লাইলাতুল ক্বদরের রাত কোনটি

প্রশ্ন: লাইলাতুল ক্বদরের রাত কোনটি? প্রত্যেক বছর লাইলাতুল ক্বদর কি এক রাতেই হয়ে থাকে, না কি এটা স্থানান্তরিত হয়? লাইলাতুল ক্বদর গোপন রাখার হিকমত কি? ক্বদরের রাতটি চিহ্নিত করার কোনো আলামত আছে কি?
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: বছরে ১২ মাসের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস রামাদান মাস। এটি রহমতের মাস। এই মাসে যে রহমত পেল, সে সত্যিকারের সৌভাগ্যবান। আর যে বঞ্চিত হল, সে চরম পর্যায়ের হতভাগ্য। ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেছেন, ‘বছরের বারোটি মাস যেন (নবি) ইয়াকুব (আ.)-এর বারো জন পুত্রের ন্যায়৷ তাদের মধ্যে ইউসুফ (আ.) যেমন তাঁর পিতার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ছিলেন, তেমনি রামাদান মাসও আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে এক ভাই (ইউসুফ আ.)-এর দু‘আয় এগারো জন (ভাই)-কে ক্ষমা করেছিলেন, সেভাবে রামাদান মাসে তোমার দু‘আর ফলে তোমার বাকি এগারো মাসের পাপগুলো তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন৷ প্রিয় পাঠক, প্রকৃতপক্ষে রামাদান মাস পাওয়া একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ দয়া ও নেয়ামত। বিশেষ করে এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার বছরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
.
◾লাইলাতুল ক্বদর কোন রাত্রিতে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: লাইলাতুল ক্বদর রামাদান মাসে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রামাদান মাসে কোন রাতে লাইলাতুল ক্বদর কুরআনে এই রাত নির্দিষ্টকরণের ব্যাপারে কোনো বর্ণনা নেই। দ্বিতীয়ত: অধিকাংশ হাদীস এবং প্রায় সকল প্রসিদ্ধ আলেমগনের বিশুদ্ধ মতে রামাদান মাসের শেষ দশকের যে কোন একটি রাত্রি শবে ক্বদরের রাত্রি। হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, এই রাত রামাদানের শেষ দশকেই রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রমজান মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন। এরপর তিনি মাঝের দশকেও ইতিকাফ করলেন। তারপর তাঁকে বলা হলো, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে নিহিত আছে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে ওই রাতটি স্বপ্নেও দেখানো হল, তিনি যেন সে রাতে কাদা ও পানির মধ্যে ফজরের (সালাতের) সিজদাহ করছেন। সেটা ছিল রামাদানের একবিংশ রাতে। তিনি (ﷺ) ই‘তিকাফরত অবস্থায় ছিলেন। সে রাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হল। ফলে ছাদ থেকে মাসজিদে পানি বর্ষিত হল। তখন নাবী (ﷺ) এর মাসজিদের ছাদ ছিল খেজুর ডাটায় তৈরি। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে ফজরের সালাত পড়লেন। তিনি জমিনের উপর সিজদা দিলেন। (বর্ণনাকারী) আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, তিনি কাদা ও পানিতে সিজদা দিলেন। এমনকি আমি স্বচক্ষে তাঁর কপালে কাদা ও পানির চিহ্ন দেখতে পেলাম। (সাহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭)। এখন রামাদান মাসের শেষ দশকের কোন রাত্রিতে লাইলাতুল ক্বদর তা নির্ধারণ সম্পর্কে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি বক্তব্য পাওয়া যায়। আমরা ধারাবাহিক ভাবে হাদীস এবং ইতিহাস বিখ্যাত ইমামগণের বক্তব্য থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
.
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রাহ.) তাঁর জগদ্বিখ্যাত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারি’-তে লাইলাতুল কদরের তারিখ নিয়ে আলেমগণের অনেকগুলো মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন:
.
◾ ২১ তম রাত:
.
ইমাম শাফিঈর ব্যাপারে বলা হয়, তিনি ২১ তম রাতকে ক্বদরের রাত মনে করতেন। তাঁর মতের পক্ষে দলিল হল: আবু সা‘ঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে রমাদানের মধ্য দশকে ইতিকাফ করি। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হয়ে আমাদের সম্বোধন করে বলেন, ‘‘আমাকে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছিল; পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে ) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহর সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে।’’ আমরা সবাই ফিরে আসলাম। আমরা আকাশে হালকা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। (২১ তারিখ রাতের) পরে এমনভাবে মেঘ দেখা দিল ও জোরে বৃষ্টি হল যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ বেয়ে পানি ঝরতে লাগল। সালাত শুরু করা হলে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।’ (বুখারী, আস-সহিহ: ১৮৮৯)। মুহাদ্দিসগণ অনেকেই এই হাদিস থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সে বছর ক্বদর হয়েছিল ২১ তম রাতে। [ড. আব্দুল্লাহ্ জাহাঙ্গীর (রাহ.) অনূদিত ফিকহুস সুনান গ্রন্থে (১/৪৮০) এই বিষয়টি টীকায় উল্লেখিত হয়েছে]
.
◾শেষ সাত রাতে:
.
আরেকদল আলেমের মতে, এটি শেষ সাত রাতের কোনো এক রাতে। তাঁদের পক্ষে দলিল হল: ইবনু উমার (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘তোমরা রামাদানের শেষ দশকে ক্বদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।’’ (মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৩৬)
.
◾ ২৩ তম রাত:
.
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনু উনাইস (রা.) ২৩ তম রাতকে ক্বদরের রাত মনে করতেন বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলি- ‘আমি দূরে বনভূমিতে অবস্থান করি এবং আল্লাহর অনুগ্রহে সেখানে সালাতও পড়ি। কাজেই আপনি আমাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে বলে দিন, যাতে আমি সে রাতে আপনার মাসজিদে এসে ইবাদাত করতে পারি।’ তখন তিনি বলেন, ‘‘তুমি রামাদানের ২৩ তম রাতে আসবে।’’ (আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৮০; হাদিসটি হাসান)। সে অনুসারে তিনি ২৩ তম রাতটি মাসজিদে সালাতে কাটাতেন। এরপর সকালে মাসজিদ থেকে বের হতেন। (সহিহ মুসলিম)
.
◾ ২৪ তম রাত:
.
তাবি’ঈ ইকরামা (রাহ.) বলেন, সাহাবি আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে, ‘তোমরা ২৪ তম রাতে (ক্বদর) তালাশ কর।’ (বুখারি, আস-সহিহ: ২০২১)
.
◾ ২৭ তম রাত:
.
আলেমদের বিরাট আরেক জামাত বলেছেন, এটি রামাদানের ২৭ তম রাতে। এই মত দিয়েছেন উবাই ইবনু কা’ব (রা.), ইবনু আব্বাস (রা.), উমার (রা.), ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)-সহ অনেকেই। এই মতের পক্ষে দলিল হলো, সাহাবি উবাই ইবনু কা’ব (রা.) কসম খেয়ে বলতেন, ২৭ তম রাতটি লাইলাতুল ক্বদর। (মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৬২)। ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এর কয়েকটি মতের মধ্যে একটি হল, “বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে ক্বদরের রাত হওয়ার সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ও সম্ভবনাপূর্ণ রাত হল ২৭ তম রাত। কিন্তু লাইলাতুল ক্বদর নির্দিষ্টভাবে ২৭ তম রাতে হবে না। (আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৯৫]
.
◾শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলো:
.
অর্থাৎ শেষ দশকের, ২১,২৩, ২৫,২৭, ২৯ তম এই পাঁচটি রাত এই দশকের মধ্যে অধিক আশাব্যঞ্জক। এই রাতগুলোর কোন এক রাতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মর্মে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর।’’(সহিহ বুখারি: ২০১৭)। ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, “তবে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলো অধিক আশাব্যঞ্জক। নাবী (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করো, আর তা প্রত্যেক বিজোড় রাতে তালাশ করো।” (সাহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭)। শেষ দশকের বিজোড় রাত কোনগুলো? উত্তর: ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তম; এই পাঁচটি রাত এই দশকের মধ্যে অধিক আশাব্যঞ্জক। এর অর্থ এই নয় যে, লাইলাতুল ক্বদর কেবলমাত্র বিজোড় রাতেই সংঘটিত হয়। বরং এই রাতটি জোড়-বিজোড় উভয় রাতগুলোতে হতে পারে। (আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৯৪)
.
◾ জোড় রাতেও ক্বদর হতে পারে:
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহ.) একটি বিশুদ্ধ হাদিসকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, যদি রামাদান মাস ৩০ দিনে হয়, তবে শেষ দশকের জোড় রাতগুলোতেও ক্বদরের রাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৫/২৮৫)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘(শেষ দশকের) অবশিষ্ট নবম রাতে, অবশিষ্ট সপ্তম রাতে, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতে এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতে (লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর)।’ (আবু দাউদ ত্বয়ালিসি, আল-মুসনাদ: ৯২২; আলবানি, সহিহু সুনানিত তিরমিযি: ৬৩৬; হাদিসটি সহিহ)। এ হাদিস থেকে আমরা দেখতে পারি যে, যদি কোনো রামাদান মাস ৩০ দিনের হয়, তাহলে অবশিষ্ট নবম রাতটি হবে রামাদানের ২২ তম রাত, অবশিষ্ট সপ্তম রাতটি হবে ২৪ তম রাত, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতটি হবে ২৬ তম রাত এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতটি হবে ২৮ তম রাত। আর এভাবেই বিশিষ্ট সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কদরের রাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (এই গণনা শেষ দিক থেকে করা হয়েছে। হাসান বাসরি (রাহ.) থেকেও এভাবে গণনার পক্ষে দলিল রয়েছে। অন্য দিকে, যদি কোনো রামাদান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে উক্ত হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অতএব, ঈমানদারদের উচিত, রামাদানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। (মাজমু‘উ ফাতাওয়া: খন্ড: ২৫ পৃষ্ঠা:২৮৪-২৮৫)
.
◾ রামাদানের শেষ দশ রাতে:
.
অধিকাংশ আলিমের মতে, এটি রামাদানের শেষ দশকে রয়েছে। তাঁদের পক্ষে দলিল হল: আমভাবে রাসূল (ﷺ) শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করতে বলেছেন। আম্মিজান আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা রমজান শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর।(সাহীহ বুখারী, হা/২০২০; সাহীহ মুসলিম, হা/১১৬৯)

■ হাদিসগুলোর মাঝে সমন্বয় ও সমাধান:
.
বিখ্যাত ইমামদের অনেকেই হাদীসের এসব বিভিন্নতার কারণে সবগুলো হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলেছেন; শেষ দশ রাতের যেকোনো রাতে ক্বদর হয়, তবে তা প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি দিনে হয় না, বরং এটি বিভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন দিনে হয়। ইমাম মালিক, আহমাদ, ইসহাক, সুফিয়ান সাওরি, ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইবনু হাজার, ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুমুল্লাহ্) এই মত দিয়েছেন। তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ইমাম ও মুহাদ্দিস। শুধু তাঁরাই নন, অধিকাংশ আলিম এই মতটি সমর্থন করেছেন। এই মতটি মেনে নিলে হাদীসগুলোর মাঝে কোনো বিরোধ বা পরস্পরবিরোধিতা থাকে না। সাহাবিগণের ছাত্র তাবি‘ঈ আবু কিলাবাহ (রাহ.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদর শেষ দশকের মাঝে স্থানান্তরিত হয়।’ (তিরমিযি, আস-সুনান: ৭৯২ ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ২৮৪-২৮৬; ইমাম ইবনু উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, আশ-শারহুল মুমতি‘ আলা যাদিল মুস্তাক্বনি; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৮৯-৪৯২)
.
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ও মুহাদ্দিস শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন—“নাবী (ﷺ) জানিয়েছেন যে, লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ দশকে রয়েছে। আর তা বিজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে সংঘটিত হওয়া বেশি আশাব্যঞ্জক। যেমন নাবী (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা তা অনুসন্ধান করো রমজানের শেষ দশকে, তোমরা তা অনুসন্ধান করো প্রত্যেক বিজোড় রাতে।” (সাহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, ওই রাতটি শেষ দশকের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। প্রতি বছর নির্দিষ্ট এক রাতে হয় না। তাই তা কখনো ২১শের রাতে হতে পারে, কখনো ২৩শের রাতে হতে পারে, কখনো ২৫শের রাতে হতে পারে, কখনো ২৭শের রাতে হতে পারে; ২৭শের এই রাতটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কখনো ২৯শের রাতে হতে পারে, আবার কখনো জোড় রাতগুলোতেও হতে পারে। সুতরাং, কেউ যদি শেষ দশকের প্রত্যেক রাতে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় ক্বিয়াম করে, তবে নিঃসন্দেহে সে ওই রাতটি পেয়ে যাবে। আর আল্লাহ যে অঙ্গীকার এই রাতের অধিবাসীদের (যারা এই রাতে ক্বিয়াম করে) দিয়েছেন তা লাভ করে সফলকাম হবে। নাবী (ﷺ) এই দশকের রাতগুলোতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ইবাদত করতে যে অতিরিক্ত চেষ্টা প্রচেষ্টা করতেন, সেটা তিনি প্রথম বিশ রমজানে করতেন না। আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন, “নাবী (ﷺ) রমজানের শেষ দশকে ইবাদত করতে যে প্রচেষ্টা করতেন, সে প্রচেষ্টা তিনি অন্য সময় করতেন না।” (সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫)। তিনি আরও বলেছেন, “রামাদানের শেষ দশক শুরু হবার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সারা রাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন। তিনি নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতেন এবং লুঙ্গি কষে বাঁধতেন (ইবাদতে খুব সচেষ্ট থাকতেন)।” (সাহীহ বুখারী, হা/২০২৪; সাহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪; ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৪২৬-৪২৮; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২১ হিজরী; ১ম প্রকাশ) (অনুবাদ: আব্দুল্লাহ মৃধা)
.
❑ প্রত্যেক বছর লাইলাতুল ক্বদর কি এক রাতেই হয়ে থাকে, না কি এটা স্থানান্তরিত হয়?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
.
উত্তর: এ বিষয়ে আলিমদের মধ্যে মতনৈক্য রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মত হল, এই রাতটি স্থানান্তরিত হয়। সুতরাং কোনো বছর ২১তম রাতটিও লাইলাতুল ক্বদর হতে পারে, আবার কোনো বছর ২৯তম রাতে, কোনো বছর ২৫তম রাতে, কোনো বছর ২৪তম রাতেও লাইলাতুল ক্বদর হতে পারে এবং অনুরূপভাবে (শেষ দশকের বাকি রাতগুলোতেও) হতে পারে। কেননা এই কথা ব্যতীত আর অন্য কোনো কথার উপর এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। তবে অধিক আশাব্যঞ্জক রাত হলো ২৭শের রাত। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে এই রাতটিই লাইলাতুল ক্বদর নয়, যেমনটি কতিপয় লোক ধারণা করে থাকে। কোন কোনো ব্যক্তি তার ধারণার ওপর ভিত্তি করে, এই একটি রাতেই অধিক পরিমাণে পরিশ্রম করে এবং অন্যান্য রাতগুলোতে শিথিলতা প্রদর্শন করে। এই রাতটি (নির্দিষ্টভাবে একই রাতে না হয়ে, বিভিন্ন রাতে) স্থানান্তরিত হওয়ার পিছনে হিকমাহ এই যে, এই ভাগ্য রজনীটি যদি নির্দিষ্ট কোনো রাতে হতো, তবে অলস বান্দা এই একটি রাতে ক্বিয়াম করেই ক্ষান্ত হয়ে যেত। কিন্তু যখন রাতটি স্থানান্তরিত হবে এবং প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভবনা থাকবে, তখন ব্যক্তি পুরো শেষ দশকেই ক্বিয়াম করবে। এ ব্যাপারে আরো হিকমাহ এই যে, এতে অলসতা পরিহার করে এই রাত তালাশ করার ব্যাপারে আগ্রহী বান্দার জন্য রয়েছে পরীক্ষা।” (ইমাম ইবনু উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৮৯-৪৯২; দারু ইবনিল জাওযী, দাম্মাম কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৪ হিজরী) (অনুবাদ: আব্দুল্লাহ মৃধা)
.
◾লাইলাতুল ক্বদর গোপন রাখার হিকমত কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
এর হিকমত হল, লাইলাতুল ক্বদর তালাশে বান্দা যাতে করে প্রতি রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করতে পারে। ওবাদা ইবনু সামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ক্বদর রাত্রির সংবাদ দেয়ার জন্য বের হলেন। এ সময় মুসলিমদের দু’ব্যক্তি ঝগড়া আরম্ভ করল। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে ক্বদর রাত্রি সম্পর্কে খবর দেয়ার জন্য বের হয়েছিলাম কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়ায় লিপ্ত হল, ফলে তা উঠিয়ে নেয়া হল। সম্ভবত এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলই হয়েছে। সুতরাং তোমরা তা ২৯, ২৭ ও ২৫ শে রাতে তালাশ করবে। (সহীহ বুখারী, হা/২০২৩, ৬০৪৯)
.
▪️কিভাবে লাইলাতুল ক্বদরের রাতটি চিহ্নিত করা যায়?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে লাইলাতুল ক্বদর চেনার কিছু আলামত আছে যা রাতের মধ্যেই দেখা যায় এবং আর কিছু আলামত আছে যা রাতের পরে সকালে দেখা যায়। যে সব আলামত রাতে পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপ:
.
❑ লাইলাতুল কদরের রাতটি হবে আলোকোজ্জ্বল:
.
ওয়াসিলা ইবনু আসক্বা’ (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ক্বদরের রাতটি হবে আলোকোজ্জ্বল। [আলবানি, সহিহুল জামি: ৫৪৭২; হাদিসটি হাসান সহিহ]
.
❑ সেরাতে নাতিশীতোষ্ণ আবহওয়া:
.
জাবির (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই রাতটি গরমও হবে না, ঠাণ্ডাও হবে না। (ইবনু খুযাইমাহ, আস-সহিহ: ২১৯০; হাদিসটি সহিহ)
.
❑ রাতটি সহজ (আরামদায়ক) হবে:
.
অন্যান্য রাতের তুলনায় শবে ক্বদরের রাতে মুমিন তার হৃদয়ে এক ধরনের প্রশস্ততা, স্বস্তি ও শান্তি বোধ করে। এবং অন্যান্য রাতের তুলনায় মুমিন শবে ক্বদরের রাতে কিয়াম বা নামাযে অধিক মিষ্টতা অনুভব করে। ইবনু আব্বাস (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এই রাতটি সহজ (আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দময়) হবে। (আলবানি, সহিহুল জামি: ৫৪৭৫; হাদিসটি সহিহ)
.
❑ রাতের চাঁদটি হবে থালার মতো:
.
আবু হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে কদরের রাত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে কে সেই (রাত) স্মরণ রাখবে, যখন চাঁদ উদিত হবে থালার (প্লেটের) একটি টুকরার ন্যায়।’’ (মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৬৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, চাঁদটি এমন হবে, যেন সে নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে। (ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৩৬৮৮; হাদিসটি সহিহ)
.
❑ পরের দিন সকালের সূর্যে থাকবে না কিরণ:
.
উবাই ইবনু কা’ব (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ক্বদরের রাতের আলামত জানিয়েছেন যে, পরদিন সকাল বেলা এমনভাবে সূর্য ওঠবে যে, এতে কিরণ বা রশ্মি (ray) থাকবে না। (মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৬২)
.
একই হাদিসের বর্ধিত বর্ণনায় এসেছে, যে পর্যন্ত সূর্য উপরে ওঠে, ততক্ষণ সূর্য এমন কিরণহীন থাকবে। (আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৭৮; হাদিসটি হাসান সহিহ)
.
❑ সকালের সূর্যটি হবে রক্তিম ও নিস্তেজ:
.
ইবনু আব্বাস (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, এই রাতের পরদিন সকালের সূর্য ওঠে লাল ও নিস্তেজ অবস্থায়। (ইবনু খুযাইমাহ, আস-সহিহ: ২৯১২; হাদিসটি সহিহ)
.
❑ কোনো ঈমানদারকে ক্বদরের রাতটি স্বপ্নে দেখানো হতে পারে:
.
একবার কয়েকজন সাহাবি রামাদানের শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর স্বপ্নে দেখেছিলেন। নবিজি তাদের সেই স্বপ্নকে সত্যায়ন করেছিলেন। (বুখারী, আস-সহিহ: ২০১৫; মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৫)
.
⭕উল্লেখ্য যে, ক্বদরের রাত সম্পর্কে সমাজে লোক মুখে যে সব আলামতের কথা প্রচলিত। যেমন:
🔸(১). সে রাতে কুকুর ভেকায় না বা কম ভেকায়।
🔸(২). দালান কোঠা ঘুমিয়ে পড়ে।
🔸(৩). গাছ-পালা মাটিতে নুয়ে পড়ে আল্লাহকে সিজদা করে।
🔸(৪). সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মিঠা হয়ে যায়।
🔸(৫). নূরের ঝলকে অন্ধকার জায়গা আলোকিত হয়ে যায়।
🔸(৬). নেক লোকেরা ফেরেশতার সালাম শুনতে পান ইত্যাদি আলামতসমূহ কাল্পনিক-বানোয়াট গল্প ছাড়া কিছু নয়। কেননা এগুলো শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এ সব কথা নিশ্চিতরূপে অভিজ্ঞতা ও বাস্তব বিরোধী। (বিস্তারিত ইমাম উসাইমীন আশ শারহুল মুমতে খন্ড:৬ পৃষ্ঠা: ৪৯৮-৪৯৯)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, অগ্রগণ্য মতানুসারে লাইলাতুল ক্বদর তথা শবে ক্বদর রমাদান মাসের শেষ দশকের মধ্যে রয়েছে। তাই এই রাতটি পাওয়ার জন্য শেষ দশকের জোড়-বিজোড় সব রাতেই তাকে তালাশ করতে হবে। কোনরকম অবহেলা করা যাবে না। (আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।