যে মুসলিম পুরুষ চারের অধিক বিয়ে করেছে ইসলামে তার বিধান কী

প্রশ্ন: যে মুসলিম পুরুষ চারের অধিক বিয়ে করেছে, ইসলামে তার বিধান কী? একজন মুসলিমের জন্য কখন পঞ্চম বিবাহ করা বৈধ?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর : ইসলামি শরীয়তে একজন পুরুষের জন্য সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় পঞ্চম বিবাহ করা হারাম। আর এই মাসালায় কুরআন-সুন্নাহ চার মাজহাবসহ অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুসলিম স্কলারা সবাই সর্বসম্মতভাবে একমত এবং এই মাসালায় কোন মতপার্থক্য নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি চারজন স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় পঞ্চম বা তার অধিক বিবাহ করবে এক্ষেত্রে অবশ্যই পঞ্চম বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে এবং সে কবিরাহ গুনাহে লিপ্ত থাকবে। কারণ এটি কুরআন, সহীহ হাদীস ও ইজমা বিরোধী কার্যকলাপ’।(দেখুন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, খন্ড: ২০/ পৃষ্ঠা.২১ ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪২৯৮)। পাশাপাশি সে ব্যক্তি যদি শরীয়তের এই বিধান জানার পরেও বুঝে শুনে সজ্ঞানে বিশ্বাস করে যে, একই সাথে চারের অধিক বিবাহ করা তার জন্য হালাল তাতে কোন সমস্যা নেই, কিংবা কুরআন হাদীসের এই বিধানকে অস্বীকার করে তাহলে মুসলিম ইমামগনের সম্মতিক্রমে সে কাফির হিসাবে বিবেচিত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الۡهُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِهٖ جَهَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا “আর কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করাব, আর তা কতই না মন্দ আবাস”!(সূরা নিসা, ১১৫) একজন পুরুষের জন্য একই সাথে চারের অধিক বিবাহ করা হারাম এটি সূরা নিসার ৩ নং আয়াত এবং বহু হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেমন,হাদীসে এসেছেعَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ غَيْلَانَ بْنَ سَلَمَةَ الثَّقَفِيَّ أَسْلَمَ وَلَهُ عَشْرُ نِسْوَةٍ فِي الجَاهِلِيَّةِ فَأَسْلَمْنَ مَعَهُ فَأَمَرَهُ النَّبِيُّ ﷺ أَنْ يَتَخَيَّرَ أَرْبَعًا مِنْهُنَّ
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘যে সময়ে গাইলান ইবনু সালামাহ আস-সাক্বাফী ইসলাম গ্রহণ করেন, সে সময়ে তাঁর দশজন স্ত্রী ছিল, যাদের তিনি জাহিলী যুগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর সাথে সাথে তাঁরাও মুসলিম হয়। রাসূল (ﷺ) তাঁকে এদের মধ্যে হতে যে কোন চারজনকে বেছে নেয়ার নির্দেশ দেন’ (তিরমিযী, হা/১১২৮)।
.
একজন মুসলিম পুরুষের জন্য শর্ত সাপেক্ষে একই সাথে সর্বোচ্চ চারটি বিবাহ বৈধ এই মর্মের দলিল হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تُقۡسِطُوۡا فِی الۡیَتٰمٰی فَانۡکِحُوۡا مَا طَابَ لَکُمۡ مِّنَ النِّسَآءِ مَثۡنٰی وَ ثُلٰثَ وَ رُبٰعَ ۚ فَاِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تَعۡدِلُوۡا فَوَاحِدَۃً اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَلَّا تَعُوۡلُوۡا “আর যদি আশঙ্কা কর যে, তোমরা ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে, তাদের মধ্যে হতে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করবে, আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই (স্ত্রীরূপে) গ্রহণ কর। এটাই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর নিকটবর্তী’ (সূরা আন-নিসা: ৩)।
.
কুরআনের উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন পুরুষ একই সঙ্গে সর্বাধিক চারজন মহিলাকে বিবাহ করতে পারবে। কেননা এখানে বিবাহের সর্বোচ্চ সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে, আর তা হল, ‘চার’। এই চার পর্যন্ত কথাটি আরোপ করে তার উর্ধ্ব সংখ্যক কোন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না বরং তা হবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ- তাও ব্যক্ত করে দিয়েছে। এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায় বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর কর। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরীআত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটাই ইসলামের নির্দেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন এবং যারা এর খেলাফ করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন। নিজের ব্যবহারিক জীবনেও তিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করে দেখিয়েছেন। এমনকি তিনি এমন বিষয়েও সমতাপূর্ণ আদর্শ স্থাপন করেছেন যে ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন ছিল না। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,مَنْ كَانَتْ لَهُ امْرَأَتَانِ فَمَالَ إِلَى إِحْدَاهُمَا، جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ مَائِلٌ صحيح
“যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে”। (আবু দাউদঃ ২১৩৩, তিরমিযী হা/ ১১৪১, ইবন মাজাহ,হস/১৯৬৯,মুসনাদে আহমাদঃ ২/৪৭১ আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪২৯৮)।
.
রাসূল ﷺ থেকে বিশুদ্ধ সনদে হাদিস এসেছে,

عَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ غَيْلَانَ بْنَ سَلَمَةَ الثَّقَفِيَّ أَسْلَمَ وَلَهُ عَشْرُ نِسْوَةٍ فِي الجَاهِلِيَّةِ فَأَسْلَمْنَ مَعَهُ فَأَمَرَهُ النَّبِيُّ ﷺ أَنْ يَتَخَيَّرَ أَرْبَعًا مِنْهُنَّ

ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘যে সময়ে গাইলান ইবনু সালামাহ আস-সাক্বাফী ইসলাম গ্রহণ করেন, সে সময়ে তাঁর দশজন স্ত্রী ছিল, যাদের তিনি জাহিলী যুগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর সাথে সাথে তাঁরাও মুসলিম হয়। রাসূল (ﷺ) তাঁকে এদের মধ্যে হতে যে কোন চারজনকে বেছে নেয়ার নির্দেশ দেন’ (তিরমিযী, হা/১১২৮)। অপর বর্ননায় হারিস ইবনু ক্বায়িস ইবনু ‘উমাইর আল-আসাদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, أَسْلَمْتُ وَعِنْدِيْ ثَمَان نِسْوَةٍ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ ﷺ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ اخْتَرْ مِنْهُنَّ أَرْبَعًا “আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন আমার আটজন স্ত্রী ছিল। বিষয়টি আমি নবী (ﷺ)-কে জানালে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে হতে যে কোন চারজনকে বেছে নাও”(আবূ দাঊদ, হা/২২৪১; ইবনু মাজাহ, হা/১৯৫২)।
.
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াত এবং রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত একাধিক হাদীসের আলোকে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম কুরতুবী, ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আলেমদের ঐকমত্যানুসারে চারের অধিক বিবাহ করা হারাম। এক্ষেত্রে অবশ্যই পঞ্চম বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এটি কুরআন, সহীহ হাদীছ ও ইজমা বিরোধী কার্যকলাপ’ (বিন বায মাজমূঊ ফাতাওয়া, খন্ড: ২০ পৃষ্ঠা: ২১, ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪২৯৮)।
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন,
فدلت سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم على أن انتهاء الله عز وجل في العدد بالنكاح إلى أربع ، تحريم أن يجمع رجل بنكاح بين أكثر من أربع
“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) -এর সুন্নাহ, প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ বিবাহের সংখ্যা চারটিতে সীমাবদ্ধ করেছেন, এবং একজন পুরুষের জন্য চারের অধিক বিবাহ করা নিষিদ্ধ করেছেন”।( ইমাম শাফেঈ আল-উম্ম, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৩১)
.
আবূ হাইয়ান আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
” ( مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ) فظاهر هذا التخصيص : تقسيم المنكوحات إلى : أن لنا أن نتزوج اثنين اثنين ، وثلاثة ثلاثة ، وأربعة أربعة ، ولا يجوز لنا أن نتزوج خمسة خمسة ، ولا ما بعد ذلك من الأعداد
(দুই, তিন বা চার) এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের জন্য দু’টি, তিনটি অথবা চারটি পর্যন্ত বিবাহ করা বৈধ। আর আমাদের জন্য পাঁচটি বা এর বেশি বিবাহ করা জায়েয নয়”।(আল-বাহরুল মুহীত্ব, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৭১)
.
ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,” المقام مقام امتنان وإباحة ، فلو كان يجوز الجمع بين أكثر من أربع لذكره ” .”যদি এক সঙ্গে চারের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয হত, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা সেটা বর্ণনা করতেন” (তাফসীরে ইবনু কাসীর, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২০৯ পৃ.)।
.
ইমাম ইবনু হায্ম (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম বাগাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ” وهذا إجماع : أن أحدا من الأمة لا يجوز له أن يزيد على أربع نسوة ، وكانت الزيادة من خصائص النبي صلى الله عليه وسلم ، لا مشاركة معه لأحد من الأمة فيها “আলেমগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর পরে কোন পুরুষের জন্য চারের অধিক বিবাহ করা হালাল নয়। কেননা এটি রাসূল (ﷺ)-এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল” (মারাতিবুল ইজমা, পৃ. ১১৫; তাফসীরে বাগাবী, ২/১৬১ পৃ.)।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أنه يجمع ماءه في أكثر من أربع نسوة، وهو ما أجمع الصحابة على تحريمه “সাহাবীদের ইজমা অনুযায়ী চারের অধিক বিবাহ করা হারাম’ (আল-ফাতাওয়াউল কুবরা, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ২৬৪)
.
▪️কখন চারের অধিক বিবাহ করা জায়েজ?
.
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি মহান আল্লাহ একজন মুসলিম পুরুষকে সামর্থ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ চারটি বিয়ের অনুমতি দিয়ে বলেছেন, فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً “নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে তাকে তোমরা বিয়ে কর; দুটি, তিনটি অথবা চারটি। আর যদি আশঙ্কা করো, তোমরা ন্যায়সম্মত আচরণ করতে পারবে না, তবে একটি।” [সুরা নিসা: ৩] কোন ব্যক্তি যদি পঞ্চম বিবাহ করতে চায় তাহলে হয় তার পূর্বের চারজন স্ত্রীর কোন একজন মৃত্যুবরণ করতে হবে আর এমন হলে স্বামী তৎক্ষণাত বিয়ে করতে পারবে। অথবা চারজন স্ত্রী জীবিত থাকলে ঐ চারজনের কোন একজন কে শরীয়ত সম্মত কারনে প্রথমে তালাক দিয়ে ঐ নারীর ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কিংবা পুরোপুরি ৩ ত্বালাক্ব দেওয়া শেষ হলেই শুধুমাত্র পঞ্চম বিবাহ করা বৈধ হবে এর পূর্বে নয়।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনু বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৭৮; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমা, ২য় খণ্ড,পৃষ্ঠা: ৬৪১; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৪; ফাতাওয়া ইসলামিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৭৪, ফৎওয়া নং-১২২৯৮)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।