প্রশ্ন: যাওয়ালের সালাত কাকে বলে? যাওয়ালের সালাতের পরিচয়, সময়, গুরুত্ব ও ফজিলত কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: দুঃখজনক হলেও সত্য ইসলামী শরীয়তে যাওয়ালের সালাত তথা সূর্য ঢলার বা হেলার সালাত নামে কোন সালাতের অস্তিত্ব আছে এ বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত।অথচ একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমানিত রাসূল সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ঠিক মাথা বরাবর থেকে পশ্চিম দিগন্তে একটু ঢলে গেলে নিয়মিতভাবে চার রাকআত সালাত আদায় করতেন।
.
✪ যাওয়ালের সালাতের পরিচয় ও সময়:
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
যাওয়াল (زَوَال) অর্থ: বিলোপ, বিলুপ্তি, অস্তগামিতা, সূর্য হেলার সময়, উধাও, মধ্যাহ্ন, দ্বিপ্রহর ইত্যাদি। চাশতের সালাত আদায়ের পর সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর থেকে পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করে, তখন যোহরের সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর যোহরের সূচনাতেই পড়তে হয় যাওয়ালের সালাত।
.
শরিয়তের পরিভাষায় যাওয়াল হলো দিনের দ্বিতীয় প্রহরের প্রারম্ভ, মধ্যাহ্নোত্তর, অপরাহ্ণের সূচনা সময়; দিনের মধ্যভাগে বা দুপুরে সূর্য যখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে যায়। এই সময়কে ওয়াক্তুজ যাওয়াল বলা হয়। এটি মূলত মধ্যদিনের সিজদা ও সালাত নিষিদ্ধ সময়ের পর জোহরের ওয়াক্তের সূচনা পর্ব। এ সময় যে নফল সালাত আদায় করা হয়, তাকে যাওয়ালের সালাত বলা হয়। সহজে বলতে গেলে, যোহরের ওয়াক্ত সূচনা পর্ব চার রাকাত নফল সালাত পড়াকে যাওয়ালের সালাত বলে।উক্ত ৪ রাকাত নফল সালাত পড়া সুন্নাহ।
.
হাদিসে এসেছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ঢলার পর চার রাকাআত পড়তেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চার রাকাআত শেষ করার পূর্বে সালাম ফেরাতেন না। [সিলসিলা সহিহাহ ৭/১১৯৭, শাইখ আলবানী রহঃ বলেন, এর সনদ সহিহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী جيد (ভালো)। এছাড়াও তিনি তাখরীজু মিশকাতিল মাসাবিহ গ্রন্থে এটিকে সহিহ বলেছেন। হা/১২২৬]
.
অপর বর্ননায়, আবু আইয়ুব রা. হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যোহরের পূর্বে চার রাকআত যার মাঝে কোন সালাম নেই তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।” [আবূ দাঊদ ১২৭০, সহীহ আত্ তারগীব ৫৮৫, সহীহ আল জামি‘ ৮৮৫, ইবনু মাজাহ্ ১১৫৮ সনদ হাসান]।
উপরোক্ত দুটি হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, এ চার রাকআত এক সালামে শেষ করতে হবে অর্থাৎ দু রাকআত পড়ে সালাম ফেরানো যাবে না বরং চার রাকআত শেষ করে সালাম ফিরাতে হবে।
.
✪ যাওয়ালের সালাতের ফজিলত ও রাকাআত সংখ্যা:
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যোহরের পূর্বের চার রাকাত সালাত ভোররাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) সমতুল্য।’’ [আলবানি, সহিহুল জামি’: ৮৮২, হাদিসটি হাসান]
.
আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিয়ত (পশ্চিমাকাশে) সূর্য ঢলার সময় চার রাকাআত সালাত পড়তেন। একবার আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (আপনাকে দেখছি) সূর্য ঢলার সময় চার রাকাআত প্রতিনিয়তই পড়ছেন!’ তিনি বললেন, “সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং যোহরের সালাত না পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। তাই, আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক আমল (আসমানে) উঠুক।” আমি বললাম, ‘এ সালাতের প্রত্যেক রাকাআতেই কি কিরাত আছে?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ।” আমি বললাম, ‘তার মাঝে কি পৃথককারী সালাম আছে?’ (অর্থাৎ, দুই রাকাআত পর সালাম ফেরানো আছে?) তিনি বললেন, “না।” (অর্থাৎ, এক সালামে চার রাকাআত। যেভাবে আমরা যোহরের চার রাকাত সুন্নাহ সালাত পড়ি, ঠিক সেভাবে) [তিরমিযি, আশ-শামাইল: ২৪৯; হাদিসটি সহিহ]
আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ সূর্য (পশ্চিম গগনে) ঢলে যাবার পর, যোহরের ফরযের পূর্বে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চার রাকআত সুন্নাহ সালাত পড়তেন। আর বলতেন, “এটা এমন সময়, যখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তাই আমার পছন্দ যে, সে সময়েই আমার সৎকর্ম ঊর্ধ্বে উঠুক। [তিরমিযী ৪৭৮,হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ৮৭৯]।
.
✪ এখন এই সালাত কি যোহরের চার রাকাআত সুন্নাত সালাত নাকি অন্য কোনো নফল সালাত?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
এটি কোন সালাত এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে দুটি মত রয়েছে কতিপয় আলেম বলেন, এই চার রাকআত মূলত: যোহরের চার রাকআত সালাত আর কতিপয় বিদ্বানের মতে, এটি যোহরের পূর্বের চার রাকআত সুন্নাহ নয় বরং এটি স্বতন্ত্র সালাত।তবে মতানৈক্য থাকলেও অধিক বিশুদ্ধ হল একটি স্বতন্ত্র সালাত অর্থাৎ যোহরের সুন্নাহ নয় এই মর্মে কয়েকটি মত,
➤(১) ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহ.) বলেন, এই চার রাকাআত সালাত যোহরের সুন্নাহ নয়, বরং এটি অন্য সালাত, যা তিনি (নবিজি) সূর্য ঢলার পর পড়তেন। আর এই স্বতন্ত্র আমলটি করার পেছনে কারণ হলো, এটি দিনের ঠিক মধ্যভাগ ও সূর্য ঢলার সময়। এর রহস্য হল, আল্লাহ ভালো জানেন। এটি দিনের মধ্যভাগ, যার অবস্থান রাতের ঠিক মধ্যভাগের বিপরীতে। দিনের মধ্যভাগে সূর্য ঢলার পর আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় আর রাতের মধ্যভাগের পর আসমানে মহান আল্লাহর অবতরণ ঘটে (যা সহিহ হাদিসে আছে)। সুতরাং এ দুটি আল্লাহর নৈকট্য ও রহমতের সময়। [ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা‘আদ মিশকাতুল মাসাবি,১১৬৮ নং হাদিসের ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য]
➤(২) আল্লামা ইরাক্বী বলেন, এ চার রাকাআত সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) যুহরের পূর্বের চার রাকাআত ভিন্ন অন্য সালাত। এ সালাতকে সুন্নাতে যাওয়াল বলা হয়। [মিশকাতুল মাসাবীহ ১১৬৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য]
.
➤(৩) এছাড়া ইমাম গাযালি, ইমাম মুনাউয়ি, আল্লামা মুবারকপুরি সহ অনেকেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যোহরের চার রাকাআত সুন্নাহ এবং যাওয়ালের চার রাকাআত সুন্নাহ ভিন্ন ভিন্ন সালাত। [ইহয়াউ উলুমিদ্দিন, ফায়দ্বুল ক্বাদির, মির‘আতুল মাফাতিহ, তুহফাতুল আহওয়াযি]
.
➤বিপরীত দিকে যারা ভিন্ন মত পোষণ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে হানাফি মাযহাবের ফকিহদের একাংশ, ইমাম বায়যাবি (রাহ.) সহ অনেক আলেমের মতে, হাদিসে যাওয়ালের সালাত দ্বারা মূলত যোহরের চার রাকাআত সুন্নাহ উদেশ্য। তাঁরা আবদুল্লাহ্ ইবনু সায়িব (রা.) এর হাদিসের ব্যাখ্যায় এই মত পেশ করেছেন। [আদ দুররুল মুখতার: ২/১৩] তবে, এই মতটির পক্ষে শক্তিশালী স্পষ্ট কোনো দলিল পাওয়া যায় না। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। [কিছুটা নোট তাসবিহ ফেইজ থেকে]
❂ উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝলাম যে,
➤যাওয়ালের সালাতের রাকাআত সংখ্যা চার।
➤উক্ত সালাত একত্রে চার রাকাআত পড়তে হয়, যেভাবে যোহরের চার রাকাআত সুন্নাহ পড়া হয় যদিও যোহরের চার রাকাআত সুন্নাহ দুই রাকাআত করে দুই সালামে পড়া উত্তম।
➤যাওয়ালের সালাত এবং যোহরের পূর্ব চার রাকাআত সুন্নাহ ভিন্ন সালাত প্রমানিত।
➤যোহরের চার রাকাআত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এটি ত্যাগ করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে যাওয়ালের সালাত মুস্তাহাব আমল; আদায় করলে নেকি হবে, আদায় না করলে কোনো অসুবিধা নেই ইনশাআল্লাহ ।
➤যাওয়ালের সালাত যোহরের ওয়াক্ত শুরুর সাথে সাথেই পড়তে হয়। অপর দিকে যোহরের চার রাকাআত সুন্নাহ আযানের পর ফরজ সালাতের পূর্বে পড়তে হয়।
অতএব, বেশি দেরি না করে, যাওয়ালের সালাত আনুমানিক সাড়ে বারোটার মধ্যে পড়ে নেওয়াই উত্তম। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।