কোন এক রামাদানের মাঝাঝামি শুক্রবার আসমান থেকে একটি আওয়াজ আসবে মর্মে বর্ননাটি বানোয়াট

প্রশ্ন: কোন এক রামাদানের মাঝাঝামি শুক্রবার আসমান থেকে একটি আওয়াজ আসবে মর্মে বর্ননাটি কতটুকু সঠিক?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: নিঃসন্দেহে বর্ণনাটি ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। পরিপূর্ণ বর্ননাটি হল: ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
.
“কোন এক রামাদানে আওয়াজ আসবে”। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের শুরুতে? নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে?’ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় সত্তর হাজার মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে আর সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উম্মতের কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সিজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চ শব্দে আল্লাহু আকবর বলবে। পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিব্রাইল এর, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের। ঘটনার পরম্পরা এরূপঃ শব্দ আসবে রামাদানে। ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে। আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জুলকাদা মাসে। হাজী লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটবে জিলজ্জ মাসে। আর মুহাররমের শুরুটা আমার উম্মতের জন্য বিপদ। শেষটা মুক্তি। সেদিন মুসলমান যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে।” (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, খণ্ড:৭, পৃষ্ঠা: ৩১০, আল-সুয়ুতি এটি আল-লালী খন্ড:২, পৃষ্ঠা: ৩৮৭-৩৮৮)
.
তাহক্বীক: বর্ননাটি বানোয়াট মিথ্যা। এটি আল-তাবারানী দ্বারা “আল-কাবীর” (১৮/৩৩৩ হি,৮৫৩) এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন; আহমদ বিন আবদ আল-ওয়াহাব বিন নাজদাহ থেকে, যিনি বলেছেন: ইবনে ওয়াহব আমাদেরকে বলেছেন, মাসলামা ইবনে আলীর সূত্রে, কাতাদার সূত্রে, ইবনে আল-মুসায়্যিবের সূত্রে, আবু হুরায়রার সূত্রে…ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত:৫৫৭ হি:) তার আল মাউযুআত:৩/১৯১ হা/১৬৮৭) উল্লেখ করে বলেন এটি বানোয়াট এবং মিথ্যাভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আরোপিত করা হয়েছে। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৪৮) বলেছেন, এ বর্ননাটি বাতিল। (তারতীবুল মাউযুআত, ২৭৮) ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনার ঘটার বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো সহিহ নয়। (আল মানারুল মুনীফ পৃষ্ঠা: ৯৬)। বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন, এটি বানোয়াট। (সিলসিলা যঈফা হা/৬০৭৮ ও ৬০৭৯ আলোচনা দষ্টব্য)
.
সবশেষে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বর্ননাটি উল্লেখ করে বলেছেন,
.
এই হাদীসের কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই; বরং এটা মিথ্যা এবং বানোয়াট। মুসলিমরা বহু বছর দেখেছে যে শুক্রবারের আগের রাতে রমজানের মাঝামাঝি পড়েছিল, কিন্তু এই বিস্ফোরণের মিথ্যা বর্ননা যা উল্লেখ করা হয়েছে তা ঘটেনি আল্লাহর প্রশংসা। সুতরাং, যে কেউ এই মিথ্যা শব্দগুলি দেখতে পাবে তার জানা উচিত যে- এই মিথ্যা হাদীসটি প্রচার করা জায়েজ নয়। বরং এই মিথ্যা বর্ননার সেই কাগজ ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে এবং মানুষকে সচেতন করতে হবে যে এটা মিথ্যা। এটা সুপরিচিত যে, মুসলমানকে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করতে হবে এবং তার জীবনের শেষ অবধি আল্লাহ যা হারাম করেছেন সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে…..মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ) কে উল্লেখ করে বলেন, আর ইয়াকীন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত কর। (সূরা হিজর; ১৫/৯৯)। সবচেয়ে সুনিশ্চিত যেটা সেটা হলো মৃত্যু। তিনি অপর আয়াতে বলেন; হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে করা উচিৎ এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করনা। (সূরা আলে ইমরান, ৩/১০২)। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তুমি যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং পাপের পরে পুণ্য কর, যা পাপকে মুছে ফেলবে। আর মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।” (তিরমিযী হা/১৯৮৭)। এ আয়াত ও হাদীসগুলো আল্লাহকে ভয় করার বাধ্যবাধকতার কথা বলে, রামাদান মাসে এবং অন্যমাসে আল্লাহ যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন সেগুলি থেকে সাবধান থাকা সম্পর্কিত আয়াত এবং হাদিসগুলি অনেক এবং সুপরিচিত।আল্লাহ মুসলমানদেরকে তা করতে সাহায্য করুন যা তাকে খুশি করে এবং তিনি মিথ্যা প্রচারকারীদের কে ইসলামের বুঝ দান করুন এবং তিনি আমাদেরকে তাদের বিভ্রান্তিকর অশান্তি থেকে এবং যারা মিথ্যার দিকে আহ্বান করে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন,… (দেখুন ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড:২৬ পৃষ্ঠা:৩৩৯-৩৪১)

পরিশেষে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের জাল-জয়ীফ হাদিস বর্ণনা এবং প্রচার করা থাকে হেফাজত করুক সাথে ভ্রান্ত আলেমদের থেকে দূরে রাখুক আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।