সালাতে সূরা ফাতেহা পড়ার পর অন্যান্য সূরা পাঠ করার বিধান

প্রশ্ন: যেকোন সালাতে সূরা ফাতেহা পড়ার পর অন্যান্য সূরা পাঠ করার বিধান কি? কুরআন সুন্নার আলোকে সঠিক তথ্য জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাতে সূরা ফাতেহার পর অন্য সূরা মিলানো সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ সুন্নাহয় বিভিন্ন ধরনের বর্ননা পাওয়া যায়। সকল বর্ননাগুলো পর্যালোচনা করে বিশুদ্ধ বক্তব্য হল ১,২,৩ বা ৪ রাক‘আত বিশিষ্ট সালাত ফরজ হোক আর সুন্নত হোক, ব্যক্তি একাকী হোক আর জামাতের সাথে হোক ইমামের জন্য সকল সালাতের প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরজ বা ওয়াজিব। এবং ফরয-নফল সব সালাতে সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য সূরা পাঠ করা ওয়াজিব নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘কোন সালাত সিদ্ধ নয় সূরা ফাতিহা ব্যতীত।’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭৫৬; সহীহ মুসলিম, হা/৩৯৪; মিশকাত হা/৮২২)। কারন জমহুর ওলামাদের মতে সূরা ফাতিহা পড়া সালাতের রোকন। এটি ছাড়া সালাত শুদ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’ (ছহীহ বুখারী হা/৭৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৯০০, ৯০১, ৯০২, ৯০৪, ৯০৬, ৯০৭ (ইফাবা হা/৭৫৮, ৭৫৯, ৭৬০, ৭৬২); মিশকাত, হা/৮২২ ও ৮২৩)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সালাত আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার সালাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন।তখন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কে জিজ্ঞেস করা হল, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি?উত্তরে তিনি বললেন, তুমি চুপে চুপে পড়।’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৯০৪, (ইফাবা হা/৭৬২); মিশকাত, হা/৮২৩)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, بَابُ وُجُوْبِ الْقِرَاءَةِ لِلْإِمَامِ وَالْمَأْمُوْمِ فِى الصَّلَوَاتِ كُلِّهَا فِي الْحَضَرِ وَالسَّفَرِ وَمَا يُجْهَرُ فِيْهَا وَمَا يُخَافَتُ ‘প্রত্যেক সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য ক্বিরা‘আত (সূরা ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফর অবস্থায় হোক, জেহরী সালাতে হোক বা সের্রী সালাতে হোক।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৫৬ এর অনুচ্ছেদ দ্রঃ)।
.
আমাদের সকলের উচিত সুন্নাহর অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী সালাতে কিরাআত পাঠের সঠিক পদ্ধতি হলো, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ অথবা নফল উভয় সালাতে প্রথম দু’রাকআতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠের পর একাকী অথবা ইমাম হলে যেকোন আরেকটি সূরা পাঠ করা। আর ইমামের পিছনে মুক্তাদী হ’লে ফজর, মাগরিব ও এশার সালাতে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়ার পর আর কিছুই না পড়ে কেবল ইমামের ক্বিরাআত মনোযোগ দিয়ে শুনা।(ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩ সালাতে দাঁড়ানো’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-১১)। ওবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন ফজরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের দিকে ফিরে বললেন, সম্ভবতঃ তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন ‘তোমরা এরূপ করো না কেবলমাত্র সূরা ফাতিহা ব্যতীত। কেননা এটি পাঠ না করলে সালাত সিদ্ধ হয় না।’ (আহমাদ হা/২২৭২৩; আবুদাঊদ হা/৮২৩; মিশকাত হা/৮৫৪ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ)।
.
তবে যোহর ও আসর তথা সের্রী সালাতে মুক্তাদিগণ ইমামের পিছনে ১ম ও ২য় রাক‘আতে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা এবং শেষ ২ রাকআতে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। জাবের (রাঃ) বলেন, আমরা যোহর ও আসরের সালাতের প্রথম দু’রাক‘আতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা এবং শেষ দু’রাক‘আতে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করতাম। (ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩, সনদ ছহীহ)। অপর বর্ননায় আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যোহরের প্রথম দু’রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও অন্য দু’টি সূরা পড়তেন এবং শেষের দু’রাক‘আতে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়তেন। অনুরূপ করতেন আসরে’। (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৮, সালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; নায়ল ৩/৭৬, ৪/২৪ পৃঃ)। আবার দুটি সূরা না পড়ে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পাঠ করলেও যথেষ্ট হবে। (সহীহ মুসলিম হা/৪৫১)।
.
আবার শেষ দু’রাক‘আতেও সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা মিলানো যায়। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) যোহরের প্রথম দু’রাক‘আতে ৩০ আয়াত পরিমাণ এবং শেষের দু’রাক‘আতের প্রতি রাক‘আতে ১৫ পনের আয়াত পরিমাণ পাঠ করতেন। (মুসলিম হা/৪৫২)। আলবানী (রহঃ) বলেন, শেষ দু‘রাক‘আতে সূরার ফাতিহার সাথে অন্য সূরা মিলানো সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে অত্র হাদীসে দলীল রয়েছে। (ছিফাতু ছালাতিন নবী (ছাঃ) ১১৩ পৃ.)। ইবনে উসাইমীন (রহঃ) বলেন, শেষ দু’রাক‘আতেও মুক্তাদী ইমাম রুকূতে না যাওয়া পর্যন্ত সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা পাঠ করতে পারে। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১০৮)
.
মোটকথা ১, ২, ৩ বা ৪ রাকআত বিশিষ্ট যে কোন সালাতে প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা মিলানো চলে, আবার প্রথম দু’ রাকআতে ১টি মিলিয়ে শেষ দু’রাকআতে না মিলালেও চলে। আবার কোন রাকআতেই সূরা ফাতিহার পর অন্য কোন সূরা পাঠ না করলেও সালাত সহীহ হবে। তবে সওয়াব কম হবে। কিন্তু জেনে রাখা ভাল, প্রত্যেক সালাতের প্রথম দুই রাক‘আতে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা পাঠ করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা। রাসূল (ﷺ) কখনো তা পরিত্যাগ করেননি। অতএব ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ তা ত্যাগ করবে না।
.
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি মু’আয (রাঃ) এর ঘটনা বর্ননা করে বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক যুবককে বললেন, হে ভ্রাতুস্পুত্র! তুমি সালাতে কী পড়?সে বললো, আমি সূরা ফাতিহা পড়ি এবং আল্লাহর কাছে জান্নাতের প্রত্যাশা ও জাহান্নাম হতে আশ্রয় চাই। আমি আপনার ও মু‘আয এর অস্পস্ট শব্দগুলো বুঝিনা। (অর্থাৎ আপনি এবং আমাদের ইমাম মু‘আয সালাত নিরবে কোন কোন শব্দযোগে দু‘আ ও মুনাজাত করেন তা আমি অবহিত নই)। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি এবং মু‘আয উভয়েই আশে-পাশেই ঘুরে থাকি (অর্থাৎ আমরাও জান্নাতের প্রত্যাশা এবং জাহান্নাম হতে আশ্রয় প্রত্যাশা করি) অথবা অনুরুপ কিছু বলেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৭৯৩ সনদ সহীহ)।
.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘কোন সালাত সিদ্ধ নয়,সূরা ফাতিহা ব্যতীত।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯৪; মিশকাত হা/৮২২)। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, সূরা ফাতিহা বিশিষ্ট নামায পরিণত ও সম্পূর্ণ। আর অন্য সূরা পাঠ জরুরী নয়। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ১/২৫৮)।
.
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যেক সালাতেই ক্বিরআত পড়া হয়। তবে যেসব সালাত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শুনিয়ে পড়েছেন, আমরাও তোমাদের শুনিয়ে পড়ব। আর যেসব সালাতে আমাদেরকে না শুনিয়ে পড়েছেন, আমরাও তোমাদেরকে না শুনিয়ে পড়ব। যদি তোমরা সূরা ফাতেহার পরে আরো অধিক আয়াত পাঠ না কর তবুও সালাত হয়ে যাবে। আর যদি অধিক আয়াত পাঠ কর তাহলে সেটাও তোমার জন্য উত্তম হবে। (সহীহ বুখারী, হা/৭৭২; সহীহ মুসলিম, হা/৩৯৬)।
.
জেনে রাখা ভাল যে, সালাতে কিরাআত পড়ার ক্ষেত্রেভউত্তম হল, কুরআনের সূরার সমূহের ধারবাহিকতা রক্ষা করা। অর্থাৎ আগের সূরা আগে এবং পরেরটা পরে পড়া এবং ১ম রাকাআতে বড় সূরা পড়লে তার পরের রাকাআতে তুলনা মূলক ছোট সূরা পড়া। (সহীহ মুসলিম, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮৪২, ৮৪৮; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৮, ৮২৯, ৮৫৩; আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী পৃঃ ৮৯-১০২, ১৩৭)। তবে এর ব্যতিক্রম হলেও সালাত শুদ্ধ হবে কেননা, কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ “তোমার কুরআনের যেখান থেকে সুবিধা হয় পড়ো।” (সূরা মুযাম্মিল: ২০)।তাছাড়া হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই রাকাআতে সূরা আন-নিসা পড়ার পর সূরা আলে-ইমরান পাঠ করেছেন। অথচ কুরআনের ধাবাবাহিকতা অনুযায়ী সূরা সূরা আলে ইমরানের পরে সূরা নিসা এর অবস্থান। (সহীহ মুসলিম,
১৬৯৯ (ই.ফা. ১৬৮৪, ই.সে. ১৬৯১)। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীন বুঝার তওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।