সালাতুল ইস্তিখারা সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: সালাতুল ইস্তিখারা কী? যেকোনো কাজে কল্যাণ লাভ করার জন্য ‘ইস্তিখারা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। আজ আমরা ইস্তিখারা সম্পর্কে আলোচনা করবো। যদিও লিখাটি একটু বড় তবে পড়লে উপকৃত হবেন ইন শাহ্ আল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
❑ ইস্তিখারা কী: আরবি ‘ইস্তিখারা’استخارة শব্দের অর্থ হলো কল্যাণ কামনা করা, ভালো কিছু চাওয়া। ইমাম ইবনে হাজার রহঃ বলেন,ইস্তিখারা শব্দটি বিশেষ্য। আল্লাহ্‌র কাছে ইস্তিখারা করা মানে কোন একটি বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র সাহায্য চাওয়া। উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তিকে দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় বাছাই করে নিতে হবে, সে যেন ভালটিকে বাছাই করে নিতে পারে সে প্রার্থনা।

শরীয়তের পরিভাষায় ইস্তিখারা হলো,যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করলে, কাজটি করার পূর্বে আল্লাহর সাথে পরামর্শ পথনির্দেশনা চেয়ে সেই কাজটির মধ্যে কল্যাণ প্রার্থনা করা এবং কাজটিতে কোনো অকল্যাণ থাকলে আল্লাহ্ যেন তা দূর করে দেন এবং সঠিক পথনির্দেশ দেখিয়ে দেন, সেটি কামনা করা। অর্থাৎ যেকোন বৈধ বিষয় বা কাজে (যেমন ব্যবসা, সফর, বিবাহের ব্যাপারে) ভালো মন্দ বুঝতে না পারলে, মনে ঠিক-বেঠিক, উচিৎ-অনুচিত বা লাভ-নোকসানের দ্বন্দ্ব হলে আল্লাহর নিকট মঙ্গল প্রার্থনা করতে দুই রাকআত নফল সালাত পড়ে ইস্তিখারার দু’আ পাঠ করা সুন্নত। আরো সহজ করে বলতে গেলে ইস্তিখারা করা হয় দুটো বৈধ কাজের মধ্যে কোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে। ধরুন, একই সাথে দুটো চাকরির অফার এসেছে। দুটো চাকরিই হালাল। বুঝতে পারছেন না, কোনটিতে জয়েন করবেন কিংবা কোনটি আপনার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে। তখন আপনি ইস্তিখারা করবেন। আশা করা যায়, আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন।
.
❑ ইস্তিখারা কখন করতে হয়? ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে দুই ক্ষেত্রে ইস্তিখারা করা যায়। যেমন:
.
➤১। যখন কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে চায়, তখন ইস্তিখারা করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা। যেমন: কোনো কষ্টকর ঝুঁকিপূর্ণ সফরে বের হওয়ার আগে ইস্তিখারা করা। ইস্তিখারার পর যদি মন সায় দেয়, তবে বের হবে, অন্যথা অন্য চিন্তা করবে বা অন্যদিন বের হবে। এভাবে যেকোনো কাজ শুরু করার আগে ইস্তিখারা করা উত্তম।
.
➤২। যখন দুটো বৈধ কাজের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয়, তখন ইস্তিখারার মাধ্যমে তুলনামূলক ভালো (better) কাজটি নির্বাচন করার জন্য আল্লাহর তাওফিক চাওয়া। বিশেষত, যে কাজটিতে অধিক কল্যাণ রয়েছে, সেটি কামনা করা। যেমন: একই সাথে দুটো চাকরি হলো বা দুটো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ এলো কিংবা বিয়ের দুটো প্রস্তাব এলো। এমতাবস্থায় একটিকে বেছে নিতে হবে, কিন্তু আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তখন ইস্তিখারা করবেন। এরপর মন যেটির দিকে সায় দেবে, সেটি বেছে নেবেন।
.
❑ ইস্তিখারার গুরুত্ব ও উপকারিতা:
.
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ্ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রতিটি বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) ইস্তিখারা করতে শেখাতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সুরা শেখাতেন।’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১১৬২]। ইস্তিখারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। ইস্তিখারা করে কোনো কাজ করলে, সেই কাজে গতি পাওয়া যায় এবং এতে আল্লাহর সাহায্য থাকে। ইস্তিখারা করার মাধ্যমে হীনম্মন্যতা দূর হয় এবং মানসিকভাবে সুদৃঢ় থাকা যায়।
.
ইস্তিখারা করার পর আর পেছনে না তাকিয়ে কাজে নেমে পড়তে হয়। কারণ ইস্তিখারার পর যে সিদ্ধান্তটিতে মন সায় দেবে, সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, ধরে নিতে হয়। এ ব্যাপারে উমার (রা.) বলেন, ‘কোনো কোনো মানুষ ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য (সিদ্ধান্ত) বাছাই করে দেন। কিন্তু (বাহ্যিক দৃষ্টিতে বান্দার কাছে তা কল্যাণকর মনে না হওয়ায়) সে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এরপর যখন বিষয়টির সুন্দর পরিণাম দেখতে পায়, তখন বুঝতে পারে, সেই ফায়সালা তার জন্য কতো কল্যাণকর ছিলো।’ [ইমাম ইবনুল মুবারক, কিতাবুয যুহদ: ১২৮]।
.
❑ইস্তেখারা করা কতটুকু সঠিক?
.
এই ব্যাপারে ইতিহাস বিখ্যাত ইমাম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন: “সে ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তেখারা করে এবং মানুষের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।” আল্লাহ তাআলা বলেন:“আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরামর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদের পছন্দ করেন।“ [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]।

কাতাদা (রহঃ) বলেন: “মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তাওফীক দেন।” ইমাম নববী রহ. বলেন: “আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরিমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দুর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়। (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং ১১৯৮১)।
.
❑ ইস্তিখারার সংক্ষিপ্ত রূপ: ইস্তিখারার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হল:
.
প্রথমে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অযু করা, তারপর ইস্তেখারার উদ্দেশ্যে দুই রাকআত সাধারণ নফল সালাতের ন্যায় সালাত আদায় করা। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই।এক্ষেত্রে সূরা ফাতেহার পর যেকোন সূরা পড়া যায় তারপর সালাত শেষে সালাম ফিরিয়ে আল্লাহ তায়ালা বড়ত্ব ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও আন্তরিকতা সহকারে অর্থের দিকে খেয়াল রেখে নিচের দুয়াটি পাঠ করা। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা করবে, প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর বলবে:
.
اَللّٰهُمّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ
আল্লাহুম্মা ইন্নী আসতাখীরুকা বি‘ইলমিকা
[হে আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের উসিলায় আপনার কাছে (আমার উদ্দিষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই]
.
وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ
ওয়া আসতাক্বদিরুকা বিক্বুদরাতিকা
[আপনার কুদরতের উসিলায় আপনার কাছে (কল্যাণ অর্জনের) শক্তি চাই]
.
وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ
ওয়া আসআলুকা মিন ফাদ্বলিকাল ‘আযীম
[আর আপনার কাছে আপনার মহান অনুগ্রহের কিছুটা আমি চাই]
.
فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ
ফাইন্নাকা তাক্বদিরু, ওয়া লা আক্বদির
[কেননা, (সকল বিষয়ে) আপনার ক্ষমতা রয়েছে; আমার কোনো ক্ষমতা নেই]
.
وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ
ওয়া তা‘অ্লামু, ওয়া লা আ‘অলাম
[আপনি (সবকিছু) জানেন, আমি কিছুই জানি না]
.
وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوْبِ
ওয়া আনতা ‘আল্লামুল গুয়ূব
[আপনি অদৃশ্যের সকল বিষয়ে সর্বজান্তা]
.
اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ
আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তা‘অ্লামু
[হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন]
.
أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ
আন্না ★হাযাল আমরা★ খাইরাল লী
[★এই কাজটি★ আমার জন্য কল্যাণকর]
.
فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ
ফী দী-নী, ওয়া মা‘আ-শী, ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী [আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে]
.
فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ
ফাক্বদুরহু লী, ওয়া ইয়াসসিরহু লী
[তাহলে আমার জন্য তা নির্ধারণ করে দিন এবং বিষয়টিকে আমার জন্য সহজ করে দিন]
.
ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ
সুম্মা বা-রিক লী ফীহি
[অতঃপর এতে আমার জন্য বরকত দান করুন]
.
وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ
ওয়া ইন কুনতা তা‘অ্লামু
[আর, যদি আপনি জানেন]
.
أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ
আন্না ★হাযাল আমরা★ শাররুল লী
[★এই কাজটি★ আমার জন্য অকল্যাণকর]
.
فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ
ফী দী-নী, ওয়া মা‘আ-শী, ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী [আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে]
.
فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ
ফাসরিফহু ‘আন্নী, ওয়াসরিফনী ‘আনহু
[আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন]
.
وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ
ওয়াক্বদুর লিয়াল খাইরা ‘হাইসু কা-না
[আর আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন; তা যেখানেই হোক]
.
ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِه
সুম্মা আরদ্বিনী বিহি
[অতঃপর তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন]
.
জাবির (রা) বলেন, দু‘আটির যে দুই জায়গায় هَذَا الأَمْرَ হাযাল আমর (যার অর্থ) ‘‘এই কাজটি’’ বলা আছে, সেখানে নিজ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। (কিংবা অন্তত মনে মনে সেটি কল্পনা করবে) [সহীহ বুখারি ১১৬৬; তিরমিযি ৪৮০; আবুদাঊদ হা/১৫৩৮; মিশকাত হা/১৩২৩ ‘ঐচ্ছিক সালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৯; মির‘আত ৪/৩৬২)। উক্ত দু‘আ শেষ করার পর মন যেদিকে সায় দেবে এবং যেভাবে কাজটি করা কল্যাণকর মনে হবে, সেটিকে সঠিক ভেবে কাজ শুরু করবেন। ধরুন, আপনার কোথাও যাওয়া দরকার আবার বাসার মধ্যেও থাকা দরকার। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তখন ইস্তিখারা করবেন। ইস্তিখারার পর যদি মনে হয়, বাসায় থাকাটাই আপনার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে, তাহলে আপনি সেটিই করবেন এবং ভেবে নিবেন, এই সিদ্ধান্তটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে আর এতেই আপনার কল্যাণ রয়েছে।
.
ইস্তিখারা করার সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের জন্য ইস্তিখারা করলে এক বেলা বা কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিনও অপেক্ষা করতে পারেন। তবুও সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হলে প্রয়োজনে একাধিকবার ইস্তিখারা করতে পারেন। এটিও জায়েয। এরপর মন যেদিকে ঝুঁকবে, সেদিকেই কল্যাণ আছে ভেবে নেবেন। এর সাথে সাথে নিজের বিবেক-বুদ্ধির সাহায্য নেবেন এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সাথেও পরামর্শ করবেন।

❑প্রিয় পাঠক,যেকোনো বৈধ কাজে (হোক সেটি দ্বীনি অথবা দুনিয়াবি) সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং কাজটিতে সফলতা ও কল্যাণ লাভ করতে তিনটি কাজ করুন।
_______________________________________
➤ (১) প্রথমে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করে সেই কাজ ও সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, উপকারী-অনুপকারী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবুন।নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমার জন্য যা কল্যাণকর, তা অর্জনের জন্য তুমি প্রলুব্ধ হও আর আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও। কখনই হতাশ হবে না।’’ [সহিহ মুসলিম: ২৬৬৪]।
.
➤(২) এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দু‘আর মাধ্যমে ইস্তিখারা করুন ও আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করুন। [সহিহ বুখারি: ১১৬৪, তিরমিযি: ৪৮০]।
.
➤(৩) একই সাথে আপনার আপনজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করুন। আল্লাহ্ বলেন, ‘‘তুমি তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]।

❑পরামর্শ আগে না ইস্তেখারার নামায আগে?* এ ব্যাপারে আহালুল আলেমগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে সবচেয়ে সঠিক হল, বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এর মত যা তিনি রিয়াদুস সালিহীনের ব্যাখ্যা গ্রন্থে প্রাধান্য দিয়েছেন।তিনি বলেন, আগে ইস্তেখারার সালাত আদায় করতে হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ তোমাদের কেউ কোন কাজের মনস্থ করলে সে যেন, (সালাতুল ইস্তিখারার) দুরাকাআত সালাত আদায় করে।” এখানে প্রিয় নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করার কথা বলেছেন। (সহীহ বুখারী:১১৬৬; রিয়াদুস সালেহীন: ৭২২; হাদীসের ব্যাখ্যা দষ্টব্য)।

❑ইস্তিখারা সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে রাখা ভাল। যেমন:
_______________________________________
➤(১) মহানবী (ﷺ) এই দুআ সাহাবীগণকে শিখাতেন, যেমন কুরআনের সূরা শিখাতেন। আর এখান থেকেই ছোট-বড় সকল কাজেই ইস্তিখারার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।তাই ছোট-বড় সকল বিষয়ে ইস্তিখারা করার অভ্যাস গড়ে তোলা ভাল।

➤(২) একটি বিষয়ের জন্য একবার ব্যতীত একাধিকবার ‘সালাতুল ইস্তেখা-রাহ’ আদায়ের কথা রাসূল (ﷺ) থেকে স্পষ্টভাবে কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো দো‘আ করলে একই সময়ে তিনবার করে দো‘আ করতেন এবং কিছু চাইলে তিনবার করে চাইতেন। (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭, ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-৪)। এই সহীহ হাদীসের উপরে ভিত্তি করে ইস্তেখারাহর দো‘আ পাঠের উদ্দেশ্যে অত্র সালাত ইস্তিসক্বার সালাতের ন্যায় একাধিকবার পড়া যায় বলে ইমাম শাওকানী মন্তব্য করেছেন। ইমাম নববী বলেন, উক্ত দো‘আ পাঠের সময় হৃদয়কে যাবতীয় ঝোঁক প্রবণতা হতে খালি করে নিতে হবে এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করতে হবে। নইলে ঐ ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে কল্যাণপ্রার্থী না হয়ে বরং নিজের প্রবৃত্তির পূজারী হিসাবে গণ্য হবে।(নায়লুল আওত্বার ৩/৩৫৬, ‘ইস্তেখা-রাহর সালাত’ অনুচ্ছেদ)। তবে একটি বিষয়ে একাধিকবার ইস্তিখারার বিষয়ে সাহাবিগণের আমল পাওয়া যায়। যেমন: আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা.) কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণ করার আগে তিন দিন ইস্তিখারা করেন। এরপর সেই কাজ করেন। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৩১৩৬]। অতএব, কোনো বিষয়ে একাধিকবার ইস্তিখারা করা জায়েয। তবে, একবার করা উত্তম। সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে একাধিকবার করা যায়।
.
➤(৩) খুব তাড়াহুড়া বা একান্ত জরুরী প্রয়োজন না হলে যে সকল সময়ে সাধারণ নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ সে সকল সময়ে সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকুন। তবে তাড়াহুড়া থাকলে নিষিদ্ধ সময়গুলোতেও তা পড়া যাবে।

➤ (৪) মহিলাদের ঋতু স্রাব বা সন্তান প্রসব জনিত রক্ত প্রবাহের সময় অন্যান্য সালাতের ন্যায় সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে এমতাবস্থায় নামায না পড়ে শুধু ইস্তিখারার দুয়াটি পড়া যাবে।

➤(৫) ইস্তিখারা করতে হবে হাদিসে বর্ণিত উপায়ে। কোনো অনির্ভরযোগ্য বইয়ের নিয়মে এটি করা যাবে না। ইস্তিখারা নামাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সুরা নেই। যেকোনো সুরাই পড়া যাবে। ইস্তিখারার দুয়া মুখস্ত না থাকলে দেখে দেখে তা পড়তে অসুবিধা নেই। তবে মুখস্ত করার চেষ্টা করা ভাল।ইস্তিখারার দুয়াতে যেন অতিরিক্ত কোন শব্দ যোগ না হয় বা সেখান থেকে কোন শব্দ বাদ না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। বরং হাদীসে বর্ণিত শব্দাবলী যথাযথভাবে পড়ার চেষ্টা করুন।

➤(৬) ইস্তিখারার পর মন যেদিকে ঝুঁকবে সেই দিকটি ইসলামী শরিয়ত ও সুস্থ বিবেকের বিচারেও উত্তম হওয়া জরুরি। কোনো হারাম বা নাজায়েয কাজে ইস্তিখারা নেই। কেবল বৈধ কাজের ব্যাপারেই ইস্তিখারা করা যায়।
.
➤(৭) একথাও মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী ভালো-মন্দ উভয়ের সমষ্টি। তাই ইস্তিখারার পর যে দিকটি অবলম্বন করা হবে, তাতে ইনশাআল্লাহ কল্যাণের অংশই বেশি হবে। তবে, অকল্যাণের কিছু অংশ তাতে থাকা বিচিত্র নয়। অর্থাৎ অধিক কল্যাণের বিবেচনাই এখানে মূখ্য বিষয়।

➤(৮) ইস্তিখারার পর যে পথ ও পন্থা অবলম্বন করা হবে, ইনশাআল্লাহ তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হবে। অর্থাৎ ইসতিখারার পর বান্দার জন্য কল্যাণের পথই উন্মুক্ত হবে। অকল্যাণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এই কল্যাণ ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নিজের খারাপ আমল, উদাসীনতা কিংবা অন্য কোনো কারণে সেই কল্যাণ যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: ইস্তিখারার পর কোনো গাড়ি, বাড়ি বা কোনো জমি সংগ্রহ করা হলো, কিংবা কোনো মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হলো বা ছেলেকে বিয়ে করানো হলো; এখন এসবের হক আদায় করে সেই কল্যাণ বজায় রাখতে হবে। নিজের কোনো খারাপ আমলের কারণে যদি কোনো ধরনের অকল্যাণ প্রকাশ পায়, সেটার জন্য ইস্তিখারাকে দোষারোপ করা যাবে না।
.
➤(৯) আখিরাতের কল্যাণই মুমিনের প্রকৃত কল্যাণ। সুতরাং দুনিয়ার জীবনে যদি কোনো সমস্যা, সংকট বা পেরেশানি হয়, কিন্তু আখেরাতের হিসাবে তা কল্যাণকর হয়, তাহলে এতেই মুমিনের অধিক কল্যাণ। সুতরাং ঈমানদারকে আল্লাহর যেকোনো ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটি বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার, হয়তো কোনো একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্য তা অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সুরা বাকারাহ, আয়াত: ২১]।
.
➤(১০) স্বপ্ন শরিয়তের দলিল নয়। তাই, ইস্তিখারার রেজাল্ট জানার জন্য স্বপ্নের মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়ার ধারনা সঠিক নয়। সুতরাং ইস্তিখারা দিনে বা রাতের যেকোনো সময় বা রাতের যেকোনো সময়েই করতে পারেন।ছাহেবে মির‘আত বলেন, ইস্তেখারাহর পরে যেটা প্রকাশিত হয় বা ঘটে যায়, সেটাই করা উচিৎ। এজন্য তাকে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং স্বপ্ন দেখা বা কাশ্ফ হওয়া অর্থাৎ হৃদয় খুলে যাওয়া শর্ত নয়।(মির‘আত ৪/৩৬৫।)
.
➤(১১) নিজে না করে অন্যকে দিয়ে ইস্তিখারা করানো একটি ভুল পদ্ধতি। তবে, সন্তানাদির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে বাবা-মা ইস্তিখারা করতে পারবেন।
.
➤(১২) অদৃশ্যের বিষয় জানার জন্য ইস্তিখারা করা শির্ক। তাছাড়া, এটি হাস্যকর ব্যাপার। এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইস্তিখারা মানে কল্যাণ কামনা করা; কোনো অদৃশ্য বিষয় জানা নয়।
.
➤(১৩) ইস্তিখারা করার পর আর হীনম্মন্যতায় ভোগা উচিত নয়। বরং দৃঢ় মনোবল রাখা উচিত। আল্লাহ বলেন, “আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ফেল, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো।” [সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]। তবে, ইস্তিখারা করার পর দেখা গেলো, যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন, সেটিতে সরাসরি সমস্যা হচ্ছে। তখন কোনো আলিমের সাথে বিষয়টি শেয়ার করতে পারেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
.
❑পরিশেষে,ইস্তিখারা সম্পর্কে উমর (রা.)-এর একটি মূল্যবান মন্তব্যের মাধ্যমে শেষ করছি। উমর (রা.) বলেন, অনেক সময় মানুষ ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তার জন্য সেই বিষয়টিই নির্বাচন করেন, যাতে তার কল্যাণ নিহিত। কিন্তু (বাহ্যিক দৃষ্টিতে বান্দার কাছে তা কল্যাণকর মনে না হওয়ায়) সে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এরপর যখন বিষয়টির সুন্দর পরিণাম দেখতে পায়, তখন সে বুঝতে পারে, সেই ফায়সালা কত কল্যাণময় ছিল।’ [ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃষ্ঠা ৩৩, রিওয়ায়াত: ১২৮]।
.
উমর (রা.) এর কথাটি যেন কুরআনের একটি আয়াতেরই ব্যাখ্যা। আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটি বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার, হয়তো কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্য তা অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ২১]।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।