সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করার বিধান

প্রশ্ন: সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করার বিধান কি? জামআতে জেহেরী কিরাআতে ইমামের পিছনে মুক্তাদী কখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে? ইমামের ফাতিহা পাঠ করার সময় নাকি ইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করে অন্য সূরা পাঠ শুরু করলে? কোনটি অধিক বিশুদ্ধ মত?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রথমত: কুরআন-সুন্নাহ এবং প্রসিদ্ধ সালাফদের গ্রহণযোগ্য এবং নিরাপদ মত অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে একাকী অথবা জামআতের সাথে আদায় করার সময় ইমাম এবং মুক্তাদির উভয়ের জন্য সূরা ফাতেহা পাঠ করা অপরিহার্য। কারণ,সূরা ফাতেহা সালাতের রুকন। তাই এটি ছাড়া সালাত শুদ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার সালাত হয় না।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৫৬; সহীহ মুসলিম, হা/৯০০, ৯০১, ৯০২, ৯০৪, ৯০৬, ৯০৭, ইফাবা হা/৭৫৮, ৭৫৯, ৭৬০, ৭৬২; মিশকাত, হা/৮২২ ও ৮২৩)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সালাত আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার সালাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন। তখন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করা হলো- আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি চুপে চুপে পড়।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৯০৪, ইফাবা হা/৭৬২; মিশকাত, হা/৮২৩)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, بَابُ وُجُوْبِ الْقِرَاءَةِ لِلْإِمَامِ وَالْمَأْمُوْمِ فِى الصَّلَوَاتِ كُلِّهَا فِي الْحَضَرِ وَالسَّفَرِ وَمَا يُجْهَرُ فِيْهَا وَمَا يُخَافَتُ ‘প্রত্যেক সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য ক্বিরা‘আত (সূরা ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফর অবস্থায় হোক,জেহরী সালাতে হোক বা সের্রী সালাতে হোক।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৫৬-এর অনুচ্ছেদ দ্রঃ)

▪️দ্বিতীয়ত: জামআতে জেহেরী কিরাআতে ইমামের পিছনে মুক্তাদী কখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে?
.
জেহেরী সালাত যেমন: ফজর, মাগরিব এবং এশার প্রথম দুই রাকাআতে মুক্তাদী কখন সূরা ফাতেহা তেলোয়াত করবে এই মর্মে কিছুটা মতানৈক্য থাকলেও কুরআন-হাদীসের আলোকে অধিক বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, ইমামের সূরা ফাতেহা তেলোয়াত শেষ হওয়ার পর মুক্তাদী তেলোয়াত করবে। কারণ আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا قُرِیٴَ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ وَ اَنۡصِتُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর। (সূরা আ‘রাফ ৭/২০৪)। এই নির্দেশ সালাতের মধ্যে ও বাইরে সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। রাসূল (ﷺ) বলেন, وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا আর যখন ইমাম ক্বিরাআত তেলাওয়াত করবে, তখন তোমরা চুপ থাকবে।(সহীহ মুসলিম হা/৪০৪; মিশকাত হা/৮৫৭)। অতঃপর ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ করবে তখন মুক্তাদি চুপে চুপে পড়ে নিবে।‌ ওবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ফজরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের দিকে ফিরে বললেন, সম্ভবতঃ তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন ‘তোমরা এরূপ করো না শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা ব্যতীত। কেননা সূরা ফাতেহা পাঠ না করলে সালাত শুদ্ধ হয় না। (আহমাদ হা/২২৭২৩; আবু দাঊদ হা/৮২৩; মিশকাত হা/৮৫৪)
.
ইমামদের পিছনে সূরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে মর্মে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে ইমামের পিছনে সরাসরি সূরা ফাতিহা পড়া সম্পর্কে অনেক সহীহ আসার আছে। যেমন: عَنْ يَزِيْدَ بْنِ شَرِيْكٍ أَنَّهُ سَأَلَ عُمَرَ عَنِ الْقِرَاءَةِ خَلْفَ الإِمَامِ فَقَالَ اقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قُلْتُ وَإِنْ كُنْتَ أَنْتَ؟ قَالَ وَإِنْ كُنْتُ أَنَا قُلْتُ وَإِنْ جَهَرْتَ؟ قَالَ وَإِنْ جَهَرْتُ. ইয়াযীদ ইবনু শারীক একদা ওমর (রাঃ)-কে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ কর। আমি বললাম, যদি আপনি ইমাম হোন? তিনি বললেন, আমিও যদি ইমাম হই। আমি পুনরায় বললাম, যদি আপনি জোরে ক্বিরাআত পাঠ করেন? তিনি বললেন, যদিও আমি জোরে ক্বিরআত পাঠ করি। (বায়হাক্বী,সুনানুল কুবরা হা/৩০৪৭; সনদ সহীহ)। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক মন্তব্য করেন, أَنَا أَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ وَالنَّاسُ يَقْرَءُوْنَ إِلَّا قَوْمًا مِنْ الْكُوفِيِّيْنَ আমি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করি এবং অন্য মানুষেরাও করে। কিন্তু কূফাবাসী করে না।(তিরমিযী:খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৭১)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়, মুক্তাদী কখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে? ইমামের ফাতিহা পাঠ করার সময়? নাকি ইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করে অন্য সূরা পাঠ শুরু করলে?
.
উত্তরে শাইখ বলেন: উত্তম হচ্ছে ইমামের ফাতিহা পাঠ শেষ হওয়ার পর মুক্তাদী ফাতিহা পাঠ করবে। কেননা ফরয ক্বিরআত পাঠ করার সময় নীরব থাকা রুকন। ইমামের পড়ার সময় যদি মুক্তাদীও পাঠ করে তবে রুকন আদায় করার সময় নীরব থাকা হলো না। আর ফাতিহা পাঠ করার পর যখন ইমাম অন্য ক্বিরআত শুরু করবে, সে সময় তা শোনার জন্য নীরব থাকা মুস্তাহাব। অতএব উত্তম হলো, ফাতিহা পাঠ করার সময় নীরব থাকবে। নামাযের সুন্নাত ক্বিরআত পাঠের সময় নীরব থাকার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অন্যতম রুকন সূরা ফাতিহা পাঠ করার সময় নীরব থেকে তা শ্রবণ করা। তাছাড়া ইমামের ‘ওয়ালায্‌ যওয়াল্লীন’ বলার সময় মুক্তাদীও (‘ওয়ালায্‌ যওয়াল্লীন’) পাঠ করলে তাঁর সাথে ‘আমীন’ বলা সম্ভব হবে না। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম; পৃষ্ঠা:৩২২)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরো জিজ্ঞেস করা হয় সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর কিছুক্ষণ চুপ থাকার বিধান কি?
.
জবাবে শাইখ বলেন: “السكتة بين قراءة الفاتحة ، وقراءة سورة لم ترد عن النبي صلى الله عليه وسلم ، على ما ذهب إليه بعض الفقهاء من أن الإمام يسكت سكوتا يتمكن به المأموم من قراءة الفاتحة ، وإنما هو سكوت يسير يتراد به النفس من جهة ، ويفتح الباب للمأموم من جهة أخرى ، حتى يشرع في القراءة ويكمل ، ولو كان الإمام يقرأ ، فهي سكتة يسيرة ليست طويلة ” انتهى. ফিক্বাহবিদদের মধ্যে থেকে কেউ মত প্রকাশ করেছেন যে, ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর অন্য সূরা শুরু করার পূর্বে কিছুক্ষণ নীরব থাকবেন, যাতে করে মুক্তাদী ফাতিহা পাঠ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এব্যাপারে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি। তবে তা হচ্ছে সামান্য বিরতি নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এবং এই ফাঁকে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পাঠ করা আরম্ভ করে দিবে। এরপর ইমাম অন্য ক্বিরাত শুরু করে দিলেও কোন অসুবিধা নেই। কেননা সূরা ফাতিহা পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য রুকন। কিন্তু ইমামের ক্বিরআত শ্রবণ করা তার জন্য মুস্তাহাব। মোটকথা নীরব থাকার মুহূর্তটি অতি সামান্য দীর্ঘ নয়।(ফাতওয়ায় আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা: ৩২৩-৩২৪)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন; আহালুল ইমামগণের দুটি মতের অধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে, যদি ইমাম সূরা ফাতেহা তেলোয়াত শেষে বিরতি না দেন, তাহলে ইমাম যখন (অন্য সূরা) পাঠ করবে তখন মুত্তাদী সূরা ফাতেহা পড়ে নিবে। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা:২২১)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, বিশুদ্ধ মতে জেহরী-সের্রী সকল সালাতে সর্বাবস্থায় ইমাম-মুক্তাদী উভয়কেই সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। এক্ষেত্রে মুত্তাদীর জন্য উত্তম সময় হচ্ছে- ইমাম সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত শেষ করে অন্য সূরা পড়ার সময় মুক্তাদী তেলাওয়াত করবে। তবে কেউ যদি ইমামের সূরা ফাতেহা তেলোয়াতের পর পর পড়ে তাতেও কোন সমস্যা নেই, তবুও পড়া উচিত। হাদীসে কুদসিত আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন, আমার এবং আমার বান্দার মধ্যে সালাতকে আমি দু’ভাগে বিভক্ত করেছি, আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে যা সে চায়।(মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৩, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০২)। চাওয়ার বিষয়টি সবার জন্য প্রযোজ্য। কারন ইমাম ও মুক্তাদী উভয়েই আল্লাহর বান্দা। অতএব উভয়ে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে ‘সিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর সর্বোত্তম হেদায়াত প্রার্থনা করবে। অপর এক বর্ননায় আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, সূরা ফাতিহা ব্যতীত কোন সালাত সিদ্ধ হবে না। আমি বললাম, যদি আমি ইমামের পিছনে থাকি? তখন তিনি আমার হাত ধরে বললেন, তুমি তা চুপে চুপে পড়। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/১৭৮৬, সনদা সহীহ)। উল্লেখিত হাদীসসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম-মুক্তাদী সকলকেই সর্বাবস্থায় সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।