ইমামের পিছনে মুক্তাদী কি সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ অতঃপর রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ বললে নাকি শুধুমাত্র রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ বলবে

প্রশ্ন: ইমামের পিছনে মুক্তাদী কি ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ অতঃপর ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বললে নাকি শুধুমাত্র ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ বলবে’? কোন মতটি অধিক বিশুদ্ধ বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সালাতে রুকু থেকে উঠার সময় “সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ” এবং সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময় “রাব্বানা লাকাল হামদ” কারো মতে বলা সুন্নত অধিকাংশ আলেমদের মতে মুস্তাহাব। হাম্বলী মাযহাবের মতে এগুলো ওয়াজিব। তবে অধিক সঠিক মত হলো এগুলো ওয়াজিব। এই সম্পর্কে বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: রুকু থেকে উঠার সময় এগুলো পাঠ করা ওয়াজিব এর প্রমান হল:

(১) রাসূল (ﷺ) এটি করেছেন, তিনি কখনো সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ” বলতে অবহেলা করেননি।
.
(২) এটি রুকু থেকে দাড়ানোর জন্য সংকেত।
.
(৩) রাসূল ﷺ বলেছেন, ইমাম যখন “সামিআল্লা-হু লিমান হামিদাহ” বলেন তখন তোমরা বলবে “রব্বানা ওয়ালাকাল হামদ।(উসাইমীন আল-শারহ আল-মুমতি খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৪৩৩)
.
আহালুল আলমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে একাকী সালাত আদায়কারীর উচিত তাসমীহ ও তাহমীদ উভয়ই পাঠ করা। তাই সে রুকু থেকে উঠার সময় সামি আআল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলবে এবং সোজা হয়ে দাঁড়ালে রাব্বানা ওয়া লাকাল-হামদ বলবে। কিন্তু ইমামের পিছনে মুক্তাদী ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলবে নাকি’ শুধুমাত্র ‘রাব্বালা লাকাল হামদ’ বলবে এই মাসালায় আহালুল আলেমগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দুটি মত রয়েছে। যেমন:
.
(১). ইমামদের ক্ষেত্রে: হানাফী ও মালিকীগণের অভিমত যে,তার অর্থাৎ ইমামের শুধু তাসমীহ বলা উচিত এবং রাব্বানা লাকাউল-হামদ বলা তার জন্য সুন্নাত নয়।অপরদিকে শাফাঈ ও হাম্বলী মাযহাবের মতে ইমামের তাসমীহ ও তাহমীদ উভয়ই বলা উচিত। তবে দলিলের আলোকে অধিকতর সঠিক মত হল পরেরটি, অর্থাৎ ইমামের উভয়টিই পড়া উচিত। কারন আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ অর্থাৎ সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ) বলে (রুকূ‘ হতে উঠতেন) তখন اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ অর্থাৎ আল্লা-হুম্মা রব্বানা লাকাল হামদ বলতেন, সহীহ বুখারীহা/৭৯৫ সহীহ মুসলিম হা/৩৯২) উক্ত হাদীসের আলোকে হাফিজ ইবনে হাজার বলেন যে, ইমামের জন্য তাহমীদ বলা মুস্তাহাব তা এই হাদীছ এবং অন্যান্য হাদীস থেকে বোঝা যায়। (ফাতহুল বারী: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:৩৬৭)

(২). ইমামের পিছনে সালাত আদায়কারীর ক্ষেত্রে:

হাদীস পর্যালোচনা করে জমহুর বা অধিকাংশ আলেম, হানাফী, মালিকি ও হাম্বলীর অভিমত যে,ইমামের পিছনে নামায পড়া ব্যক্তিকে শুধুমাত্র তাহমীদের মধ্যে অর্থাৎ রাব্বানা লাকাল হামদ বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং তার জন্য সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলা উচিত নয়। দলিল আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ইমাম যখন “সামিআল্লাহু লিমান হামিদা” বলেন তখন তোমরা বলবে “রাব্বানা ওয়ালাকাল হাম্‌দ” (হে আমাদের রব! সকল প্রশংসা তোমার জন্য)। (সহীহ বুখারী ৬৮৯, ৭৩২-৩৩, ৮০৫, ১১১৪; মুসলিম ৪১১, তিরমিযী ৩৬১, নাসায়ী ৭৯৪, ৮৩২, ১০৬১; আবূ দাঊদ ৬০১, মুসনাদে আহমাদ ১১৬৬৪, ১২২৪১; সুনানে ইবনে মাজাহ ৮৭৬)। এই মর্মে আরো কয়েকটি দলিল রয়েছে।
.
তবে শাফাঈ ও জাহিরিগণ এবং আলবানী উক্ত মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং তারা বলেছেন যে ইমামের পিছনে নামায পড়া ব্যক্তির জন্য তাসমীহ ও তাহমীদ উভয়ই বলা মুস্তাহাব। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এর পক্ষ থেকে এটাই পছন্দ করা মত। (সিফাতু সালাতিন নাবী (ﷺ)পৃষ্ঠা: ১৩৫) তারা বলেছেন: আল্লাহর নবী (ﷺ) উভয়ই বলেছেন।(সহীহ বুখারী হা/ ৭৩৫, নাসায়ী ১০৫৯, সহীহ ইবনু হিব্বান হা ১৮৬১ মিশকাত হা/ ৭৯৩ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ) পৃষ্ঠা: ১৩৫-১৩৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
.
ইমাম যখন সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলবে তখন যারা তার পিছনে সালাত আদায় করতেছে তাদের উচিত হবেনা সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলা। কারন রাসূল ﷺ বলেছেন: ইমাম নির্ধারণই করা হয় তাঁর ইক্তিদা করার জন্য। কাজেই ইমাম যখন দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে, সে যখন রুকূ‘ করে থাকে তোমরাও রুকু‘ করবে, সে যখন উঠে, তখন তোমরাও উঠবে, আর সে যখন সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলে তখন তোমরা রব্বানা লাকাল হামদ বলবে।এই হাদীসে তিনি বললেন, “যখন ইমাম তাকবীর বলবে, তখন তোমারা তাকবীর বলবে,” এবং “যখন সে সামিয়াআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলবে, তখন রাব্বানা ওয়া লাকাল-হামদ বলবে”। এভাবে রাসূল (ﷺ) তাকবীর ও তাসমীহর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাকবীরের ব্যাপারে, তিনি যা বলেন তা আমরা বলি, কিন্তু তাসমীর ব্যাপারে আমরা তা বলি না, কারণ তিনি যা বলেন, তার কথা “যখন তিনি সামিআআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলেন, তখন রাব্বানা ওয়া লাকাউল-হামদ বলেন।”বলার সমতুল্য: যখন সে সামিআআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলে, তখন সামিআআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলো না, বরং রাব্বানা ওয়া লাকা’ল-হামদ বলবে। এটি সেই হাদিসের প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে যেখানে তিনি বলেছেন, “যখন ইমাম তাকবীর বলবে, তখন তাকবীর বলবে। “যেসব আলেম বলেন যে মুত্তাদী সামিআআল্লাহু লিমান হামিদাহ এবং রাব্বানা ওয়া লাকাআল-হামদ বলতে হবে, এটি একটি দুর্বল যুক্তি। কোনো মতামতকে সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটিকে কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি পেশ করা হয়। যখন আমরা এটিকে সুন্নাহের উপর ভিত্তি করে পেশ করবো তখন আমরা সে বিষয়টি পেয়ে যাব যেভাবে আমরা শুনেছি।(উসাইমীন, লিকাউল বাবিল মাফতুহ,৩২০/১ আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া,২৭/৯৩-৯৪)। আল মুগনী: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৫৪৮)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদী ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলবে নাকি’ শুধুমাত্র ‘রাব্বালা লাকাল হামদ’ বলবে? এটি একটি মতানৈক্যপূর্ণ মাসালা যার উভয় পক্ষই নিজ নিজ মতের পক্ষে দলিল রয়েছে। তবে সুস্পষ্ট দলিল এবং জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী যেটি অধিক সঠিক বলে প্রমানিত হয় তা হল: ইমামের পিছনে অত্যাধি শুধুমাত্র রাব্বালা লাকাল হামদ’ বলবে।
সুতরাং বাড়াবাড়ি না করে যার কাছে যে মতটি অধিক সঠিক মনে হয় তিনি সেই মত অনুযায়ী আমল করতে পারেন ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।