স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে তুমি আমার হৃৎপিণ্ড কিংবা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না অথবা এ জাতীয় অন্য কিছু বলার বিধান কী

উত্তর: একজন স্ত্রীর তার স্বামীকে কিংবা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে “my Heart” বা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না” বলা দোষের কিছু নেই ইনশাআল্লাহ।কারন যে মহিলা তার স্বামীকে বলে, “তুমি আমার হার্ট” তবে তিনি এটি আক্ষরিক বা প্রকৃত অর্থে বোঝান না; বরং তিনি এর দ্বারা যা বুঝান তা হচ্ছে, তার কাছে তার স্বামীর মূল্য, মর্যাদা এবং তার স্বামীর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মহত্ত্ব প্রদর্শন করা,ঠিক যেমন দেহের কাছে আত্মার গুরুত্ব রয়েছে। অনুরূপ কথা “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না” বলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর দ্বারা সে যা বোঝায় তা হল: তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকলে আমি খুব একা বোধ করতাম,কিংবা আমি তোমাকে ছাড়া একাকী অনুভব করি। এগুলি এমন শব্দ যা তাদের বাস্তবিক অর্থের উদ্দেশ্য ছাড়াই বলা হয় এবং এটি আরবদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি পরিভাষা। যেমন: আরবরা বলতো,”তেমার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক” বা “তোমার উভয় হাত ধুলিময় হোক” ইত্যাদি।

বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন,أفديك بأبي وأمي، كلمة تقولها العرب في تعظيم المخاطب.”আরবরা কোনও সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে বলতো “আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ করছি।”(শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-২৪১৬৮)

স্বয়ং রাসূল (ﷺ) কিছু সাহাবীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য কুরবান’, অথচ তাঁর পিতা-মাতা সেই সময় জীবিত-ই ছিলেন না।যেমন হাদীসে এসেছে, আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন,مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يُفَدِّي رَجُلاً بَعْدَ سَعْدٍ، سَمِعْتُهُ يَقُولُ “‏ ارْمِ فِدَاكَ أَبِي وَأُمِّي “নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সা’দ (রাঃ) ব্যতীত আর কারো জন্যও তাঁর পিতা-মাতাকে উৎসর্গ করার কথা বলতে দেখিনি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি,”তুমি তীর নিক্ষেপ কর, তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ (ফিদা) হোক”।(সহিহ বুখারী হা/২৯০৫ এটি ও ওহুদ যুদ্ধের ঘটনা) অপর বর্ননায় সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাছ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)
বলেন, كِنَانَتَهُ يَوْمَ أُحُدٍ فَقَالَ ارْمِ فِدَاكَ أَبِيْ وَأُمِّي ‘উহুদের দিন নবী (ﷺ) আমার জন্য তাঁর তীরাধার খুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক’, তুমি তীর চালাতে থাকো’ (সহীহ বুখারী, হা/৪০৫৫, ৪০৫৬, ৬১৮৪

উক্ত হাদীসের বাক্য “তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ (ফিদা) হোক” এখানে উৎসর্গ বা কুরবানী বলতে বাস্তবিক অর্থে কুরবানী বলা হয়নি। বরং এটি একটি প্রবাদ বাক্য বা বাকরীতি, এই বাক্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল “হে আল্লাহর রাসূল আমার পিতা-মাতা আমার অনুপস্থিতিতে আমার পক্ষ হতে আপনাকে রক্ষা করুন অর্থাৎ শত্রুর মোকাবিলায় আমার পিতা-মাতা প্রয়োজনে আপনার জন্য জীবন কুরবানি করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে। এটা হল, প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সম্মান প্রদর্শনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। এখানে প্রকৃত “উৎসর্গ” উদ্দেশ্য নয়।
.
উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বানী:

( اِرْمِ فِدَاك أَبِي وَأُمِّي ) فيه جواز التفدية بالأبوين , وبه قال جماهير العلماء , وكرهه عمر بن الخطاب والحسن البصري رضي الله عنهما , وكرهه بعضهم في التفدية بالمسلم من أبويه .
والصحيح الجواز مطلقا ; لأنه ليس فيه حقيقة فداء , وإنما هو كلام ، وإلطاف ، وإعلام بمحبته له , ومنزلته ”

“তুমি তীর নিক্ষেপ কর,তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হোক”। এটি ইঙ্গিত করে যে এই অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করা অনুমোদিত। এটাই ছিল অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। যদিও উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) উভয়েই এটি বলা অপছন্দ করেছেন এবং কিছু আলেম একজন মুসলিমের জন্য এগুলো বলা মাকরূহ বলে মনে করেছেন। তবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হল এটা সব ক্ষেত্রেই জায়েজ। কারণ এর অর্থ আসলে তাদের প্রকৃত “উৎসর্গ” করা উদ্দেশ্য নয়; বরং এটি তার প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সম্মান ও মর্যাদার প্রদর্শনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি”।(শারহুন নববী ‘আলা মুসলিম, খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ১৮৪; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৭৬৯৫৭,২০৪২১১)
.
তাছাড়া স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে my Heart” বা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না” এ জাতীয় কিছু বলা এটি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি উত্তম আচরণের শিরোনামে আসে। কেননা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা: একটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি।মহান আল্লাহ বলেন, : (وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ) “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে,তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।”[সূরা রূম: আয়াত: ২১] এখানে আল্লাহ্‌ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর মাঝের “ভালোবাসা” কে আল্লাহ্‌র সৃষ্টি ও তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন; তাঁর নির্দেশিত আবশ্যক পালনীয় হিসেবে উল্লেখ করেননি। কারণ অন্তরের ভালোবাসা বান্দার মালিকানাধীন নয়। বরং বান্দা যেটার মালিক সেটা হচ্ছে অনুগ্রহ ও সদাচরণ।
.
ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭০১ মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেন,

” وَقَوْلُهُ: وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا أَيْ: خَلَقَ لَكُمْ مِنْ جِنْسِكُمْ إِنَاثًا يَكُنَّ لَكُمْ أَزْوَاجًا، لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا ، كَمَا قَالَ تَعَالَى: هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا [الْأَعْرَافِ: 189] ؛ يَعْنِي بِذَلِكَ: حَوَّاءَ، خَلَقَهَا اللَّهُ مِنْ آدَمَ مِنْ ضِلَعه الْأَقْصَرِ الْأَيْسَرِ. وَلَوْ أَنَّهُ جَعَلَ بَنِي آدَمَ كُلَّهُمْ ذُكُورًا وَجَعَلَ إِنَاثَهُمْ مَنْ جِنْسٍ آخَرَ مِنْ غَيْرِهِمْ إِمَّا مِنْ جَانٍّ أَوْ حَيَوَانٍ، لَمَا حَصَلَ هَذَا الِائْتِلَافُ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْأَزْوَاجِ، بَلْ كَانَتْ تَحْصُلُ نَفْرَة لَوْ كَانَتِ الْأَزْوَاجُ مِنْ غَيْرِ الْجِنْسِ. ثُمَّ مِنْ تَمَامِ رَحْمَتِهِ بِبَنِي آدَمَ أَنْ جَعَلَ أَزْوَاجَهُمْ مِنْ جِنْسِهِمْ، وَجَعَلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَهُنَّ مَوَدَّةً: وَهِيَ الْمَحَبَّةُ، وَرَحْمَةً: وَهِيَ الرَّأْفَةُ، فَإِنَّ الرَّجُلَ يُمْسِكُ الْمَرْأَةَ إِمَّا لِمَحَبَّتِهِ لَهَا، أَوْ لِرَحْمَةٍ بِهَا، بِأَنْ يَكُونَ لَهَا مِنْهُ وَلَدٌ، أَوْ مُحْتَاجَةٌ إِلَيْهِ فِي الْإِنْفَاقِ، أَوْ لِلْأُلْفَةِ بَيْنَهُمَا، وَغَيْرِ ذَلِكَ ”

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন”। এর অর্থ তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করেছেন। “যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও”। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।”[সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৮৯] এর দ্বারা আল্লাহ্‌ বুঝাতে চাচ্ছেন ‘হাওয়া’ কে। আদম (আঃ) এর বাম পাঁজরের ছোটতম হাড় থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। যদি আল্লাহ্‌ সকল বনী আদমকে পুরুষ বানাতেন, আর তাদের নারীদেরকে অন্য জাতি থেকে বানাতেন, যেমন- জ্বিন কিংবা অন্য প্রাণী থেকে তাহলে তাদের মাঝে ও তাদের স্ত্রীদের মাঝে এ ধরণের মেল-বন্ধন তৈরী হত না। বরং স্ত্রীরা অন্য জাতির হলে তাদের পরস্পরের মাঝে বিরাগ ঘটত। বনী আদমের প্রতি আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ অনুগ্রহ হচ্ছে যে, তিনি তাদের স্ত্রীদেরকে তাদের জাতি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের পরস্পরের মাঝে অনুরাগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যেটা হচ্ছে ভালোবাসা। এবং দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যেটা হচ্ছে মায়া। তাই একজন স্বামী তার স্ত্রীকে ধরে রাখেন হয়তো তার প্রতি ভালোবাসার কারণে কিংবা তার প্রতি মায়ার কারণে সেই স্ত্রীর ঘরে তার সন্তান থাকলে কিংবা স্ত্রী তার ভরণপোষণের মুখাপেক্ষী হলে কিংবা তাদের দুইজনের মাঝে মেলবন্ধনের কারণে ইত্যাদি”।(তাফসিরে ইবনে কাছির; খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩০৯ থেকে সমাপ্ত]
.
উল্লেখ্য যে, You are my Heart” বা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না” এজাতীয় শব্দ স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে অনুমোদিত হলেও এ জাতীয় শব্দ গুলোর সর্বাধিক প্রয়োগ দেখা যায় নাটক সিনেমায় কিংবা তথাকথিত বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড নামক প্রচলিত রিলেশনশীপে,সুতরাং বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ যেমন হারাম তেমনি বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের ক্ষেত্রে এ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করাও নাজায়েজ।পাশাপাশি স্বামী স্ত্রী যদি একে অন্যকে হাকিকী তথা বাস্তবিক অর্থে বলে যেমন: তোমার কিছু হলে আমি সত্যিই বাঁচবো না কিংবা “আত্মহত্যা করব” তাহলে স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও এ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করা শরীয়ত সম্মত নয়,কেননা ইসলামে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।