ইমামের অনুসরণের বিধান এবং ইমামের পিছনে মুত্তাদীর সালাম ফেরানোর সঠিক সময়টি

প্রশ্ন: ইমামের অনুসরণের বিধান কি?ইমামের পিছনে মুত্তাদীর সালাম ফেরানোর সঠিক সময়টি কখন? ইমামের প্রথম সালামের পর নাকি উভয় সালামের পর কোনটি অধিক সঠিক? একটি দলিল ভিত্তিক আলোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়। সালাত আদায়ে তিনি নেতৃত্ব দেন। সকল শ্রেণীর মুসল্লী তার নেতৃত্বে সালাতে রুকু সিজদা দেন, উঠেন ও বসেন। তার তাকবীর ধ্বনি শুনে সকলে তার অনুকরণ ও অনুসরণ করেন, কেউই তা লঙ্ঘন করে না। ইমামের এরূপ অনুসরণই হলো ইক্তিদা। ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সালাতে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব।রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ ‘ইমাম নির্ধারণ করা হয় তার অনুসরণের জন্য।’(সহীহ বুখারী, হা/৩৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/৪১১; মিশকাত, হা/১১৩৯)।
.
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সালাত আদায় করালেন। সালাত শেষে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। তাই তোমরা রুকু করার সময়, সাজদাহ্‌ করার সময়, দাঁড়াবার সময়, সালাম ফিরাবার সময় আমার আগে যাবে না, আমি নিশ্চয়ই তোমাদেরকে আমার সম্মুখ দিয়ে ও পেছন দিক দিয়ে দেখে থাকি। (সহীহ মুসলিম,৪২৬ মিশকাত হা/১১৩৭)।
.
এ ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠোরতা আরোপ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে তার মাথা ইমামের পূর্বেই উত্তোলন করে সে কি ভয় করে না যে, আল্লাহ তার মাথাকে গাধার মাথাতে অথবা গাধার আকৃতিতে পরিনত করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৪২৭; আবু দাঊদ, হা/৬২৩, মিশকাত হা/১১৪১, ১১৩৮)।

◾এবার আসি মূল কথায় মুত্তাদী ইমামের পিছনে সালাম ফেরানোর সঠিক সময়টি কখন?
____________________________________
সালাতে ইমামের পিছনে মুত্তাদী কখন সালাম ফিরাবেন এটি নিয়ে আহালুল আলেমগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। আহালুল আলেমগনের একটি অংশ বলেছেন ইমাম ডানদিকে ফিরানোর মুত্তাদী ডানদিকে ফিরাবে অনুরুপ বামদিকেও। আবার অপর পক্ষের আলেমগন বলেছেন ইমাম ডানে-বামে উভয় দিকে ফিরানোর পর মুত্তাদী সালাম ফিরাবেন। কেননা এই মর্মে সুনির্দিষ্ট কোন হাদীস নেই। এক্ষেত্রে যে হাদীসটি মূলনীতি হিসেবে ধরা হয় সেটি হল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ইমাম নিযুক্ত করা হয় কেবল তার পরিপূর্ণ অনুসরণ করার জন্য। অতএব ইমাম যখন তাকবীর দিবে তখন তোমরা তাকবীর দাও এবং যখন ইমাম রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর,ইমাম সিজদা করলে তোমরাও সিজদা করবে’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৭৮;সহীহ মুসলিম, হা/৪১৭)।

অপর বর্ননায় ইত্‌বান ইব্‌নু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে সালাত আদায় করেছি। তিনি যখন সালাম ফিরান তখন আমরাও সালাম ফিরাই। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৮৩৮)।

উপরোক্ত হাদীসের মর্ম হল, সালাতে ইমামের আগে বেড়ে কোন কাজ করা হারাম। যেমন: ইমামের আগে রুকূ, সিজদা, ক্বিয়াম ইত্যাদি করা হারাম। ইমামের অনুসরণ হবে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার জন্য।
.
ইমাম নাওয়াউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: সালাতে ইমাম দুইদিকে সালাম না ফিরানো পর্যন্ত মুত্তাদী সালাম শুরু না করাই বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ ইমান ডানে বামে সালাম শেষ করার পর মুক্তাদী ডানে শুরু করবে এবং তার বাম দিকে শেষ করবে।(আল-নাওয়াবী, আল-মাজমু’ (৩/৪৬৩)।
.
বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ সৌদি ফতোয়া বোর্ডের বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতী শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে ইমামের প্রথম সালাম ফিরানোর পর মুত্তাদী সালাম ফিরানো জায়েজ কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন: এতে দোষের কিছু নেই, এটা ঠিক যে এতে সালাতের কোন ক্ষতি হয় না, তবে সুন্নত এবং উত্তম হল তাড়াহুড়া না করে ইমামের দ্বিতীয় সালাম পর্যন্ত বিলম্ব করা, কেননা হাদিসের আপাত অর্থ এবং অনুসরণের সম্পূর্ণতার বিষয় হিসাবে দ্বিতীয় সালাম পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ইমাম নিযুক্ত করা হয় কেবল তার পরিপূর্ণ অনুসরণ করার জন্য। অতএব ইমাম যখন তাকবীর দিবে তখন তোমরা তাকবীর দাও এবং যখন ইমাম রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর, ইমাম সিজদা করলে তোমরাও সিজদা করবে। তাই মুত্তাদী দ্বিতীয় সালাম না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, এটাই হল সতর্কতা, এবং অনুসরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ। কিন্তু কেউ যদি প্রথমটির পর প্রথম সালাম দেয় এবং দ্বিতীয়টির পর দ্বিতীয়টিকে সালাম দেয়, তাহলেও নামায পরিপূর্ণ হবে এবং কোন দোষ বা গুনাহ নেই। (binbaz.org.sa ফাতওয়া নং: ১০৬৮)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ,ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: আফযল হল ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরার পরই সালাম ফিরানো। অবশ্য যদি কেউ ইমামের ডান দিকে সালাম ফিরার পর ডান দিকে এবং তাঁর বাম দিকে সালাম ফিরার পর বাম দিকে সালাম ফিরে, তাহলে তা দোষের নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭)।
.
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) কে ইমাম ডানদিকে সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরাও কি ডানদিকে সালাম ফিরাবে নাকি ইমাম উভয় দিকে সালাম ফিরানোর পর মুত্তাদীরা ডানে পর বামে সালাম ফিরাবে? মর্মে প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন: এটি একটি চমৎকার প্রশ্ন। মুক্তাদী ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত অপেক্ষা করবেনা। কারন প্রথম সালামের মাধ্যমে সালাত থেকে বের হওয়া যায় বা সালাত শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ দুই সালামের প্রথম সালামটি রুকন দ্বিতীয় সালামটি সুন্নত। অএতব ইমাম ডান দিকে সালাম ফিরালে মুসল্লিরাও ডানদিকে ফেরাবে ইমাম সালাম না ফিরালে মুসল্লিরাও ফেরাবে না। এটিই গ্রহণযোগ্য মত। ইমামের দ্বিতীয় স্থান পর্যন্ত অপেক্ষা করা গ্রহণযোগ্য পরিপন্থী।(তুরাসুল আলবানী রহঃ ফিল ফিকহ ৫/৪৯৯)।

ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটির আলেমগন বলেন: ইমামের দুই সালাম ফিরানোর আগে মুক্তাদীর সালাম ফিরানো বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১২/৯১)। আবার অনেকের মতে ইমামের দুই সালাম ফিরানোর আগে যদি মুক্তাদী সালাম ফিরিয়ে দেয় অথবা বাকী সালাত পড়ার জন্য উঠে যায়, তাহলে তার সালাত নষ্ট হয়ে নফলে পরিণত হয়ে যায়। (ফাতওয়া শায়খ সা’দী ১৭৪পৃ:, মুত্বাসা ৯৭পৃ:)।

◾পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যে বিষয়টি বুঝা যায় সেটা হল, ইমামের সাথে মুক্তাদীর চারটি অবস্থা হতে পারে। যেমন:

১) ইমামের আগে কোন কিছু করা। এটি সম্পূর্ণ হারাম।
২) ইমামের সাথে সাথে করা।দলিল অনুযায়ী এটিও
হারাম।
৩) ইমামের অনুসরণ করা। এটি সুন্নাহ পদ্ধতি।
৪) ইমামের পিছনে অতিরিক্ত দেরী করে ইমামের অনুসরণ করা। ইহা সুন্নাহপরিপন্থী।সুতরাং দলিলের আলোকে আমরা বলতে পারি, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর জন্য ইমামের ডানদিকে সালাম ফিরানোর পর যেমন সালাম ফিরানো বৈধ তেমনি ইমামের দু’দিকে ফিরানোর পরেও বৈধ অর্থাৎ দলিল অনুযায়ী উভয় আমলই জায়েজ রয়েছে। কেননা ইমাম শাফেঈ ও ইবনুল মুনযিরসহ জমহূর বিদ্বানগণের মতে,সালাতে প্রথম সালাম ওয়াজিব এবং দ্বিতীয় সালাম সুন্নত।(ইবনু কুদামাহ ১/৩৯৬; নববী, আল-মাজমু ৩/৪৮৩; আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়াহ ৩৭/১৬৩)। কারন রাসূল (ﷺ) কখনো কখনো শুধুমাত্র ডানদিকে একটি সালাম ফিরিয়ে সালাত সম্পন্ন করেছেন। যেমন: আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সামনের দিকে একবার সালাম ফিরাতেন। (তিরমিযী ২৯৬, আহমাদ ২৫৪৫৬। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৯১৯)। সালামাহ ইবনুল আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সলাত আদায় করতে দেখেছি। তিনি একবার সালাম বলেছেন।(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৯২০) এমনকি আম্মাজান আয়েশা رضي الله عنها এরও এই আমল ছিল। (সহীহ ইবনে খুযাইমাহ্‌,৭৩০, ৭৩২, বায়হাকী ২/১৭৯)। অনুরুপ এক সালামের আমল ছিল যুবাইর (রাঃ) এরও। (সহীহ ইবনে খুযাইমাহ্‌,৭৩১বায়হাকী ২/১৭৯)। তাই বাড়াবাড়ি না করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী দুটি মতের যে কোন একটি মত অনুযায়ী আমল করতে পারেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু ইমামের আগেও করা যাবে না আবার অনেক দেরি করেও করা যাবে না। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ইমাম নিযুক্ত করা হয় কেবল তার পরিপূর্ণ অনুসরণ করার জন্য। অতএব ইমাম যখন তাকবীর দিবে তখন তোমরা তাকবীর দাও এবং যখন ইমাম রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/৪১৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।