সালাতুত তাসবিহ

প্রশ্ন: সালাতুত তাসবিহ কি? সালাতুত তাসবীহ’ আদায় করার হুকুম কি? কিভাবে আদায় করতে হয় সালাতুত তাসবিহ?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আরবি: (صلاة تسبيح) সালাতুত তাসবিহ অর্থাৎ তাসবিহ’র সালাত। অধিক তাসবীহ পাঠের কারণে এই সালাতকে ‘সালাতুত তাসবীহ’ বলা হয়। এটি ঐচ্ছিক সালাত সমূহের অন্তর্ভুক্ত।

❖ কেন এর নাম ‘সালাতুত তাসবিহ’? সালাতুত তাসবিহ মানে তাসবিহ’র সালাত। যেহেতু এই সালাতে প্রচুর পরিমাণে (৩০০ বার) তাসবিহ (আল্লাহর পবিত্রতা ও গুণ বর্ণনা) পাঠ করা হয়, তাই এই সালাতের নামকরণ হয়েছে সালাতুত তাসবিহ।
.
❖ এই সালাতের দলিল কী? ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে বলেন, ‘‘হে চাচা! আমি কি আপনাকে (বিশেষ কিছু) দেবো না? আমি কি আপনাকে (গুরুত্বপূর্ণ কিছু) প্রদান করবো না? আমি কি আপনার নিকটে (উপঢৌকন) উপস্থাপন করবো না? আমি কি আপনার জন্য দশটি উপকার বর্ণনা করবো না, যা করলে আল্লাহ তা‘আলা আপনার পূর্ব ও পরবর্তী, নতুন ও পুরাতন, ইচ্ছায় ও ভুলবশত, ছোট ও বড়, গোপন ও প্রকাশ্য সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন?
.
আর সে দশটি উপকারি ব্যাপার হল: আপনি চার রাকাআত সালাত পড়বেন। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বেন। প্রথম রাকাআতে যখন কিরাত (অর্থাৎ সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা) পড়া শেষ করবেন, তখন দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার বলবেন:
.
سُبْحَانَ اللّٰهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ
.
[সুবহা-নাল্লা-হি ওয়ালহামদু লিল্লা-হি ওয়ালা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার]
.
এরপর রুকুতে যাবেন এবং রুকু অবস্থায় (উক্ত দু‘আটি) ১০ বার পড়বেন। এরপর রুকু থেকে মাথা ওঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদায় যাবেন। সিজদারত অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন, অতঃপর ১০ বার পড়বেন। এরপর আবার সিজদায় যাবেন এবং সিজদারত অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। অতঃপর, সিজদা থেকে মাথা ওঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এই হল এক রাকাতে ৭৫ বার।
.
আপনি চার রাকাআতেই অনুরূপ করবেন।
.
যদি আপনি প্রতিদিন (এই) আমল করতে পারেন, তবে তা করুন। আর যদি না পারেন, তবে প্রতি জুমু‘আয় (সপ্তাহে) একবার। যদি প্রতি জুমু‘আয় না করেন, তবে প্রতি মাসে একবার। আর যদি তাও না করেন, তবে জীবনে একবার হলেও এই আমল করুন।
.
[আবু দাউদ, আস-সুনান: ১২৯৭; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৩৮৭; আলবানি, সহিহুল জামি’: ৭৯৩৭]
.
❖উপরোক্ত হাদিসটি কি সহীহ? উপরোক্ত এই হাদিসটিকে ইমাম আবু দাউদ, ইবনু হাজার আসকালানি, শায়খ আলবানি (রাহ.) সহ অধিকাংশ মুহাদ্দিস সহিহ বা হাসান (গ্রহণযোগ্য) বলেছেন। শুধু তাই নয়, আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস হিসেবে খ্যাত ইমাম আবদুল্লাহ্ ইবনু মুবারক (রাহ.) এই হাদিসের উপর আমল করেছেন। পরবর্তীতেও নেককার ব্যক্তিগণ এই আমল করেছেন। [ইবনু আবদিল বার, আত তামহিদ: ১/৬২]।

তবে, মুহাদ্দিসগণের অপর একটি অংশ হাদিসটিকে দুর্বল বলেছেন। তাঁদের মতে, এই হাদিসটির সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র) সহিহ হলেও মতন (মূল টেক্সট) শায (অভিনব ও বিচ্ছিন্ন)। যাঁরা হাদিসটিকে দুর্বল অথবা মুনকার (আপত্তিকর) বলেছেন, তাঁদের মতে, এই আমলটি বিদ‘আত। এঁদের মধ্যে একজন হলেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)। তিনি বলেছেন, ‘নবী (ﷺ) থেকে এ হাদীস সহীহ সূত্রে বর্ণিত নয়।’ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ বলেন, ‘উক্ত সালাতের হাদীসটি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর প্রতি আরোপিত মিথ্যা।’ উক্বায়লী, ইবনুল আরাবী, ইমাম নাবাবী রহ, ইবনু আকিল হাদী, আল মাজী এবং ইবনুল জাওযী এ হাদীসকে জাল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।(মিসকাতুল মারাফিহ, ১৩২৮ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলেম ইবনে বায রহঃ এবং ইবনে উসাইমীন রহঃ না পড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। (মাজমু’ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন (রহ:)১৪/৩২৭)।

প্রকৃত প্রস্তাবে যে ব্যক্তি এ হাদীসটি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করবে, সে দেখতে পাবে যে, এতে রয়েছে একাধিক উদ্ভট্টি। এমনকি সালাতটি বিধিবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও উদ্ভট্টি লক্ষণীয়। কেননা, ইবাদত হয় হৃদয়ের জন্য উপকারী হবে। আর তা হলে ঐ ইবাদত সর্বকাল ও সর্বস্থানের জন্য বিধিবদ্ধ হবে। নচেৎ তা উপকারী হবে না। আর তা হলে তা বিধিবদ্ধই নয়। বলা বাহুল্য, উক্ত হাদীসে যে সালাতের কথা বলা হয়েছে যে, তা প্রত্যেক দিন অথবা প্রত্যেক সপ্তাহ্‌ অথবা প্রত্যেক মাস অথবা প্রত্যেক বছরে একবার। আর তা না পারলে জীবনেও একবার পড়বে এমন কথার নযীর শরীয়তে মিলে না। সুতরাং উক্ত হাদীসটি তার সনদ ও মতন (বর্ণনা সূত্র ও বক্তব্য) উভয় দিক দিয়েই যে উদ্ভট, তা স্পষ্ট হয়। আর যিনি হাদীসটিকে মিথ্যা বলেছেন, যেমন শায়খুল ইসলাম বলেছেন, তিনি ঠিকই বলেছেন। এ জন্য শায়খুল ইসলাম আরো বলেছেন, ‘ইমামগণের কেউই এই সালাতকে মুস্তাহাব মনে করেননি।’

সালাতুত তাসবীহ আদায় করা সম্পর্কে সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ মন্তব্য করেছেন, صَلَاةُ التَّسْبِيْحِ بِدْعَةٌ وَحَدِيْثُهَا لَيْسَ بِثَابِتٍ بَلْ هُوَ مُنْكَرٌ وَذَكَرَهُ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ فِى الْمَوْضُوْعَاتِ ‘সালাতুত তাসবীহ’ বিদ‘আত। এর হাদীস প্রমাণিত নয়; বরং মুনকার বা অস্বীকৃত। কোন কোন মুহাদ্দিস জাল হাদীসের মধ্যে একে উল্লেখ করেছেন।’ [ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪ ফৎওয়া নং ২১৪১]। তাই বিষয়টি দ্বিধামুক্ত নয় তাই এরূপ বিতর্কিত, সন্দেহযুক্ত ও দুর্বল ভিত্তির উপরে কোন ইবাদত বিশেষ করে সালাত প্রতিষ্ঠা করা যায় না বিধায় ‘হাদীস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ এর ‘দারুল ইফতা’ বিষয়টি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। (ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) এর বিস্তারিত আলোচনা; আলবানী, মিশকাত পরিশিষ্ট, ৩ নং হাদীস ৩/১৭৭৯-৮২ পৃঃ; আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩২৮ হাশিয়া; বায়হাক্বী ৩/৫২; আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ, মাসায়েলে ইমাম আহমাদ,মাসআলা নং ৪১৩, ২/২৯৫ পৃঃ; মির‘আত ৪/৩৭২-৭৫)

❖ এখন কেউ পড়তে চাইলে যেভাবে পড়বেন সালাতুত তাসবিহ:
__________________________________
সালাতুত তাসবিহ দিনে রাতে যেকোন সময় পড়া যায়। প্রথমে সালাত শুরু করবেন আল্লাহু আকবার বলে। এরপর সানা পড়বেন, এরপর সূরা ফাতিহা ও একটি সূরা মিলাবেন। এরপর ১৫ বার তাসবিহটি পড়বেন। তাসবিহটি হলো: সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।
.
এরপর রুকুতে আরো ১০ বার পড়বেন।
.
এরপর রুকু হতে দাঁড়িয়ে “রাব্বানা লাকাল হামদ” পড়ার পরে আরও ১০ বার পড়বেন।
.
এরপর সিজদায় ১০ বার পড়বেন।
.
প্রথম সিজদা থেকে ওঠে বসে ১০ বার পড়বেন। (অর্থাৎ দুই সিজদার মাঝে বসা অবস্থায়)
.
এরপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে ১০ বার পড়বেন।
.
এরপর সিজদা থেকে ওঠে একটু সময়ের জন্য বসবেন; বসে আরও ১০ বার পড়বেন। মোট হলো: ৭৫ বার।
.
এরপর দ্বিতীয় রাকাতের জন্য ওঠে দাঁড়াবেন। প্রথমে সূরা ফাতিহা পড়বেন এবং অন্য সূরা পড়বেন। অতঃপর আবার ১৫ বার পড়বেন। এরপর রুকুতে ১০ বার, রুকু থেকে দাঁড়িয়ে ১০ বার, প্রথম সিজদায় ১০ বার, সিজদা থেকে ওঠে ১০ বার, দ্বিতীয় সিজদায় ১০ বার, এরপর সিজদা থেকে ওঠে বসবেন। বসে আরও ১০ বার পড়বেন। এরপর তাশাহ্হুদ পড়বেন। আরো হলো ৭৫ বার। মোট: ১৫০ বার।
.
এরপর তৃতীয় রাকাতের জন্য ওঠে যাবেন। এরপর সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পড়ে ১৫ বার, রুকুতে ১০ বার, রুকু থেকে সোজা হয়ে ১০ বার, সিজদায় ১০ বার, সিজদা থেকে ওঠে ১০ বার, দ্বিতীয় সিজদায় ১০ বার এবং দ্বিতীয় সিজদা থেকে ওঠে অল্প সময় বসবেন। তখন আরও ১০ বার পড়বেন। পড়া শেষে আবার ওঠে দাঁড়াবেন। আরো হলো: ৭৫ বার। মোট: ২২৫ বার।
.
এরপর চতুর্থ রাকাতে প্রথমে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পড়ে ১৫ বার, রুকুতে ১০ বার, রুকু থেকে ওঠে ১০ বার, সিজদায় ১০ বার, সিজদা থেকে ওঠে ১০ বার, দ্বিতীয় সিজদায় আবার ১০ বার, সিজদা থেকে ওঠে বসবেন। বসে আরও ১০ বার পড়বেন। পড়ার পর তাশাহহুদ ও দরুদ পড়বেন। (জানা থাকলে) দু‘আ মাসুরাও পড়বেন। এরপর সালামের মাধ্যমে নামাজ শেষ করবেন। এই রাকাতে আরো হলো ৭৫ বার। মোট: ৩০০ বার।

❖ বিশেষ কিছু জ্ঞাতব্য:
.
(১) কোনো এক স্থানে উক্ত তাসবিহ পড়তে সম্পূর্ণ ভুলে গেলে বা ভুলে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম পড়লে পরবর্তী যে রুকনেই (অর্থাৎ, দাঁড়ানো, রুকু, সিজদা অবস্থায়) স্মরণ আসুক, সেখানে সেই সংখ্যার সাথে এই ভুলে যাওয়া সংখ্যাগুলোও আদায় করে নেবে।
.
(২) আর এই সালাতে কোনো কারণে সাজদায়ে সাহু ওয়াজিব হলে সেই সাজদা এবং তার মধ্যকার বৈঠকে উক্ত তাসবিহ পাঠ করতে হবে না।
.
(৩) তাসবিহর সংখ্যা স্মরণ রাখার জন্য আঙ্গুলের রেখা গণনা করা যাবে না, তবে আঙ্গুল চেপে স্মরণ রাখা যেতে পারে।
.
(৪) সালাতুত তাসবিহর সালাত দিনে বা রাতে যেকোনো সময়েই পড়া যাবে। তবে তিনটি হারাম সময় ব্যতীত।
.
(৫) এটি সাধারণ নফল সালাত। সুতরাং নফলের নিয়তে পড়বেন।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে সালাতুত তাসবিহ আদায় সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে আহালুল আলেমগন দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ জায়েজ বলেছেন কেউ বিদআত বলেছেন। সুতরাং যেহেতু বিষয়টি নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে সেক্ষেত্রে পাঠকের কাছে যেটি শক্তিশালী মত মনে হয় সেটি গ্রহন করতে পারেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।