অযূর সময় মাথার কতটুকু অংশ মাসাহ করতে হবে এবং কিভাবে মাসাহ করতে হবে

প্রশ্ন: অযূর সময় মাথার কতটুকু অংশ মাসাহ করতে হবে এবং কিভাবে মাসাহ করতে হবে? এই পোস্টে মাথা মাসাহ সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মুসলিমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে, ওযু করার সময় নারী পুরুষ উভয়ের জন্য মাথা মাসেহ করা ফরজ/ওয়াজিব, এটি নিয়ে কারো মধ্যে মতানৈক্য নেই। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেন: یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡهَکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ وَ امۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর। (সূরা মায়েদা: ৫/৬) পাশাপাশি আহালুল আলেমগন সবাই একমত যে, পুরো মাথা মাসেহ করাই উত্তম, তবে পুরা মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব কিনা তা নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
.
(১). মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের এবং অধিকাংশ আলেমগনের অভিমত হচ্ছে, সম্পূর্ণ মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কর্ম থেকে দলিল নিয়েছেন। কেন না রাসূল (ﷺ) মাথা কিছু অংশ মাসেহ করেছিলেন এ বিষয়ে বিশুদ্ধ সনদে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। আর এই মতটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারন পবিত্র কুরআনে সূরা মায়েদার ৬ নং আয়াতের শব্দ মুজমাল (সার-সংক্ষেপ)-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ণ মাথা মাসেহ করা।যদিও কেউ কেউ বলেছেন আয়াতে باء “বা” অক্ষর অতিরিক্ত অথবা কিছু অংশ মাসেহ করা, কিন্তু মৌলিক কথা পূর্ণ মাথা মাসেহ্ করা যা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমল দ্বারা প্রতীয়মান হয়। মালিকী ও হাম্বলীগণ দলীল হিসাবে বেশ কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছেন যেমন: আল্লাহ তাআলার কথা: ( وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ ) “তোমরা তোমাদের মাথা মাসেহ করো” এই কথা দ্বারা সম্পূর্ণ মাথাকে বোঝানো হচ্ছে। তোমরা তোমাদের মাথা মাসেহ করো এই কথাটি হলো সেই বাক্যাংশের মতো যেখানে আল্লাহ তায়াম্মুম সম্পর্কে বলেছেন: “( فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ অর্থাৎ তোমরা পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করো এবং তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হাত মাসেহ কর) আল্লাহ তায়ালার কথার মতই। এখানে হাতকে তেমন ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বোঝানো হয়েছে যেমনভাবে মাথাকে বোঝানো হয়েছিল। (মাজমূঊ ফাতাওয়া খন্ড: ২১ পৃষ্ঠা: ১২৫)।
.
ইবনে আব্দুল বার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:اختلف الفقهاء فيمن مسح بعض الرأس ، فقال مالك : الفرض مسح جميع الرأس ، وإن ترك شيئا منه كان كمن ترك غسل شيء من وجهه ، هذا هو المعروف من مذهب مالك ، وهو قول ابن علية ، قال ابن علية : قد أمر الله بمسح الرأس في الوضوء كما أمر مسح الوجه في التيمم ، وأمر بغسله في الوضوء ، وقد أجمعوا أنه لا يجوز غسل بعض الوجه في الوضوء ولا مسح بعضه في التيمم ، فكذلك مسح الرأس ” انتهى .মাথা মাসেহ করা সম্পর্কে ফুকাহাদের নিকটে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মালেক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন মাথা মাসেহ পরিপূর্ণভাবে করতে হবে। যদি কেউ মাথা মাসেহ কিছু ছেড়ে দেয় তাহলে সে ব্যক্তি ওই ব্যক্তির মত হবে যে ব্যক্তি মুখমন্ডল ধৌত করতে গিয়ে কিছু ছেড়ে দেয়। এই কথাটি হল ইমাম মালেক (রহিমাহুল্লাহ)-এর প্রসিদ্ধ একটি কথা। এমনটি বলেছেন ইবনে আলিয়া। ইবনে আলিয়া বলেন আল্লাহ তা’য়ালা ওযুর ক্ষেত্রে মাথা মাসেহ করার আদেশ দিয়েছেন যেমন ভাবে তায়াম্মুমের ক্ষেত্রে মুখ মাসেহ করার আদেশ দিয়েছেন। সকল ওলামা একমত পোষণ করেছেন যে ওযুর ক্ষেত্রে এবং তায়াম্মুম এর ক্ষেত্রে মুখমণ্ডল কিছু অংশ ধৌত করা জায়েজ নাই ঠিক তেমনিভাবে মাথার পুরো অংশ মাসেহ না করে কিছু অংশ মাসেহ করা জায়েজ নাই। (আত তামহীদ: খন্ড: ২০ পৃষ্ঠা: ১১৪)।
.
ইবনুল মুসায়্যিব (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, الْمَرْأَةُ بِمَنْزِلَةِ الرَّجُلِ تَمْسَحُ عَلَى رَأْسِهَا وَسُئِلَ مَالِكٌ أَيُجْزِئُ أَنْ يَمْسَحَ بَعْضَ الرَّأْسِ فَاحْتَجَّ بِحَدِيثِ عَبْدِ اللهِ بْنِ زَيْدٍ.নারী পুরুষের মধ্যে মাথা মাসেহ করার ব্যাপারে ভেদাভেদ নেই। ইমাম মালিক (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হল, মাথার কিছু অংশ মাসেহ করা কি যথেষ্ট হবে? তিনি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যায়দ (রাযি.)-এর হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করলেন। অর্থাৎ পূর্ণ মাথা মাসেহ করতে হবে।(দেখুন সহীহ বুখারী হা/১৮৫ টীকা)।
.
▪️(২). অপরদিকে হানাফী ও শাফীঈগণের মতে মাথার কিছু অংশ অর্থাৎ মাথার এক তৃতীয়াংশ মাসেহ করাই যথেষ্ট। হানাফী মাযহাব এবং শাফীঈ মাযহাবের আলেমগন দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন:

(ক). মহান আল্লাহ বলেন: وامْسَحُوا بِرُءُوسِكُم অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মাথা মাসেহ করো।সূরা মায়েদাহ: ৫/৬) তারা বলেন, এখানে باء “বা”অক্ষর অতিরিক্ত অথবা কিছু অংশ মাসেহ করা বুঝানোর জন্য। কিন্ত তাদের এই বক্তব্যের প্রতি উত্তরে বলা হয়েছে: বা অক্ষরটি আংশিক বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয় না বরং এটি ব্যবহার হয়েছে মিলানো অর্থে সে অনুযায়ী অনুবাদ হবে মাথার সাথে এমন কিছু মিলাবে যেটা দ্বারা মাসেহ করা হয়। (মাজমূঊ ফাতাওয়া: খন্ড: ২১ পৃষ্ঠা: ১২৩)।
.
(খ). তারা বুখারী মুসলিম থেকে দলিল উল্লেখ করেছেন যেখানে মুগীরাহ্ ইবনু শু‘বাহ্-এর হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার অংশ বিশেষের উপর মাসেহ করেছেন। তবে মুগীরার হাদীসেও এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: مَسَحَ بِنَاصِيَتِهِ وَعِمَامَتِهِ উভয় মোজার উপর এবং মাথার সম্মুখভাগ ও পাগড়ীর উপর মাসাহ করেন। (সহীহ মুসলিম হা/২৪৭ ও ৫২২) তারা এই হাদীস থেকে দলিল নিয়েছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার কিছু অংশ অর্থাৎ অর্ধেক ভাগ মাসেহ করেছিলেন। কিন্তু এ বর্ণনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, মাথার অংশ বিশেষের উপর মাসেহ করা ওয়াজিব যেহেতু মাথা মাসেহের ক্ষেত্রে কোন সংখ্যার উল্লেখ নেই। তাই তাদের প্রতি উত্তরে বলা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করেছিলেন এবং পাগড়ীর উপরে পূর্ণ মাসেহ করেছিলেন। পাগড়ী মাসেহ করাটা মাথা মাসেহ করার স্থলাভিষিক্ত।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং ১৪৭১৪০ মিশকাতুল মাসাবি হা/৩৯৪ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] তার যাদুল মায়াদ গ্রন্থে বলেন: ” لَمْ يَصِحَّ عَنْهُ صلى الله عليه وسلم فِي حَدِيثٍ وَاحِدٍ أَنَّهُ اقْتَصَرَ عَلَى مَسْحِ بَعْضِ رَأْسِهِ أَلْبَتَّةَ , وَلَكِنْ كَانَ إذَا مَسَحَ بِنَاصِيَتِهِ أَكْمَلَ عَلَى الْعِمَامَةِ ” انتهى .রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার কিছু অংশ মাসেহ করেছিলেন এমন বিষয়ে কোন হাদিস বর্ণিত হয়নি কিন্তু তিনি মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করেছিলেন আর পাগড়ীর উপরে তিনি পরিপূর্ণ মাসেহ করেছিলেন দ্বারা বর্ণিত হয়েছে।(যাদুল মা‘আদ,খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৯৩)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন: মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করার দ্বারা যথেষ্ট হয়ে গেছে কেননা পাগড়ীর উপরে তার সাথে মাথা মাসেহ করা হয়েছিল ফলে মাথার অগ্রভাগ শুধুমাত্র মাসেহ করাটা দলিল হিসেবে নেওয়া জায়েজ হবে না। (ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৭৮)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা তে বলা হয়েছে যে.
” الواجب مسح جميع الرأس في الوضوء ؛ لقوله تعالى :
(وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ) ولما أخرجه البخاري ومسلم عن عبد الله بن زيد بن عاصم رضي الله عنهما في صفة الوضوء قال : ( ومَسَحَ رسول الله صلى الله عليه وسلم بِرَأْسِهِ فَأَقْبَلَ بِيَدَيْهِ وَأَدْبَرَ ) , وفي لفظ لهما : ( بدأ بمقدم رأسه حتى ذهب بهما إلى قفاه , ثم ردهما إلى المكان الذي بدأ منه ) ” انتهى
অযুর ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন তোমরা তোমাদের মাথা মাসেহ করো। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম আবদুল্লাহ্ ইবনু যায়দ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে অযু করার বর্ণনা নিয়ে এসেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন: “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি) তার উভয় হাত দিয়ে সামনে এবং পেছনে একবার মাত্র মাথা মাসেহ করলেন। অন্য বর্ননা অনুযায়ী রাসূল (ﷺ) তার মাথার সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করে উভয় হাত পেছনের চুলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিলেন। তারপর আবার যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে আনলেন। (সহীহ বুখারী হা/১৮৫-১৮৬ ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ২২৭)।
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: ” ولو مسح بناصيته فقط دون بقيَّة الرَّأس فإنَّه لا يجزئه ؛ لقوله تعالى : ( وامسحوا برءوسكم ) المائدة/6 ولم يقل : (ببعض رؤوسكم)” انتهى .
কেউ যদি মাথার শুধু অগ্রভাগ মাসাহ করে আর মাথার বাকি অংশগুলো মাসাহ না করে, তাহলে তার জন্য ওযু যথেষ্ট হবে না কেননা আল্লাহ তায়ালা সুরা মায়িদাহ ৬ নং আয়াতে বলেছেন “তোমরা তোমাদের মাথা মাসাহ করো” তিনি বলেননি: “তোমাদের মাথার কিছু অংশ মাসেহ করো”। (ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৮৭)।
.
সুতরাং প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যেটা সর্বাধিক স্পষ্ট মনে হচ্ছে সেটা হল অজুর ক্ষেত্রে পুরো মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব, এক তৃতীয়াংশ নয়।
.
▪️এবার আমরা জানার চেষ্টা করবো মাথা মাসেহ করার বিশুদ্ধ পদ্ধতি কি?
.
রাসূল ﷺ এর হাদীসের আলোকে অযুতে মাথা মাসেহ করার দুটো পদ্ধতি উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন:

(১). যাদের চুল কিছুটা ছোট তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে: দুই হাত পানিতে ভিজানোর পর সেই হাত মাথার অগ্রভাগে রাখা; অতঃপর মাথার সামনে থেকে পেছনে পর্যন্ত মাসেহ করা। এরপর হাতদ্বয়কে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া। অর্থাৎ যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। এভাবে একবার মাসেহ করবে। এটিই রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের নিয়মিত সুন্নাত। তবে তিনবার করাও জায়েজ কেননা এই বিষয়ে উসমান (রাঃ) থেকে একটি আমল পাওয়া যায়। (আবুদাঊদ হা/১০৭, ১১০)। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অনেকে কান মাসেহকে ফরয মনে করেনা। অথচ কানসহ মাথা মাসোহ করা ফরয। কারণ রাসূল ﷺ বলেন, ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’।(তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪) তাছাড়া রসূল ﷺ একই পানিতে মাথা ও কান মাসেহ করতেন। যেমন- ثُمَّ غَرَفَ غَرْفَةً فَمَسَحَ رَأْسَهُ وَأُذُنَيْهِ ‘অতঃপর তিনি এক অঞ্জলি পানি নিতেন এবং মাথা ও দুই কান মাসেহ করতেন’।(সহীহ আবু দাঊদ হা/১৩৭; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১, সনদ সহীহ)।
.
উক্ত নিয়মে মাথা মাসেহ করার পক্ষে দলিল হচ্ছে: আবুল আযহার মুগীরাহ ইবনু ফারওয়াহ ও ইয়াযীদ ইবনু আবূ মালিক (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা মু‘আবিয়াহ (রাঃ) লোকদের দেখাবার উদ্দেশ্যে ঐভাবে অযু করলেন, যেভাবে তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অযু করতে দেখেছিলেন। তিনি (অযু করতে করতে) যখন মাথা মাসেহ্ পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন বাম হাতে এক অঞ্জলি পানি নিয়ে তা মাথার তালুতে দিলেন। ফলে সেখান থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল অথবা পড়ার উপক্রম হলো। অতঃপর তিনি (মাথার) সামনে থেকে পিছনের দিকে ও পিছন থেকে সামনের দিকে মাসেহ্ করলেন। (মুসনাদে আহমেদ: ৪/৯৪ আবু দাউদ হা/১২৪) অপর বর্ননায় মিকদাম ইবনু মা‘দীকারিব (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অযু করতে দেখেছি। অযু করতে করতে যখন তিনি মাথা মাসেহ্ পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তাঁর উভয় হাতের তালু মাথার সামনের অংশে রেখে পেছনের দিকে নিয়ে গেলেন। এমনকি তাঁর উভয় হাত পেছনের চুলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিলেন। অতঃপর তিনি উভয় হাত ঐ স্থানে ফিরিয়ে আনলেন, যেখান থেকে মাসেহ্ শুরু করেছিলেন। (আবু দাউদ হা/১২২) ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ) তার শারহ মুসলিমে বলেছেন যে, আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে এটি মুস্তাহাব। তবে এ পদ্ধতিতে চুল ছড়িয়ে পড়ে ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তাই নারীদের জন্য দ্বিতীয়টি হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি।
.
(২). গোটা মাথা মাসেহ করা; তবে চুল যেই দিকে ভাঁজ হয়ে আছে সেই দিক বিবেচনা করে। যাতে করে চুলের পজিশন পরিবর্তন বা এলোমেলো না হয়। যার চুল লম্বা (পুরুষ বা নারী) তার জন্য এই পদ্ধতিটি উপযুক্ত; যাতে করে হাতদ্বয় ফিরিয়ে নিতে গিয়ে তার চুল এলোমেলো হয়ে না যায়। এভাবে একবার মাসেহ করবে,তিনবার করাও বৈধ। এর মধ্যে কানদ্বয় মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত হবে যেমনটি উপরে উল্লেখ করেছি। এই নিয়মের দলিল হচ্ছে: রুবাঈ বিনতে মুআওয়িয বিন আফরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,একদা রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাসায় অযু করলেন; তখন তিনি মাথার চূড়া থেকে গোটা মাথা মাসেহ করলেন। মাথার প্রত্যেক দিক চুলের অভিমুখের দিকে মাসেহ করলেন। চুলের পজিশন নাড়ালেন না। [মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৪৮৪ আবু দাউদ হা/১২৮) উক্ত হাদিসের ভাষ্য: مِنْ قَرْن الشَّعْر (চুলের চূড়া) দ্বারা উদ্দেশ্য চূলের উপরের ভাগ। অর্থাৎ মাসেহ শুরু করবে চুলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। ইরাক্বী বলেন: “হাদিসের মর্ম হচ্ছে মাথার উপর থেকে মাসেহ শুরু করে মাথার নীচ পর্যন্ত মাসেহ করবে। আলাদা আলাদা ভাবে মাথার প্রত্যেক পার্শ্ব মাসেহ করবে।” (আওনুল মাবুদ থেকে সংকলিত ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৭১১০)।
.
উক্ত হাদীসের আলোকে হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বলী (রহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:যদি হাত পুনরায় ফিরালে চুল এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আশংকা করে তাহলে হাত ফিরাবে না। এটি ইমাম আহমাদের স্পষ্ট ভাষ্য। কারণ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: যার চুল কাঁধ পর্যন্ত; সে কিভাবে মাসেহ করবে? তখন ইমাম আহমাদ তাঁর হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনে একবার সঞ্চালন করলেন এবং বললেন: এভাবে করবে; যাতে করে তার চুল বিক্ষিপ্ত হয়ে না পড়ে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি মাথার পেছন পর্যন্ত একবার মাসেহ করবে; পুনরায় হাত ফিরিয়ে নেবে না। আহমাদ বলেন: আলী (রাঃ) এর হাদিসে এভাবে এসেছে। আর চাইলে মাসেহ করতেও পারেন; যেমনটি রুবাঈ’ এর হাদিসে এসেছে যে, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাসায় অযু করেছেন। তিনি তার গোটা মাথা মাসেহ করেছেন। চুলের চূড়া থেকে প্রত্যেক পার্শ্ব; চুলের অভিমুখের দিকে। চুলের পজিশন পরিবর্তন করেননি। [সুনানে আবু দাউদ]। আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: নারী কিভাবে মাসেহ করবেন? তিনি বললেন: এভাবে তারপর তিনি তাঁর হাত মাথার মধ্যখানে রাখলেন। এরপর হাতকে সামনের দিকে টেনে আনলেন। এরপর হাত উঠিয়ে পুনরায় আগের জায়গায় রাখলেন। এরপর মাথার পেছনের দিকে হাতকে টেনে নিলেন। ওয়াজিব অংশটুকুর মাসেহ সম্পূর্ণ করার পর যেভাবেই মাসেহ করুক সেটা জায়েয হবে। (ইবনে কুদামা ‘আল-মুগানী খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৮৭)।
.
উল্লেখ যে, নারীর জন্য মাথার চুল বাঁধা কিংবা বেনী করতে কোন অসুবিধা নেই এবং অযুর ক্ষেত্রে এগুলোর উপরেই তিনি মাসেহ করবেন। কিন্তু যদি নারীর মাথায় কোন সাজগোজের জিনিস থাকে; যেমন ফিতা, প্লাস্টিক টুকরা ইত্যাদি তাহলে সেগুলো খুলে ফেলা জরুরী; যদি এসব জিনিস মাথার একটি অংশ জুড়ে থাকে। কেননা দলিলের আলোকে বিশুদ্ধ কথা গোটা মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব। আল-বাজী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:وإذا كثّرت المرأة شعرها بصوف أو شعر لم يجز أن تمسح عليه لأنه لا يصل الماء إلى شعرها من أجله وإن وصل فإنما يصل إلى بعضه وهذا مبني على وجوب الاستيعاب “যদি কোন নারী কোন পশম বা কৃত্রিম চুল যোগ করে চুল বাড়ানোর চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে ওগুলোর ওপর মাসেহ করা জায়েয হবে না। কেননা ওগুলোর কারণে পানি তার সকল চুলে পৌঁছবে না। বরং কিছু চুলে পৌঁছবে। এই অভিমত সব চুল মাসেহ করা ওয়াজিব এর উপর নির্ভরশীল”। (আল-মুনতাক্বা: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৮)।

বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে ‘নারীর বাঁধা চুলের উপর মাসেহ করার হুকুম সম্পর্কে’ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন:
: “يجوز أن تمسح المرأة على رأسها سواءً كان ملفوفاً أو نازلاً ، ولكن لا تلف شعر رأسها فوق وتبقيه على الهامة لأني أخشى أن يكون داخلاً في قول النبي صلى الله عليه وسلم: (ونساء كاسيات عاريات رؤوسهن كأسنمة البخت المائلة لا يدخلن الجنة ولا يجدن ريحها ، وإن ريحها ليوجد من مسيرة كذا وكذا)” انتهى من
“অর্থাৎ “নারীর জন্য তার মাথার উপর মাসেহ করা জায়েয; তার চুল বাঁধা থাকুক কিংবা ছাড়া থাকুক। তবে নারী তার মাথার চুল মাথার উপরের অংশে উটের কুঁজের মত করে বাঁধবে না। কেননা এতে করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তির অধীনে পড়ে যাওয়ার আশংকা করছি: “এমন নারী যারা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ। তাদের মাথা উটের বাঁকা কুঁজের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা: ১৫২)।
.
আরো একটি বিষয় জেনে রাখা ভাল, ওযু করার সময় মহিলাদের মাথার ওড়না বা হিজাবের উপর দিয়ে মাসেহ করা যাবে কিনা এটি নিয়ে সালাফগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে,সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, مَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ وَمُقَدَّمِ رَأْسِهِ وَعَلَى عِمَامَتِهِ ‏.‏ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় মোজার উপর এবং মাথার সম্মুখভাগ ও পাগড়ীর উপর মাসাহ করেন।(সহীহ মুসলিম হা/৫২২ ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫২৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ৫৪১) এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে ইবনে হাযম সহ কিছু আলেম, মহিলাদের মাথার হিজাব বা ওড়নার উপর মাসেহ করা বৈধ বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন।وكل ما لُبس على الرأس من عمامة أو خمار أو قلنسوة أو بيضة أو مغفر أو غير ذلك: أجزأ المسح عليها، المرأة والرجل سواء في ذلك، لعلة أو غير علة (আল-মুহাল্লা”: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা:৩০৩) কিন্তু সরাসরি এ ব্যাপারে সহীহ দলীল পাওয়া যায় না।
.
এজন্য শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:”وعلى كُلِّ حالٍ: إِذا كان هناك مشقَّة إِما لبرودة الجوِّ، أو لمشقَّة النَّزع واللَّفّ مرَّة أخرى: فالتَّسامح في مثل هذا لا بأس به، وإلا فالأوْلى ألاَّ تمسح، ولم ترد نصوصٌ صحيحة في هذا الباب “ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে কষ্ট হলে বা মাথা থেকে খুলে পূনরায় মাথায় হিজবা বাধা যদি কষ্টকর মনে হয় তাহলে তারা মাথার হিজাব/উড়নার উপর মাসেহ কতে কোন অসুবিধা নেই। আর এমনটি না হলে তার উপর মাসেহ না করাই উত্তম। কেননা, এ ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল বর্ণিত হয় নি।” (যাদুল মুস্তাকনা: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৩৯ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৮১২৯) সুতরাং আমরা বলব, বিশেষ কোন ওজর থাকলে মহিলাদের মাথার ওড়ানা বা হিজাবের উপর মাসেহ করা জায়েয রয়েছে। যেমন, ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মাথা খুলে মাসেহ করলে পর পুরুষ দেখার সম্ভাবনা, মাথায় মেহদী দিয়ে কাপড়ের মাধ্যমে চুল বাধা থাকলে বা খোলার পর পূণরায় বাধা কষ্টকর ইত্যাদি। অন্যথায় মাসেহ করা ঠিক নয়।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যেটা সর্বাধিক স্পষ্ট মনে হচ্ছে সেটা হল অজুর ক্ষেত্রে পুরো মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব, এক তৃতীয়াংশ নয়। পাশাপাশি অযূতে গাড় মাসাহ করার বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই, তাই আহালুল আলেমগন এটিকে বিদআত বলেছেন। আশা করি সবাই পরিস্কার ভাবে মাসায়ালাটি বুঝতে পেরেছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।