ইকামাতের সময় সুন্নাত সালাত শুরু করার বিধান

প্রশ্ন: ইকামাতের সময় সুন্নাত সালাত শুরু করার বিধান কি? ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত সালাত আদায়কালে ফরয সালাতের ইকামত শুরু হয়ে গেলে করণীয় কি? ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত সালাতের কাযা আদায় করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ফরজ সালাতের জন্য ইকামত দেওয়া হলে সুন্নাত সালাত আদায় করার বিধান সম্পর্কে দুটি বিষয় লক্ষনীয়। যেমন: (১). ইকামাতের সময় নতুন করে সুন্নাত শুরু করা এবং (২). সুন্নাত পড়া অবস্থায় ইকামত হওয়া। এবার দুটি বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
(১). ইকামাতের সময় নতুন করে সুন্নাত সালাত শুরু করা:
.
পাচঁ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের মধ্যে যেমন: (ফজর, যোহর, মাগরিব ইত্যাদি) যে কোন ওয়াক্তের ফরজ সালাতের জন্য ইকামত দেওয়া হলে নতুন করে সুন্নাত সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ। আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ফরয সালাতের ইক্বামাত দেয়া হলে তখন উক্ত ফরয ব্যতীত অন্য কোন সালাত আদায় করা যাবে না। (সহীহ মুসলিম হা/১৫৩১, ই.ফা. ১৫১৬, ই.সে. ১৫২৩)। এই হাদীসটি ইঙ্গিত করে যে, ফরজ সালাতের জন্য ইক্বামাত বলা শুরু হলে তখন ঐ ফরয সালাত ব্যতীত কোন নফল সালাত শুরু করা নিষেধ। এ অর্থকে শক্তিশালী করে ইমাম বুখারী কর্তৃক তার তারীখ গ্রন্থে এবং ইমাম বাযযার-এর বাযযার গ্রন্থে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন; যখন সালাতের জন্য ইক্বামাত বলা হলো তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে এলেন এবং লোকদেরকে ফজরের (ফজরের) দু’ রাক্‘আত সুন্নাত সালাত আদায় করতে দেখে বললেন, দু’ সালাত একত্রে আদায় করা হচ্ছে। আর ইক্বামাত হয়ে গেলে তিনি ঐ দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করতে নিষেধ করলেন। আর নিষেধ দ্বারা হারাম উদ্দেশ্য। কেননা নিষেধের আসল অর্থ হলো হারাম। উল্লেখ্য যে, যে সালাতের জন্য ইক্বামাত বলা হয় কোন ব্যক্তি আগেই এ সালাত আদায় করে থাকলে তার জন্য ইমামের পিছনে নফল সালাতের নিয়্যাতে ইমামের ইকতিদা করা বৈধ অন্য দলীলের ভিত্তিতে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১ মিশকাতুল মাসাবিহ হা/১০৫৮ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, যখন সালাতের ইক্বামাত বলা হবে তখন নফল সালাত নিয়ে ব্যস্ত থাকবে না রাক‘আত ছুটে যাবার আশংকা থাক বা না থাক। ইমাম শাফি‘ঈর অভিমতও এটাই। এতে বুঝা যায় যে, ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ আহলুয যাহিরদের মতের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। সাহাবিদের মধ্যে আবু হুরাইরাহ, ইবনে ওমর, উরওয়াহ, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আল-শাফিঈ, ইসহাক এবং আবু সাওর। (আল-মুগনী খন্ড:১ পৃষ্ঠা:২৭২)
.
ভারতবর্ষে হাদীসশাস্ত্রের আরেক দিকপাল, মিশকাতুল মাসাবীহ’র বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ মিরআতুল মাফাতীহ’র সম্মানিত মুসান্নিফ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ,আল-আল্লামাহ,
ইমাম উবাইদুল্লাহ বিন আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] বলেছেন উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ), আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ), আবূ মূসা আল আশ‘আরী ও হুযায়ফাহ্ (রাঃ) ইকামত শুরু হলে সুন্নাত সালাত আদায় করা বৈধ মনে করতেন না। উমার (রাঃ) কাউকে এরূপ করতে দেখলে তাকে প্রহার করতেন। আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) তার প্রতি কঙ্কর ছুঁড়ে মারতেন, আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) এরূপ করাকে অস্বীকার করতেন। আর আবু মূসা এবং হুযায়ফাহ্ (রাঃ) সুন্নাত না আদায় করে সালাতের কাতারে প্রবেশ করতেন। আর ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে তার বক্তব্য ও কর্মের মধ্যে অমিল পরিলক্ষিত হয়। এরূপ অবস্থার বক্তব্যকেই দলীল হিসেবে ধরা হয়, কর্ম নয়। আর তাবি‘ঈদের মধ্যে সাঈদ ইবনু জুবায়র ইবনু সীরীন, উরওয়াহ্ ইবনু যুবায়র ইব্রা-হীম নাখ্‘ঈ এবং আত্বা, ইমামদের মাঝে শাফি‘ঈ, আহমাদ, ইবনুল মুবারাক, ইসহাক্ব এবং জমহূর মুহাদ্দিসীন এরূপ করা বৈধ মনে করেন না। ইবনু আবদুল বার বলেন, মতভেদ দেখা দিলে সুন্নাত তথা হাদীসই দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। যে ব্যক্তি সুন্নাতের আশ্রয় নিলো সে সফল হল। ইক্বামাত হলে নফল সালাত পরিত্যাগ করে জামাআতের পর তা আদায় করা সুন্নাতের অনুসরণের নিকটবর্তী। অতএব, সে সৌভাগ্যবান যে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সুন্নাতের অনুসরণ করে। (মির‘আতুল মাফাতীহ’ হা/১০৫৮ ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য:)
.
(২). সুন্নাত সালাত পড়া অবস্থায় ফরজ সালাতের ইকামত দেওয়া:
.
সুন্নাত পড়া অবস্থায় জামাআতের ইকামত হুলেন করনীয় সম্পর্কে আহালুল আলেমগণের একটি অংশ এবং শাফি‘ঈদের মাঝে আবু হামিদ বলেন; সুন্নাত সালাত পড়া অবস্থায় ফরজ সালাতের ইকামত হলে মুসুল্লি তখন সুন্নাত পরিত্যাগ করবে এবং জামাআত যোগদান করবে। তাদের দলীল (فَلَا صَلَاةَ إِلَّا الْمَكْتُوبَةَ) ইক্বামাত হয়ে গেলে ফরয সালাত ব্যতীত কোন সালাত নেই। অন্যান্য আলিমগণ হাদীসের এ নিষেধাজ্ঞাকে ‘‘তোমাদের আমল বিনষ্ট করো না’’ আল্লাহর এ বাণী দ্বারা খাস করেছেন। আবু হামিদ শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন, সুন্নাত পূর্ণ করতে গিয়ে যদি ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমা ছুটে যায় তাহলে সুন্নাত ছেড়ে দেয়াই উত্তম। তবে অধিকাংশ ওলামাদের বিশুদ্ধ মত হলো, সুন্নাত সালাত পড়া অবস্থায় ফরজ সালাতের ইকামত শুরু হলে করণীয় কি হবে এটি মুসল্লীর অবস্থার উপর নির্ভর করবে। জামা‘আত শুরু হওয়ার পর সুন্নাত সালাত আদায়কারী যদি বুঝতে পারে যে, ইমাম রুকূতে যাওয়ার পূর্বে সে জামা‘আতে শরীক হতে পারবে এবং সূরা ফাতিহা পাঠ করতে পারবে, তাহলে সে সংক্ষেপে উক্ত সুন্নাত শেষ করে জামা‘আতে শরীক হবে। (সহীহ বুখারী হা/৫৮০; মুসলিম হা/৬০৭; মিশকাত হা/৬৮৬, ১৪১২)। কিন্তু এমনটি সম্ভব না হলে অর্থাৎ ইমাম রুকূতে যাওয়ার পূর্বে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তাহলে উক্ত সুন্নাত সালাত ছেড়ে জামা‘আতে শরীক হতে হবে। (সহীহ মুসলিম হা/৭১০; মিশকাত হা/১০৫৮)। এজন্য তাকে সালাম ফিরাতে হবে না। আর ফরয সালাত শুরু হয়ে গেলে নতুনভাবে সুন্নাত সালাত শুরু করা যাবে না। (শায়খ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৩৮৯; উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১০১)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: নফল নামায পড়া অবস্থায় জামাআতের ইকামত হল তখন নফল সালাত সংক্ষিপ্ত করে ইমামের সাথে শুরুর তাকবীরে যোগ দেওয়া কি জায়েজ,নাকি নফল নামায শেষ করা উচিত?
.
তারা উত্তর দিল: হ্যাঁ, যদি ফরজ নামাযের ইকামাত দেওয়া হয়, তাহলে আপনার নফল নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলতে হবে যাতে আপনি ইমামের সাথে তাকবীরে যোগ দিতে পারেন, কারণ এটি প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। :“যদি নামাযের ইকামাত দেওয়া হয়, তাহলে ফরজ সালাত ছাড়া আর কোন নামায নেই।”(ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আল-দাইমাহ,খন্ড,৭ পৃষ্ঠা :৩১২)

ফরজ সালাতের ইকামাত হলে সুন্নাত সালাত আদায় করার বিধান সম্পর্কে সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হলে
.
জবাবে শাইখ বলেন, যদি কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এবং ইকামাহ্‌ বলা অবস্থায় সুন্নাত নামায পড়ে, তবে এক্ষেত্রে সর্বোত্তম অভিমত হলো যে, দ্বিতীয় রাকাতে থাকলে তা সংক্ষিপ্ত করবে এবং যদি প্রথম রাকাতে থাকে। আহ, তার উচিত শুধু তার নামায ভঙ্গ করে ইমামের সাথে জামাতে প্রবেশ করা । ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে যা বর্ণনা করেছেন তা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়: রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; যদি নামাযের জন্য ইকামত বলা হয় তাহলে ফরয ছাড়া আর কোন নামায নেই। (সহীহ মুসলিম, ১/৪৯৩)। সুতরাং, কেউ যদি দ্বিতীয় রাকাতের রুকু করে থাকে, তবে তার সালাত শেষ করতে হবে এবং যদি না করে তবে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ তার সুজূদ ও তাশাহহুদ থেকে যা অবশিষ্ট থাকে তার আর প্রয়োজন নেই। অধিকন্তু, সালাম ছাড়াই বিরতি দেওয়া উচিত এবং সাধারণ ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে অন্তরে নিয়ত থাকাই যথেষ্ট। (ইমাম উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা:৩৪৫)
.
🔹ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নাত সালাতের কাযা:
_______________________________________
অন্যান্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ সালাতের তুলনায় ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত সালাতের এত বেশী গুরুত্ব যে, রাসূল (ﷺ) ঘরে-সফরে তা পড়তেন এবং তা ছুটে গেলে কাযা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। একদা মহানবী (ﷺ) সাহাবাবর্গের সাথে এক সফরে ছিলেন। ফজরের নামাযের সময় সকলে গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকলে সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সূর্যের ছটা তাঁদের মুখে লাগলে চেতন হলেন। অতঃপর একটু সরে গিয়ে মহানবী (ﷺ) বিলাল (রাঃ)-কে আযান দিতে বললেন। এরপর ফজরের দুই রাকআত সুন্নত পড়লেন। তারপর ইকামত দিয়ে ফজরের ফরয পড়লেন। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ৬৮১)
.
উক্ত নামায কাযা করার দুটি সময় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ফজরের পর কোন নফল পড়া নিষিদ্ধ হলেও ফজরের আগে ছুটে যাওয়া সুন্নাতকে ফরযের পর পড়া যায়। আর এটি হলো ব্যতিক্রম নামায। ক্বায়েস ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ফজরের সালাতের পর এক ব্যক্তিকে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, ফজরের সালাত দুই রাক‘আত। তখন ঐ ব্যক্তি বলল, আমি ফজরের পূর্বের দুই রাক‘আত আদায় করিনি। তাই এখন সেই দুই রাক‘আত আদায় করলাম। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপ থাকলেন। (আবু দাঊদ হা/১২৬৭, ১/১৮০ পৃঃ; মিশকাত হা/১০৪৪, পৃঃ ৯৫; তিরমিযী হা/৪২২, সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীস প্রমাণ করে ফজরের সালাতের পরই ছুটে যাওয়া সুন্নাত পড়া যাবে। আরেক হাদীসে মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের ২ রাকআত (সুন্নত) না পড়ে থাকে, সে যেন তা সূর্য ওঠার পর পড়ে নেয়।” (তিরমিযী হা/৪২৩, সিলসিলাহ সহীহাহ ২৮৩, সহীহুল জামে ৬৫৪২) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।