আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আকাশে নেমে আসেন এর সঠিক ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আকাশে নেমে আসেন। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্র একসাথে শেষ রাত হয় না। তাহলে হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের রব। তিনি শোনেন ও জানেন আমরা যা প্রকাশ করি আর যা গোপন করি। বান্দার কোনো ডাকই তাঁর জানার বাইরে নয়। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদের আকুতি শোনেন। তবে কিছু সময় আছে যখন দু‘আ করলে তিনি সে ডাকে সাড়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তেমনই একটা সময়ের কথা আমরা জানতে পারি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর একটি হাদিস থেকে যেখানে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন লোককে করয দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন। (সহীহ বুখারী হা/১১৪৫, সহীহ মুসলিম হা/৭৫৮ মিশকাত হা/১২২৩)।
.
হাদীসটি ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা শেষ তৃতীয়াংশে প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। তারপর তিনি বলেন,কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব?কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব? অর্থাৎ রাতের এ সময়ে আল্লাহ তার বান্দাদের থেকে এ কামনা করেন যে, তারা যেন তাকে ডাকে এবং তার প্রতি তিনি তাদের উৎসাহ প্রদান করেন। যে তাকে ডাকে তিনি তার ডাকে সাড়া দেন। তিনি তাদের থেকে চান যে, তারা যেন তাদের চাওয়া-পাওয়া তার কাছেই চায়। যে তার কাছে চায়, তিনি তাকে দেন। আর তিনি তাদের কাছে চান যে, তারা যেন তাদের গুনাহসমূহ হতে তার কাছে ক্ষমা চায়, তিনি তার মু’মিন বান্দাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর চাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাদের উৎসাহ প্রদান ও আহ্বান করা। আর অবতরণটি হলো বাস্তব অবতরণ। তার মহত্ব ও কামালিয়্যাতের সাথে প্রযোজ্যভাবে। এটি মাখলুকের অবতরণের মতো নয়। তিনি কিভাবে নেমে আসেন তা অজ্ঞাত। এগুলি অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। যা স্রেফ আল্লাহর ইলমে রয়েছে। অতএব হাদীসে যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে।মোটকথা আল্লাহ তা‘আলার প্রথম আসমানে অবতরণের ধরণ ও প্রকৃতি হলো তার পবিত্র স্বকীয় সত্ত্বার জন্য যেভাবে শোভন সেভাবেই। এর অর্থ এতটুকু গ্রহণ করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।কিন্তু মহান আল্লাহর অবতরণকে রহমত বা ফিরিশতা ইত্যাদি অবতরণ করেছে বলে ব্যখ্যা করা সহীহ নয়। যেমনটি প্রাচীন পথভ্রষ্ট ফির্কা জাহমিয়া ও মুতাযিলারা করতো। তাদের বক্তব্যঃ স্থান পরিবর্তন আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আরশ থেকে অবতরণ করলে আরশ কি শূন্য থাকে? তারা আরো বলেঃ অবতরণ অর্থ নৈকট্য বা বিশেষ করুণা। (আল ফিকহুল আকবর পৃষ্ঠা ২৬৩) অথচ এগুলো ভ্রান্ত আকিদা। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য হল, আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে তার শানের সাথে যেভাবে প্রযোজ্য সেভাবে অবতরণ করেন। এ কথার ওপর কোন প্রকার বিকৃতি, অকার্যকর করা, ধরণ এবং তুলনা করা ছাড়া ঈমান আনা ওয়াজিব।
.
উপরোক্ত হাদীসটি সম্পর্কে প্রখ্যাত তাবেঈ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) কে প্রশ্ন করা হ’লে তিনি বলেন, তিনি (আল্লাহ) প্রতি রাতেই অবতরণ করেন। তখন জিজ্ঞেস করা হ’ল, অবতরণের ফলে কি আরশ খালি হয়ে যায় না? জবাবে ইবনুল মুবারাক বললেন, ‘রে যঈফ! তিনি যেভাবে ইচ্ছা অবতরণ করেন’ (আক্বীদাতুস সালাফ পৃঃ ২৯)। শায়খুল হাদীস আল্লামা মুবারকপূরী (রহঃ) আরো বলেন, আমাদের নিকট হক হলো জমহূর সালাফগণ যা গ্রহণ করেছেন। কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে সহীহায় ইজমালীভাবে যা বিধৃত হয়েছে আমরা তার প্রতি ঈমাণ আয়নায় করি, আর আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া এবং তার ধরণ প্রকৃতি ইত্যাদি থেকে পবিত্র মনে করি। আমরা অহেতুক তাবিল থেকে বিরত থেকে তার প্রতি ঈমান রাখাই জরুরী মনে করি। আল্লাহ তা‘আলার নাযিল হওয়া সংক্রান্ত হাদীস এবং সাদৃশ্য বিষয়ক বর্ণনাগুলো নিয়ে আমাদের পূর্বসুরী ইমামগণ যেমন ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ্, হাফিয ইবনুল ক্বইয়্যূম হাফিয যাহাবী বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রত্যেক রাতেই অবতরণ বলতে রাতের নির্দিষ্ট কিছু সময় আর সেটা হলো রাতের শেষ প্রহর যদিও একাধিক মতামত রয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, ১২২৩ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে মহান আল্লাহর অবতরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন: আল্লাহর অবতরণ ঘটে প্রত্যেক দেশের হিসেব অনুযায়ী। কারণ আল্লাহর অবতরণ সৃষ্টি জীবের অবতরণের মতো নয়। আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে অবতরণ করেন সমগ্র বিশ্বব্যাপী যেভাবে তার মর্যাদার জন্য উপযুক্ত। তার অবতরণের ধরন তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না যেমন ভাবে তার সত্তা সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। (আল্লাহ বলেছেন), “তার মত আর কোন কিছু নেই। তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” তিনি আরো বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর সাদৃশ্য পেশ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন; তোমরা জানো না।” (মাজমু ফাতওয়া ইবনে বায ৪/৪২০)।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত হাদীসটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই হাদীসের ভাষ্য মেনে নিতে হবে। এ বিষয়ে বিতর্ক উত্থাপন করা সহীহ হাদীস সন্দেহ করার শামিল। যা নেহায়েতই অন্যায় এবং অযৌক্তিক।ঈমানদারের জন্য যরূরী হ’ল, আল্লাহ অবতরণ করেন একথা বিশ্বাস করা এবং কিভাবে করেন সেকথা বলা থেকে বিরত থাকা। কারণ আল্লাহর কাজ তাঁর মতই হয় মানুষের মত নয়। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে রাত হয় এটা আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয় এবং তাঁর অবতরণ তাঁর ইচ্ছাতেই হয়। পৃথিবীর যে অংশে যখন রাত হয়, সে অংশে তাঁর মর্যাদা অনুযায়ী তাঁর অবতরণ ঘটে। যা অনুভব করার ক্ষমতা মানুষ রাখে না (ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ, পৃঃ ২৯)। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।