হিজামা কি এবং রামাদান মাসে হিজামা করালে কি সিয়াম ভেঙ্গে যাবে

ভূমিকা: হিজামা (حِجَامَة) আরবী শব্দ ‘আল-হাজম’ থেকে এসেছে। যার অর্থ চোষা বা টেনে নেওয়া। অর্থাৎ শরীরের দূষিত রক্ত অপসারণ করা। এটা এমন এক চিকিৎসা যার মাধ্যমে দূষিত ও ব্যবহৃত রক্ত বের করা হয়। (আবু দাঊদ, হা/৩৮৫৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩৪৮৪)।ফলে শরীরের মাংসপেশী সমূহের রক্ত প্রবাহ দ্রুততর হয়। পেশী, চামড়া, ত্বক ও শরীরের ভিতরের অরগান সমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শরীর সতেজ ও শক্তিশালী হয়। হিজামা করা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত।
.
রামাদান মাসে হিজামা সিয়াম পালনকারীর সিয়াম ভঙ্গ হয় কিনা এই মাসালায় আহালুল ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সবগুলো মতামত পর্যালোচনা করলে তিনটি সুপরিচিত মতামত পাওয়া যায়। যেমন:-
.
(১). হাম্বলী মাযহাব, আত্বা, আওযা‘ঈ, ইসহাক, আবু সাওর, ইবনু খুযায়মাহ্, ইবনুল মুনযির,আবুল ওয়ালীদ নীসাপূরী ও ইবনু হিব্বান, শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া, সঊদী আরবের ‘আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল-বুহূছ আল-ইলমিইয়া ওয়াল-ইফতা’ আলেমগণ, শাইখ বিন বায,শাইখ ইবনে উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এর-মতে রমাদানে দিনের বেলা থাকা অবস্থায় হিজামা করালে সিয়াম বঙ্গ হবে। তাদের দলীল। সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত; আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, রক্তমোক্ষণকারী ও যার রক্তমোক্ষণ করা হয়েছে তারা উভয়ে সিয়াম ভঙ্গ করেছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ,হা/১৬৮০ আবী দাউদ হা/ ২০৪৯, ২০৫২-২০৫৩।ইরওয়াহ হা/৯৩১ ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা:২৬২)
.
(২). ইমাম মালিক, ইমাম শাফি‘ঈ, ইমাম আবু হানীফাহ শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সহ জমহূর মুহাদ্দিস ফকীহর মতে, শিঙ্গা লাগালে সাওম নষ্ট হবেনা। তাদের দলিল ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি। যেমন: যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুহরিম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন এবং সায়িম (রোযা রাখা) অবস্থায়ও শিঙ্গা লাগিয়েছেন।(সহীহ বুখারী হা/১৮২৫, ১৯৩৮, ২৯২৯, ২১০৩, সহীহ মুসলিম হা/১২০২, তিরমিয়ী হা/৭৭৫, ৭৭৬, ৭৭৭, নাসায়ী হা/২৮৪৫, ২৮৪৬, ২৮৪৭, ১৮২৫, ইবনু মাজাহ হা/১৬৮২, ২০৮১, মুসনাদে আহমাদ হা/১৮৫২, ১৯২২,সুনানে দারেমী হা/১৮১৯, ১৯২১, বুলুগুল মারাম, হা/৬৬৫)। অপর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তিনটি বিষয় রোজা ভাঙে না: সিঙ্গা লাগানো, বমি করা এবং স্বপ্নদোষ হওয়া।’’ (তিরমিযি, আস-সুনান: ৭১৯; বাযযার, আল-মুসনাদ: ৫২৮৭; হাদীসটি সহীহ)
.
(৩). উপরোক্ত দুটি মতকে সমন্বয় করে অপর কিছু ইমামগণের মতে সায়িমের জন্য সিঙ্গা লাগানো মাকরূহ। এ অভিমত পোষণ করেন মাসরূক, হাসান বাসরী এবং ইবনু সিরীন। যারা বলেন রক্তমোক্ষণ সিয়াম ভঙ্গ করেন তারা বলেন, (أفطر الحاجم والمحجوم) হাদীসটি মানসূখ। (আল্লামাহ, ইমাম উবাইদুল্লাহ বিন ‘আব্দুস সালাম মুবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহ; মিশকাতুল মাসাবীহ’ হা/২০০২ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত পরস্পর বিরোধী উক্ত সকল বর্ণনা দেখে কিছু উলামা মনে করেন যে, শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাদীস আজও নাসেখ (কার্যকর) এবং এর বিপক্ষে অর্থাৎ সিয়াম নষ্ট হবেনা মর্মে সকল হাদীস মনসূখ (রহিত)। অপরদিকে অন্যান্য কিছু সত্য-সন্ধানী গবেষক ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, ইমামগণ মনে করেন যে- বরং প্রথম হাদীসটাই মনসূখ অর্থাৎ সিয়াম পালন অবস্থায় হিজামা করলে সিয়াম ভঙ্গ হবে এই হাদীসটির হুকুম মানসূখ (রহিত) আর সিয়াম অবস্থায় হিজামা করলে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা এটাই সঠিক আর সে ব্যাপারে সাক্ষ্য বহন করে আনাস ইবনে মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীস। তিনি বলেন, শুরুতে রোযাদারের জন্য দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করা মাকরূহ ছিল। একদা জা’ফর বিন আবী তালেব রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলেন। তা দেখে তিনি বললেন, ‘‘এদের উভয়ের রোযা নষ্ট।’’ অতঃপর পরবর্তীকালে তিনি রোযাদারের জন্য দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার অনুমতি দিলেন। আর স্বয়ং আনাস (রাঃ) রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করতেন। (ইমাম বাইহাকী সুনানুল কোবরা ৪/২৬৮, ইমাম দারাকুত্বনী, হা/২৩৯)
.
অপর বর্ননায়, সাবিত আল-বুনানী (রহঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, একদা আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনারা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে কি সিয়াম অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করাকে মকরূহ মনে করতেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না। অবশ্য দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা করলে মকরূহ মনে করা হত। (সহীহ বুখারী হা/১৯৪০)। তদনুরূপ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রোযাদারকে স্ত্রী-চুম্বন ও দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন। ( ইমাম ত্ববারানী, দারাকুত্বনী, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ, ইরওয়াউল গালীল; ৪/৭৪) আরেক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] তিনি বলেন, (পেটের ভিতরে) কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভাঙ্গে, কিছু বাহির হলে নয়।(ইবনু আবী শাইবাহ ৯৩১৯, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ, ইরওয়াউল গালীল, ৪/৭৫)
.
উপরোক্ত কিছু বর্ণনায় ‘অনুমতি’ দেওয়ার অর্থই হলো যে, প্রথমে সে কাজ অবৈধ ছিল এবং পরে তা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইমাম ইবনু হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; আবূ সা‘ঈদ থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সায়িমকে রক্তমোক্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং এর সানাদ সহীহ। এতে জানা গেল যে, অনুমতি দেয়ার পূর্বে তা নিষেধ ছিল। এ অনুমতির ফলে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়ে গেল। অতএব, সর্বাধিক সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য মত এই যে- দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে কারো রোযা নষ্ট হবে না; যে বের করাবে তার এবং যে বের করে দেবে তারও নয়। (বিস্তারিত দষ্টব্য মুহাল্লা ৬/২০৪-২০৫)আলবানী রাহিমাহুল্লাহ, ইরওয়াউল গালীল, ৪/৭৪, ইমাম উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহ, মিশকাতুল মাসাবীহ হা/২০০২ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
পরিশেষে সবার উদ্দেশ্যে বলবো প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে- রোজাদারের রোজা থাকা অবস্থায় হিজামা করলে সিয়াম ভঙ্গ হবে কিনা এটি একটি মতানৈক্য পূর্ণ মাসয়ালা। যদিও সঠিক মত এই যে, সিয়াম অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে সিয়াম নষ্ট হবে না, তবুও উত্তম ও পূর্ব সতর্কতা মূলক আমল এই যে, সিয়াম পালনকারী সিয়াম অবস্থায় একান্ত অসুস্থ না হলে হিজামা করানো বর্জন করবে। এর ফলে সে মতভেদের বেড়াজাল থেকে নিষ্কৃতি পাবে। রক্ত বের করার পর সে দৈহিক দুর্বলতার শিকার হবে না এবং যে ব্যক্তি মুখে টেনে খুন বা রক্ত বের করে সে ব্যক্তির গলায় কিছু রক্ত চলে গিয়ে তারও সিয়াম নষ্ট না হয়ে যায়। অবশ্য একান্তই তা করার দরকার হলে দিনে হিজামা না করে রাত্রে করবে। আর সেটাই হবে উভয়ের জন্য উত্তম। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।