রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত বমি করা কিংবা গিলে ফেলা সংক্রান্ত শারঈ হুকুম

প্রশ্ন: রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত বমি করা কিংবা গিলে ফেলা সংক্রান্ত শারঈ হুকুম কী?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আহালুল ইমামগনের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা রোযা ভঙ্গের কারণ। আর কারো যদি অনিচ্ছাকৃত বমি এসে যায় তাহলে তার রোযা ভঙ্গ হবে না। এক্ষেত্রে বেশি বমি ও কম বমির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে এবং সামান্য একটুও বের হয় এতে করে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (এটি উল্লেখ করেছেন আল-খাত্তাবী ও ইবনুল মুনযির।ইমাম ইবনে মুনযির বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করেছে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অভিমত (ইজমা) হচ্ছে তার রোযা ভেঙ্গে গেছে।(দেখুন: ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী: খন্ড ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬৮)
.
সুন্নাহ থেকে এর দলিল হচ্ছে প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: (مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ – أي : غلبه- فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ ، وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ)
“যে ব্যক্তির বমি এসে গেছে তার উপর কাযা নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করেছে তাকে কাযা পালন করতে হবে।”(তিরমিযি হা/৭২০; এ হাদিসের উপর আলেমগণ আমল করেছেন,ইমাম আলবানী সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
.
আল-ফুরু নামক গ্রন্থে বলা হয়: “যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করার চেষ্টা করে, ফলে কোন কিছু বমি করে দেয়; তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। দলিল হচ্ছে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস।(তিনি পূর্বোক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেন)।(আল-ফুরু, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৪৯ আবু দাউদ হা/২৩৮০) ও তিরমিযি হা/৭২০).
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:

أَمَّا الْقَيْءُ : فَإِذَا استقاء أَفْطَرَ ، وَإِنْ غَلَبَهُ الْقَيْءُ لَمْ يُفْطِرْ اهـ
আর বমি: যদি কেউ নিজে থেকে বমি করে তাহলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি কারো বমি এসে যায় তাহলে তার রোযা ভাঙ্গবে না।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৫ ১৩; পৃষ্ঠা: ২৬৬)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে এমন ব্যক্তির হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় রোযা অবস্থায় যার বমি হয়ে গেছে তাকে কি ঐ দিনের রোযার কাযা পালন করতে হবে?

জবাবে তিনি বলেন:

لا قضاء عليه ، أما إن استدعى القيء فعليه القضاء ، واستدل بالحديث السابق اهـ .

তার উপর কাযা পালন নেই্। যে ব্যক্তি নিজে থেকে বমি করেছে তাকে কাযা পালন করতে হবে। তিনি পূর্বোক্ত হাদিস দিয়ে দলিল দেন।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে রমযান মাসে বমি করলে রোযা ভাঙ্গবে কিনা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন:

إذا قاء الإنسان متعمدا فإنه يفطر ، وإن قاء بغير عمد فإنه لا يفطر ، والدليل على ذلك حديث أبي هريرة رضي الله عنه وذكر الحديث المتقدم .فإن غلبك القيء فإنك لا تفطر ، فلو أحس الإنسان بأن معدته تموج وأنها سيخرج ما فيها ، فهل نقول : يجب عليك أن تمنعه ؟ لا . أو تجذبه ؟ لا . لكن نقول : قف موقفا حياديا ، لا تستقئ ولا تمنع ، لأنك إن استقيت أفطرت ، وإن منعت تضررت . فدعه إذا خرج بغير فعل منك ، فإنه لا يضرك ولا تفطر بذلك اهـ .

যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে তাহলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি এসে যায় তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। দলিল হচ্ছে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস। (তিনি পূর্বোক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেন।) অতএব, যদি আপনার বমি হয়ে যায় তাহলে আপনার রোযা ভঙ্গ হবে না। এমনকি কেউ যদি তার পাকস্থলিতে অস্বাভাবিকতা অনুভব করে এবং কিছু বের হয়ে আসবে এমন অনুভব করে; সে ক্ষেত্রে আমরা কি বলব যে, সেটাকে আটকিয়ে রাখা আপনার উপর ওয়াজিব? উত্তর: না। কিংবা সেটাকে টেনে আনা? উত্তর: না। কিন্তু আমরা বলব: আপনি নিরপেক্ষ অবস্থান নিন। বমিকে টেনে আনবেন না; প্রতিরোধও করবেন না। যদি আপনি বমিকে টেনে আনেন তাহলে আপনার রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদি প্রতিরোধ করে রাখেন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। যদি আপনার কোন তৎপরতা ছাড়া বমি বের হয়ে আসে তাহলে আপনার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হল না এবং আপনার রোযাও নষ্ট হল না।[উসাইমীন মাজালিসু শাহরি রামাদান, পৃষ্ঠা: ২৩১)

দুই: যদি বমির কিছু অংশ ব্যক্তির অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেটে চলে যায় তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে। কেননা তার ইখতিয়ার ছাড়াই সেটা চলে গেছে।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: এমন রোযাদার সম্পর্কে যে ব্যক্তির বমি এসেছে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে সে বমি গিলে ফেলেছে তার হুকুম কী? জবাবে তারা বলেন:

إذا تقيأ عمدا فسد صومه ، وإن غلبه القيء فلا يفسد صومه ، وكذلك لا يفسد ببلعه ما دام غير

যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে তাহলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি বমি চলে আসে তাহলে তার রোযা নষ্ট হবে না। অনুরূপভাবে যেহেতু অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি গিলে ফেলেছে তাই রোযা নষ্ট হবে না।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ, খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ২২৫)
.
অপরদিকে যদি বমির কিছু অংশ মুখের ভিতর চলে আশা শর্তেও ইচ্ছাকৃত গিলে ফেলে তাহলে অধিক বিশুদ্ধ মতে তাহলে তার উপর রোজাটির কাযা পালন আবশ্যক হবে।
.
মুয়াত্তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল-মুনতাকা’-তে বলেন: “মালেক থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: রমযানের রোযাকালীন সময়ে যে ব্যক্তির সামান্য বমি মুখে চলে আসার পর সে এটাকে পুনরায় গিলে ফেলে তার উপর কাযা আবশ্যক হবে না। ইবনুল কাসেম বলেন: মালেক এ মত থেকে প্রর্ত্যাবর্তন করেছেন। তিনি বলেন: যদি সামান্য বমি এমন স্থান পর্যন্ত চলে আসে যে, ব্যক্তি চাইলে এটাকে ফেলে দিতে পারে; তদুপরি গিলে ফেলে তাহলে তার উপর কাযা পালন করা আবশ্যক হবে। শাইখ আবুল কাসেম বলেন: যদি জিহ্বাতে চলে আসার পরেও কেউ গিলে ফেলে তাহলে তার উপর কাযা পালন আবশ্যক হবে। আর যদি এই স্থানে পৌঁছার আগে গিলে ফেলে তাহলে তার উপর কোন কিছু আবশ্যক হবে না।(আল-মুনতাকা’ খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৬৫)
.
আল-ইনসাফ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে: বমি বা (القلس) মুখে চলে আসার পর যদি কেউ সেটাকে গিলে ফেলে তাহলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে; এমনকি সেটা অতি সামান্য হলেও। যেহেতু এর থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। এটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন (অর্থাৎ ইমাম আহমাদ)। ‘হাশিয়াতুল আদাওয়ি’ গ্রন্থে বমির হুকুম উল্লেখ করার পর বলেন: “(القلس) বমির মত; যা পাকস্থলি ভরে যাওয়ার পর পাকস্থলির মুখ থেকে বেরিয়ে যায়।(হাশিয়াতুল আদাওয়ি’ খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৪৮)
.
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জান ভাল তা হচ্ছে, রোযাদার যদি গলার ভেতরে রক্তের স্বাদ অনুভব করে এর বিধান কি?
.
এক্ষেত্রে আলেমগন বলেছেন, রোযাদার যদি গলার ভেতরে রক্তের স্বাদ অনুভব করে এতে তার রোযার কোন ক্ষতি হবে না; এমনকি সেটা যদি গিলে ফেলে তদুপরিও। তবে, যদি মুখে চলে আসার পর গিলে ফেলে তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। একই বিধান প্রযোজ্য হবে শ্লেষ্মা, কফ ও গলার ভেতরে আরও যা কিছু আসতে পারে সবকিছুর ক্ষেত্রে।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন,

“وأنبه على مسألة النخامة والبلغم ، فإن بعض الصائمين يتكلف ويشق على نفسه فتجده إذا أحس بذلك في أقصى حلقه ذهب يحاول إخراجه ، وهذا خطأ ، وذلك لأن البلغم أو النخامة لا تفطر الصائم إلا إذا وصلت إلى فمه ثم ابتلعها فإنه يفطر عند بعض العلماء ، وعند بعض العلماء لا يفطر أيضاً .
وأما ما كان في حلقه ونزل في جوفه فإنه لا يفطر به ولو أحس به ، فلا ينبغي أن يتعب الإنسان نفسه في محاولة أن يخرج ما في حلقه من هذا الأذى”

“আমি কফ ও শ্লেষ্মার মাসয়ালার ক্ষেত্রে দৃষ্টি আর্কষণ করতে চাই যে, কিছু কিছু রোযাদার নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেন। আপনি দেখবেন, উনার গলার একেবারে ভেতরেও যদি কিছু থাকে তিনি সেটা বের করার চেষ্টা করেন। এটি ভুল। কেননা কফ ও শ্লেষ্মা রোযা ভঙ্গ করে না। তবে যদি এগুলো মুখে চলে আসার পর গিলে ফেলে সেক্ষেত্রে কিছু কিছু আলেমের মতে, এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে। আর অপর কিছু আলেমের মতে, সেক্ষেত্রেও এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না। আর যদি গলার ভেতরের জিনিস নীচের দিকে নেমে পেটে চলে যায় সেক্ষেত্রে এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না; এমনকি রোযাদার যদি সেটা অনুভব করেন তা সত্ত্বেও। অতএব, গলার ভেতরের জিনিস বের করে আনার জন্য নিজেকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়।”।[উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ১৯ পৃষ্ঠা: ৩৫৬) আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮৫৭৯, ৩৮২০৫ (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।