সালাত পরিত্যাগকারীর কুরবানীর বিধান এবং বেনামাজির সাথে শরিকানা কুরবানীতে অংশগ্রহণ করার বিধান

ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত পরিত্যাগ করা কুফর, যা একজন ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, যে ব্যক্তি সালাত আদায় করেনা তার যাকাত, রোজা, হজ্জ, কুরবানী ইত্যাদি কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন; আমাদের ও তাদের মধ্যে চুক্তি হলো নামাযের। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করল, সে কুফরি করল। (জামে তিরমিযী হা/২৬২১)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করল, নিঃসন্দেহে তার আমল নষ্ট হয়ে গেল।” (সহীহুল বুখারী হা/৫৫৩, ৫৯৪, নাসায়ী হা/৪৭৪, ইবনু মাজাহ হা/৬৯৪)। উক্ত হাদীসে তার “আমল নিষ্ফল হয়ে যায়” এর অর্থ হলো: তার ঐদিনের সকল আমল বাতিল হয়ে যায় এবং তা তার কোনো কাজে আসবে না। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, বেনামাযীর কোনো আমল আল্লাহ কবুল করেন না এবং বেনামাযী তার আমল দ্বারা কোন ভাবে উপকৃত হবে না। তার কোনো আমল আল্লাহর কাছে উত্তোলন করা হবে না।(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৯৩৯৮)।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] “আস-স্বালাত” নামক গ্রন্থে উপরোক্ত হাদিসের মর্মার্থ আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:– “এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, নামায ত্যাগ করা দুই প্রকার। যথা:

(১). পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা। কোন নামাযই না-পড়া। এ ব্যক্তির সমস্ত আমল বিফলে যাবে।

(২). বিশেষ কোন দিন, বিশেষ কোন নামায ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে তার বিশেষ দিনের আমল বিফলে যাবে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে সালাত ত্যাগ করলে তার সার্বিক আমল বিফলে যাবে। আর বিশেষ নামায ত্যাগ করলে বিশেষ আমল বিফলে যাবে। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম; ‘আস-স্বালাত’; পৃষ্ঠা: ৬৫)।
.
ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আমাদের কাছে উমর বিন খাত্তাব (রাঃ), মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) সহ একদল সাহাবী থেকে এবং ইবনুল মুবারক, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন রাহুইয়া এবং ঠিক ১৭ জন সাহাবী থেকে এই মর্মে বর্ণনা এসেছে যে, মনে থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে ফরয নামায বর্জনকারী কাফের ও মুরতাদ। এ অভিমত পোষণ করেন, ইমাম মালেকের শিষ্য আব্দুল্লাহ বিন মাজিশুন। এ মত ব্যক্ত করেন, আব্দুল মালিক বিন হাবিব আল-আন্দালুসি প্রমুখ।(আল-ফাসলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল ৩/১২৮)
.
ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন; উমর (রাঃ), আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ), মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), আবু হুরায়রা (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীর মত বর্ণিত আছে যে, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত ফরয নামায ত্যাগ করে, এক পর্যায়ে ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় সে ব্যক্তি কাফের ও মুরতাদ।” (আল মুহাল্লা ২/১৫, শাইখ বিন বাযের নেতৃত্বাধীন ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এই অভিমতের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। ফাতাওয়াল লাজনা আদ-দায়িমা ৬/৪০, ৫০)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেন; সালাত আদায় না করে সিয়াম আদায় করলে তার সিয়ামে কোন উপকার হবে না, সিয়াম সঠিক হবে না, সিয়াম আল্লাহ তাআলার কাছে কবুলও হবে না। যদিও সে অন্যান্য ইবাদাত করে। এতদাসত্বেও যতক্ষণ পর্যন্ত সে সালাত আদায় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোন ধরনের ইবাদত কবুল হবে না। ফলে সালাত পরিত্যাগকারীর সিয়াম আদায় করে কোন লাভ নাই। (আল মুনতাকা মিন ফাতাওয়ায়ে ফাওযান,১৬/৩৯)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন; যদি সালাত পরিত্যাগকারী কুরবানী করার ইচ্ছা করে তাহলে তার উচিত হলো সালাত পরিত্যাগ করার জন্য প্রথমত আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করা। যদি সে তওবা না করে এবং তার উপরেই সে অটল থাকে অর্থাৎ সালাত আদায় না করে তাহলে তার ওই কুরবানীতে নেকি হবে না এবং কুরবানী কবুলও হবে না । যদি সে সালাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেই যবেহ করে তাহলে সেই যবেহটি হবে মৃত্যুর ন্যায়। আর মৃত্যু খাওয়া হালাল নয়। কারণ মুরতাদ কর্তৃক জবাই করা গোশত হারাম। (উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব,৩২/১২৪)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন; যদি কোন সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি পশু জবেহ করে তাহলে তার জবেহিত পশুর গোশত খাওয়া বৈধ নয় কেন? কারণ, সেটা হারাম। যদি ইয়াহুদী এবং খ্রিস্টান জবেহ করে তাহলে তার জবেহকৃত গোশতটা আমাদের জন্য হালাল। কেননা ইহুদী-খ্রিষ্টানের জবেহকৃত গোশতের চেয়ে সালাত পরিত্যাগকারীর যবেহকৃত গোশতটি বেশি জঘন্যতম এবং নাপাক। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড:১২, পৃষ্ঠা:৪৫, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৫৯৬৪৫)
.
জেনে রাখা ভালো যে, আল্লাহর নামে ইহুদী-খ্রিস্টানের জবাইকৃত পশুর গোশত স্বাভাবিক খাওয়া হালাল হলেও কুরবানীর পশু তাদের মাধ্যমে জবাই করা শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ, ইহুদি-খ্রিস্টানরা কাফের আর কাফেরদের ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। এই মর্মে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; কোন কিতাবীকে (ইহুদী-খ্রিস্টানকে) কুরবানীর পশু জবাই করার দায়িত্ব দেয়া সঠিক নয়; যদিও কিতাবীর জবাই হালাল। কিন্তু কুরবানী একটি ইবাদত। তাই কিতাবীকে এ দায়িত্ব দেয়া সঠিক নয়। যেহেতু কিতাবী ইবাদত ও আনুগত্য পালন করার উপযুক্ত নয়। কেননা সে কাফের। কাফেরের কোন ইবাদত কবুলযোগ্য নয়। তার নিজের ইবাদত যেহেতু কবুলযোগ্য নয়; সুতরাং সে কর্তৃক অন্যের ইবাদত পালনও সঠিক নয়। পক্ষান্তরে, কোন কিতাবীকে যদি গোশত খাওয়ার জন্য কোন পশু জবাই করার দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে তাতে অসুবিধা নাই। (আল-শারহুল মুমতি, খন্ড:৭, পৃষ্ঠা:৪৯৪)
.
🔹বেনামাজির সাথে নামাজী ব্যক্তি শরিকানা কুরবানীতে অংশগ্রহণ করা যাবে কি?
______________________________________
হালাল জীবিকা উপার্জন করা শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন মুসলিম কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, পানীয় সর্বক্ষেত্রে হালালকে গ্রহণ করবে এবং হারাম ও সন্দেহযুক্ত বস্ত্ত থেকে দূরে থাকবে। হালালকে গ্রহণ ও হারামকে বর্জনের মধ্যেই রয়েছে মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা। তাছড়া হালাল উপার্জন দু’আ কবুলের অন্যতম শর্ত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; ‘আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া অন্য কিছু কবুল করেন না। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে যে আদেশ দিয়েছেন মুমিনগণকেও সে আদেশ দিয়েছেন। যেমন: রাসূলগণকে বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র হালাল রূযী খান এবং নেক আমল করুন।’ (সূরা আল-মুমিনূন: ১২)। মুমিনগণকে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আমার দেয়া পবিত্র রিযিক হতে খাও।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৭২)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উল্লেখ করলেন, ‘এক ব্যক্তি দূর-দূরান্তে সফর করছে। তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলা-বালি, এমন অবস্থায় সে উভয় হাত আসমানের দিকে উঠিয়ে কাতর স্বরে হে প্রভু! হে প্রভু!! বলে ডাকছে। কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারাই বেষ্টিত। এই ব্যক্তির দু‘আ কিভাবে কবুল হতে পারে? (সহীহ মুসলিম, হা/১০১৫; মিশকাত, হা/২৭৬০)। এই হাদীসটি প্রমাণ করে আল্লাহর রাস্তায় যা কিছু দান করা হয় তা যদি পবিত্র না হয়, শারী‘আতের দৃষ্টিতে হালাল না হয় এবং নিয়্যাতের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা ঐ দান গ্রহণ করেন না। আল্লামা ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, অত্র হাদীসে হালাল উপার্জন থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং অসদোপায়ে উপার্জন করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করা থেকে পরোক্ষভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (শারহে মুসলিম ৭/৮ খন্ড, হাঃ ১০১৫)
.
সুতরাং শরীয়তের দৃষ্টিতে জেনে বুঝে সালাত পরিত্যাগকারী, হারাম উপার্জন কারী, সুদখোর, ঘুষখোর এবং প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত এমন ব্যক্তিদের সাথে শরিকানা কুরবানীতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ নয়। কারণ, এতে ঐ ব্যক্তির হারাম অর্থ খরচে সহযোগিতা করা হয়। যা মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নয়। তাই দ্বীনদার- তাকওয়াশীল যাদের আয় উপার্জন হালাল তাদের সাথে ভাগে কুরবানি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে যদি অজানা বশত: সাত জনের মধ্যে এমন কেউ থাকে অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন ব্যক্তিকে ভাগে নেয়ার প্রয়োজন হয় যার অর্থ সম্পূর্ণ হালাল নয় (হালাল-হারামের সংমিশ্রণ আছে) তাহলে এটি অন্যান্য ভাগীদারদের উপরে প্রভাব ফেলবে না ইনশাআল্লাহ। কেননা একজনের দায়-দায়িত্ব অন্যজন বহন করবে না। ক্বিয়ামাতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলা কারোর উপর বিন্দুমাত্র যুলুম করবেন না এবং কেউ অন্য কারো পাপের বুঝাও বহন করবে না। (সূরা আল-আন‘আম: ১৬৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ।’ (সূরা আত-তূর: ২১; সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৩৮; ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-৩১৮৬৯৮)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, সালাত পরিত্যাগকারীর কুরবানী গ্রহনযোগ্য নয়, তাই যে সকল ঈমানদার মুত্তাকী মুসলিম কুরবানী দিবেন আপনাদের প্রতি বিশেষ ভাবে অনুরোধ থাকবে আপনারা শরিকানা কুরবানী দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার অপর অংশীদার সালাত আদায় করে কিনা? সে সুদ ঘুষের মত হারামের সাথে জড়িত আছে কিনা? তাকে অংশীদার হিসেবে নেওয়ার পূর্বে অবশ্য যাচাই-বাছাই করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ ভাবে দ্বীনের বিধি বিধান মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।