ইসলামে ঋণ আদান-প্রদান তথা টাকা পয়সা ধার দেওয়ার শরীয়ত সম্মত প্রদ্ধতি

প্রশ্ন: ইসলামে ঋণ আদান-প্রদান তথা টাকা পয়সা ধার দেওয়ার শরীয়ত সম্মত প্রদ্ধতি কী? ইসলামে ঋণ লিখতে বলা হয়েছে কেন?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মানুষ সামাজিক জীব। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। আর এই সামাজিকতার এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে কোন মানুষ একা সবসময় নিজের সব প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হয় না। এজন্যই পরস্পরকে বিভিন্ন উপায় বা লেনদেনের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। এরকমই একটি বড় উপায় হচ্ছে ঋণ। মানব জীবনের পথচলায় ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলাম এ বিষয়ে মানুষকে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। মহান আল্লাহ মানবজাতিকে ঋণ গ্রহণ করার যেমন অনুমতি দিয়েছেন, তেমনি যথাসময়ে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। যাপিত জীবনের বাঁকে-বাঁকে যেহেতু আমরা ঋণের সাথে জড়িত থাকি, সেহেতু ঋণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরী‘আতের দিক-নির্দেশনা ও বিধি-বিধান সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।
.
অপর ভাইকে সুদ বিহীন ঋণ দান করা সাদক্বাহর ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল। কাউকে নেকীর আশায় বা সহযোগিতার জন্য কর্যে হাসানা প্রদান করা আল্লাহর পথে দান-ছাদাক্বাহ করার সমতুল্য। এমনকি ঋণ দানকে দান-ছাদাক্বার চেয়েও বেশী মর্যাদাপূর্ণ বলা হয়েছে। আবূ উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,دخل رجل الجنة، فرأى مكتوباً على بابها: الصدقةُ بعشرِ أمثالها، والقرضُ بثمانية عشر ‘এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে তার দরজায় একটি লেখা দেখতে পেল যে, সাদাক্বার নেকী দশ গুণ বৃদ্ধি করা হয় এবং ঋণ দানের নেকী আঠারো গুণ বৃদ্ধি করা হয়’।(সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৪০৭; সহীহুত তারগীব হা/৯০০, সনদ হাসান) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, كُلُّ قَرْضٍ صَدَقَةٌ ‘প্রত্যেক ঋণই সাদক্বাহ’।(বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩২৮৫; তাবারাণী, আওসাত্ব হা/৩৪৯৮, হাদীসটি হাসান) অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ مُسْلِمًا قَرْضًا مَرَّتَيْنِ إِلَّا كَانَ كَصَدَقَتِهَا مَرَّةً “কোন মুসলিম অপর কোন মুসলিমকে দুইবার ঋণ দিলে সে একবার সাদক্বাহ করার নেকী পাবে”।(ইবনু মাজাহ হা/২৪৩০; ইরওয়াউল গালীল হা/২৪৩০)
.
ইসলামে টাকা ধার দেওয়ার সঠিক উপায় সম্পর্কে সূরা আল-বাকারায় ঋণ সংক্রান্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন, যেখানে আল্লাহ বলেন: “হে ঈমানদারগণ!তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান কর তখন তা লিখে রেখো; তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন ন্যায়ভাবে তা লিখে দেয়; কোন লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না, যেমন আল্লাহ্‌ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সে যেন লিখে; এবং যে ব্যক্তির উপর হক্ক রয়েছে (ঋণগ্রহীতা) সে যেন লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয়,এবং সে যেন তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তা থেকে কিছু যেন না কমায় (ব্যতিক্রম না করে)। অতঃপর যার উপর হক্ক রয়েছে (ঋণগ্রহীতা) যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু সে বলে দিতে না পারে। তবে যেন তার অভিভাবক ন্যায্যভাবে লেখার বিষয়বস্তু সে বলে দিতে না পারে তবে যেন তার অভিভাবক নায্যভাবে লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয়। আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখ, অতঃপর যদি দু’জন পুরুষ না হয় তবে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক যাদেরকে তোমরা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ কর, যাতে স্ত্রীলোকদের মধ্যে একজন ভুলে গেলে তাদের একজন অপরজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর সাক্ষীগণকে যখন ডাকা হবে তখন তারা যেন অস্বীকার না করে। আর তা (লেনদেন) ছোট-বড় যাই হোক, মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনরূপ বিরক্ত হয়ো না। এটাই আল্লাহর নিকট ন্যায্যতর ও সাক্ষ্যদানের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত। তবে তোমরা পরস্পর যে নগদ ব্যবসা পরিচালনা কর তা তোমরা না লিখলে কোন দোষ নেই। আর তোমরা যখন পরস্পর বেচাকেনা কর তখন সাক্ষী রেখো। আর কোন লেখক ও সাক্ষীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। আর যদি তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত কর, তবে তা হবে তোমাদের সাথে অনাচার। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দিবেন। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞানী।আর যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোন লেখক না পাও তবে হস্তান্তরকৃত বন্ধক রাখবে। অতঃপর তোমাদের একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে করলে, যার কাছে আমানত রাখা হয়েছে সে যেন আমানত প্রত্যার্পণ করে এবং তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। আর যে কেউ তা গোপন করে অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবগত।(সূরা বাকারাহ আয়াত: ২৮২-২৮৩)
.
আলোচ্য আয়াতসমূহে লেন-দেন সম্পর্কিত আইনের জরুরী মূলনীতি ব্যক্ত হয়েছে। যাকে চুক্তিনামাও বলা যেতে পারে। এরপর সাক্ষ্য-বিধির বিশেষ ধারা উল্লেখিত হয়েছে। আজকাল লেখালেখির যুগ। লেখাই মুখের কথার স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তখন দুনিয়ার সব কাজকারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য মুখে মুখেই চলত। লেখালেখি এবং দলীল-দস্তাবেজের প্রথা প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম কুরআনুল কারীম এদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়েছে “তোমরা যখন পরস্পর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ধার-কর্জের কারবার কর, তখন তা লিখে নাও”। এতে প্রথম নীতি এই যে, ধার-কর্জের লেনদেনে দলীল-দস্তাবেজ লিপিবদ্ধ করা উচিত যাতে ভুল-ভ্রান্তি অথবা কোন পক্ষ থেকে অস্বীকৃতির কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তখন কাজে লাগে। তাই টাকা ধার দেওয়ার সঠিক উপায় হল:

(১).ঋণের মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে হবে, অর্থাৎ কত সময় পর ঋণ পরিশোধ করা হবে অবশ্যই সেটা নির্দিষ্ট করতে হবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার-কর্জের লেন-দেন জায়েয নয়। এতে কলহ-বিবাদের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এ কারণেই ফেকাহবিদগণ বলেছেনঃ মেয়াদও এমন নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে কোনরূপ অস্পষ্টতা না থাকে। মাস এবং দিন তারিখসহ নির্দিষ্ট করতে হবে। কোনরূপ অস্পষ্ট মেয়াদ যেমন “ধান কাটার সময়”- এরূপ নির্ধাতির করা যাবে না। কেননা, আবহাওয়ার পরিবর্তনে ধান কাটার সময় আগে-পিছে হয়ে যেতে পারে।
.
(২).ঋণ এবং কখন তা পরিশোধ করতে হবে তা লিখতে হবে।লেন-দেন ছোট কিংবা বড় হোক – সবই লিপিবদ্ধ করা দরকার। এ ব্যাপার বিরক্তিবোধ করা উচিত নয়। কেননা, লেন-দেন লিপিবদ্ধ করা সত্য প্রতিষ্ঠিত রাখতে, নির্ভুল সাক্ষ্য দিতে এবং সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকতে চমৎকাররূপে সহযোগীতা করে। যদি লেন-দেন বাকী না হয়ে নগদ হয়, তবে তা লিপিবদ্ধ না করলেও ক্ষতি নেই।
.
(৩).যিনি ঋণ লিখে দেন তিনি যদি ঋণগ্রহীতা ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি হন, তবে ঋণগ্রহীতা সেই ব্যক্তি যিনি ঋণের বিবরণ তাকে নির্দেশ করবেন।ঋণের লেখক নিরপেক্ষ হওয়াই উচিত। কেননা উপরোক্ত আয়াতে, “তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখবে”। এতে একদিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, লেখক কোন এক পক্ষের লোক হতে পারবে না; বরং নিরপেক্ষ হতে হবে যাতে কারো মনে সন্দেহ-সংশয় না থাকে। অপরদিকে লেখককে ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যের ক্ষণস্থায়ী উপকার করে নিজের চিরস্থায়ী ক্ষতি করা তার পক্ষে উচিত হবে না। এরপর লেখককে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে এ লেখার বিদ্যা দান করেছেন। এর কৃতজ্ঞতা এই যে, সে লিখতে অস্বীকার করবে না।ঋণের লেখক যদি লেখার বিনিময়ে পারিশ্রমিক দাবী করে কিংবা সাক্ষী যাতায়াত খরচ চায়, তবে এটা তাদের নায্য অধিকার। ফকীহগণ এমনটাই বলেছেন।
.
(৪).যদি ঋণগ্রহীতা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে হুকুম দিতে অক্ষম হয়, তাহলে যিনি তার পক্ষ থেকে হুকুম দেবেন তিনিই তার অভিভাবক। অর্থাৎ লেন-দেনের ব্যাপারে দেনাদার ব্যক্তি কখনো নির্বোধ বা অক্ষম, বৃদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক, মুক অথবা অন্য ভাষাভাষী হতে পারে। এ কারণে দলীলের বিষয়বস্তু বলে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তার পক্ষ থেকে তার কোন অভিভাবক লেখাবে। পাগল ও নাবালেগের তো অভিভাবক থাকেই। তাদের সব কাজ-কারবার অভিভাবক দ্বারাই সম্পন্ন হয়। মুক ও অন্য ভাষাভাষীর অভিভাবকও এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে। যদি তারা কাউকে উকিল নিযুক্ত করে, তাতেও চলবে। এখানে কুরআনুল কারীমের ‘ওলী’ শব্দটি উভয় অর্থই বোঝায়।

(৫).ঋণের সাক্ষী হতে হবে এবং সাক্ষী হতে হবে দুইজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন নারী।সাক্ষী এজন্য যে, অনেক সময় দলীলের লেখাকেই যথেষ্ট হয়না; বরং এতে সাক্ষ্যও রাখা উচিত -যাতে কোন সময় পারস্পরিক কলহ দেখা দিলে আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য দ্বারা ফয়সালা হতে পারে। এ কারণেই ফেকাহবিদগণ বলেছেন যে, লেখা শরীআতসম্মত প্রমাণ নয়, তাই লেখার সমর্থনে শরীআতসম্মত সাক্ষ্য বিদ্যমান না থাকলে শুধু লেখার উপর ভিত্তি করে ফয়সালা করা যায় না। আজকালকার সাধারণ আদালতসমূহেও এ রীতিই প্রচলিত রয়েছে। লেখার মৌখিক সত্যায়ন ও তৎসমর্থনে সাক্ষ্য ব্যতীত কোন ফয়সালা করা হয় না। তাছাড়া উপরোক্ত আয়াতে সাক্ষ্য-বিধির কতিপয় জরুরী নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণতঃ (১) সাক্ষী দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা হওয়া জরুরী। একা একজন পুরুষ অথবা শুধু দু’জন মহিলা সাধারণ লেন-দেনের সাক্ষ্যের জন্য যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে (২) সাক্ষী মুসলিম হতে হবে। (مِنْ رِجَالِكُمْ) শব্দে এদিকেই নির্দেশ করা হয়েছে। (৩) সাক্ষী নির্ভরযোগ্য আদিল’ (বিশ্বস্ত) হতে হবে, যার কথার উপর আস্থা রাখা যায়। ফাসেক ও ফাজের (অর্থাৎ পাপাচারী) হলে চলবে না। (مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ) বাক্যে এ নির্দেশ রয়েছে।
.
(৬).ঋণদাতার অধিকার আছে ঋণগ্রহীতাকে একটি বন্ধক তথা অঙ্গীকারসহ ঋণের গ্যারান্টি দিতে যা ঋণদাতা রাখবে। ঋণ আদান-প্রদানে বন্ধক গ্রহণ করা জায়েয। দলিল হচ্ছে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মুকীম অবস্থায় বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ইয়াহুদীর নিকট থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদে (বাকী) কিছু খাদ্য সামগ্রী খরিদ করেন এবং ঐ সময়ের জন্য তিনি ইয়াহুদীর নিকট তার বর্ম বন্ধক রাখেন।(সহীহ বুখারী হা/ ২৫০৯) বন্ধক তথা অঙ্গীকারের সুবিধা হল যদি ঋণ পরিশোধের সময় আসে এবং ঋণগ্রহীতা পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে অঙ্গীকারের জিনিস বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা যেতে পারে; যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তা বন্ধকের মালিককে দিতে হবে, অর্থাৎ ঋণগ্রহীতাকে। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষনীয় আর তা হচ্ছে, ঋণগ্রহীতা ঋণ নেওয়ার সময় যা কিছু বন্ধক রাখবে ঋণদাতার জন্য সেই বন্ধকী বস্তু থেকে উপকৃত হওয়া জন্য জায়েয নয়। সে শুধু ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত একে নিজের অধিকারে রাখবে। এর যাবতীয় মুনাফা আসল মালিক তথা ঋণগ্রহীতার প্রাপ্য।
.
▪️ইসলামে ঋণ দিয়ে তা লিখে রাখতে বলা হয়েছে কেন?
.
ইসলামী শরীয়তে ঋণ প্রদান করে লেখা,সাক্ষী রাখা বা অঙ্গীকার এই তিনটি উপায়ে একটিতে ঋণের নিশ্চয়তা দেওয়া বাঞ্ছনীয় এবং পছন্দনীয়,তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। যদিও কোন কোন আলেম এ মত পোষণ করেন যে, ঋণ লিপিবদ্ধ করা ওয়াজিব,তবে অধিকাংশ আলেম বলেছেন যে,ঋণ লিপিবদ্ধ করা ওয়াজিব নয় বরং উত্তম। আর দলিলের আলোকে এটিই অধিকতর সঠিক মত।(দেখুন তাফসির আল-কুরতুবী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৮৩) ঋণ লিপিবদ্ধ করার অন্যতম কারণ হল এর মাধ্যমে মানুষের অধিকার রক্ষা করা যাতে তারা ভুলে যাওয়া বা বিভ্রান্তির কারণে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় এবং যারা আল্লাহকে ভয় করেনা তাদের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসেবে। যদি একটি ঋণ লিপিবদ্ধ করা না হয় বা সাক্ষীও রাখা না হয় কিংবা কোন অঙ্গীকার নেওয়া না হয়, তার মানে এই নয় যে এটি একটি পাপ এর কারনে কেউ গুনাহগার হবে। বরং সূরা বাকারার ২৮৩ নং আয়াতটি নির্দেশ করে যে: فَاِنۡ اَمِنَ بَعۡضُکُمۡ بَعۡضًا فَلۡیُؤَدِّ الَّذِی اؤۡتُمِنَ اَمَانَتَهٗ وَ لۡیَتَّقِ اللّٰهَ رَبَّهٗ “অতঃপর তোমাদের একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে করলে, যার কাছে আমানত রাখা হয়েছে সে যেন আমানত (বিশ্বাসের সাথে) প্রত্যার্পণ করে এবং তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে”।(সূরা বাকারা: ২৮৩) এই আয়াতে ‘বিশ্বস্ত’ মানে ঋণের গ্যারান্টি লিখা ছাড়াই, সাক্ষী না রেখে কিংবা অঙ্গীকারের জন্য জিজ্ঞাসা না করে। তবে এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাকে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করা অপরিহার্য। কেননা আয়াতে আল্লাহ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে আল্লাহকে ভয় করতে এবং তার আস্থা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন: তিনি বলেছেন, “যার উপর অর্পিত হয়েছে সে যেন তার আমানত (বিশ্বস্ততার সাথে) পালন করে এবং সে তার পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে”।(দেখুন তাফসির আস-সাদী, পৃষ্ঠা:১৬৮-১৭২)
.
যদি ঋণ লিপিবদ্ধ না করা হয় এবং পরবর্তীতে ঋণগ্রহীতা তা অস্বীকার করে বা তা পরিশোধ করতে দীর্ঘ সময় নেয়, তাহলে ঋণদাতার নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারপ করার অধিকার নেই, কারণ সে নিজেই তার সম্পত্তি ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত যে, যদি ঋণ লিপিবদ্ধ না করা হয় তবে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ঋণদাতার দু‘আ কবুল হবে না যদিও সে পরিশোধ করতে বেশি সময় নেয় বা অস্বীকার করে। হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তিনজন আছে যারা আল্লাহকে ডাকে কিন্তু তাদের দোয়া কবুল হয় না… তারমধ্যে একজন হচ্ছে, সেই ব্যক্তি যে ব্যক্তি অন্য কাউকে টাকা ধার দেয় কিন্তু সে (ঋণের) সাক্ষ্য রাখেনি।(আলবানী সহীহ আল-জামি’,হা/৩০৭৫ হাদীসটি বিশুদ্ধ) সুতরাং যে কেউ এই বিধানগুলি এবং অন্যদের সম্পর্কে চিন্তা করবে সে ইসলামী শরীয়তের পরিপূর্ণতা দেখতে পাবে এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষতির সম্মুখীন না করার ক্ষেত্রে ইসলাম কতটা উদ্বিগ্ন।কারণ আল্লাহ যার সম্পদ আছে তাকে তা রক্ষা করতে এবং ক্ষতির সম্মুখীন না করার নির্দেশ দিয়েছেনন, তা যত কমই হোক না কেন: তিনি আল্লাহ বলেছেন,”আর তা (লেনদেন) ছোট-বড় যাই হোক, মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনরূপ বিরক্ত হয়ো না। এটাই আল্লাহর নিকট ন্যায্যতর ও সাক্ষ্যদানের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত।(সূরা বাকারাহ: আয়াত: ২৮২)
.
পরিশেষে, হে আমাদের পাঠক আপনিই বলুন!ইসলামি শরীয়তের মতো নিখুঁতভাবে দুনিয়া ও আখেরাতের স্বার্থকে একত্রিত করে এমন অন্য কোনো আইন বা বিধান আছে কি? কেউ কি ইসলামি শরীয়তের এই বিধি-বিধানের চেয়ে আরও নিখুঁত কিছু নিয়ে আসতে পারবে? যেখানে আমাদের সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই বলেছেন,وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰهِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ “আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে উত্তম হতে পারে?”(সূরা মায়িদাহ, ৫: ৫০) নিশ্চয়ই আমাদের মহান রব ছাড়া আর কেউই পারেনি,এবং কখনো পারবেও না। সুতরাং ইসলাম হচ্ছে পুরোপুরি জ্ঞানের পথ। কারণ, ইসলামের পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ নিজেই। আর আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। অপরদিকে ইসলামের বাইরের যে কোন পথই জাহেলিয়াতের পথ। হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছে তিনজন। যে ব্যক্তি হারাম শরীফের মধ্যে অন্যায় কাজ করে, যে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্বেও জাহেলী যুগের রীতি-নীতি অনুসন্ধান করে এবং যে ব্যক্তি কোন অধিকার ব্যতীত কারো রক্তপাত দাবী করে।(সহীহ বুখারী হা/ ৬৮৮২) ইমাম হাসান বসরী বলেন, যে কেউ আল্লাহর দেয়া বিধানের বিপরীত বিধান প্রদান করল সে জাহিলিয়াতের বিধান দিল। [ইবন আবি হাতিম, ইবন কাসীর:সূরা মায়েদার ৫০ নং আয়াতের তাফসির) আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁর দ্বীনের প্রতি অবিচল রাখেন যতক্ষণ না আমরা তার সাথে মিলিত হই।(আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩১৮০) আল্লাহই ভালো জানেন।
_____________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।