রামাদান মাস থেকে আমরা কী শিক্ষা নিবো এবং শাওয়াল মাসের ৬টি সিয়াম

মহিমান্বিত মাস রামাদান তো শেষ হয়ে গেলো। রামাদান মাস থেকে আমরা কী শিক্ষা নিবো? শাওয়াল মাসের ৬টি সিয়াম সম্পর্কে যে বিষয়গুলো আপনার জানা উচিত।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আরবী ১২টি মাসের মধ্যে রামাদান মহান আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি মাস। অফুরন্ত সওয়াব ও অধিক কল্যাণে পরিপূর্ণ এ মাস। এ উম্মাতের জন্য এই মাস আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক বিষেশ নিয়ামত ও রহমত। কথায় আছে ভালো সময়গুলো খুব দ্রুত চলে যায়। রামাদান তো তাই এসেছে আবার চলেও গেছে। আল্লাহ চাইলে এই মাসটি আবার ফিরে আসবে প্রায় এক বছর পর। রামাদান চলে গেল। কিন্তু রামাদান পরে আমাদের অবস্থা কি, কর্ম কি? এবং কর্তব্য কি? রামাদানের আমলে ভরা দিনগুলি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু মুমিনের আমল তো কোন দিনের জন্য শেষ হওয়ার নয়। যেহেতু মুমিনদের রব মহান আল্লাহ যিনি রামাদানের প্রভু, তিনিই শা’বান ও শাওয়াল তথা বাকী মাসসমূহ ও সারা বছরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রভু। মুসলিমের কর্তব্য হল, রামাদান মাসে যে সব নেক আমলে অভ্যাসী হয়েছে সেই সব আমল বন্ধ না করে একটানা নিয়মিত করে যাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, “মৃত্যু আসা অবধি তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাক।” (সূরা হিজর; ১৫/৯৯)। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সেই আমল অধিক পছন্দনীয়, যা লাগাতার করে যাওয়া হয়; যদিও বা তা পরিমাণে কম হয়।’’(সহীহ বুখারী হা/৬৪৬৫; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৩)
.
রামাদানের অন্যতম উদেশ্য ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। কতটুকু তাকওয়া অর্জন করতে পেরেছি আমরা? কেননা তাক্বওয়াই মুমিন নারী- পুরুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তাক্বওয়ার স্থান হল, ক্বলব বা অন্তর। যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করবে সে ব্যক্তি যেমন আল্লাহর ক্ষমা, রহমত ও জান্নাত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে; তেমনি তাকে কোন পাপ, হারাম কাজ, মিথ্যা কথা, প্রতারণা, ধোঁকা, আত্মসাৎ, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, সূদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, গান-বাজনা, যেনা-ব্যভিচার, বেহায়াপনা, নগ্নতা, জাহেলিয়াত অর্থাৎ আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কোন কর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এটাই তাক্বওয়া। ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‌’আলা এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকাই হল ‘তাক্বওয়া’। (ইবনে তাইমিয়া মাজমূউল ফাতাওয়া; খন্ড:২৭/৩৯)। সুতরাং রামাদানে যেমন পাপী মুসলিমরা পাপ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছে, বিড়ি-সিগারেট, তামাক, জর্দাখোর ব্যক্তিরা যাবতীয় নিষিদ্ধ কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেছিল। এবং যতদূর সম্ভব এ মাসে বড় প্রচেষ্টা ও শ্রম দিয়ে আমল-ইবাদত করার চেষ্টা করেছিল, ঠিক তেমনি পরের মাসগুলিতেও যেন সেই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম অব্যাহত থাকে। তার সমস্ত আমল এমন হওয়া উচিত, যেন সে তা রামাদানেই করছে।
.
বান্দার যাবতীয় নেক আমল বা কোনও সৎকর্ম আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো আমলকারী ব্যক্তি ঐ আমল বা কর্মের পরে পুনরায় অন্যান্য সৎকর্ম করে থাকে। সুতরাং, রামাদানের পর আপনার অন্যান্য নেক আমল করতে থাকা এই কথারই লক্ষণ যে- আপনার রোযা ও তারাবীহ মহান আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন। আর হ্যাঁ, খবরদার পুনরায় আপনি আপনার সেই অবস্থায় ফিরে যাবেন না, যে অবস্থা ছিল রমাযানের পূর্বে। মক্কায় অদ্ভুত এক নারী ছিলো; যে সুতা পাকিয়ে সুন্দর সুন্দর কাপড়, টুপি, কম্বল ইত্যাদি তৈরি করতো। এরপর সে নিজেই সুতার দুই দিক থেকে টান দিয়ে এগুলোকে নষ্ট করে ফেলতো। এই নারীকে লোকজন পাগল মনে করতো তার এমন কাজের জন্য। সে এত পরিশ্রম করে পাকানো সুতাগুলোকে খামখেয়ালিপনায় টুকরো টুকরো করে ফেলতো। ইমাম ইবনু কাসির (রাহ.) তাঁর ‘তাফসিরুল কুরআনিল আযিম’-এ বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনুল কারিমে এই নারীর উদাহরণ দিয়ে বলেন—وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا
.তোমরা ওই নারীর মতো হয়ো না, যে পরিশ্রমের পাকানো সুতো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে।’’(সুরা নাহল,১৬/৯২)। আয়াত দ্বারা যদিও শপথ পাকাপাকি হওয়ার পর তা ভেঙে না ফেলতে বলা হয়েছে, কিন্তু রোজাদারের সাথে মিল রয়েছে। যেমন: রোজাদারদের অনেকে সারা মাস রোজা রাখে, আমল করে,কিন্তু রামাদানের শেষ দিকে বা রমাদান মাস শেষ হলে হাল ছেড়ে দেয়, গুনাহে জড়িয়ে যায় আর সারা মাসের সিয়াম সাধনাকে পণ্ড করে দেয়। এটি খুবই বাস্তব একটি বিষয়। ব্যাপারটি এমন যে, কেউ ৩ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষার খাতায় চমৎকার উত্তর লিখেছে। এরপর খাতাটি জমা না দিয়ে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে।
.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ কোনো আমল করে, তখন আল্লাহ পছন্দ করেন যে, সে যেন ওই আমলটি পূর্ণাঙ্গভাবে করবে।’’ (ইমাম বাইহাকি, শু‘আবুল ঈমান: ৪৯৩০; ইমাম তাবারানি, মু‘জামুল আওসাত্ব: ৮৯৭; শায়খ আলবানি, সহিহুল জামি’: ১৮৮০; হাদিসটি সহীহ) সুতরাং,রামাদান শেষ হলেও আমরা হাল ছাড়বো না, বরং সুন্দর ও যথার্থভাবে বাকি সময়গুলো অতিবাহিত করবো। দীর্ঘ এক মাসের সিয়ামসাধনা এবং ইবাদত-বন্দেগি ধরে রাখবো। এরপর,আবার নতুন করে অন্ধকারময় গুনাহের জীবনে ডুবে যাবো না। রামাদানের মতই সারা বছর গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবো। বলা হয়, জীবন যদি কাটে রামাদানের মতো, তবে মৃত্যুর মুহূর্তটিও হবে ঈদুল ফিতরের মতো (আনন্দময়)!
.
হে ভাই মুসলিম ভাই-বোন! আপনি আপনার ঔদাস্য বর্জন করুন। আরামের নিদ্রা থেকে জেগে উঠুন। আপনার সফরের জন্য কিছু পথের সম্বল সংগ্রহ করে নিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি প্রত্যাবর্তন ও রুজু করুন। হয়তো বা আপনি তাঁর সাড়া পাবেন। তাঁর রহমত ও করুণা অর্জন করে আপনি সৌভাগ্যবান হবেন। আল্লাহর অলীদের পথের পথিক হয়ে তাঁদের সাথে গিয়ে মিলিত হতে পারবেন। আল্লাহ ও তাঁর জাহান্নামের ভয়ে নয়নাশ্রু বিগলিত করে রমাযান মাসকে বিদায় জানান। যে ছিলো প্রিয়তম, সে বিদায় নিলো। তাতে তো আপনার চোখে পানির স্রোত নামারই কথা। কি জানি আবার আগামী বছরে সেই প্রিয়তমের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে কি না? আবার আপনি ঐ ফরয রোযা পালন করার তওফীক লাভ করবেন কি না? পুনরায় ঐ উদ্দীপনার সাথে জামাআতে ঐ তারাবীহর সালাত পড়তে সুযোগ পাবেন কি না? কাজ শেষে মজুরকে তার মজুরী দিয়ে দেওয়া হয়। আমরা আমাদের কাজ তো শেষ করলাম। কিন্তু হায়! যদি আমরা আমাদের মধ্যে কার কাজ মহান আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়েছে তা জানতে পারতাম, তাহলে তাকে তার উপর মোবারকবাদ জানাতাম। আর কার কাজ গৃহীত নয়, তা জানতে পারলে তার সাথে বসে সমবেদনা ও শোক প্রকাশ করতাম।(তাওজীহাতুন অফাওয়াএদ লিসসা-য়েমীনা অসসায়েমাত পৃষ্ঠা: ১০১-১০৬ থেকে সংক্ষেপিত; বিস্তারিত: রামাদানের ফাজায়েল ও রোজার মাসায়েল)
.
ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ), বলেন, রামাদানের বিদায়ে মুমিনের চোখ কীভাবে অশ্রুসিক্ত হয় না—অথচ সে জানে না যে, তার জীবনে রামাদান আবার ফিরে আসবে কি না!’ (ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ২১৭)। ইবনু রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য নয় যে নতুন পোশাক পরিধান করে; বরং ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য যে তার আনুগত্য বৃদ্ধি করে। ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য নয় যে নতুন পোশাকের সাজসজ্জা ও গাড়ি বহর প্রদর্শন করে; বরং ঈদ ওই ব্যক্তির জন্য যার পাপ মোচন করা হয়েছে।’ (ইবনে রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) লাত্বায়েফুল মাআরেফ, পৃষ্ঠা: ২৭৭)। সুফিয়ান সাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) -এর কতিপয় সাথী বলেন, আমি ঈদের দিন তাঁর সাথে বের হয়েছিলাম। অতঃপর তিনি বলেন, আমরা এই দিন (ঈদের) সর্বপ্রথম শুরু করব চোখ নিম্নগামী করার মাধ্যমে। (ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) আত্ব-তাবছিরা, পৃ. ১০৬)
.
▪️রামাদান পরবর্তী মাস শাওয়াল। এ মাসে আমাদের করনীয় কি?
_______________________________________
শাওয়াল: شوال শব্দটি ‘شول’ মাসদার থেকে উদ্গত। অর্থ উত্তোলিত হওয়া, উত্তোলন করা বা বহন করা ইত্যাদি। এ মাসে উটনী বাচ্চা প্রসব করত এবং লেজ পিঠে করে রাখত। এ জন্যেই এই মাসের নাম হয়ে যায় শাওয়াল। কারো মতে, শব্দটি ‘شائلة’ ধাতু থেকে উদ্গত। যার অর্থ, ৭/৮ বছরের দুগ্ধহীন উষ্ট্র। প্রাক-ইসলামী যুগে এ মাসের নামকরণের সময় সম্ভবত: সবুজ ঘাসের অভাবজনিত কারণে উষ্ট্রের দুগ্ধ হত না, শুকিয়ে যেত। তাই একে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। শাওয়াল মাস হজ্জের মাসগুলোর প্রথম মাস। এ মাস থেকে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া সহীহ হাদীস দ্বারা এ মাসের একটি ফযীলত প্রমাণিত। যে ব্যক্তির রমাযানের রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে, তার জন্য শওয়াল মাসের ৬টি রোযা রাখা মুস্তাহাব।
.
শাওয়াল মাসের ছয়টি নফল সিয়াম পালন করলে পূর্ণ এক বছর সিয়াম পালনের সওয়াব হবে। তবে শর্ত হল- এর পূর্বে রামাযান মাসের পূর্ণ সিয়াম পালন করতে হবে। আবু আইয়ুব আনসারী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; যে রামাদান মাসের সিয়াম রাখবে। অতঃপর শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম পালন করবে। সে পূর্ণ এক বছর সিয়াম পালনের সওয়াব পাবে। (সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৪; আবু দাঊদ হা/২৪৩৩; তিরমিযী, হা/৭৫৯; আহমাদ হা/২৩৫৬১)। প্রশ্ন হতে পারে শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখা দ্বারা কীভাবে এক বছরের রোজা রাখার সমান সওয়াব হয়? এই হাদীসটির ব্যাখ্যা এসেছে অন্য বর্ণনায়। যেমন; সাওবান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন; যে রামাদান মাসে সিয়াম পালন করে এবং ঈদুল ফিত্বরের পর ছয়টি সিয়াম রাখে, তার এই সিয়ামগুলো পূর্ণ এক বছর সিয়াম পালনের সমপরিমাণ। (আল্লাহর বাণী) ‘যে একটি পুণ্য কাজ সম্পাদন করবে, সে অনুরূপ দশটি পুণ্যের অধিকারী হবে।’ (ইবনু মাজাহ হা/১৭১৫; বায়হাক্বী, হা/৮৬৯৪, হাদীসটি সহীহ)
.
সাওবান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, মহান আল্লাহ কারো একটি পুণ্য কাজকে ১০ দিয়ে গুণ করবেন। সে হিসাবে রামাদান মাসের ৩০ দিন সমান ১০ মাস। (৩০×১০=৩০০ দিন)। এবং ঈদুল ফিত্বরের পর শাওয়াল মাসের ছয় দিনের সিয়াম সমান ২ মাস (৬×১০=৬০)। সব মিলে এক বছর (৩০০+৬০=৩৬০ দিন, ১ বছর)। (নাসাঈ, হা/২৮৬১; আহমাদ, হা/২২৪১২, নাসাঈর শব্দ, হাদীসটি সহীহ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, রামাদানের ৩০টি সিয়ামকে ১০ দিয়ে গুণ করলে (৩০´১০)=৩০০ দিন হয়। আর শাওয়াল মাসের ৬টি ছিয়ামকে ১০ দিয়ে গুণ করলে (৬´১০)=৬০ দিন হয়। মোট ৩৬০ দিন হয়। আর আরবী গণনা হিসাবে ৩৬০ দিনে এক বছর। সুতরাং রামাদানের ৩০টি সিয়াম পালন করে যে ব্যক্তি শাওয়ালের ৬টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল। মূলতঃ এখানে উদ্দেশ্য হলো সওয়াব বর্ণনা করা। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ২/৮১-৮২)
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই হাদীস বলছে- যখন রামাদান মাস শেষ হয়, তখন কল্যাণের দরজা বন্ধ হয়ে যায় না। কল্যাণের দরজা খোলা রাখা হয়। কাজেই তুমি শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখো। যদি তুমি রামাদান মাসের সিয়াম রাখার পর শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম রাখ, তাহলে তুমি যেন পূর্ণ এক বছর সিয়াম রাখলে। এরপর ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) অন্যান্য মাসের নফল সিয়ামগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন কল্যাণের দরজা খোলা থাকার প্রমাণস্বরূপ। (আরবাঈন খন্ড:৭ পৃষ্ঠা: ৬৪)
.
▪️শাওয়ালের ৬ সিয়াম রাখা সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়:
_______________________________________
.
➤(১). হাদিসের ভাষ্য এবং আলিমগণের বিশুদ্ধ মত হলো, যদি কেউ সারা বছর রোজার ফজিলত অর্জন করতে চায়, তবে প্রথমেই কারো রামাদানের কাযা সিয়াম থাকলে আগে সেগুলো রাখতে হবে, এরপর শাওয়ালের ৬ টি রোজা রাখবে। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি রামাদানের রোজা রাখলো, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখলো, সে যেন সারা বছর রোজা রাখলো।” (মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৪)। এই হাদিসে উল্লেখিত ثُمَّ শব্দটি حرف عطف যা الترتيب (বিন্যাস) ও التعقيب (ক্রমধারা) অর্থে ব্যবহৃত হয়।এদিক থেকে হাদিসটি প্রমাণ করছে যে, আগে রামাদানের রোজাপূর্ণ করতে হবে। সেটা সুনির্দিষ্ট সময়ে আদায় হিসেবে হোক অথবা (শাওয়াল মাসে) কাযা পালন হিসেবে হোক। অর্থাৎ রমজানের রোজা পূর্ণ করার পর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখতে হবে। তাহলে হাদীসে উল্লেখিত সওয়াব পাওয়া যাবে। কারণ, যে ব্যক্তির উপর রামাদানের কাযা রোজা বাকী আছে সেতো পূর্ণ রামাদান মাস রোজা রাখেনি। রামাদান মাসের কিছুদিন রোজা রেখেছে। তবে কারো যদি এমন কোন ওজর থাকে যার ফলে তিনি শাওয়াল মাসে রামাদানের কাযা রোজা রাখতে গিয়ে শাওয়ালের ছয় রোজা রাখতে পারেননি। যেমন; কোন নারী যদি নিফাসগ্রস্ত (প্রসবোত্তর স্রাবগ্রস্ত) হন এবং গোটা শাওয়াল মাস তিনি রমজানের রোজা কাযা করেন তাহলে তিনি জিলক্বদ মাসে শাওয়ালের ছয় রোজা রাখতে পারবেন। কারণ এ ব্যক্তির ওজর শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। অন্য যাদের এমন কোন ওজর আছে তারা সকলে রামাদানের রোজা কাযা করার পর শাওয়ালের ছয় রোজা জিলক্বদ মাসে কাযা পালন করতে পারবেন। এবং এতে তিনি পরিপূর্ণ সওয়াব পাবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু বড় ধরনের কোন ওজর ছাড়া কেউ যদি শাওয়াল মাসে ছয় রোজা না রাখে এবং শাওয়াল মাস শেষ হয়ে যায় পরের মাসে উক্ত সিয়াম রাখে তাহলে সে ব্যক্তি এই সওয়াব পাবেন না। কারন এখানে গ্রহনযোগ্য কোনো ওজর নেই। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪০৩৮৯)
.
➤(২). শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়ামের নির্দিষ্ট কোন দিন-তারিখ নেই। এই ছয়টি সিয়াম শাওয়াল মাসের প্রথম বা মধ্য বা শেষ যেকোনো দিন রাখা যাবে। মোটকথা শাওয়াল মাসের মধ্যেই রাখতে হবে আর তাতেই উক্ত এক বছরের ফযীলত অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু শাওয়াল মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে কাযা করা জায়েজ নয়। যেহেতু তা সুন্নাত এবং তার যথাসময় পার হয়ে গেছে। তাতে তা কোন ওযরের ফলে পার হোক অথবা বিনা ওযরে। (শাইখ বিন বায ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ১৬৫-১৬৬)। কিন্তু মাসের শুরু থেকে সিয়াম রাখতে হবে মর্মে বক্তব্য দলীলহীন। এ ব্যাপারে ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদের সাথীগণ বলেন, ঈদুল ফিত্বরের পরের দিন থেকে ধারাবাহিকভাবে শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন করা ফযীলতপূর্ণ। যদি কেউ বিচ্ছিন্নভাবে সিয়াম রাখে বা দেরি করে শাওয়াল মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেকোনো দিন সিয়াম রাখে, তাহলে রামাযান মাসের অনুগামী হওয়ার ফযীলত অর্জিত হবে। কারণ সে রামাদানের পরে শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রেখেছে।’ (ইমাম নববী শারহু মুসলিম; ৮/৫৬)
.
➤(৩). শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম ধারাবাহিক ভাবে যেমন রাখা যাবে তেমনি উক্ত মাসের মধ্যে বিরতি দিয়েও রাখা যাবে। তবে উত্তম হল, রোজাগুলো বিরতিহীন ভাবে রাখা; কিন্তু মাঝখানে গ্যাপ দিলেও কোনো অসুবিধা নেই। (এ ব্যাপারে মোটামুটি সব আলেমই এমন মত দিয়েছেন) এর স্বপক্ষে দলিল আল্লাহ্ বলেন, “আর, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, সে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।”(সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাযা পালনের ক্ষেত্রে বিরতিহীন রাখার শর্ত আরোপ করেননি। সুতরাং এতে প্রশস্ততা রয়েছে। (ইমাম নববী আল-মাজমু’: ৬/১৬৭; ইবনু কুদামাহ,আল মুগনি: ৪/৪০৮; বিন বায, মাজমু‘উ ফাতাওয়া খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা:৩৫)

➤(৪).যেসকল বোনদের শরীয়ত সম্মত ওজরের কারণে রামাদানের বেশি রোযা মিস হয়ে গেছে অথবা যেই সমস্ত বোনদের পিরিয়ডের দিন এতো বেশি যে, কাযা সিয়াম রেখে এরপরে শাওয়ালের ছয় সিয়াম রাখার মতো মাসের দিন আর বাকী থাকবে না, তাহলে তারা প্রথমে শাওয়ালের ছয় সিয়াম রেখে পরে কাযা শুরু করতে পারেন এবং এইভাবে শাওয়ালের সিয়াম ফযীলত পাওয়ার আশা করতে পারেন ইনশাআল্লাহ। কেননা মহান আল্লাহ বলেন তুমি তোমার সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো। (সূরা তাগাবুন: ১৬) আল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ কারো উপর সাধ্যের বাইরে বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন না (সূরা বাকারা: ২/২৮৬) তাছাড়া ব্যস্ততার কারণে আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) তাঁর রামাদানের ছুটে যাওয়া সিয়াম পরবর্তী শা‘বান মাসে আদায় করতেন (সহীহ বুখারী হা/১৯৫০ সহীহ মুসলিম হা/১১৪৬ মিশকাত হা/২০৩০) এই হাদীস থেকে অনুমান করা যায়—আয়শা (রাঃ) রামাদানের কাজা রোজা না রেখেই শাওয়ালের রোজা রাখতেন। আমরা বলব, যেহেতু সকল আলেমের মতে, আগে কাজা রাখা ও পরে শাওয়ালের রোজা রাখা উত্তম, তাই সাধ্যানুযায়ী এভাবে আমল করে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা ভাল কেননা ফরযের ক্বাযা যত দ্রুত সম্ভব আদায় করাই উচিৎ (মির‘আত খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা:২৩)

➤(৫) শাওয়াল মাসের ৬ টি সিয়াম রাখা ছাড়া আর কোনো বিশেষ ফযীলত নেই। উল্লেখ্য যে সমাজে প্রচলিত আছে যে ব্যক্তি রামাদান, শাওয়াল, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’(মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৪৭২) উক্ত হাদীস সহীহ নয়। শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসের সনদে আরীফ আল-কুরাশী অজ্ঞাত হওয়ার কারণে হাদীছটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ, হা/৪৬১২)
.
▪️এবার যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফাতওয়া :
_______________________________________
➤ প্রশ্ন: যার উপরে রামাদানের কাযা রোযা রয়েছে তার জন্যে কি শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা শরীয়ত সম্মত হবে?
.
উক্ত প্রশ্নের উত্তরে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, বান্দা যেসব আমল করে সেগুলোর সওয়াবের পরিমাণ নির্ধারণ করার দায়িত্ব আল্লাহ্‌র উপরে। বান্দা যদি আল্লাহ্‌র কাছে প্রতিদান প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যের পথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তার প্রতিদান নষ্ট করবেন না। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন; “নিশ্চয় আল্লাহ্‌, ভালো কর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। যে ব্যক্তির দায়িত্বে রমযানের রোযা অবশিষ্ট রয়েছে তার কর্তব্য হচ্ছে, প্রথমে রামাদানের রোযা পালন করা; তারপর শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা। কেননা যে ব্যক্তি রামাদানের রোযা পূর্ণ করেনি তার ক্ষেত্রে এ কথা বলা চলে না যে, সে রামাদানের রোযা রাখার পর শওয়ালের ছয় রোযা রেখেছে।” আল্লাহ্‌ই উত্তম তাওফিক দাতা। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ খন্ড:১০ পৃষ্ঠা: ৩৯২)
.
➤প্রশ্ন: রামাদানের কাযা আদায় ও শাওয়ালের ছয় দিনের রোযা এক নিয়্যতে এক সাথে আদায় করা শুদ্ধ হবে কি?
.
জবাব: না, তা শুদ্ধ নয়। কারণ রামাদানের না-রাখা রোযার কাযা পালন সম্পূর্ণ শেষ না করা পর্যন্ত শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা যাবে না। শাইখ ইবনে উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; “যে ব্যক্তি আরাফাতের দিন অথবা আশুরার দিনে রোযা পালন করে এবং তার উপর রামাদানের কাযা রোযা অনাদায় থাকে তবে তার রোযা রাখাটা সহীহ। তবে তিনি যদি এই রোযার মাধ্যমে রামাদানের কাযা রোযা পালনেরও নিয়্যত করেন তবে তার দুটি সওয়াব হবে। আরাফাতের দিন অথবা আশুরার দিন রোযা পালনের সওয়াব ও কাযা রোযা আদায়ের সওয়াব। এটি সাধারণ নফল রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রামাদানের রোযার সাথে নফল রোযার কোন সম্পর্ক নেই। তবে শাওয়ালের ছয় রোযা রামাদানের সাথে সম্পৃক্ত। সে রোযা রামাদানের কাযা রোযা আদায়ের পরেই রাখতে হবে। তাই যদি কেউ কাযা আদায়ের আগে তা পালন করে তবে তিনি এর সওয়াব পাবেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন : من صام رمضان ثم أتبعه بست من شوال فكأنما صام الدهر “যে ব্যক্তি রামাদান মাসে রোযা পালন করল, সে রোযার পর শাওয়াল মাসেও ছয়দিন রোযা পালন করল,, সে যেন গোটা বছর রোযা রাখল।” আর এটি জানা বিষয় যে, যার উপর কাযা রোযা রয়ে গেছে সে রামাদান মাসে রোযা পালন করেছে বলে ধরা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার কাযা রোযা আদায় সম্পূর্ণ করে।”(ফাতাওয়াস সিয়াম ৪৩৮; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৯৩২৮)
.
➤প্রশ্ন: শাওয়ালের ছয় রোযা কি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রাখাটা সঠিক; যাতে করে আমি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার সওয়াবও পেতে পারি?

উত্তর: হ্যাঁ। এতে কোন বাধা নেই। এভাবে রোযা রাখলে আপনার জন্য ছয় রোযার সওয়াব এবং সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার সওয়াবও লেখা হবে। শাইখ মুহাম্মদ বিন উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; যদি এই ছয়দিনের রোযা সোমবারে বা বৃহস্পতিবারে পড়ে তাহলে তিনি দুটো সওয়াবই পেতে পারেন; যদি তিনি ছয় রোযার নিয়ত করেন এবং সোমবার বা বৃহস্পতিবারে রোযা রাখারও নিয়ত করেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “কর্মসমূহ নিয়ত অনুযায়ী হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যা নিয়ত করেন সেটাই তার প্রাপ্য।” (ইমাম উসাইমীন ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:১৫৪)।
.
পরিশেষে, প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা! প্রস্তুতি নিন, রামাদানের সিয়ামের পর সামান্য আজরের বিনিময়ে বিরাট সওয়াব অর্জন করার জন্য। আল্লাহ আমাদের সকলকে তোওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।