সালাতুত তাওবাহর পরিচয় ও সঠিক পদ্ধতি

প্রশ্ন: শরীয়তের দৃষ্টিতে সালাতুত তাওবাহর পরিচয় কি, এর সঠিক পদ্ধতি কি এবং তাওবাহর সালাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই?
▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬
❖ তাওবাহর পরিচয়: তাওবাহ (توبة‎‎) আরবি শব্দ যার অর্থ ফিরে আসা,অনুশোচনা করা, কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় তওবার অর্থ বিগত গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তার ধারে কাছে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা অর্থাৎ বান্দা গুনাহ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। পরে সে অনুতপ্ত হয়ে আবার মহান আল্লাহ তায়া’লার কাছে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা এটাই তাওবাহ্। কোরআন এবং হাদীসে শব্দটি আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করা ও তার আদেশকৃত বিষয়সমূহর দিকে ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’ [সূরা নূর ২৪/৩১]।
.
❖তাওবার ফজিলত: কোন বান্দা যখন খালেছ অন্তরে তওবা করে তখন আল্লাহ তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। আল্লাহ বলেন,যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়’ [নিসা ৪/১১০]।
.
বান্দা যখন তওবা করে তখন আল্লাহ পূর্বের পাপগুলি ক্ষমা করে ভাল কাজে রূপান্তরিত করেন। আল্লাহ বলেন, কিন্তু যারা তওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের গুনাহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ [সূরা ফুরক্বান ২৫/৭০]।
.
আবদুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি তার আমলনামায় অধিক পরিমাণ “ক্ষমা প্রার্থনা” যোগ করতে পেরেছে, তার জন্য সুসংবাদ, আনন্দ। [হাদীস টি ইমাম ইবনু মাজাহ একক ভাবে বর্ণনা করেছেন। মিশকাত ২৩৬, আত তা’লীকুর রাগীব ২/২৬৮। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৮১৮]
.
রাসূল (সাঃ)আরো বলেন, ‘আল্লাহ সবচেয়ে খুশী হন বান্দা তওবা করলে’। [মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩২]।
.
❖ তাওবাহর সঠিক পদ্ধতি:
_____________________________
কোন গুনাহগার ব্যক্তি তওবা করতে চাইলে, প্রথমে যে পাপে লিপ্ত ছিল সেটা ছাড়তে হবে এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ে ও পরকালে জান্নাত পাওয়ার আশায় তওবার নিয়ত করতে হবে। আর মনে মনে ঐ পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে তাতে আর ফিরে না আসার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। সেই সাথে যে যন্ত্রের মাধ্যমে পাপ সংঘটিত হয়েছিল সেটাও ধ্বংস বা সরিয়ে ফেলতে হবে।তাওবাহ করার জন্য অজু, গোসল, নামাজ কোনোটিই জরুরি নয়। বরং তাওবাহর কিছু শর্ত রয়েছে সেই শর্তগুলো মেনে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। তাওবাহর শর্ত তিনটি: নিজ গুনাহের স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাথে সাথে গুনাহটি ওই মুহূর্তে ছেড়ে দেওয়া, গুনাহটি করার জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়া এবং সেই গুনাহটি ভবিষ্যতে আর না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। উল্লেখ্য, যদি পাপটি বান্দার সাথে যুক্ত থাকে, তাহ’লে উপরের তিনটি শর্ত পূরণের সাথে চতুর্থ শর্ত হিসাবে তাকে বান্দার নিকটে ক্ষমা চাইতে হবে ও তাকে খুশী করতে হবে। নইলে তার তওবা শুদ্ধ হবে না। [নববি, রিয়াদুস সালিহিন তওবাহ’ অনুচ্ছেদ, পৃ. ১৪-২২]।
.
ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাদের মতো হয়ো না, যারা আমল না করে আখিরাতে (কল্যাণের) আশা করে আর হায়াত লম্বা ভেবে তাওবাহ করতে বিলম্ব করে। [ইবনু রজব, লাত্বাইফুল মা‘আরিফ: ১/৩৪৪]।
.
❖ তাওবাহর সালাত কাকে বলে এবং উক্ত সালাতের গুরুত্ব কি?:
_____________________________________
অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিশেষভাবে যে নফল সালাত আদায় করা হয়, তাকে ‘ছালাতুত তাওবাহ’ বলা হয়। গুনাহ মাফের জন্য সালাতুত তওবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সালাত।ওলামায়ে কেরামগণ এ সালাত পড়ার বৈধতার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
.
উপরে আলোচনা থেকে আমরা জানলাম, তাওবাহর জন্য শুধু তিনটি শর্ত মানতে হয়। তবে, উত্তম হলো, প্রথমে ভালোভাবে অজু করে তাওবাহর উদ্দেশ্যে দুই রাকাত সালাত আদায় করা। এরপর তাওবাহর শর্তগুলো অনুসরণ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
.
আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যখন কোনো বান্দা গুনাহ করার পর সুন্দরভাবে অজু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেন।” অতঃপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেন, ‘‘আর, যখন তারা কোনো অন্যায় কাজ করে কিংবা (গুনাহ করার মাধ্যমে) নিজেদের উপর জুলুম করে, আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায় (তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন)। আর, আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না।’’ (সুরা আলে ‘ইমরান, আয়াত: ১৩৫) [আবূদাঊদ,আস সুনান ১৫২১ তিরমিযি, আস-সুনান: ৪০৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৫৯; মিশকাত হা/১৩২৪ ‘ঐচ্ছিক সালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৯; আলে ইমরান ৩/১৩৫ হাদিসটি সহিহ]।

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি উত্তমরুপে ওযূ করে অতঃপর উঠে ২ রাকআত অথবা ৪ রাকআত ফরয অথবা সুন্নত বা নফল সালাত উত্তমরুপে রুকূ ও সিজদা করে আদায় করে, অতঃপর সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” [ত্বাবারাণী কাবীর, আহমাদ হা/২৭৫৮৬; ছহীহাহ হা/৩৩৯৮; সহীহ আত-তারগীব হা/২৩০ হাদীসটি সহীহ]।
.
সুতরাং যখনই শয়তানের ওয়াস ওয়াসায় পড়ে
গুনাহ সংঘটিত হয়ে যাবে তখনই আমাদের কর্তব্য হবে, কাল বিলম্ব না করে সুন্দরভাবে ওযু করে একান্ত নিবিষ্টচিত্তে দু বা চার রাকআত সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাহলে আশা করা যায়, দয়াময় আল্লাহ আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি পরম দয়ালু ও অতিশয় ক্ষমাশীল।
তিনি বলেন, আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও।আমি ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।’ [সুরা হিজর, আয়াত: ৪৯]।
.
❂তাওবার সালাত প্রসঙ্গে কিছু কথা:
__________________________________
➤(১) প্রতিদিন সকালে কিংবা রাতে বা অন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিতভাবে তা আদায় করা ঠিক নয়। কেননা সালাফদের থেকে প্রতিদিন পড়ার আমল প্রমাণিত নয়। বরং যখনই কোনো গুনাহ সংঘটিত হবে তখনই তা পড়া উচিৎ।
.
➤(২) উক্ত সালাত আদায়ের পূর্বে উত্তমরূপে অজু করে সাধারণ নফল সালাতের মতো দুই রাকাত সালাত পড়বেন তাওবাহর উদ্দেশ্যে। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই সাধারণ নফল সালাতের মতই। মনের মধ্যে এই নিয়ত রাখবেন যে, তাওবাহর উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নফল সালাত পড়ছেন। উল্লেখ্য যে, নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়া সর্বসম্মতিক্রমে বিদআত।
.
➤(৩) উক্ত সালাতের সিজদায় (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা ৩ বার পড়ার পর) হাদিসে বর্ণিত বাক্যগুলো দিয়ে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করতে পারেন। তবে, এটি জরুরি নয়। শেষ বৈঠকে সালাম ফেরানোর আগেও ইস্তিগফার করতে পারেন। যাদের দু‘আ মাসুরা (আল্লাহুম্মা ইন্নি যলামতু নাফসি…শেষ পর্যন্ত) মুখস্থ, তারা অর্থের দিকে লক্ষ রেখে এটি পড়তে পারেন এবং অন্যান্য ইস্তিগফারও করতে পারেন। এরপর সালাম ফেরাবেন। সালাম ফিরিয়ে কান্নাকাটি করে আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করবেন। তওবার জন্য নিম্নের দো‘আটি বিশেষভাবে সিজদায় ও শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করতে পারেন ইনশাআল্লাহ।

أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ-

উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে।
অনুবাদ: ‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেই আল্লাহর নিকটে যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক এবং তাঁর দিকেই আমি ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’। [তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৫৩]।
.
➤(৪) তবে, এগুলো কোনোটিই না করলেও, শুধুমাত্র তাওবাহর উদ্দেশ্যে স্রেফ দুই রাকাত সালাত শেষ করে তাওবাহর শর্তগুলো মেনে দু‘আ করলেই যথেষ্ট হবে। তাওবাহর ৩ টি শর্তের কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
.
➤(৫) যদি এমন মনোভাব থাকে যে, ‘‘এখন তাওবাহ করে নিই; পরেরটা পরে দেখা যাবে কিংবা আপাতত এই গুনাহে জড়াবো না, কিছুদিন ভালো থাকবো অথবা আমি তো গুনাহটি ছাড়তে পারবো না, কিছুদিন পরেই করে ফেলবো’’ তাহলে সে তাওবাহর দাবিতে সত্যবাদী নয়। বরং তাওবাহ করার সময়ে সে সত্যিকারার্থেই আন্তরিকভাবে তাওবাহ করতে হবে এবং মনোভাব থাকবে, আসলেই সে এই গুনাহটি বাকি জীবনে করতে চায় না এবং পূর্বে যা হয়েছে তার জন্য সে খুবই দুঃখিত, লজ্জিত ও অনুতপ্ত। এভাবে মনের দিক থেকে শতভাগ সৎ থেকে তাওবাহ করলে তার তাওবাহ কবুল হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। পরবর্তিতে যদি কিছুদিন পর শয়তান আবার গুনাহে প্ররোচিত করে এবং প্রবৃত্তির প্ররোচনায় আবার সে গুনাহ করে বসে, তবে সে আবারও আন্তরিকভাবে তাওবাহ করবে। কখনই হাল ছাড়বে না এবং মনের সাথে অসততা দেখাবে না। এভাবে আন্তরিকতার সাথে তাওবাহ চালিয়ে গেলে আশা করা যায়, সে মুক্তি পেয়ে যাবে। কুরআন-সুন্নাহ এমনটিই বলে। [দেখুন সূরা তাহরীম ৮; সূরা যুমার৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫০; মিশকাত হা/২৩৬৩]।
.
➤ (৬) একসাথে একাধিক গুনাহর ব্যাপারেও তাওবাহ করা যায় আবার নির্দিষ্ট একটি গুনাহের ব্যাপারেও তাওবাহ করা যায়।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।