ইফতিরাশ ও তাওয়াররুক শব্দের অর্থ এবং সালাতের বৈঠকে বসার নিয়ম

প্রশ্ন: ইফতিরাশ এবং তাওয়াররুক শব্দের অর্থ কি? এক তাশাহ্হুদ বিশিষ্ট সালাত তথা এক বা দুই রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতের সময় এবং তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট সালাতের শেষ বৈঠকে কিভাবে বসতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أُصَلِّىْ ‘তোমরা সালাত আদায় কর সেভাবেই যেভাবে তোমরা আমাকে দেখছ।’(সহীহ বুখারী, হা/৬৩১)। এই হাদীস সালাত আদায়ের স্পষ্ট একটি নীতিমালা।উক্ত নীতিমালার আলোকে তাকবীরে তাহরীমা থেকে শুরু করে সালাম ফিরানো পর্যন্ত সালাতে সর্বোচ্চ দুটি তাশাহুদের বৈঠক রয়েছে। যার প্রথম বৈঠকে বসার শরী‘আত সম্মত পদ্ধতিকে ‘ইফতিরাশ’এবং শেষ বৈঠকে বসার শরী‘আত সম্মত পদ্ধতিকে তাওয়াররুক বলে। যেমন মাগরিব, এশা, যোহর ও আসর সালাতের প্রথম তাশাহুদে ইফতিরাশ করা এবং শেষ তাশাহুদে তাওয়াররুক করা সুন্নত। এই বিধান নারী পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য।
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইফিতরাশ বলতে বুঝায়, বাম পাকে বিছিয়ে দিয়ে তার উপর নিতম্ব রেখে বসা, আর ডান পাকে খাড়া করে রাখা।’ (কিতাবুল মাজমূঊ, ৩/৪৩৭ পৃ.)। যা দুই রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতে করতে হয় যাতে শুধু একটি-ই তাশাহ্হুদ থাকে। এটাই সুন্নাত। (নাসাঈ হা/১১৫৯; মুসলিম হা/৪৯৮; তামামুল মিন্নাহ,পৃ: ২২৩; বিস্তারিত আলোচনা দ্র. মির‘আতুল মাফাতীহ হা/৯১৭-এর ব্যাখ্যা)। অপরদিকে যে সকল সালাতে দুটি বৈঠক রয়েছে সেসকল সালাতের শেষ বৈঠকে বসার শরী‘আত সম্মত পদ্ধতিকে ইসলামী পরিভাষায় ‘তাওয়াররুক’ বলা হয়। তাওয়াররুক বলতে বুঝায় ‘দ্বিতীয় বা শেষ বৈঠকে বসার সময় ডান পাকে খাড়া করে রাখা এবং বাম পাকে ডান পায়ের নিচ দিয়ে বের করে দেয়া অতঃপর বাম নিতম্বের উপর ভর করে ভূপৃষ্ঠের উপর বসা।’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১০৩৮৮৬)।
.
আবার যেসকল সালাতে একটি তাশাহ্হুদ যেমন ফজরের সালাত, দুই রাকাআত বিশিষ্ট নফল সালাত এক রাকাআত বিতিরের সালাত ইত্যাদি রয়েছে সে সালাতের শেষ বৈঠকে বসা নিয়ে মুহাদ্দিস গণের মাঝে দুই ধরনের মত দেখা যায়। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকটে এক তাশাহ্হুদ বিশিষ্ট সালাতে পায়ের উপর বসতে হবে। তবে দুই তাশাহ্হুদ বিশিষ্ট সালাতের শেষ বৈঠকে নিতম্বের উপর বসতে হবে। শায়খ আলবানীও তাই বলেছেন। উক্ত সালাত ফরয হোক কিংবা নফল হোক। (বিস্তারিত দ্র: মির‘আতুল মাফাতীহ, হা/৮০৭, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৮; ইবনু বায, মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩; উসাইমীন, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৩ তম খণ্ড, পৃ. ১৬৯; ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৪৪ এবং ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৫)।
.
আর ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, অন্যান্য সালাতের শেষ বৈঠকের ন্যায় ফজর সালাতের শেষ বৈঠকেও নিতম্বের উপর বসবে। (ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃ. ১৫৬; নাসাঈ, হা/৮৮৯ ও হা/১২৬৮; আবূ দাঊদ, হা/৯৬৪; মির‘আতুল মাফাতীহ, হা/৮০৭, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৮)।
.
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি, শাফিঈ, হাম্বালী মাযহাবের আলেমগণ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম, ইমাম ইবনু কুদামাহ, শায়খ উসাইমীন ও শায়খ আলবানী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘যে সকল সালাতে দু’টি তাশাহ্হুদ আছে শুধু তার শেষ তাশাহ্হুদের বৈঠকে-ই তাওয়াররুক করা সুন্নাত। যেমন মাগরিব, এশা, জোহর ও আসরের সালাত। পক্ষান্তরে যেগুলো দুই রাক‘আত বিশিষ্ট সালাত যাতে শুধু একটি-ই তাশাহ্হুদ থাকে, সে সমস্ত সালাতের বৈঠকে তাওয়াররুক করা সুন্নাত নয়। যেমন, ফজর, জুমু‘আহ ও অন্যান্য নফল সালাত।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ১/৩৪৯, ৬/৪৪৬ ও ৭/১৫-১৮ পৃ.; তুহফাতুল মুহতাজ, ২/৭৯ পৃ.; মুগনীউল মুহতাজ, ১/১৭২ পৃ.; আসনাল মাত্বালীব, ১/১৬৪ পৃ.; আল-ইনছাফ, ২/৬৫ পৃ.; কাশ্শাফুল ক্বিনা‘, ১/৩৬৩-৩৬৪ ও ৩৯২ পৃ.; যাদুল মা‘আদ, ১/২৩৫, ২৪৫ পৃ.; আল-মুগনী, ১/৩১৮ পৃ. ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৩৩৪, ফৎওয়া নং-২৫৬; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃ. ১৮১)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘প্রথম তাশাহ্হুদে ইফতিরাশ করা সুন্নাত, আর দ্বিতীয় তাশাহহুদে তাওয়াররুক করা সুন্নাত।’ (কিতাবুল মাজমূঊ, ৩/৪৫১ পৃ.; যাদুল মা‘আদ, ১/২৪৬ পৃ.; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ইিবনি বায, ৮/৩৫৩ পৃ.)।
.
আবু হুমাইদ আস-সাঈদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর প্রশিক্ষণ দেয়া হাদীছে এসেছে, .فَإِذَا جَلَسَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ جَلَسَ عَلَى رِجْلِهِ الْيُسْرَى وَنَصَبَ الْيُمْنَى وَإِذَا جَلَسَ فِي الرَّكْعَةِ الآخِرَةِ قَدَّمَ رِجْلَهُ الْيُسْرَى وَنَصَبَ الأُخْرَى وَقَعَدَ عَلَى مَقْعَدَتِهِ‏.‏ যখন তিনি দুই রাক‘আতের পর বসতেন তখন বাম পায়ের উপর বসতেন আর ডান পা খাড়া করে রাখতেন এবং যখন শেষ রাক‘আতে বসতেন তখন তিনি তাঁর বাম পা এগিয়ে দিতেন, আর ডান পা খাড়া করে রাখতেন এবং স্বীয় নিতম্বের উপর ভর করে বসতেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/৮২৮; আবু দাঊদ, হা/৭৩০, ৭৩১)।

এ প্রসঙ্গে শায়খ ইবনু বায, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী, শায়খ উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘এই সুন্নাত নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে-ই প্রমাণিত। কেননা ইসলামী শরী‘আতের বিধানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ে-ই বরাবর। তবে সহীহ সুন্নাহর আলোকে ও দলীলের ভিত্তিতে যে কয়েকটি বিষয়ে মহিলারা পুরুষদের থেকে ভিন্নরূপ আমল করে থাকে তা ব্যতীত। এক্ষেত্রে এমন কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না যার দ্বারা নারী-পুরুষের সালাতে পার্থক্য প্রমাণিত হয়। সালাতের পদ্ধতির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সকলেই সমান। ঔ (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১১/৭৯-৪১ পৃ.; ছিফাতু ছালাতিন নবী (ﷺ), পৃ. ১৮৯, আশ-শারহুল মুমতি‘, ৩/৩০৩-৩০৪ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৩৮১৬২)।
.
রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّمَا النِّسَاءُ شَقَائِقُ الرِّجَالِ ‘নারীরা তো পুরুষের-ই সহোদরা।’ (আবু দাঊদ, হা/২৩৬; তিরমিযী, হা/১১৩; সনদ হাসান)। এছাড়া ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) উম্মুদ দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণনা করে বলেছেন, أَنَّهَا كَانَتْ تَجْلِسُ فِىْ صَلَاتِهَا جِلْسَةَ الرَّجُلِ وَكَانَتْ فَقِيْهَةً ‘তিনি (উম্মুদ দারদা) সালাতে পুরুষের মতই বসতেন, আর তিনি একজন ফকীহাহ অর্থাৎ দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন।’ (তা‘লীকু সহীহিল বুখারী, হা/৮২৭;০ আত-তারীখুছ ছাগীর, ৯৫ পৃ.; ফাৎহুল বারী, ২/৩৫৫; ছিফাতু ছাালাতিন নবী (ﷺ), পৃ. ১৮৯)। এ সম্পর্কে বিখ্যাত তাবিঈ ইব্রাহীম নাখাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, تفعل المرأة في الصلاة كما يفعل الرجل ‘নারীরা সালাতে তাই করবে যা একজন পুরুষ করে। এটি বর্ণনা করেছেন ইবনু আবী শাইবাহ।’ (ছিফাতু ছালাতীন নবী (ﷺ), পৃ. ১৮৯ আল ইখলাস)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।