সিয়াম ভঙ্গের কারণ

প্রশ্ন: ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে একজন রোজাদারের সিয়াম ভঙ্গের কারণগুলো কী কী?
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মহান আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণ হেকমত অনুযায়ী রোযার বিধান জারী করেছেন। তিনি রোযাদারকে ভারসাম্য রক্ষা করে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন; একদিকে যাতে রোযা রাখার কারণে রোযাদারের শারীরিক কোন ক্ষতি না হয়। অন্যদিকে সে যেন রোযা বিনষ্টকারী কোন বিষয়ে লিপ্ত না হয়। এ কারণে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, সিয়াম -বিনষ্টকারী বিষয়গুলো দুইভাগে বিভক্ত। যথা:
.
প্রথমত: (ক). এমন কিছু সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যেগুলো শরীর থেকে নির্গত হয়, যেমন; (১). যৌন মিলন, (২). ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, (৩). মাসিক ঋতুস্রাব, (৪). শিঙ্গা লাগানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে শরীর থেকে যা বের হয় তা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে সিয়াম বিনষ্টকারী বিষয় হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। যাতে করে সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং সিয়াম তার স্বাভাবিক মধ্যম পন্থার সীমারেখা অতিক্রম না করে। (খ). কিছু সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যেগুলো শরীরে প্রবেশ করার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন; (১). খাওয়া-দাওয়া, (২). পান করা ইত্যাদি। একজন সিয়াম পালনকারী যদি কিছু খায় বা পান করে, তাহলে সিয়াম পালনের মাধ্যমে উদ্দিষ্ট হিকমাহ অর্জিত হয় না।’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ২৫/২৪৮)। মহান আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত আয়াতে রোযা-বিনষ্টকারী বিষয়গুলোর মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন; “এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা (সন্তান) তালাশ করো। আর পানাহার করো যতক্ষণ না কালো সুতা থেকে ভোরের শুভ্র সুতা পরিস্কার ফুটে উঠে…”(সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা রোযা-নষ্টকারী প্রধান বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- পানাহার ও সহবাস। আর রোযা নষ্টকারী অন্য বিষয়গুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদিসে উল্লেখ করেছেন।
.
দ্বিতীয়ত, কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়ের সংখ্যা সাতটি। (তবে আমি গবেষণা করে আরো তিনটি কারন বেশি পেয়েছি যা নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
.
(১). স্ত্রী মিলন করা:
.
এটি সিয়াম ভঙ্গের সবচেয়ে মারাত্মক কারণ এবং গুণাহের দিক থেকে সর্বাধিক ভয়াবহ। যে ব্যক্তি রামাযান মাসে দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে যৌন মিলন করে বীর্যপাত ঘটাক বা না ঘটাক, তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। পাশাপাশি জেনে রাখা ভালো যে, স্ত্রীর পায়খানাদ্বারে সঙ্গম করা মহাপাপ এবং এক প্রকার কুফরী। সুতরাং রমাদান মাসে সিয়াম রাখা অবস্থায় দিনে সহবাস করলে তাহলে ঐ মিলনের ফলে যথাক্রমে ৫টি জিনিস সংঘটিত হবেঃ-(ক). কাবীরা গোনাহ; আর তার ফলে তাকে তওবা করতে হবে। (খ). তার সেদিনের রোযা বাতিল হয়ে যাবে। (গ). তাকে ঐ দিনের অবশিষ্ট অংশ পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। (ঘ). ঐ দিনের রোযা (রমাযান পর) কাযা করতে হবে। (ঙ). বড় কাফফারাহ আদায় করা করতে হবে। আর তা হলো, একটি ক্রীতদাসকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাতে সক্ষম না হলে, লাগাতার (একটানা) দুই মাস রোযা রাখতে হবে। আর তাতে সক্ষম না হলে, ৬০ জন মিসকীনকে খাদ্যদান করতে হবে। এ ব্যাপারে মূল ভিত্তি হলো, মহান আল্লাহর এই বাণী; “রোযার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে।” (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৭; সহীহ বুখারী হা/ ১৯৩৭; সহীহ মুসলিম হা/১১১১)। উল্লেখ্য, যৌন মিলন ব্যতীত অন্য কোন সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়ের ক্ষেত্রে কাফফারা ওয়াজিব হয় না। (রমাদান মাসে দিনে স্ত্রী সহবাস সম্পর্কে আলাদা একটি পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ)
.
(২). হস্তমৈথুন করা:
.
সিয়াম ভঙ্গের দ্বিতীয় কারন হলো হস্তমৈথুন। রোযা নষ্টকারী কর্মাবলীর মধ্যে জাগ্রত অবস্থায় সকাম যৌন-স্বাদ অনুভূতির সাথে বীর্যপাত অন্যতম; চাহে সে বীর্যপাত (নিজ অথবা স্ত্রীর) হস্তমৈথুন দ্বারা হোক অথবা কোলাকুলি দ্বারা, নচেৎ চুম্বন অথবা প্রচাপন দ্বারা। কারণ, উক্ত প্রকার সকল কর্মই হলো এক এক শ্রেণীর যৌনাচার। আর এটা যে সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় তার দলীল হলো নিম্নের হাদীসে কুদসী। সেখানে সিয়াম পালনকারী সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সিয়াম আমার জন্যই, আর আমিই এর যথার্থ প্রতিদান দেব। যেহেতু সে আমারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার প্রবৃত্তি বা কামাচার, খাদ্য দ্রব্য এবং পানীয় বস্তু পরিহার করেছে। আর সিয়াম হল ঢালস্বরূপ।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪)। নিঃসন্দেহে স্বহস্তে বীর্যপাত করা কামনা-বাসনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা একজন সিয়াম পালনকারীকে পরিত্যাগ করতে হবে। যে রামাযান মাসের দিনের বেলা হস্তমৈথুন করে, তার উপর ওয়াজিব হলো: (ক). আল্লাহর কাছে তাওবাহ করা। (খ). দিনের বাকি অংশ সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা এবং (গ). সেদিনের সিয়ামের ক্বাযা আদায় করা। পাশাপাশি জেনে রাখা ভালো যে, হস্ত অথবা অন্য কিছু দ্বারা বীর্যপাত ঘটানো যেমন রোযার মাসে হারাম, তেমনি অন্য মাসেও। কিন্তু রমাযানে তা অধিকরূপে হারাম। যেহেতু এ মাসের রয়েছে পৃথক মর্যাদা এবং তাতে হয়েছে রোযা ফরয। (ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান পৃষ্ঠা: ৬১)
.
(৩). খাওয়া ও পান করা:
.
পানাহার বলতে পেটের মধ্যে যে কোন প্রকারে কোন খাদ্য অথবা পানীয় পৌঁছানোকে বুঝানো হয়েছে; চাহে তা মুখ দিয়ে হোক অথবা নাক দিয়ে, পানাহারের বস্ত্ত যেমনই হোক; উপকারী বা হোক অথবা অপকারী হোক হালাল হোক অথবা হারাম, অল্প হোক অথবা বেশী হোক সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। পানাহারে রোযা নষ্ট হওয়ার মূল ভিত্তি হলো মহান আল্লাহর এই বাণী; আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৭)। সুতরাং ফজর উদয় হওয়ার আগে পর্যন্ত মহান আল্লাহ সিয়াম পালনকারীর জন্য পানাহার বৈধ করেছেন। অতঃপর তিনি রাত পর্যন্ত রোযা রাখার আদেশ দিয়েছেন। আর তা হল রোযা নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকার নাম। তিনি বলেন, অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। (সূরা বাকারাহ; ২/১৮৭)। অর্থাৎ, মাগরেব পর্যন্ত।আর মহান আল্লাহ (হাদীসে কুদসীতে) বলেন, ‘‘সে আমার (সন্তুষ্টি লাভের) আশায় নিজের প্রয়োজনীয় পানাহার ও যৌনাচার পরিহার করে।’’ (সহীহ বুখারী হা/১৮৯৪, সহীহ মুসলিম হা/১১৫১)। সুতরাং যে স্বেচ্ছায় পানাহার করবে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। সে গোনাহগার হবে, বিধায় তার জন্য তওবা ওয়াজিব এবং কাযাও। অবশ্য এর জন্য কোন কাফ্ফারা নেই। তবে ইচ্ছা করে কেউ রোযা নষ্ট করার পর তা কাযা করলেও তা কবুল হবে কি না -তা নিয়ে মতভেদ আছে।
.
(৪). খাওয়া ও পানের বিকল্প কিছু গ্রহণ করা:
.
স্বাভাবিক পানাহারের পথ ছাড়া অন্য ভাবে পানাহারের কাজ নিলে তাতেও রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তা দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। (ক). সিয়াম পালনকারীর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবেশ করানো। যেমন, সে যদি রক্তপাতের শিকার হয় তবে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবিষ্ট করা হলে তার সিয়াম ভেঙ্গে যাবে। কারণ খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা খাবার গ্রহণের সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে রক্ত তৈরি হওয়া। (খ). খাদ্য ও পানীয়ের স্থলাভিষিক্ত হয় এমন খাবার বা প্রোটিন জাতীয় ইনজেকশন। কারণ তা খাদ্য ও পানীয়ের অন্তর্ভুক্ত। (মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭০)। তবে যে সমস্ত ইনজেকশন খাদ্য ও পানীয়ের বদলে ব্যবহৃত হয় না, শুধু চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। যেমন; পেনসিলিন, ইনসুলিন ইত্যাদি অথবা শরীরকে তৎপর করার জন্য বা ভ্যাকসিনের জন্য যে ইনজেকশন দেয়া হয়, তাতে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না। (ফাতাওয়া মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম, ৪/১৮৯)। তবে সর্বাধিক নিরাপদ হলো এগুলো রাতের বেলায় করা। তবে কিডনী ডায়ালাইসিস, যা পরিষ্কার করার জন্য রক্ত বের করে তা কেমিক্যাল পদার্থ, পুষ্টি দানকারী উপাদান। যেমন; চিনি, লবণ ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে আবারো কিডনীতে প্রবেশ করানো হয়, তা সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় বলে গণ্য হবে। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/১৯ পৃ.)।
.
(৫). কাপিং করা বা শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করা:
.
দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হবে কি না – সে নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। (এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাসহ একটি পর্ব আসবে)। তবে এই মাসালায়
বিশুদ্ধ মত হলো তাতে সিয়াম নষ্ট হবে না। অবশ্য নিরাপদ থাকার জন্য পূর্ব সতর্কতামূলক আমল এই যে, রোযাদার রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় একান্ত নিরুপায় না হলে ঐ কাজ করবে না। কারণ, কয়েকটি হাদীসে এসেছে যেমন; সাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেছেন, أَفْطَرَ الْحَاجِمُ وَالْمَحْجُوْمُ ‘রক্তমোক্ষণকারী এবং যার রক্তমোক্ষণ করানো হয়েছে, তাদের উভয়ের সিয়াম নষ্ট হয়ে গেছে।’ (আবু দাঊদ, হা/২৩৬৭-২৩৭০; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৮০-১৬৮১, সনদ সহীহ)। কাউকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করাটাও হিজামাহ বা কাপিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য সিয়াম থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় রক্ত দান করা জায়েয নয়। কেননা তা কাপিং বা শিঙ্গার মতই শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। তবে হ্যাঁ যদি রোগীর অবস্থা খুবই বিপদজনক হয়, আর সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে না পারে এবং ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির রক্ত পেলে রোগী উপকৃত হবে, এবং তার প্রয়োজন পূরণ হবে, সেক্ষেত্রে রক্তদান করা জায়েয। পরে অবশ্যই সে এই দিনের ক্বাযা আদায় করে নেবে। (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৪৭৮; মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০৪০৬)। আর যার রক্তপাত হয়েছে, তার সিয়াম শুদ্ধ হবে। কারণ সে ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/২৬৪)। পক্ষান্তরে দাঁত তোলা বা ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা বা রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির জন্য রক্ত বের হলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। কারণ তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানোর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানোর ন্যায় শরীরের উপর প্রভাবও ফেলে না। (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৪৭৮; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০৪০৬)।
.
(৬). ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা:
.
ইচ্ছাকৃত বমি করলে, অর্থাৎ পেটে থেকে খাওয়া খাদ্য (বমন ও উদ্গিরণ করে) বের করে দিলে, মুখে আঙ্গুল ভরে, পেট নিঙ্রে, কোন বিকট দুর্গন্ধ জাতীয় কিছুর ঘ্রাণ নাকে নিয়ে, অথবা অরুচিকর ঘৃণ্য কিছু দেখে উল্টি করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ঐ রোযার কাযা জরুরী। (ইমাম ইবনে উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৩৮৫)। অপরদিকে সামলাতে না পেরে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বমি হয়ে গেলে সিয়াম নষ্ট হয় না। কারন নবী (ﷺ) বলেছেন, مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ ‘যার অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি আসে তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে না, আর যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে সে যেন ক্বাযা আদায় করে।’ (তিরমিযী, হা/৭২০; আবু দাঊদ, হা/২৩৮০; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৭৬, সনদ সহীহ)। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আলিমগণের মাঝে এ ব্যাপারে ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে সিয়াম বাতিল হবে। (আল-মুগনী, ৪/৩৬৮; মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭১)। পাশাপাশি ঢেকুর তুলতে গিয়ে যদি রোযাদারের গলাতে কিছু খাবার উঠে আসে অথবা খাবারের স্বাদ গলাতে অনুভব করে এবং তারপরেই ঢোক গিলে নেয়, তাহলে তাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, তা আসলে মুখ পর্যন্ত বের হয়ে আসে না। বরং গলা পর্যন্ত এসেই পুনরায় তা পেটে নেমে যায় এবং রোযাদার কেবল নিজ গলাতে তার স্বাদ অনুভব করে থাকে। (উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৪৩১)
.
(৭). হায়েয (মাসিক ঋতুগ্রাব) ও নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) হওয়া:
.
মহিলার মাসিক অথবা নিফাসের খুন বের হতে শুরু হলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যায়। যদি সূর্য অস্ত যাওয়ার সামান্য ক্ষণ পূর্বে খুন দেখা দেয়, তাহলে তার ঐ দিনের রোযা বাতিল এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সামান্য ক্ষণ পরে দেখা দিলে তার ঐ দিনের রোযা শুদ্ধ। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ ‘আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না?’ (সহীহ বুখারী, হা/৩০৪, ১৯৫১, ২৬৫৮; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯, ৮০)। তাই যখনই কোন নারী হায়েয বা নিফাসের রক্ত দেখবে, তখনই তার সিয়াম বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা সূর্যাস্তের এক মুহূর্ত আগেও হোক না কেন। যদি একজন হায়েযাহ (মাসিক ঋতুস্রাব ওয়ালী) বা নুফাসা (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত ওয়ালী) নারীর রাত্রীতে রক্ত পড়া বন্ধ হয় ও সে সয়াম পালনের নিয়ত করে এবং তার গোসল করার আগেই ফজর উদিত হয়, এক্ষেত্রে সকল আলিমের মতানুযায়ী তার সিয়াম শুদ্ধ হবে (আল-ফাতহ্, ৪/১৪৮ পৃ.)। উল্লেখ্য, একজন নারীর জন্য উত্তম হলো তার স্বভাবজাত প্রকৃতির উপর থাকা, আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, রক্ত বন্ধ করে এমন কিছু গ্রহণ না করা। কেননা এর মধ্যে নানাবিধ ক্ষতি আছে। সুতরাং তার করণীয় হলো, হায়েযের সময় সিয়াম ভঙ্গ করা ও পরে ক্বাযা আদায় করার যে বিধান আল্লাহ তার জন্য প্রদান করেছেন, তা গ্রহণ করা। এমনই ছিলেন উম্মুল মুমিনীন, পরবর্তী সাহাবী ও তাবি‘ঈগণের স্ত্রীরা। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/১৫১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৩৮০২৩)।
.
(৮). নিয়ত বাতিল করা:
.
নিয়ত প্রত্যেক ইবাদত তথা রোযার অন্যতম রুকন।
একথা সর্বজন বিদিত যে, সিয়াম হচ্ছে নিয়ত এবং পরিত্যাগের সমষ্টির নাম। অর্থাৎ সাওম বিনষ্টকারী যাবতীয় বস্তু পরিত্যাগ করে সাওম আদায়কারী সাওমের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের নিয়ত করবে। কিন্তু সত্যিই যদি এটাকে সে ভঙ্গ করার দৃঢ় সংকল্প করে ফেলে তবে তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। আর এটা রামাযান মাসে হলে দিনের অবশিষ্ট অংশ তাকে পানাহার ছাড়াই কাটাতে হবে। কেননা বিনা ওযরে যে ব্যক্তি রামাযানে সিয়াম ভঙ্গ করবে তাকে যেমন দিনের বাকী অংশ সিয়াম অবস্থাতেই কাটাতে হবে, অনুরূপভাবে তার কাযাও আদায় করতে হবে। কিন্তু যদি দৃঢ় সংকল্প না করে বরং দ্বিধা-দ্বন্দে থাকে, তবে তার ব্যাপারে বিদ্বানদের মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন, তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ দৃঢ়তার বিপরীত। কেউ বলেছেন, বাতিল হবে না। কেননা আসল হচ্ছে, নিয়তের দৃঢ়তা অবশিষ্ট থাকা, যে পর্যন্ত তা আরেকটি দৃঢ়তা দ্বারা বিচ্ছিন্ন না করবে। আর এর উদাহরণ সেই ব্যক্তির মত, যে নামাযে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করার পর কথা না বলে অথবা নামায পড়তে পড়তে হাওয়া ছাড়ার ইচ্ছা করার পর তা সামলে নিতে পারে। এমন ব্যক্তির যেমন নামায ও ওযু বাতিল নয়, ঠিক তেমনি ঐ রোযাদারের রোযা। রোযা নষ্ট হবে না। আমার দৃষ্টিতে এমতই বিশুদ্ধ। (আল্লাহই অধিক জ্ঞান রাখেন)। (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪১২, ইবনে উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ ৬/ পৃষ্ঠা:৩৭৬)
.
(৯). বেহুশ হওয়া:
.
রোযাদার ব্যক্তি যদি ফজর থেকে শুরু করে মাগরিব পর্যন্ত বেহুশ থাকে, তাহলে অধিকাংশ উলামার মতে তার রোযা শুদ্ধ হবেনা।তাকে সেদিনের রোযার কাযা করতে হবে; কিন্তু কেউ যদি দিনের বেলা বেহুঁশ হয় এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে কিংবা পরে হুঁশ ফিরে এলে তার রোযা শুদ্ধ। যেহেতু সে ভোরে ভালো অবস্থায় রোযা রেখেছে। (ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৩৬৫)। পাশাপাশি জেনে রাখা ভালো, ঘুমের জন্য সিয়াম ভঙ্গ হয়না যদিও সে সারাটি দিন ঘুমিয়ে থাকে। কারণ, ঘুম হলো স্বাভাবিক কর্ম। আর তাতে সার্বিকভাবে অনুভূতি নষ্ট হয় না। ঘুমন্ত ব্যক্তি যদিও তার উপর থেকে কলম তুলে নেওয়া হয়ে থাকে, তবুও তার রোযা শুদ্ধ, তাকে আর কাযা করতে হবে না। (ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে’ খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৩৬৬)
.
(১০). মুরতাদ্দ হওয়া:
.
কোন সন্দেহ, কথা বা কাজের ফলে যদি কোন রোযাদার মুরতাদ্দ (কাফের) হয়ে যায় (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), তাহলে আহালুল আলেমদের ঐক্যমতে তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। অতঃপর সে যদি তওবা করে পুনরায় মুসলিম হয়, তাহলে ঐ রোযা তাকে কাযা করতে হবে; যদিও সে ঐ দিনে রোযা নষ্টকারী কোন জিনিস ব্যবহার না করে। যেহেতু খোদ মুরতাদ্দ্ হওয়াটাই একটি রোযা নষ্টকারী কর্ম। তাতে সে কুফরী কোন বিশ্বাসের ফলে মুরতাদ্দ হোক অথবা কুফরী কোন সন্দেহ করার ফলে, আল্লাহ ও তদীয় রসূল কিংবা দ্বীনের কোন অংশ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে কুফরী কথা বলে মুরতাদ্দ হোক অথবা তা না করে যে কোন প্রকার কুফরী মন্তব্য করে। আর যদিও তার ও তার বাপের নামখানি মুসলিমের তবুও তার সকল ইবাদত প্রত্যাখ্যাত। (বিস্তারিত দ্রঃ আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ,পৃষ্ঠা:৮৩)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো হচ্ছে- রোযা বিনষ্টকারী। তবে,উল্লেখিত কারণগুলোর মধ্যে একমাত্র হায়েয ও নিফাস ছাড়া অবশিষ্ট বিষয়গুলো রোযা ভঙ্গ করার জন্য তিনটি শর্ত পূর্ণ হতে হয়। যেমন: (১).রোযাদার জানবে যে, এই জিনিস এই সময়ে ব্যবহার করলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ, তা ব্যবহার করার সময় তার এ কথা অজানা থাকলে চলবে না যে, এই জিনিস রোযা নষ্ট করে অথবা এখন রোযার সময়।(২).তার স্মরণে থাকা। (৩).জোর-জবরদস্তির স্বীকার না হয়ে স্বেচ্ছায় তাতে লিপ্ত হওয়া। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮০২৩)। মহান আল্লাহ বলেন,“কোন ব্যাপারে তোমরা ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; কিন্তু ইচ্ছাকৃত করলে অপরাধ আছে।” (সূরা আহযাব; ৩৩/৫)। তিনি আরো বলেছেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা যদি ভুল ও ত্রুটি করে ফেলি, তাহলে তুমি আমাদেরকে অপরাধী করো না। (সূরা বাকারা, ২/২৮৬)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার জন্য আমার উম্মতের ভুল-ত্রুটি এবং বাধ্য হয়ে কৃত পাপকে মার্জনা করে দিয়েছেন।’’ (সহীহুল জামেইস সাগীর হা/১৭৩১)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।