যেসকল কারণে রোজা ভাঙে না

এক নজরে, এমন ৪১ টি কারণ যাতে রোজা ভাঙে না (অথচ অনেকে মনে করে, এসব কারণে রোজা ভেঙে যায়) সেগুলো বিস্তারিত।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন বহু কারণ রয়েছে যেগুলোর জন্য সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির সিয়াম ভঙ্গ হয় না; অথচ সঠিক মাসয়ালা না জানার কারণে আমরা অনেকেই সেগুলোকে সিয়াম ভঙ্গের কারণ মনে করি। আজকের পর্বে আমরা এমন ৪১টি কারণ জানার চেষ্টা করব যেগুলো রমাদানে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সংঘটিত হলেও সিয়াম ভঙ্গ হয় না। যেমন:
.
(১). সেহরীর শেষ সময় পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-সহবাস করা রোযাদারের জন্য বৈধ। কিন্তু ফজর উদয় (সময় বা আযান) হওয়ার সাথে সাথে মুখের খাবার উগলে ফেলা ওয়াজিব। (এ ব্যাপারে মতভেদ পূর্বের পর্বে আলোচিত হয়েছে)। অনুরূপ সহবাস করতে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী পৃথক হয়ে যাওয়া জরুরী। এরূপ করলে রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে অর্থাৎ সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। পক্ষান্তরে সেহরীর সময় শেষ হয়ে গেছে বা ফজরের আযান শুরু হয়ে গেছে জেনে বা শুনেও যদি কেউ পানাহার বা স্ত্রী-সঙ্গমে মত্ত থাকে, তাহলে তার রোযা হবে না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘বিলাল রাতে আযান দেয়। সুতরাং তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে উম্মে মাকতূম আযান দেয়।’’ (সহীহ বুখারী হা/৬১৭)
.
(২). ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় না খেয়ে সিয়াম রাখলে সিয়াম হবে। তবে ইচ্ছাকৃত ভাবে সেহরী না করে ঘুমিয়ে থাকা সুন্নাতের বরখেলাফ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামঃ) বলেন, ‘‘তোমরা সাহারী খাও। কেননা তাতে বরকত রয়েছে।” (বুখারী হা/১৯২৩, মুসলিম হা/১০৯৫)। তিনি বলেন; ‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের সিয়ামের পার্থক্য হলো সাহারী করা।’ (মুসলিম হা/১০৯৬)। অর্থাৎ ইহূদী-নাসারারা সেহরী করে না, আমরা করি। তিনি আরও বলেন, সেহরী বরকতপূর্ণ খাদ্য। অতএব, তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। বরং একঢোক পানি হলেও তোমরা তা পান করো। কেননা আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ সেহরী গ্রহণকারীদের উপর রহমত বর্ষণ করেন। (আহমাদ, সহীহুল জামে‘ হা/৩৬৮)। তবে বাধ্যগত কারণে সেহরী খেতে না পারলেও সিয়ামের নিয়ত করলে সিয়াম আদায় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। (বুখারী, ফাৎহুল বারী; ৪/১৭৫; হা/১৯২২-এর আলোচনা দ্রঃ ‘সাহারী ওয়াজিব নয়’ অনুচ্ছেদ; নায়লুল আওত্বার ২/২২২)
.
(৩). ঘুম থেকে জাগতে না পারার কারণে সেহরী খাওয়া সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় সিয়াম রাখা যাবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো সেহরী না করেও সিয়াম রেখেছেন। (সহীহ মুসলিম, হা/১১৫৪; মিশকাত, হা/২০৭৬)। তাছাড়া সেহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ। সিয়াম না হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয়। (সহীহ বুখারী, হা/১৯২৩)। আর আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যতীত কোন কাজের ভার দেন না…(সূরা আল-বাক্বারাহ; ১৮৬)। এছাড়া ঘুমন্ত ব্যক্তির উপর থেকে শারঈ বিধান উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। (আবু দাঊদ, হা/৪৩৯৮, সনদ সহীহ)
.
(৪). সিয়াম অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত বমি (মুখ ভরে হলেও) রোজা ভঙ্গ হবে না। তেমনি বমি কণ্ঠনালীতে এসে নিজে নিজে ভেতরে ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না। এমনকি ঢেকুর তুলতে গিয়ে যদি রোযাদারের গলাতে কিছু খাবার উঠে আসে অথবা খাবারের স্বাদ গলাতে অনুভব করে এবং তারপরেই ঢোক গিলে নেয়, তাহলে তাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, তা আসলে মুখ পর্যন্ত বের হয়ে আসে না। বরং গলা পর্যন্ত এসেই পুনরায় তা পেটে নেমে যায় এবং রোযাদার কেবল নিজ গলাতে তার স্বাদ অনুভব করে থাকে। (ইবনে উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ ৬/৪৩১)। ইবনে হাযম (রহঃ) বলেছেন; “গলা থেকে বের হয়ে আসা ‘ওগরানো’ রোযা নষ্ট করবে না; যতক্ষণ না এটি মুখে চলে আসার পরে ও ফেলে দিতে দিতে সক্ষম হওয়ার পরে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সেটাকে ফিরিয়ে না নেয়।” (আল-মুহাল্লা খন্ড:৪ পৃষ্ঠা;৩৩৫)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তির বমি এসে গেছে তার উপর কাজা নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে বমি করেছে, তাকে কাজা আদায় করতে হবে।’’ (তিরমিযি, আস-সুনান: ৭২০)
.
(৫). স্বপ্নদোষ বা উত্তেজনাবশত মযী নির্গত হলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কেননা যে সকল কারণে সিয়াম ভঙ্গ হয়; মযী নির্গত হওয়া তার অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সকল ক্ষেত্রে মযীকে পেশাবের ন্যায় বিধান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং পেশাব করলে যেমন সিয়াম ভঙ্গ হয় না; ঠিক তেমনি মযী বের হলেও সিয়াম ভঙ্গ হবে না। (ইবনে উসাইমিন আশ-শারহুল মুমতে’ ৬/৩৭৬; আল-মাজমু লিন-নাবাবী, ৬/৩২৩)। তবে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন সে উত্তেজনা স্বেচ্চায় বা মিলনজনিত কারণে না হয়। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট সিয়াম অবস্থায় স্ত্রীর সাথে একত্রে অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে অনুমতি প্রদান করেন। অতঃপর অন্য এক ব্যক্তি এসে অনুরূপ জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে নিষেধ করে দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি যাকে অনুমতি দিয়েছেন সে ছিল বৃদ্ধ এবং যাকে নিষেধ করেছেন সে ছিল যুবক। (আবু দাঊদ, হা/২৩৮৭, সনদ হাসান সহীহ)। এই হাদীস প্রমাণ করে মযী বের হবে এমন কাজ যুবকদের করা যাবে না।
.
(৬). রক্তদান করা, হিজামা করা, রামাদান মাসে রক্ত দান বা হিজামা করালে সিয়াম পালনকারীর সিয়াম ভঙ্গ হয় কিনা এই মাসালায় আহালুল ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে জমহূর মুহাদ্দিস-ফকীহর মতে যেমন; ইমাম মালিক, ইমাম শাফি‘ঈ, ইমাম আবু হানীফাহ শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে শিঙ্গা লাগালে বা শরীর থেকে রক্ত বের হলে সাওম নষ্ট হবেনা। তাদের দলিল ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুহরিম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন এবং সায়িম (রোযা রাখা) অবস্থায়ও শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা/১৮২৫, ১৯৩৮, ২৯২৯, ২১০৩, সহীহ মুসলিম হা/১২০২)। অপরদিকে ইমাম আহমেদ ইমাম বিন বায শায়খ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে বলেন, সিয়াম থাকা অবস্থায় অধিক মাত্রায় রক্ত নেয়া হলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন; কাউকে রক্তদান করার উদ্দেশ্যে, কেননা এটি হিজামাহ বা কাপিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য সিয়াম থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় রক্তদান করা জায়েয নয়। কেননা এর ফলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, যদি রোগীর অবস্থা খুবই বিপদজনক হয়, আর সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে না পারে এবং ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির রক্ত পেলে রোগী উপকৃত হবে এবং তার প্রয়োজন পূরণ হবে, সেক্ষেত্রে রক্তদান করা জায়েয। পরে অবশ্যই এই দিনের ক্বাযা আদায় করে নেবে। (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪ পৃ.; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৪৭৮; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০৪০৬)। প্রথমটি অধিক সঠিক অর্থাৎ রক্ত দানে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। তবে নিরাপদ রমাদানে দিনের বেলা একান্ত প্রয়োজন না হলে রক্তদান বা হিজামা না করা। (হিজামা সম্পর্কে আলাদা একটি পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ)
.
(৭). শরীরের কোন অংশ কেটে রক্ত বের হলে অথবা পরীক্ষার জন্য সামান্য রক্ত দিলে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] ও শায়খ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সিয়াম থাকা অবস্থায় প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা করলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। কেননা এতে খুবই যৎসামান্য রক্ত নেয়া হয়ে থাকে, যার ফলে শরীরে কোন প্রভাব পড়ে না। আর এটি হিজামার অন্তর্ভুক্ত নয়। (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪ পৃ.; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা:৪৭৮)
.
(৮). সুরমা, কাজল, কসমেটিকস সামগ্রী ইত্যাদি ব্যবহারে রোজার কোন ক্ষতি হয় না। রোযা অবস্থায় সুরমা লাগানো এবং চোখে ও কানে ওষুধ ব্যবহার বৈধ।আনাস ইবনু মালিক (রা.) রোজাদার অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন।। (আবু দাউদ সূত্রে ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসার: ১৩০৫; সনদ হাসান; ইবনু তাইমিয়্যাহ, হাকিকাতুস সিয়াম, পৃষ্ঠা: ৪০-৪১)। শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রমযান মাসের দিনের বেলায় নারীদের জন্য সুরমা ব্যবহার করা ও কিছু কসমেটিকস সামগ্রী ব্যবহার করা নিয়ে আলেমদের সঠিক মতানুযায়ী নারী পুরুষ কারো রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু রোযাদারের জন্য এগুলো রাতের বেলায় ব্যবহার করা উত্তম। অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য সাবান, অয়েল ইত্যাদি যেসব জিনিস দিয়ে চেহারাকে সুশ্রী করা হয়; যেগুলো বাইরের ত্বকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন- মেহেদী, মেকআপ করা ইত্যাদি। তবে মেকআপ করলে যদি চেহারার ক্ষতি হয়; তাহলে ব্যবহার করা উচিত হবে না। (ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায; কিতাবুল ফাতাওয়া আল-জামিআ খণ্ড:-১, পৃষ্ঠা:৩৪৯)
.
(৯). মশা, মাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত
ভাবে গলা বা পেটে ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না।’’ (ইবনু আবি শায়বা, আল মুসান্নাফ: ৬/৩৪৯; ইবনু উসাইমিন, রমযান মাসের ৩০ আসর,পৃষ্ঠা: ১৫৩)
.
(১০). রোযাদার ভুলে কিছু খেয়ে অথবা পান করে নিলে রোযা নষ্ট হবে না। কারণ, রোযার কথা সে ভুলে গিয়েছিল। আর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে রোযাদার ভুলে গিয়ে পানাহার করে ফেলে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে নেয়। এ পানাহার তাকে আল্লাহই করিয়েছেন।”
(বুখারী, আস-সহিহ: ১৯৩৩; মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৫৫)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি রমাযান মাসে ভুলবশতঃ রোযা নষ্টকারী কোন কাজ করে ফেলে, তার উপর কাযা ও কাফ্ফারা কিছুই নেই।”
(ইবনে হিব্বান, সহীহ মাওয়ারিদ ৯০, মুস্তাদ্রাক হাকেম,১/৪৩০)
.
(১১). শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না। বাহ্যিক শরীরের চামড়ায় পাওডার বা মলম ব্যবহার করা রোযাদারের জন্য বৈধ। কারণ, তা পেটে পৌঁছে না। তদনুরূপ প্রয়োজনে ত্বককে নরম রাখার জন্য কোন তেল, ভ্যাসলিন বা ক্রিম ব্যবহার করাও রোযা অবস্থায় জায়েজ। কারণ, এ সব কিছু কেবল চামড়ার বাহিরের অংশ নরম করে থাকে এবং শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে না। পরন্তু যদিও লোমকূপে তা প্রবেশ হওয়ার কথা ধরেই নেওয়া যায়, তবুও তাতে রোযা নষ্ট হবে না। (আবদুর রাযযাক, আল মুসান্নাফ: ৪/৩১৩ ইবনে জিবরীন, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৭)
.
(১২). দাঁতের রুট ক্যানেল করা, দাঁত ফেলা, ইত্যাদির কারনে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। সিয়াম পালনকারীর জন্য দাঁত (স্টোন ইত্যাদি থেকে) পরিষ্কার করা, ডাক্তারী ভরণ (ইনলেই) ব্যবহার করা এবং যন্ত্রণায় দাঁত তুলে ফেলা বৈধ। তবে এ সব ক্ষেত্রে তাকে একান্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ, যাতে কোন প্রকার ওষুধ এবং রক্ত পেটের ভিতরে চলে না যায়। (মাননীয় শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায মাজমুউ ফাতাওয়া ও মাকালাত মুতানাওয়িআ খন্ড:১৫ পৃষ্ঠা :২৫৯)
.
(১৩). থুথু ও গয়ের থেকে বাঁচা দুঃসাধ্য। কারণ, তা মুখে বা গলার গোড়ায় জমা হয়ে নিচে এমনিতেই চলে যায়। অতএব এতে রোযা নষ্ট হবে না এবং বারবার থুথু ফেলারও দরকার হবে না। পক্ষান্তরে মুখের ভিতরকার স্বাভাবিক লালা গিলাতে কোন ক্ষতি নেই। রোযাতেও কোন প্রভাব পড়ে না। (ইমাম উসামিন আশ শারহুল মুমতে’ ৬/৪২৮-৪২৯, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৫)। অনুরুপ, দাঁতে লেগে থাকা গোশত বা অন্য কোন খাবার ফজর উদয় হওয়ার পরে অনিচ্ছাকৃত ভাবে গিলে ফেললে, অথবা তা অতি সামান্য হওয়ার ফলে মুখে বুঝতে পারা এবং বের করে ফেলা সম্ভব না হলে তা মুখের স্বাভাবিক লালার মতই। তাতে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু বেশী হলে এবং তা বের করে ফেলা সম্ভব হলে, বের করে দিলে আর কোন ক্ষতি হবে না। পরন্তু তা ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম প্রশ্ন ৫৩)
.
(১৪). পায়খানা-দ্বারে ওষুধ ব্যবহারে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। রোযাদারের জ্বর হলে তার জন্য পায়খানা-দ্বারে ওষুধ (সাপোজিটরি) রাখা যায়। তদনুরূপ জ্বর মাপা বা অন্য কোন পরীক্ষার জন্য মল-দ্বারে কোন যন্ত্র ব্যবহার করা দোষাবহ বা রোযার পক্ষে ক্ষতিকর নয়। কারণ, এ কাজকে খাওয়া বা পান করা কিছুই বলা হয় না। এবং পায়খানা-দ্বার পানাহারের পথও নয়। (ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৩৮১)
.
(১৫). পেটে (এন্ডোসকপি মেশিন) নল সঞ্চালন করলে অর্থাৎ পেটের ভিতর কোন পরীক্ষার জন্য (এন্ডোসকপি মেশিন) নল বা স্টমাক টিউব সঞ্চালন করার ফলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। তবে হ্যাঁ, যদি পাইপের সাথে কোন (তৈলাক্ত) পদার্থ থাকে এবং তা তার সাথে পেটে গিয়ে পৌঁছে, তাহলে তাতে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এ কাজ ফরয বা ওয়াজীব রোযায় করা বৈধ নয়। (ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা :৩৮৩-৩৮৪)
.
(১৬). রোজা অবস্থায় অজ্ঞান, বেহুঁশ বা অচেতন হলে রোজা ভাঙবে না। তাবিয়ি নাফে (রাহ.) বলেন, ‘(সাহাবি) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) একবার নফল রোজা অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে যান। কিন্তু এ কারণে তিনি রোজা ভঙ্গ করেননি।’ (বাইহাকি, আস-সুনানুল কুবরা: ৪/২৩৫)। তবে রোযাদার যদি ফজর থেকে নিয়ে মাগরিব পর্যন্ত বেহুশ থাকে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে না এবং তাকে ঐ দিনের রোযা কাযা রাখতে হবে এটি জমহুর ওলামাদের মত।
.
(১৭). মেসওয়াক করা, কিংবা ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিস্কার করা; রোযাদার-অরোযাদার সকলের জন্য এবং দিনের শুরু ও শেষ ভাগে সব সময়কার জন্য সুন্নাত। তাই রোজা অবস্থায় মিসওয়াক (কাঁচা বা পাকা ডাল যাই হোক) করলে রোজার কোন সমস্যা নেই। এমনকি ইফতারের পূর্বে মিসওয়াক করলেও অসুবিধা নেই। (সহীহ বুখারী: ১/২৫৯; আবদুর রাযযাক, আল মুসান্নাফ: ৪/২০২)। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমি উম্মতের জন্য কষ্টকর না হলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় দাঁতন করতে আদেশ দিতাম।’ (বুখারী ৮৮৭, মুসলিম ২৫২)। এখানে তিনি সিয়াম পালনকারী ও সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি। ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সিয়াম অবস্থায় কাঁচা ডাল দিয়ে মিসওয়াক করাতে কোনো সমস্যা নেই। তাকে বলা হলো, এর তো স্বাদ আছে? তিনি উত্তরে বললেন, পানিরও তো স্বাদ আছে। আর পানি দিয়ে তুমি কুলি করে থাক। (সহীহ বুখারী, ‘সিয়াম পালনকারীর গোসল করা’ অনুচ্ছেদ) উল্লেখ্য যে, রামাদানে দিনের বেলায় টুথপেস্ট ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ এর কিছু স্বাদ মুখে পাওয়া যায়, ফলে এটি মাকরুহ। তবে, কেউ গিলে না ফেললে রোজা ভাঙবে না। টুথপেস্ট ব্যবহার করার বিষয়ে মাননীয় শাইখ বিন বায (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: “যদি কোন কিছু গিলে ফেলা না হয় এতে কোন অসুবিধা নেই; যেমন মিসওয়াক ব্যবহার করা শরিয়তসঙ্গত।” (ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:২৪৭)। শাইখ মুহাম্মদ সালেহ উসাইমীন বলেন: এ জায়েয হবে। তবে উত্তম হচ্ছে- টুথপেস্ট ব্যবহার না করা। কারণ টুথপেস্টের মধ্যে গলার ভিতরে ও নীচের দিকে চলে যাওয়ার শক্তি প্রবল। তাই দিনের পরিবর্তে রাতে টুথপেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। (শাইখ উছাইমীনের আল-শারহুল মুমতি; ৬/৪০৭, ৪০৮)
.
(১৮). সুগন্ধির সুঘ্রাণ নেওয়া, রোযা রাখা অবস্থায় আতর বা অন্য প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং সর্বপ্রকার সুঘ্রাণ নাকে নেওয়া রোযাদারের জন্য বৈধ। তবে ধুঁয়া জাতীয় সুগন্ধি (যেমন আগরবাতি, চন্দন-ধুঁয়া প্রভৃতি) ইচ্ছাকৃত নাকে নেওয়া বৈধ নয়। কারণ, এই শ্রেণীর সুগন্ধির ঘনত্ব আছে; যা পাকস্থলিতে গিয়ে পৌঁছে। (দ্রঃ ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৮, ফাসিঃ মুসনিদ ৪৩পৃঃ, তাযকীরু ইবাদির রাহমান, ফীমা অরাদা বিসিয়ামি শাহরি রামাযান পৃষ্ঠা: ৪৭)। জেনে রাখা ভালো, রান্নাঘরের যে ধোঁয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাকে এসে প্রবেশ করে, তাতে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কারণ, তা থেকে বাঁচার উপায় নেই। (ইবনে উষাইমীন, মাজমূ’ ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ; ১/৫০৮)। প্রকাশ থাকে যে নস্যি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, তারও ঘনত্ব আছে এবং তার গুঁড়া পেটের ভিতরে পৌঁছে থাকে। তা ছাড়া তা মাদকদ্রব্যের শ্রেণীভুক্ত হলে ব্যবহার করা যে কোন সময়ে এমনিতেই হারাম।
.
(১৯). নাকে ড্রপ, স্প্রে ব্যবহার: স্প্রে দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো ক্যাপসুল স্প্রে পাওডার জাতীয়। যা পিস্তলের মত কোন পাত্রে রেখে পুশ করে স্প্রে করা হয় এবং ধূলোর মত উড়ে গিয়ে গলায় পৌঁছলে রোগী তা গিলতে থাকে। এই প্রকার স্প্রেতে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং পরে কাযা আদায় করতে হবে। দ্বিতীয় প্রকার স্প্রে হলো বাষ্প জাতীয়। এই প্রকার স্প্রেতে রোযা ভাঙ্গবে না। কেননা, তা পাকস্থলীতে পৌঁছে না। (ইবনে উষাইমীন, ক্যাসেটঃ আহকামুন মিনাস সিয়াম)। কারণ, তা হলো এক প্রকার কমপ্রেস্ড্ গ্যাস; যার ডিব্বায় প্রেসার পড়লে উড়ে গিয়ে (নিঃশ্বাসের বাতাসের সাথে) ফুসফুসে পৌঁছে এবং শ্বাসকষ্ট দূর করে। এমন গ্যাস কোন প্রকার খাদ্য নয়। আর রমাযান ও রমাযান ব্যতীত এবং দিনে রাতে সব সময়ে (বিশেষ করে শ্বাসরোধ বা শ্বাসকষ্ট জাতীয় যেমন হাঁফানির রোগী) এর মুখাপেক্ষী থাকে। (ইবনে বায, ফাতাওয়া মুহিম্মাহ, তাতাআল্লাকু বিস্সিয়াম পৃষ্ঠা: ৩৬)। অনুরূপভাবে মুখের দুর্গন্ধ দূরীকরণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার্য স্প্রে রোযাদারের জন্য ব্যবহার করা দোষাবহ নয়। তবে শর্ত হলো, সে স্প্রে পবিত্র ও হালাল হতে হবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ খন্ড: ৩০ পৃষ্ঠা: ১১২)
.
(২০). রান্না করতে করতে প্রয়োজনে খাবারের লবণ বা মিষ্টি সঠিক হয়েছে কি না তা চেখে দেখা রোযাদারের জন্য বৈধ। তদনুরূপ কোন কিছু কেনার সময় চেখে পরীক্ষা করার দরকার হলে তা করতে পারে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, কোন খাদ্য, সির্কা এবং কোন কিছু কিনতে হলে তা চেখে দেখাতে কোন দোষ নেই।(সহীহ বুখারী ৩৮০পৃঃ, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ২/৩০৫, বাইহাকী ৪/২৬১)। ইবনু উসাইমিন (রাহ.) বলেন, ‘খাবারের স্বাদ গ্রহণ করলে রোজা ভাঙবে না, যদি গিলে ফেলা না হয়।’ (রমযান মাসের ৩০ আসর, পৃষ্ঠা: ১৫৫)। তবে, বাধ্য না হলে এমনটি করা মাকরুহ। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহ.) বলেন, ‘প্রয়োজন ছাড়া খাবার চেখে দেখা মাকরুহ; তবে এতে রোজা ভঙ্গ হবে না।’ (ফাতাওয়া কুবরা: খন্ড:৪; পৃষ্ঠা: ৪৭৪; আল-মুগনি (৪/৩৫৯)
.
(২১). রোজা অবস্থায় নখ বা চুল কাটতে কোনো সমস্যা নেই। মেয়েরা হাতে-পায়ে মেহেদী দিলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। রোযাদারের জন্য নিজ মাথার চুল বা নাভির নিচের লোম ইত্যাদি চাঁছা বৈধ। তাতে কোন স্থান কেটে রক্ত পড়লেও রোযার কোন ক্ষতি হয় না। পক্ষান্তরে দাড়ি চাঁছা সব সময়কার জন্য হারাম; রোযা অবস্থায় অথবা অন্য কোন অবস্থায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ খন্ড: ১৯ পৃষ্ঠা:১৬৫)
.
(২২). ক্ষতস্থানে ওষুধ ব্যবহার: রোযাদারের জন্য নিজ দেহের ক্ষতস্থানে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ ইত্যাদি করা দূষণীয় নয়। তাতে সে ক্ষত গভীর হোক অথবা অগভীর। কারণ, এ কাজকে না কিছু খাওয়া বলা যাবে, আর না পান করা। তা ছাড়া ক্ষতস্থান স্বাভাবিক পানাহারের পথ নয়। (আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবু সারী মঃ আব্দুল হাদী ১৪০পৃঃ)
.
(২৩). সহবাস ছাড়া স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হলে রোজা ভাঙবে না। তবে বীর্যপাত হওয়া যাবে না। আয়িশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজাদার অবস্থায় (স্ত্রীকে) চুমু খেতেন এবং আলিঙ্গন করতেন। তবে, নিজ আবেগ-উত্তেজনার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিলো তোমাদের সবার চেয়ে বেশি।’ (সহীহ বুখারি হা/১৯২৭; সহীহ মুসলিম হা/১৯০৬)। ইবনু উসাইমিন (রাহ.) বলেন, ‘কিছু লোক আছে, যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; তাদের দ্রুত বীর্যপাত হয়ে যায়। এমন ব্যক্তি ফরজ রোজা পালনকালে স্ত্রীকে চুম্বন করা, আলিঙ্গন করা ইত্যাদির মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে তাকে সাবধান থাকবে। আর যদি ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে জানে যে, সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তাহলে তার জন্য স্ত্রীকে চুম্বন করা ও জড়িয়ে ধরা জায়েয আছে; এমনকি ফরজ রোজার মধ্যেও।’ তবে, সাবধান! রোজা অবস্থায় দিনের বেলা উত্তেজনাবশত সহবাস করে বসলে কাজা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে।
.
(২৪). রাতে সহবাস করতে কোনো অসুবিধা নেই। এমনকি সহবাসের পর গোসল না করে সেহরী খেয়ে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর গোসল করলেও সমস্যা নেই। আয়িশা (রা.) ও উম্মু সালামা (রা.) বর্ণনা করেন যে, (রাতে সহবাসের ফলে) অপবিত্র থাকা অবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফজর হয়ে যেতো; এরপর তিনি গোসল করতেন ও রোজা রাখতেন। (সহীহ বুখারি হা/১৯২৬; সহীহ মুসলিম হা/১১০৯)। তবে, ফজরের সময়টি খুবই সংক্ষিপ্ত। তাই, কোনোভাবেই যেন ফজরের ওয়াক্ত কেটে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
.
(২৫). রাতের বেলা সহবাস করার পর দিনে যদি বীর্য বের হয় এতে রোজা ভঙ্গ হবে না। আমাদের জন্য সূর্যাস্ত থেকে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস বৈধ করা হয়েছে। হানাফি মাযহাবের “আল-জাওহারা আল-নাইয়্যিরা” তে এসেছে; “যদি সহবাসকারী ফজরের সময় হয়ে যাওয়ার আশংকা থেকে অঙ্গটি বের করে নেয় এবং ফজরের সময় শুরু হওয়ার পর বীর্যপাত করে এতে করে তার রোজা ভঙ্গ হবে না।(আল-জাওহারা আল-নাইয়্যিরা ১/১৩৮; মালেকি মাযহাবের “হাশিয়াতুদ দুসুকি” গ্রন্থ; ১/৫২৩)। বলা হয়েছে-কেউ যদি রাতের বেলায় সহবাস করে আর ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর তার বীর্যপাত হয়; প্রতীয়মান অভিমত হচ্ছে- এতে কোন অসুবিধা নেই। এ মাসয়ালা সে মাসয়ালার মত; ‘কেউ যদি রাতের বেলায় সুরমা লাগিয়ে থাকে সে সুরমা যদি দিনের বেলায় তার গলায় এসে যায়।’ (শিয়াতুদ দুসুকি; ১/৫২৩)
.
(২৬). গরমের কারণে, শরীর ঠাণ্ডা করতে একের অধিকবার গোসল করতেও সমস্যা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই কাজটির প্রমাণ রয়েছে। (মালিক,আল-মুওয়াত্তা: ২/২৯৪; আবু দাউদ হা/২৩৬৫; হাদিসটি সহীহ)। ইবনে কুদামা বলেন: রোযাদারের জন্য গোসল করতে কোন অসুবিধা নেই।(আল-মুগনি; ৩/১৮)। মোটকথা রোযাদারের জন্য পানিতে নামা, ডুব দেওয়া ও সাঁতার কাটা, একাধিক বার গোসল করা, এসির হাওয়াতে বসা এবং কাপড় ভিজিয়ে গায়ে-মাথায় জড়ানো বৈধ। যেমন পিপাসা ও গরমের তাড়নায় মাথায় পানি ঢালা, বরফ বা আইসক্রিম চাপানো দোষাবহ নয়। (ফুসূলুন ফিস্-সিয়ামি অত্-তারাবীহি অয-যাকাহ পৃষ্ঠা: ১৬ ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ; ২/১৩০)। অবশ্য সাঁতার কেটে খেলা করা মকরূহ। কারণ, তাতে রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই। কিন্তু যার কাজই হলো ডুবুরীর অথবা প্রয়োজনের তাকীদে পানিতে বারবার ডুব দিতে হয়, সে ব্যক্তি পেটে পানি পৌঁছনো থেকে সাবধান থাকতে পারলে তার রোযার কোন ক্ষতি হবে না। (মাসআলাহ ফিস-সিয়াম প্রশ্ন ৫৮)
.
(২৭). ওযু করার সময় যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সামান্য পানি গিলে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা ইনশাআল্লাহ। তবে সিয়াম অবস্থায় ওযু বা গোসল করার সময় কুলি করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। লাকীত ইবনু সাবিরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; ‘ভালোভাবে ওযূ্ কর ও আঙুলের ফাঁকা স্থানে খিলাল করো, সিয়াম পালনকারী না হলে নাকে পূর্ণমাত্রায় পানি প্রবেশ করা।’ (আবু দাঊদ, হা/১৪২; মিশকাত, হা/৪০২)। তবে কোনো কারণবশত যদি অনিচ্ছায় নাক বা মুখের মাধ্যমে সামান্য পানি চলে যায় তাহলেও তাতে সিয়াম হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে যে কাজ তোমরা ইচ্ছাকৃত করো (ইচ্ছাকৃত হলে গুনাহ এবং শাস্তি হবে)।’ (সূরা আল-আহযাব; ৩৩/৫)
.
(২৮). রোযাদারের ঠোঁট শুকিয়ে গেলে পানি দ্বারা ভিজিয়ে নেওয়া এবং মুখ বা জিভ শুকিয়ে গেলে কুল্লি করা বৈধ। অবশ্য গড়গড়া করা বৈধ নয়। আর এ ক্ষেত্রে মুখ থেকে পানি বের করে দেওয়ার পর ভিতরে পানির যে আর্দ্রতা বা স্বাদ থেকে যাবে, তাতে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কেননা, তা থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। আবার অতি প্রয়োজনে গড়গড়ার ওষুধ ব্যবহার করা বৈধ। তবে শর্ত হলো, যেন কোন প্রকারে পানি বা ওষুধ গলার নিচে নেমে না যায়। (নচেৎ, তাতে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে)। তাই পূর্বসতর্কতামূলক আমল হলো, তা দিনে ব্যবহার না করে রাতে করা। (মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম, মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ৫৩ ফাসিঃ জিরাইসী ২১পৃঃ)
.
(২৯). কোনো ব্যক্তি যদি রামাদানের রাত্রিতে স্ত্রী সহবাস করে ঘুমিয়ে যায় এবং অপবিত্র অবস্থায় সাহারী খেয়ে সিয়াম রাখে, তাহলে উক্ত সিয়াম শুদ্ধ হবে। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও কখনো কখনো অপবিত্র অবস্থায় ফজর করতেন। অতঃপর সিয়াম রাখতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ও উম্মে সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন, নিজ স্ত্রীর সাথে মিলনজনিত জুনুবী অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফজর হয়ে যেত। তখন তিনি গোসল করতেন এবং সিয়াম রাখতেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৯২৬; তিরমিযী, হা/৭৭৯)
.
(৩০). সিয়াম অবস্থায় ইনজেকশন নেওয়া: যেসব ইনজেকশন খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, সেগুলো সিয়াম অবস্থায় রোগমুক্তির জন্য গ্রহণ করা যাবে। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম অবস্থায় (রোগমুক্তির জন্য) শিঙ্গা লাগাতেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৯৩৮; ইরওয়াউল গালীল, হা/৯৩২)। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমে সিয়াম অবস্থায় শিঙ্গা লাগাতে নিষেধ করতেন। কিন্তু পরে আবার অনুমতি প্রদান করেছেন। (দারাকুত্বনী, হা/৭; বায়হাক্বী-সুনানুল কুবরা, হা/৮০৮৬, সনদ সহীহ)। তবে যেসব ইনজেকশন খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় বা শরীরে শক্তি জোগায়; তা গ্রহণ করলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে।
.
(৩১). ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন গ্রহণ করা যাবে। এতে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা ইনশাআল্লাহ। তবে ইফতারের পর ও সেহরীর পূর্বে ইনসুলিন নেওয়াই উত্তম। যদি এরপরেও প্রয়োজন হয়, সেটা দিনের বেলায় সিয়াম অবস্থায় নিতে পারে। কেননা ইনসুলিন গ্রহণ করা সিয়াম ভঙ্গের কারণ নয়। আর এটি কোন খাদ্য নয়। অনুরূপ হাঁপানী রোগের জন্য সিয়াম অবস্থায় ‘ইনহেলার’ নেওয়া যায়। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৫/২৪৫; মাজাল্লাতু মাজমা‘ইল ফিক্বহিল ইসলামী ১০/৯১৩; উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৯/১৯৬-৯৯)
.
(৩২). অজ্ঞতাবশত সেহরী খাওয়ার পর যদি কেউ বুঝতে পারে যে সাহারীর সময় ১৫ মিনিট আগেই শেষ হয়েছে, সেক্ষেত্রে সিয়াম রাখা যাবে এতে সিয়ামের কোন ক্ষতি হবেনা ইনশাআল্লাহ। ভুল করে কেউ সময়ের পরে সেহরী গ্রহণ করে থাকলে সে সিয়াম পূর্ণ করবে। কারণ অজ্ঞতার কারণে কেউ কোন ভুল করলে তার জন্য আল্লাহ পাকড়াও করেন না। (সূরা বাক্বারাহ; ২/২৮৬)। কতিপয় সাহাবী সাদা রেখা ও কালো রেখার ব্যাখ্যা বুঝতে না পারায় নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেহরী গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে সিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেননি। যা প্রমাণ করে যে, কেউ ভুল করে কয়েক মিনিট পরে সেহরী খেলে তার উক্ত সিয়ামই যথেষ্ট হবে। ক্বাযা আদায় করতে হবে না। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২০/৫৭২-৭৩;আল মুগনী ৩/১৪৭)
.
(৩৩). রাস্তার ধূলা বালি, রাস্তার ধূলা রোযাদারের নিঃশ্বাসের সাথে পেটে গেলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। তদনুরূপ যে ব্যক্তি আটাচাকিতে কাজ করে অথবা তার কাছে যায় সে ব্যক্তির পেটে আটার গুঁড়ো গেলেও রোযার কোন ক্ষতি হবে না। (আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী পৃষ্ঠা: ১৪৫-১৪৬)। কারণ, এ সব থেকে বাঁচার উপায় নেই। অবশ্য মুখে মুখোশ ব্যবহার করে বা কাপড় বেঁধে কাজ করা­ই উত্তম।
.
(৩৪). সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির সিয়াম অবস্থায় এমন দেশে সফর করে রোযা রাখা বৈধ, যেখানের দিন ঠান্ডা ও ছোট এতে সিয়ামের কোন সমস্যা নেই। (ইবনে উসাইমীন, মাজমূ’ ফাতাওয়া ১/৫০৬)। (সফরে সিয়াম পালন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাসহ আলাদা একটি পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ)।
.
(৩৫). করোনার টিকা গ্রহণ: সিয়ামরত অবস্থায় করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করা যাবে। কেননা সিয়াম অবস্থায় খাদ্য নয় এরূপ বস্ত্ত দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করায় কোন বাধা নেই। অতএব যেসব টিকা, ইনস্যুলিন, ইনজেকশন বা ভ্যাকসিন খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় না বা শরীরে বাড়তি পুষ্টি যোগায় না, সেগুলো সিয়াম অবস্থায় চিকিৎসা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে। অনুরূপ হাঁপানী রোগের জন্য সিয়াম অবস্থায় ‘ইনহেলার’ নেওয়া যাবে। কারণ এগুলি স্যালাইন বা গ্লুকোজ ইনজেকশনের ন্যায় খাদ্য বা পানীয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। (ইবনে উসাইমীন,মাজমূ‘ ফাতাওয়া খন্ড ১৯ পৃষ্ঠা: ১৯৬-৯৯, ১৯/২২৫, ২০/২৮৪)
.
(৩৬). ডাগায়নস্টিক ছবি তোলা কিংবা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে কিংবা শরীরের অন্য কোন অঙ্গের শিরাতে ছোট একটি টিউব প্রবেশ করানোতে রোযা ভঙ্গ হবে না। তেমনি নাড়ীভুড়ি পরীক্ষা করার জন্য কিংবা অন্য কোন সার্জিকাল অপারেশনের জন্য পেটের ভেতর একটি মেডিকেল স্কোপ প্রবেশ করালেও রোযা ভাঙ্গবে না। (শাইখ উসাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ ও ‘সিয়াম সংক্রান্ত ৭০টি মাসয়ালা’ নামক এ ওয়েব সাইটের পুস্তিকা)
.
(৩৭). কলিজা কিংবা অন্য কোন অঙ্গের নমুনাস্বরূপ কিছু অংশ সংগ্রহ করলেও রোযা ভাঙ্গবে না; যদি এ ক্ষেত্রে কোন দ্রবণ গ্রহণ করতে না হয়। গ্যাসট্রোস্কোপ (gastroscope) যদি পাকস্থলীতে ঢুকানো হয় তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না; যদি না সাথে কোন দ্রবণ ঢুকানো না হয়। চিকিৎসার স্বার্থে মস্তিষ্কে কিংবা স্পাইনাল কর্ডে কোন চিকিৎসা যন্ত্র কিংবা কোন ধরণের পদার্থ ঢুকানো হলে রোযা ভঙ্গ হবে না। (শাইখ উসাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ ও ‘সিয়াম সংক্রান্ত ৭০টি মাসয়ালা’ নামক এ ওয়েব সাইটের পুস্তিকা ও ইসলামী সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮০২৩)
.
(৩৮). মেডিকেল টেস্টের জন্য নারীর যোনিপথে যা কিছু ঢুকানো হয়; যেমন- সাপোজিটর, লোশন, কলপোস্কোপ, হাতের আঙ্গুল ইত্যাদি।-স্পেকুলাম বা আই, ইউ, ডি বা এ জাতীয় কোন মেডিকেল যন্ত্রপাতি জরায়ুর ভেতরে প্রবেশ করালে কিংবা নারী বা পুরুষের মুত্রনালী দিয়ে যা কিছু প্রবেশ করানো হয়; যেমন- ক্যাথিটার, সিস্টোস্কোপ, এক্সরে এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রঞ্জক পদার্থ, ঔষধ, মুত্রথলি পরিস্কার করার জন্য প্রবেশকৃত দ্রবণের কারণে সিয়াম ভঙ্গ হবেনা। (শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ ও ‘সিয়াম সংক্রান্ত ৭০টি মাসয়ালা’ নামক এ ওয়েব সাইটের পুস্তিকা ও ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮০২৩)
.
(৩৯). এনিমা ব্যবহার, চোখে কিংবা কানে ড্রপ দেয়া, কোন ক্ষতস্থানের চিকিৎসা নেয়া ইত্যাদি রোযা ভঙ্গ করবে না।-হাঁপানি রোগের চিকিৎসা কিংবা অন্য কোন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জিহ্বার নীচে যে ট্যাবলেট রাখা হয় সেটা থেকে নির্গত কোন পদার্থ গলার ভিতরে চলে না গেলে সেটা রোযা নষ্ট করবে না। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া খন্ড:২৫ পৃষ্ঠা:২৩৩ ও ২৪৫
ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮০২৩)
.
(৪০). রামাদান মাসে সিয়াম রেখে মিথ্যা অশ্লীল
কথা বললে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সাওম ভঙ্গ হবে না। তবে এতে তার সাওম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নেকী কমে যাবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কর্ম ছাড়ল না ;তার খানাপিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ (সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/১৯৯৯)। অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় আযীমাবাদী রহ,)বলেন, এই হাদীস দ্বারা এ দলীল নেওয়া হয় যে, এই কাজগুলো সাওমের নেকী কমিয়ে দেয়। (আওনুল মা‘বূদ; ৬/৩৫০)
.
(৪১). দিনে ঘুমানো: রোযাদারের জন্য দিনে ঘুমানো বৈধ। কিন্তু সকল নামায তার যথাসময়ে জামাআত সহকারে আদায় করতে অবহেলা প্রদর্শন করা বৈধ নয়। যেমন, বিভিন্ন ইবাদতের কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা উচিৎ নয়। বরং উচিৎ হলো, ঘুমিয়ে সময় নষ্ট না করে রমাযানের সেই মাহাত্ম্যপূর্ণ সময়কে নফল নামায, যিকর-আযকার ও কুরআন কারীম তেলাওয়াত দ্বারা আবাদ করা। যাতে তার রোযার ভিতরে নানা প্রকার ইবাদতের সমাবেশ ঘটে। (ইবনে উসাইমীন ফাসিঃ মুসনিদ পৃষ্ঠা: ৩১-৩২) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।