আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত

প্রশ্ন: আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত আদায় করে। আজ আমরা আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত নফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: نَفْلٌ আরবী শব্দ, একবচন। বহুবচনে نَوَافِلٌ অর্থ: অতিরিক্ত, বাড়তি, ঐচ্ছিক ইত্যাদি। সুন্নাত, নফল, মানদূব ও মুস্তাহাব এসবই সমার্থক। সবগুলো শব্দই কাছাকাছি একই অর্থ বহন করে। নফল সালাত আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটি বড় মাধ্যম। এর মাধ্যমে হাশরের মাঠের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমি পূর্বের পর্বেও বলেছি ফরয ব্যতীত সকল সালাতই নফল বা অতিরিক্ত। যে সকল সালাত পড়া বাধ্যতামূলক নয়, যা ত্যাগ করলে গুনাহ হয় না, কিন্তু পড়লে অসংখ্য সওয়াব হয় সেই সকল সালাতকে শরীয়তের পরিভাষায় নফল বা অতিরিক্ত সালাত বলা হয়। নফল সালাত মূলত দুই প্রকার। যেমন: (ক) সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ বা সুন্নাতে রাতেবাহ (খ) গায়ের মুওয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে গায়ের মুওয়াক্কাদাহ বা যায়েদাহ সালাত সমূহের মধ্যে আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত নফল সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। কেউ যদি তা আদায় করে তাহলে বিরাট ফজিলতের অধিকারী হবেন। আর এমনিতেও নফল সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। যেমন: আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,কিয়ামতের দিন সব জিনিসের পূর্বে বান্দার যে আমলের হিসাব হবে, তা হলো সালাত। যদি তার সালাত সঠিক হয়, তাহলে সে সফলকাম হবে ও নাজাত পাবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয সালাতে কিছু ভুল হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বলবেন, দেখো আমার বান্দার নিকট নফল সালাত আছে কি-না? তাহলে সেখান থেকে এনে বান্দার ফরয সালাতের ত্রুটি পূরণ করে দেওয়া হবে। এরপর এ বান্দার অন্যান্য হিসাব নেওয়া হবে।’ (আবু দাঊদ, হা/৮৬৪; তিরমিযী, হা/৪১৩; নাসাঈ, হা/৪৬৬; মিশকাত, হা/১৩৩০)।
.
আসরের ফরজ সালাতের পূর্ব ৪ রাকাআত নফল সালাত সম্পর্কে আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘আসরের সলাতের (ফার্‌যের) পূর্বে চার রাক্‘আত সলাত আদায় করতেন। এ চার রাক্‘আতের মধ্যখানে সালাম ফিরানোর দ্বারা নিকটবর্তী মালাক (ফেরেশ্‌তা) এবং তাদের অনুসারী মুসলিম ও মু’মিনীনদের মাঝে পার্থক্য করতেন। (সুনানে তিরমিযী ৪২৯ মিশকাতুল মাসাবিহ,হা/ ১১৭১ সনদ হাসান)।
.
অপর বর্ননায় ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত আদায় করে।”(আবু দাঊদ ১২৭১, আত্ তিরমিযী ৪৩০, আহমাদ ৫৯৮০, ইবনু খুযায়মাহ্ ১১৯৩, ইবনু হিব্বান ২৪৫৩, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪১৬৭সহীহ আল জামি‘ ৩৪৯৩,মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১১৭০,আল্লামা আলবানী (রহঃ) হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন, সহীহুত তরাগীব ওয়াত তরাহীব, হা/৫৮৮)।
.
ইমাম নাবাবী (রাহিমাহুল্লাহ) মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, আমাদের সাথীদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, আসরের পূর্বে এ চার রাক‘আত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। যারা এ চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন তাদের মাঝে ‘আলী (রাঃ) অন্যতম। ইবরাহীম নাখ্‘ঈ বলেন, সাহাবীগণ এ চার রাক্‘আত সালাত আদায় করতেন। তবে তা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ মনে করতেন না। যারা ‘আসরের পূর্বে সালাত আদায় করতেন না তাদের মধ্যে সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, হাসান বসরী, সা‘ঈদ ইবনু মানসূর ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম ও আবুল আহ্ওয়াস অন্যতম। (মিশকাতুল মাসাবিহ ১১৭০ হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী,শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে আসরের পূর্ব চার রাকাআত সালাত আদায় করার হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন, আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। এটি মুস্তাহাব হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, কারণ এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা ঐ লোকের ওপর রহ্‌মাত বর্ষণ করেন, যে লোক ‘আস্‌রের (ফার্‌য সলাতের) পূর্বে চার রাক্‘আত সলাত আদায় করে। (ফাতাওয়া নূর ‘আলা আল-দারব (১০/৩১৭)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন, আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার অথবা দু’রাক‘আত সালাত সাধারণ সুন্নাত হিসাবে আদায় করা যায়; সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ হিসাবে নয়। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৬/১২৮)।

◾ উক্ত চার রাকাআত নফল সালাত কয় সালামে পড়া উত্তম?
_______________________________________
চার রাক‘আত বিশিষ্ট নফল সালাত এক সালামে বা দুই সালামে উভয়ভাবেই পড়া যাবে। (সূনানে নাসাঈ হা/৮৭৫; ইবনু মাজাহ হা/১৩২২)। তবে উত্তম হল দুই রাকাত করে পড়া এই ব্যাপারে তিরমিযী’র ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যোহরের পূর্বের চার রাক‘আত সুন্নাত সালাতকে সালাম দ্বারা বিভক্ত করে পড়া অথবা এক সালামে পড়া কোন পক্ষেই কোন মারফূ সহীহ হাদীস সম্পর্কে আমি অবগত হতে পারিনি। ফলে কেউ এক সালামে পড়তে চাইলে পড়তে পারবে অথবা দুই সালামে পড়তে চাইলেও পড়তে পারবে।’ [আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৪১১ পৃ.]

ইমাম শাফিঈ এবং ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর মতে, রাত এবং দিনের (ফরয নামায ছাড়া অন্যান্য সব) নামায দুই রাকাআত করে আদায় হবে। তারা উভয়ে আসরের পূর্বের চার রাকাআতে দুই রাকাআত পর পর সালাম ফিরানোই পছন্দ করেছেন। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: صلاة الليل والنهار مثنى مثنى “রাত ও দিনের নফল (ফরজ ছাড়া অন্যান্য নামায) দু রাকাআত রাকাআত করে। (সহীহ বুখারী ৪৭২-৭৩, ৯৯১, ৯৯৩, ৯৯৫, ৯৯৮, ১১৩৭; মুসলিম ৭৩১-৪, ৭৪১-৩, ৭৫০, ৭৫১-৩, ৭৫১-২, ৭৫৩; তিরমিযী ৪৩৭, ৪৬১, ৪৬৭, ৪৬৯, ৫৯৭; নাসায়ী ১৬৬৬-৭৪, ১৬৮২, ১৬৮৯-৯৫; আবূ দাঊদ ১২৯৫, ১৩২৬, ১৪২১, ১৪৩৬, ১৪৩৮)। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের সাথে সাথে নফল সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।