রজ্ঞা অর্জন করার ও এর উপরে অটল-অবিচল থাকার তাওফিক দেন। (শাইখ বিন বায মাজাল্লাতুল বুহুছিল ইসলামিয়্যা, সংখ্যা-১৭, পৃষ্ঠা-৭৯-৮০)
.
🔹প্রশ্ন: ফিতরা পরিশোধ করার স্থান কোনটি?
.
আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, ফিতরা ব্যক্তির দেহের সাথে সম্পৃক্ত; সম্পদের সাথে নয়। তাই চাঁদ রাতে ব্যক্তি যে স্থানে অবস্থান করবে সে স্থানেই ফিতরা আদায় করবে। ইবনে কুদামা বলেন: পক্ষান্তরে ফিতরা, ব্যক্তির উপর যে স্থানে ওয়াজিব হয়েছে সে স্থানেই সে পরিশোধ করবে; তার সম্পদ সেখানে থাকুক; কিংবা না থাকুক। (আল-মুগনী”খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:১৩৪)
.
🔹প্রশ্ন: ফিতরা অন্য দেশে প্রেরণ করা যাবে?
.
উত্তর: ইনশাআল্লাহ; এতে কোন অসুবিধা নেই। এটি জায়েয। তবে, আপনি যেখানে অবস্থান করছেন সেখানে ফিতরা আদায় করাই উত্তম। আপনি যে স্থানে অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করছেন সেখানে অবস্থানরত গরীবদের মাঝে ফিতরাটা বিতরণ করা উত্তম। আর আপনি যদি আপনার পরিবারকে পাঠিয়ে থাকেন যাতে করে তারা গরীবদের মাঝে সেটা বিতরণ করতে পারে তাতেও কোন সমস্যা নেই। (শাইখ বিন বায ফাতওয়া নুরুন আলাদ দারব; খন্ড: ২/১২০৮, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৯০৮৭)
.
🔹প্রশ্ন: এক লোক আমাকে বড় এক বস্তা চাল হাদিয়া দিয়েছে; যা আমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। আমি কি সেটা থেকে আমার নিজের ও আমার ছেলেদের ফিতরা পরিশোধ করতে পারব? উল্লেখ্য, আমি নিজ সম্পদ থেকে ফিতরা কেনার সামর্থ্য রাখি?
.
উত্তর: যে চালের বস্তা আপনি হাদিয়া হিসেবে পেয়েছেন সেটা থেকে আপনার ফিতরা ও আপনার ছেলেদের ফিতরা পরিশোধ করতে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু হাদিয়াগ্রহীতা গৃহীত হাদিয়ার মালিক; তিনি এটাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কাজে লাগাতে পারেন। যেমন- বিক্রি করা, উপহার দেওয়া, সাদকা করা ইত্যাদি যে কোনভাবে। বরং আলেমগণ উল্লেখ করেছেন: যদি কোন গরীব ব্যক্তি ধনীদের থেকে অনেক ফিতরা পায় এবং সেটা তার প্রয়োজন ও তার পোষ্যদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তাহলে সে ব্যক্তি গৃহীত সেসব ফিতরা থেকে ফিতরা পরিশোধ করবে। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২০৪৬৯)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)
কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “যে গরীব লোক মানুষের ফিতরা গ্রহণ করে তাকে যেটা দেওয়া হয়েছে সেটা থেকে সে কি নিজের ফিতরা পরিশোধ করতে পারবে? নাকি সেটা জায়েয হবে না?
.
জবাবে তিনি বলেন: হ্যাঁ। সে ফিতরা পরিশোধ করবে। যদি ঈদের আগে তার কাছে দানটা পৌঁছে তাহলে সে পরিশোধ করবে। আর যদি তার কাছে ঈদের পরে পৌঁছে তাহলে তার উপর কোন কিছু আবশ্যক নয়; যদি সে এমন গরীব হয় যে, ঈদের রাতে তার কাছে কোন কিছু না থাকে। তীব্র অভাবের কারণে তার কাছে এমন এক স্বা খাদ্য নাই যা দিয়ে সে নিজের ফিতরা আদায় করবে। কিংবা এর চেয়ে বেশিও নাই যা দিয়ে সে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ফিতরা আদায় করবে…। সেক্ষেত্রে তার উপর কোন কিছু আবশ্যক নয়। কিন্তু সে যদি এতটুকু সচ্ছল হয় যে, সে নিজের পক্ষ থেকে এক স্বা খাদ্য এবং পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে কয়েক স্বা খাদ্য পরিশোধ করতে সক্ষম… তাহলে সে ঈদের দিন ও রাতের প্রয়োজনীয় খাদ্য রেখে বাকীটুকু তার নিজের ফিতরা ও পরিবারের সদস্যদের ফিতরা হিসেবে পরিশোধ করবে। (ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব খন্ড:১৫ পৃষ্ঠা:২৯১)
.
🔹প্রশ্ন: ফিতরা কখন বন্টন করতে হয় এবং কোথায় বণ্টন করতে হয়। মসজিদের ইমামের পক্ষ থেকে ফিতরা জমা করা এবং এরপর হকদারদের মধ্যে বণ্টন করা কি জায়েয; এমনকি সেটা যদি কিছুদিন পরেও হয়। ফিতরা কি মুদ্রাস্ফীতির অনুগামী? ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের জন্য ফিতরা পাঠানো কি জায়েয হবে? কিংবা কোন মসজিদ নির্মাণের ফান্ডে ফিতরার অর্থ কি প্রবেশ করানো যাবে?
.
উত্তর: ফিতরা পরিশোধ করার সময় ঈদুল ফিতরের রাত থেকে ঈদের নামাযের পূর্ব পর্যন্ত। একদিন বা দুইদিন পূর্বে আদায় করাও জায়েয। ফিতরা আদায়কারী যেখানে থাকেন সেখানের গরীব মুসলিমদের মাঝে ফিতরা বণ্টন করবেন।কিন্তু কোন দেশের অধিবাসী অধিক গরীব হলে সেখানে ফিতরা স্থানান্তর করা জায়েয। মসজিদের ইমাম ও অনুরূপ আমানতদার মানুষের জন্য ফিতরা জমা করে গরীবদের মাঝে বণ্টন করা জায়েয। তবে হকদারদের কাছে ঈদের নামাযের আগে পৌঁছতে হবে। ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ মুদ্রাস্ফীতির অনুগামী নয়। বরং শরিয়ত এর পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে এক সা’। যে ব্যক্তির কাছে ঈদের দিনের তার নিজের খাদ্য ও সে যাদের খরচ চালায় তাদের খাদ্য ছাড়া অন্য কিছু না থাকে তার উপর থেকে ফিতরা মওকুফ হয়ে যায়। কোন মসজিদ নির্মাণ কিংবা কোন স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্পে ফিতরা দেয়া জায়েয নয়। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৩৬৯)
.
🔹প্রশ্ন: কোন এক বাবা তার ছেলের ফিতরা পরিশোধ করতে চান। কিন্তু ছেলে নিজে সামর্থ্যবান। এমনতাবস্থায় ছেলে কি করবে?
.
উত্তর: যেহেতু ছেলে নিজে সামর্থ্যবান সুতরাং ছেলেই তার ফিতরা পরিশোধ করবে। আর তার বাবা যদি তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে; এতেও কোন অসুবিধা নেই। বিশেষতঃ এটা যদি পিতার অভ্যাসগত বিষয় হয় যে, তিনি প্রতি বছর তার ছেলেদের ফিতরা পরিশোধ করেন; এমনকি তারা বড় হলেও, চাকুরী করলেও। কেননা তিনি তার অভ্যাস জারী রাখতে পছন্দ করেন। যদি ছেলে বাবাকে বলে যে, আপনি আমার ফিতরা পরিশোধ করবেন না; এতে বাবা মনে কষ্ট পেতে পারেন। তাই সে তার বাবাকে তার ফিতরা পরিশোধ করতে দিক এবং সে নিজেও নিজের ফিতরা পরিশোধ করুক। পিতা ছেলেদের ফিতরা পরিশোধ করা অব্যাহত রাখাটা কারো কারো কাছে সন্তান পিতার সাথে সম্পৃক্ত থাকা এবং পিতার আনুগত্যশীল ও যত্নে থাকার চিহ্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ছেলে তার পিতার জন্য সে সুযোগটি রাখুক; যা করাটা তার জন্য সহজ হয়। আল্লাহ্‌ই সকলের অবস্থা পরিবর্তন করে দেয়ার কর্তৃত্ববান। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৬২)
.
🔹প্রশ্ন: যারা ইয়াতীমের তত্ত্বাবধান করেন তাদের উপর কি ইয়াতীমের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব?
.
উত্তর: এখানে দুটি বিষয় লক্ষনীয় যথা:

(১). যদি এই ইয়াতীমের এমন কোন সম্পদ থাকে যা সে উত্তরাধিকার হিসেবে কিংবা সাদকা হিসেবে পেয়েছে… তাহলে তার সম্পদের উপর ফিতরা ওয়াজিব হবে। ইমাম নববী বলেন: “… আর যে ইয়াতীমের সম্পদ রয়েছে আমাদের মাযহাবে তার সম্পদের উপর ফিতরা ওয়াজিব হবে। জমহুর আলেম এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। জমহুরের মধ্যে রয়েছেন: ইমাম মালেক, আওযায়ি, আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও ইবনুল মুনযির। (নববী আল-মাজুম খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১০৯)
.
(২). আর যদি ইয়াতীমের সম্পদ না থাকে; বরং আপনারাই তার প্রয়োজনীয় খরচ চালান সেক্ষেত্রে তার ফিতরা আদায় করা আপনাদের উপর অনিবার্য নয়। কেননা যার খরচ চালানো অনিবার্য তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা অনিবার্য হয়। আর যার খরচ চালানো অনিবার্য নয়; বরং স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে তার খরচ চালানো হয় তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: “কেউ যদি স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে কোন অনাত্মীয় ব্যক্তির খরচ বহন করে সেক্ষেত্রে আমাদের নিকট তার উপর ঐ ব্যক্তির ফিতরা আদায় করা অনিবার্য নয়। ইমাম মালেক, আবু হানিফা ও দাউদ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর আহমাদ বলেন:..তার উপর অনিবার্য।” (আল-মাজমু খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১০০)
.
🔹প্রশ্ন: একজনের ফিতরা কি শুধু এক ব্যক্তিকে দিতে হবে; বণ্টন করে দেওয়া কি জায়েয হবে না?
.
উত্তর: এক ব্যক্তির ফিতরা এক লোককে দেওয়া যেমন জায়েয তেমনি একাধিক ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করাও জায়েয। (আল্‌-লাজনাহ আদ্‌-দায়িমা লিল বুহুছ আল-ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা, ফাতওয়া নং-১২০৪)।
.
প্রশ্ন: ফিতরা পরিশোধ করার সময় পঠিতব্য বিশেষ কোন কথা আছে কি? থাকলে সেটা কি?
.
উত্তর: ফিতরা পরিশোধ করার সময় পঠিতব্য বিশেষ কোন দোয়া আছে মর্মে আমরা জানি না।(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৭০১৫) যেকোনো ভাল কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা মুস্তাহাব।
.
🔹যে ব্যক্তির ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ফিতরা আদায় করেনি তার হুকুম কী?
.
উত্তর: যে ব্যক্তি ফিতরা প্রদান করেনি তার উপর ওয়াজিব আল্লাহ্‌র কাছে তাওবা করা এবং ইস্তিগফার করা। কেননা সে ব্যক্তি ফিতরা আদায় না করে গুনাহ করেছে। তার উপর ওয়াজিব ফিতরা পাওয়ার হকদারদেরকে ফিতরা দিয়ে দেয়া। ঈদের নামাযের পরে দেয়ার কারণে এটি সাধারণ সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।(গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং- ৩৪৫১১৬)
.
🔹প্রশ্ন: আমাদের একটি কারখানা ও একটি ফার্ম আছে। এখানে কিছু শ্রমিক রয়েছে। তারা মাসিক বেতন পায়। আমাদেরকে কি তাদের ফিতরা পরিশোধ করতে হবে, নাকি তারা নিজেরা নিজেদের ফিতরা পরিশোধ করবে?

উত্তর: যে শ্রমিকগণ কারখানা ও ফার্মে কাজ করার বিনিময়ে বেতন পায় তারা নিজেরা নিজেদের ফিতরা পরিশোধ করবে। কেননা ফিতরা মূলতঃ তাদের উপরই ফরয। অতএব, আপনার উপর তাদের ফিতরা পরিশোধ করা আবশ্যক নয়। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড:৯ পৃষ্ঠা;৩৭২)
.
🔹প্রশ্ন: ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে না?
.
উত্তর: যাদের কে ফিতরা দেয়া যাবে না তারা হচ্ছে:
.
(১). যাদের যাকাত দেয়া বৈধ নয়। (২). কোন ধনী ব্যক্তিকে। (৩). ইসলামের দুশমনকে। (৪). কাফেরকে। (৫). মুরতাদকে। (৬). ফাসেককে। (৭). দুরাচারী বা ব্যভিচারিণীকে। (৮). রোজগার করার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তিদের। (৯). জিম্মি ব্যক্তিকে। (১০). নিজের স্বামীকে। (১১). নিজের স্ত্রীকে। (১২). নিজের পিতাকে এবং নিজের সন্তান সন্ততিকে। (১৩). কুরাইশ বংশের হাশিম বংশধরদের কে ফিতরা দেয়া যাবে না। (১৪). মসজিদ নির্মাণে অথবা কল্যাণমূলক কাজে যাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে গরীব আত্মীয়স্বজনকে ফিতরা দেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন:
.
“ফিতরা ও সম্পদের যাকাত গরীব আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া জায়েয। বরং আত্মীয়স্বজনকে দেয়া অনাত্মীয় কাউকে দেয়ার চেয়ে অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা আত্মীয়স্বজনকে দেয়ার মধ্যে যাকাত পরিশোধ করা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা উভয়টি সম্পাদিত হয়। কিন্তু শর্ত হলো— আত্মীয়কে যাকাত দিয়ে নিজের সম্পদ বাঁচানো যেন না হয়। সেটা এভাবে যে, এই গরীব ব্যক্তির খরচ বহন করা যদি তার উপর তথা সম্পদশালী ব্যক্তির উপর ফরয হয় সেক্ষেত্রে এই ব্যক্তির প্রয়োজনীয় খরচাদি যাকাতের সম্পদ থেকে দেয়া জায়েয নয়। কেননা এটা করলে এর মাধ্যমে তিনি নিজের কিছু সম্পদ সঞ্চয় করতে সক্ষম হন; যতটুকু তিনি গরীব আত্মীয়কে যাকাত থেকে দেন। এটি জায়েয নয়, বৈধ নয়। আর যদি তার উপর তাদের খরচ বহন করা আবশ্যকীয় না হয় সেক্ষেত্রে তিনি তাদেরকে যাকাতের সম্পদ দিতে পারবেন। বরং অনাত্মীয় কাউকে যাকাত দেয়ার চেয়ে আত্মীয়কে যাকাত দেয়া উত্তম। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিকটাত্মীয়কে যাকাত দেয়া— যাকাত পরিশোধ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৮১১২২)।
.
যাকাতুল ফিতর সম্পর্কে আমার আরো দুটি পর্ব পোস্ট করা হয়েছে আমার আইডি থেকে পড়তে পারেন ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে সবার উদ্দেশ্যে বলবো, হে আমার ভাই বোন! নিজে খাদ্যদ্রব্য দিয়েই ফিতরা আদায় করুন। মানুষকে সুন্নাহর দিকে উদ্বুদ্ধ করুন এবং মানুষের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ বা দলিলবিহীন কিয়াস পরিহার করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।