সফর শব্দ বা সফর মাস এবং আখেরী চাহার সোম্বা

প্রশ্ন: সফর শব্দ বা সফর মাসের মর্ম কি? আখেরী চাহার সোম্বা কাকে বলে। ইসলামে এর কোন ভিত্তি আছে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সফর (আরবি: صفر‎‎) হলো ইসলামি হিজরি সনের দ্বিতীয় মাস। এ মাসটিকে পূর্বে ‘সফর আখেরাহ’ বলা হতো। পরে ‘সফর উলা’ ‘মুহাররম’ নামের সাথে পরিবর্তিত হওয়ায় ‘সফর আখিরাহ’কে শুধু ‘সফর’ নামকরণ করা হয়। ‘صفر’ এর আভিধানিক অর্থ শূন্য, খালি বা হরিদ্রা বর্ণ। এ মাসে সাধারণত: আরববাসীদের ঘর-বাড়ি খালি বা শূন্য থাকত। কারণ তারা এ মাসটি ভ্রমণে কাটিয়ে দিত অথবা যুদ্ধে নামত এবং বনভূমিতে শক্তিপরীক্ষা করতে যেত। তারা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীর জনপদ ও সবুজ বাগ-বাগিচা ধ্বংস করত, ফসলাদি নষ্ট করত, সন্তান হত্যা করে মায়ের বুক খালি করত। এসব কারণেই এ মাসের নাম শূন্য, খালি বা সফর মাস রাখা হয়েছে। কারো মতে, আরবদের নিকট হেমন্তকাল ছিল বিশেষ মাস। হেমন্তকালে সাধারণত বৃক্ষের পাতা হলুদ বর্ণ হয়ে থাকে। তাই মৌসূমী প্রভাবের কারণে এ মাসকে সফর বা হরিদ্রা বর্ণের মাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগে আরববাসীরা ধারণা করত, এ মাস এলেই তাদের উপর কোন না কোন বিপদাপদ চেপে বসবে। তাই তারা একে কুলক্ষণের মাস বলে খুব ঘৃণা করত। তাদের এ কুধারণার মূলোৎপাটনকল্পে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেন, ‘ছোঁয়াচে রোগ, কুলক্ষণ, পেঁচার ডাক এবং সফর মাসে অশুভ বলে কিছুই নেই। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৭৭০ আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৫)। জেনে রাখা ভাল, সফর মাসের জন্য কোনো বিশেষ আমল বা সালাত-সিয়াম কিছুই নেই। এ মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে কোনো প্রকারের সালাত আদায়ের বিশেষ সাওয়াব বা ফযীলতের কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। অনুরূপভাবে এ মাসের কোনো দিনে সিয়াম পালনেরও কোনো বিশেষ ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। এ মাসকে কেন্দ্র করেও অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে।

◾সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরী চাহার সোম্বা:
___________________________________
আখেরী চাহার সোম্বা কথাটি ফার্সী। এর অর্থ সফর মাসের শেষ বুধবার। ইরান, ইরাক, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এটি দিবস হিসাবে পালিত হয়ে থাকে। এর ভিত্তি হলো- মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে বুধবার রাসূল (ﷺ) এর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন। অতঃপর তাঁর মাথার উপরে পানি ঢালা হলে তিনি একটু হালকা বোধ করলে মসজিদে গিয়ে যোহরের সালাত আদায় করেন এবং মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।’ (সহীহ বুখারী হা/৪৪৪২; ইবনু হিশাম ২/৬৪৯)। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উক্ত দিবস ঘটা করে পালন করা হয় এবং সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। অথচ এটি সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। সাহাবায়ে কেরামের যামানায় এরূপ প্রথার কোন অস্তিত্ব ছিল না। বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাযিল হয়। এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গ বিশ্বাস করেছেন। যেমন: ‘‘সফর মাসে একলাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাজিল হয় এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’তে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাজিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকাত নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন…।’’(খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩৯)। অথচ এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’-র প্রসিদ্ধি উপরোক্ত কারণে নয়,বরং অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মুসলিমগণ এ দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।
.
এ বিষয়ক প্রচলিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘নবী করীম (ﷺ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রা.) খুশীতে ৭ সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ৫ সহস্র দীনার, হযরত ওসমান (রা.) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রা.) ৩ সহস্র দীনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (ﷺ) এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদৎ বান্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য…। (মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৫।) উপরের এ কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এ ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পাই নি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা জীবনী গ্রন্থেও আমি এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাই নি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এ কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই।সুতরাং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উক্ত দিবস পালন করা,সরকারী ছুটি ঘোষণা করা এবং যে কোন আমল করা এগুলো সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। সাহাবায়ে কেরামের যামানায় এরূপ প্রথার কোন অস্তিত্ব ছিল না। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।’ (সহীহ বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০)। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত,রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও সালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হলো ভ্রষ্টতা।’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম।’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।মহান আল্লাহ আমাদেরকে শিরক-বিদআত বর্জন করে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুক এবং সমস্ত বিরোধী কর্মকান্ড থেকে হেফাজত করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।