হে আল্লাহ আপনি আমাকে মিসকীন অবস্থায় জীবিত রাখুন এবং মিসকীন অবস্থায় মৃত্যু দান করুন এর অর্থ কি

প্রশ্ন: নিন্মলিখিত হাদীসটি কি সহীহ? উক্ত হাদীসে রাসূল (ﷺ)-এর দু‘আ; “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মিসকীন অবস্থায় জীবিত রাখুন, মিসকীন অবস্থায় মৃত্যু দান করুন”এর অর্থ কি?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: যে হাদীসটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন হাদীসটি ইমাম তিরমিজি (রাহিমাহুল্লাহ)-তার সুনানে তিরমিজিতে, বিখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে ইমাম ইবনে মাজাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তার সুনানে ইবনে মাজাহতে, সাহাবী আবু সাঈদ খুদরি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ননা করেছেন। যেখানে রাসূল (ﷺ) বলেছেন; اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مِسْكِينًا وَأَمِتْنِي مِسْكِينًا وَاحْشُرْنِي فِي زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীন অবস্থায় জীবিত রাখো, মিসকীন অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং মিসকীনদের দলে হাশর করো। (তিরমিজি হা/২৩৫২ ইবনু মাজাহ হা/৪১২৬, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৩০৮, তিরমিযী ২৩৫২, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ৩১৯২)
.
তাহকীক: দুটি হাদীসের সনদ সহীহ-জয়ীফ নিয়ে ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। পাশাপাশি হাদীসে মিসকিন শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিনয়ী। এখানে ফকির বা গরীব উদ্দেশ্য নয়।
.
হাদীসটির সনদ সম্পর্কে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেছেন; আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনরূপে জীবিত রাখো, মিসকীনরূপে মৃত্যুদান করো এবং মিসকীনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত করো।’’এটি একটি যঈফ হাদীস এবং এটি তার সনদ থেকে প্রমাণিত নয়, কারণ এতে ইয়াযীদ বিন সিনান আবু ফারওয়াহ আল-রাহাবী রয়েছেন, যিনি অত্যন্ত দুর্বল রাবী। তার সম্পর্কে আবু আহমাদ বিন আদী আল-জুরজানী বলেন, তিনি হাদিস গ্রহনে শিথিল। আবু দাউদ আস-সাজিসতানী বলেন, তিনি দুর্বল। আবু যুরআহ আর-রাযী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য নয়। আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, তিনি দুর্বল। উক্ত হাদীসটি ইমাম তিরমিযী আনাস থেকে অন্য একটি সনদ সহ বর্ণনা করেছেন …তারপর তিনি বললেন: এটি একটি গরীব হাদীস। আমি (ইবনে কাছীর) বলছি- এর সনদে কিছু দুর্বলতা আছে এবং এর পাঠে আপত্তিকর কিছু আছে। আর আল্লাহই ভালো জানেন। (তাহযীবুল কামাল; রাবী নং ৭০০১, ৩২/১৫৫ নং পৃষ্ঠা, ইবনে কাসীর আল-বিদায়াহ ওয়াল-নিহায়াহ: খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা:৭৫)
.
হাফিজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর বলেছেন; এটি ইমাম তিরমিজি দ্বারা বর্ণিত গরিব হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে এবং এর সনদটি দ্বঈফ। ইবনে মাজাহ আবু সাঈদ থেকে অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেই সনদেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আল-মুসতাদরাক গ্রন্থে ‘আতা’ থেকে আরেকটি ইসনাদ রয়েছে এবং এটি আল-বায়হাকি উবাদাহ ইবনে সামিত থেকে বর্ণনা করেছেন। (আল-তালখীস আল-হাবীর খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১০৯, আরো বিস্তারিত জানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৫১৪৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] কে এই হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন; হাদীসটি যঈফ এবং প্রমাণিত নয়। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, খন্ড:১৮ পৃষ্ঠা: ৩৫৭)।অপরদিকে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] হাদীস দুটিকে সহীহ বলেছেন। (সিলসিলাতুস সহীহাহ ৩০৮ ও ইরওয়াল গালিল হা/৮৬১, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩১৯২)
.
হাদীসটির সঠিক অর্থ: রাসূল (ﷺ)-এর দু’আ ছিল, “হে আল্লাহ! আমাকে মিসকীন অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখো” এখানে তিনি ফকীর শব্দ ব্যবহার করেননি, যাতে মানুষের মধ্যে এ ধারণার উদ্রেক না হয় যে, তিনি হীন ও মুখাপেক্ষী ছিলেন। হাদীসের শব্দ (الْمِسْكِينُ) শব্দটি (الْمِسْكَنَةُ) শব্দ থেকে উৎপত্তি। শব্দটির অর্থ হলো: (التَّوَاضُعُ عَلٰى وَجْهِ الْمُبَالَغَةِ) অর্থাৎ অধিক মাত্রায় বিনয় প্রকাশ করা। অথবা শব্দটি (السُّكُونُ وَالسَّكِينَةُ) থেকে উদগত হয়েছে, এর অর্থ হলো (الْوَقَارُوَالِاطْمِءْنَانُ وَالْقَرَارُتَحْتَ أحْكَامِ الْأَقْدَارِرِضًابِقَضَاءِالْجَبَّارِ) মহা প্রতাপশালী আল্লাহর ফায়সালা এবং তাক্বদীরের বিধানাবলীর উপর সন্তুষ্ট থেকে প্রশান্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ জীবনযাপন। অধিকাংশ আলেমগন এর অর্থ করেছেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে বিনয়ী বানিয়ে দাও, আমাকে অহংকারী করো না। এখানে উম্মতের জন্য মিসকীনের মর্যাদার শিক্ষা রয়েছে, যাতে মানুষ তাদের সাথে বসে, তাদের ভালোবাসে। আরো রয়েছে মিসকীনদের জন্য সান্ত্বনা ও উঁচু মর্যাদার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা। সাথে সাথে এটাও উদ্দেশ্যে যে, মানুষ যেন তার জীবন নির্বাহের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপকরণ তার জীবনের জন্য যথেষ্ট মনে করে। আর সে অঢেল সম্পদ সংগ্রহের পিছনে না পড়ে থাকে। কেননা আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাদের জন্য অধিক সম্পদ জীবনের জন্য ধ্বংস এবং সম্মানের জন্য অমসৃণ উপকরণ। রাসূল ( ﷺ) মৃত্যু পর্যন্ত এই মিসকীনী অবস্থাকে কামনা করেছেন। এমনকি কিয়ামতের দিন এই মিসকীনদের দলেই হাশর বা একত্রিত হওয়ারও আশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি (ﷺ) মুবালাগাহ বা অতিরঞ্জন হিসেবে বলেছেন তা কারো কাছেই অস্পষ্ট নয়। আয়িশাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে মিসকীনী অবস্থার জন্য দু’আর কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি তার কারণ বর্ণনা করেন। অর্থাৎ ধনীরা তাদের উত্তম ইবাদত,উত্তম চরিত্রসহ সকল আমলে মিসকীনদের সমকক্ষ হলেও মিসকীনদের চল্লিশ বছর পর জান্নাতে যাবে। অতঃপর রাসূল (ﷺ) আয়িশাহ (রাঃ)-কে নাসীহত করেন যে, তুমি কখনো কোন মিসকীনকে খালি হাতে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিবে না, অর্ধ টুকরো খেজুর হলেও তাকে দিবে এবং অন্তরে তাদের প্রতি মমতা রাখবে। তাদের নিকটে বসবে তাহলে কিয়ামতের দিন তার বিনিময়ে আল্লাহও তোমাকে তার নিকটে স্থান দিবেন। (ইবনু মাজাহ হা/৪১২৬, সিলসিলাতুস সহীহাহ হা/৩০৮, মিরকাতুল মাফাতীহ তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খণ্ড, হা/২৩৫২; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড,পৃষ্ঠা: ৩৩১৪)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন; অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীন অবস্থায় জীবিত রাখো, মিসকীন অবস্থায় মৃত্যু দান করো। হাদীসটি ইমাম তিরমিজি তার সুনানে তিরমিজিতে বর্ননা করেছেন। এটিকে আবুল ফারাজ (ইবনুল জাওযী) তার আল-মাওদুআতে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের বক্তব্য সহীহ হোক বা না হোক, তবে প্রশংসিত সেই গরীব ব্যক্তি যে আল্লাহর কাছে বিনয়ী, এর অর্থ সেই দরিদ্র ব্যক্তি নয় যার কোন সম্পদ নেই। বরং একজন মানুষ গরীব এবং তার সম্পদের অভাব হতে পারে কিন্তু সে অত্যাচারী হতে পারে। যেমনটি একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন প্রকার লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। যথা: (১). ব্যভিচারী বৃদ্ধ (২). মিথ্যাবাদী শাসক এবং (৩). অহংকারী গরীব। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; “আমি একজন দাস; দাস যেভাবে খায় আমি সেভাবে খাই এবং দাস যেমন বসে তেমনি আমিও বসি। “দরিদ্র” হওয়া একটি মনোভাব, এবং এর অর্থ হলো- নম্র বা বিনয়ী হওয়া। যেমন; ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) বলেছেন; এবং (তিনি আল্লাহ আমাকে করেছেন) আমার মাতার প্রতি সদয়, তিনি আমাকে দাম্ভিক হতভাগ্য করেননি। (সূরা মারিয়াম: ১৯/৩২, মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, খন্ড: ১৮ পৃষ্ঠা: ৩১৮ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৫১৪৬)
.
ইবনে মানযুর (রাহিমাহুল্লাহ) তার বিখ্যাত অভিধান লিসানুর আরবে বলেন: আরবীতে মিসকিনের প্রকৃত অর্থ নম্র বা বিনয়ী, আর ফকিরের আসল অর্থ অভাবগ্রস্ত। তাই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; “হে আল্লাহ, আমাকে দরিদ্র (মিসকীন) জীবন দান করুন” যার অর্থ নম্র বা বিনয়ী, অহংকারী ও গর্বিতদের একজন নয়। অর্থাৎ, হে প্রভু, আপনার সামনে নম্র ও বিনয়ী করুন, অহংকারী নয়। এখানে মিসকিন শব্দের অর্থ অভাবী অর্থে দরিদ্র নয়। (লিসানুল আরব খন্ড: ১৩ পৃষ্ঠা: ২২৬)
.
হাফিজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীসটি তার আল-তালখীস আল-হাবীরে উল্লেখ করে বলেছেন; আমার দৃষ্টিতে এর অর্থ এই নয় যে তিনি অল্প থাকার অর্থে দারিদ্র্যতা চেয়েছিলেন, বরং তিনি চেয়েছিলেন নম্রতা। (আল-তালখীস আল-হাবীরে খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১০৯)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে হাদীসটি সহীহ জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে তবে বিশুদ্ধ কথা হল হাদীসটির সনদ জয়ীফ।তবে হাদীসটি সহীহ ধরে নিলেও মিসকিন শব্দের সঠিক অর্থ: নম্র বা বিনয়ী যা অহংকারের বিপরীত। রাসূল ﷺ সর্বদা তার আচার আচরণে বিনয়ী ছিলেন এবং তিনি তার মহান রবের কাছে দু’আ করেছিলেন আল্লাহ যেন তাকে মৃত্যু পর্যন্ত বিনয়ী রাখেন। সুতরাং এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষানীয় বিষয় হলো:আমাদের বাহ্যিক নিদর্শন সুন্দর হওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হ’ল অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্য। কারণ বিচারের মাঠে আল্লাহ তা‘আলা কোন সাদা-কালো, আরব-অনাবর, ধনী-গরীব বিবেচনা করে বিচার করবেন না। আল্লাহ তা‘আলার নিকট সকল সৃষ্টিই সমান। তাই তিনি বিচার করবেন আমাদের আমল ও অন্তর দেখে। তাই তিনি বিচার করবেন আমাদের আমল ও অন্তর দেখে। এই মর্মে রাসূল ﷺ বলেন,নিশ্চয় আল্লাহর তোমাদের চেহারা-ছূরাত ও ধনসম্পদের দিকে তাকান না,বরং তিনি দেখেন তোমাদের আমলসমূহ এবং অন্তরসমূহ।(সহীহ মুসলিম হা/২৫৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৪১৪৩; মিশকাত হা/৫৩১৪) আমল হচ্ছে চিরস্থায়ী সম্পদ। যে ব্যক্তি এই সম্পদ দ্বারা তার অন্তরকে সম্পদশালী করবে সে ব্যক্তিই প্রকৃত ধনী বা সম্পদশালী। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।