ইফতার

প্রশ্ন: ইফতার শব্দের অর্থ কি? ইফতারের সঠিক সময় কখন এবং কোন কোন খাদ্য দিয়ে ইফতার করা সুন্নাহ? ইফতারের সময় কোন দু’আ পাঠ করতে হয়? সূর্য ডোবার পর আবার সূর্য দেখলে করণীয় কি?
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইফতার শব্দটি আরবি ﻓﻄﺮ ফাতর থেকে এসেছে। আরবি ফুতুর শব্দের অর্থ হলো; খোলা, উন্মুক্ত করা, ভঙ্গ করা, ছিঁড়ে ফেলা, রোযা ত্যাগ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ ইফতার হচ্ছে রোযা ত্যাগ করার বা ছাড়ার জন্য খাদ্য গ্রহণ করা। ফিতর আরো যে অর্থ দেয় তা হলো এমন খাদ্য যা দ্বারা রোযা ভঙ্গ করা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় সূর্যাস্তের পরে সঙ্গে সঙ্গে খেজুর, পানি বা যেকোনো হালাল খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের মাধ্যমে রোজা ছেড়ে দেওয়াকে ইফতার বলে। ইফতার করা যেমন ফজিলতের কাজ তেমনি অন্যকে করালেও ফজিলত রয়েছে যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সায়িমকে ইফতার করাবে অথবা কোন গাযীর আসবাবপত্র ঠিক করে দেবে সে তাদের (সায়িম ও গাযীর) সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।
(তিরমিজি হা/৮০৭ মিশকাত হা/১৯৯২)
.
▪️ইফতারের সঠিক সময় কখন?
______________________________________
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এবং রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী সূর্যের পুরো বৃত্ত অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথে ইফতারের সময় হয়। আর সে সময় হলো মাগরিবের সালাতের পূর্বে। ইফতার করে সালাত আদায়ের পর প্রয়োজনীয় আহার ভক্ষণ করবে রোযাদার। কিন্তু যদি আহার প্রস্ত্তত থাকে, তাহলে প্রথমে ইফতার করেই সালাত আদায় করবে; এটাই ছিল রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِذَا أَقْبَلَ اللَّيْلُ مِنْ هَا هُنَا وَأَدْبَرَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا وَغَرَبَتْ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ ‘যখন রাত্রী ঐ দিক থেকে আবির্ভূত হয়, আর দিন এ দিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়, তখনই সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১০০-১১০১)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন, لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ‘লোকেরা যতদিন দ্রুত বা শীঘ্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৮)। সূর্যের গোলাকার বৃত্ত অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথেই আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু ইফতার করতেন।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,‘সূর্যাস্ত প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করাটাই সুন্নাত সম্মত। কেননা সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সিয়ামের সময়সীমার পরিসমাপ্তি ঘটে। সূর্যাস্তের পরও ইফতার করতে বিলম্ব করা, এটি মূলত বিদআতী এবং সুন্নাহ বিরোধীদের কাজ। অতএব, যে ব্যক্তি এমনটি করে তাকে অবশ্যই আল্লাহর কাছে তাওবাহ করতে হবে। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৯/২৪-২৫, ২৮-২৯, এবং ৩১-৩৩ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০০১৯)। অপরদিকে দেরি করে ইফতার করলে বিদআতের পর্যায়ে পড়বে এবং রাসূল (ﷺ)-এর নাফরমানি করা হবে। এমন ব্যক্তিকে খালেছ অন্তরে তওবা করতে হবে। আমাদের দেশে ইফতারের যে সময়সূচী প্রকাশ করা হয়, সেগুলোতে সূর্যাস্তের সময়ের সাথে ১ মিনিট বা ২ মিনিট বা ৫ মিনিট যোগ করে ইফতারের সময় বলে লেখা হয়। কিন্তু হাদীসে উল্লেখিত কল্যাণ লাভ করতে চাইলে সূর্যাস্তের সময় জেনে নিয়ে সাথে সাথেই ইফতার করতে হবে। সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও ইফতার না করে বসে বসে অন্ধকার করা ইয়াহুদী ও থ্রিষ্টানদের কাজ। (আবু দাঊদ, হা/২৩৫৩)।
.
জেনে রাখা ভালো যে, কেউ যদি অতি উৎসাহী হয়ে স্থানীয় সময়কে গুরুত্ব না দিয়ে তাড়াহুড়া করে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ইফতার করে, তাহলে তার জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। রাসূল (ﷺ) বলেন, আমি জাহান্নাম পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির উপর মোটা শিরায় (বাঁধা অবস্থায়) লটকানো আছে, তাদের কেশগুলো কেটে ও ছিঁড়ে আছে এবং কেশ বেয়ে রক্তও ঝরছে। নবী করীম (ﷺ) বলেন, আমি বললাম, ওরা কারা? তাঁরা বললেন, ওরা হলো ঐসব লোক; যারা সময় হওয়ার পূর্বেই ইফতার করে নিত। (হাকেম হা/১৫৬৮; সহীহাহ হা/৩৯৫১; সহীহুত তারগীব হা/১০০৫)। অতএব, দেরীতে ইফতার করে যেমন রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশনা অমান্য করা ও ইহুদী-খৃষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হবে, তেমনি সময়ের পূর্বে ইফতার করাও জাহান্নামী হওয়ার কারণ হবে। হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, সূর্য দেখে তা অস্ত যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলে বা ন্যায়পরায়ণ দু’জন বা একজন সাক্ষী সূর্যাস্তের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিলে সায়েম ইফতার করবে। (ফাৎহুল বারী হা/১৯৫৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/২২৬৭)।
.
▪️কোন কোন খাদ্য দিয়ে ইফতার করা সুন্নাহ?
__________________________________________
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ হচ্ছে- সবচেয়ে পরিপূর্ণ আদর্শ। তিনি রোজা থাকলে কাঁচা খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না পেতেন তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না পেতেন তাহলে পানি দিয়ে ইফতার করতেন। এরপর মাগরিবের ফরজ নামায আদায় করতেন। ঘরে এসে সুন্নত নামায আদায় করতেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কখনও মাগরিবের সালাত ইফতারের পূর্বে পড়তে দেখি নি, কমপক্ষে এক ঢোক পানি পান করে হলেও আগে ইফতার করতেন।” (সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫০৪)। শুয়া‘ইব আরনাবুত বলেন, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ। আলবানী রহ. তা‘লিকাতুল হাসান আলা সহীহ ইবন হিব্বান এ একে সহীহ বলেছেন। অপর বর্ণনায় আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল (ﷺ) মাগরিবের সালাত আদায়ের আগেই কিছু তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে কিছু শুকনা খেজুর দিয়ে ইফতার করে নিতেন। আর যদি শুকনা খেজুর না পেতেন তবে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন।(তিরমিযী হা/৬৯৬, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান গরীব। আবু দাউদ, ২৩৫৬, আলবানী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। সহীহ ইবন হিব্বান, ১৫৭৬। ইমাম হাকিম ও যাহাবী রহ. একে সহীহ বলেছেন)। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি খেজুর পায়, সে যেন তা দিয়ে ইফতার করে। যে ব্যক্তি তা না পায়, সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কারণ, তা হল পবিত্র।” (সহীহুল জামেউস সাগীর ৬৫৮৩)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) খেজুর দ্বারা ইফতার করতে এবং তা না পাওয়া গেলে পানি দ্বারা ইফতার করতে উৎসাহিত করতেন। আর এ হলো উম্মতের প্রতি তাঁর পরিপূর্ণ দয়া ও হিতাকাঙ্খার নিদর্শন। পেট খালি থাকা অবস্থায় প্রকৃতি (পাকস্থলী) কে মিষ্টি জিনিস দিলে তা অধিকরূপে গ্রহণ করে এবং তদ্দ্বারা বিভিন্ন শক্তিও উপকৃত হয়; বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি এর দ্বারা বৃদ্ধি পায়। মদ্বীনার মিষ্টি হলো খেজুর। খেজুরের উপরই তাদের লালন-পালন। খেজুর তাদের প্রধান খাদ্য এবং তা-ই তাদের সহযোগী খাদ্য। আর অর্ধপক্ক খেজুর তাদের ফলস্বরূপ। পক্ষান্তরে পানিও (এ সময়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।) রোযার ফলে কলিজায় এক প্রকার শুষ্কতা আসে। সুতরাং তা প্রথমে পানি দিয়ে আর্দ্র করলে তারপর খাদ্য দ্বারা উপকার পরিপূর্ণ হয়। এ জন্য পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য উত্তম হলো, প্রথমে একটু পানি পান করে তারপরে খেতে শুরু করা। এ ছাড়া খেজুর ও পানিতে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, হার্টের উপকারিতায় যার প্রভাবের কথা কেবল ডাক্তারগণই জানেন। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম যাদুল মা‘আদ খন্ড :২ পৃষ্ঠা :৫০-৫১)
.
বলা বাহুল্য, কারো কাছে পানি ও মধু থাকলে, পানিকে প্রাধান্য দিয়ে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কেননা রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘— যে ব্যক্তি তা না পায়, সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কারণ, তা হলো পবিত্র।’’ অবশ্য পানি পান করার পর মধু খাওয়া দোষাবহ নয়। (ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে খন্ড:৬ পৃষ্ঠা ৪৪২)। এই ভিত্তিতেই খালি পেটে উপকারী বলে দাবী করে প্রথমে আদা-লবণ অথবা (খেজুর ছাড়া) অন্য কোন জিনিস মুখে নিয়ে ইফতার করা সুন্নাতের প্রতিকূল। অবশ্য প্রথমে এক ঢোক পানি খেয়ে তারপর ঐ সব খেতে দোষ নেই। ইফতার করার সময় খাওয়ার মত কোন জিনিস না পাওয়া গেলে মনে মনে ইফতারের নিয়ত করাই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে আঙ্গুল চোষার প্রয়োজন নেই – যেমন কিছু সাধারণ লোক করে থাকে।
.
▪️ইফতারের সময় কোন দু’আ পাঠ করতে হয়?
_________________________________
ইফতারের শুরুতে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন দু‘আ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তাই সাধারণ দু‘আ হিসাবে ইফতারের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করবে। (সহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৬; মিশকাত, হা/৪১৫৯)। ইফতারের পূর্বে পাঠনীয় ‘আল্লা-হুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা আফতারতু’ মর্মে সমাজে প্রসিদ্ধ দু‘আটি যঈফ। (আবু দাঊদ, হা/২৩৫৮; সিলসিলা যঈফাহ, হা/৬৯৯৬; ইরওয়াউল গালীল, ৪/৩৮ পৃ.সনদ জয়ীফ)। অনুরূপ ‘আল্লা-হুম্মা ছুমতু লাকা ওয়া তাওয়াক্কালতু আলা রিযক্বিকা’… নামে প্রচলিত দু‘আটি ভিত্তিহীন। আর ইফতার শেষে পাঠনীয় শরীয়ত সম্মত দোয়া হলো: ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ ا للّٰہُ
উচ্চারণ : ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ’। অর্থ: ‘পিপাসা দূরীভূত হলো, শিরাগুলো সঞ্জীবিত হলো এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নির্ধারিত হলো।’ (আবু দাউদ হা/২৩৫৭, ১/৩২১ পৃঃ; মিশকাত হা/১৯৯৩)। তবে সাধারণ দু‘আ হিসাবে শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও বলা যাবে। (সহীহ মুসলিম, হা/২৭৩৪)
.
▪️সূর্য ডুবে গেছে মনে করে ইফতার করা;
_______________________________________
সূর্য ডুবে গেছে মনে করে রোযাদার ইফতার করে নেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, সূর্য এখনও ডুবে নি, তাহলে সঠিক মতে তার রোযা শুদ্ধ; তাকে কাযা করতে হবে না। কারণ, সে না জেনেই ইফতার করে ফেলেছে। আর অবস্থা (সময়) না জেনে রোযা নষ্টকারী জিনিস ব্যবহার করলে তার এ (না জানার) ওযর গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া আসমা বিন্তে আবী বাকর (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে একদা আমরা মেঘলা দিনে ইফতার করলাম। তারপর সূর্য দেখা গেল। (সহীহ বুখারী হা/১৯৫৯, আবু দাঊদ হা/২৩৫৯, ইবনে মাজাহ হা/১৬৭৪)। সুতরাং তাঁরা সূর্য ডুবে গেছে মনে করেই দিনের বেলায় ইফতার করেছিলেন। অতএব অবস্থা বা সময় তাঁদের অজানা ছিল; শরয়ী নির্দেশ নয়। তাঁদের ধারণায় ছিল না যে, সে সময়টা দিনের বেলা। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে সে দিনকে কাযা করতেও আদেশ দেননি। পক্ষান্তরে (উক্ত অবস্থায়) কাযা ওয়াজিব হলে তা শরীয়তরূপে পরিগণিত এবং তার বর্ণনা আজ পর্যন্ত সুরক্ষিত হতো। অতএব, তা যখন সুরক্ষিত নেই এবং সে ব্যাপারে কোন নির্দেশ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক বর্ণিত নেই, তখন মৌলিক অবস্থা হলো, দায়িত্বমুক্ত হওয়া এবং কাযা না করা। (আশ্শারহুল মুমতে; ৬/৪০২-৪০৩, ৪১০-৪১১)
.
▪️যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পর ইফতার করল, অতঃপর বিমানে উড্ডয়নের পর সূর্য দেখতে পেল। তার জন্য করণীয় কী?
___________________________________
সূর্য ডোবার পর কোন মুসাফির বিমান বন্দরে ইফতার করে বিমান উড্ডয়নের পর যদি পুনরায় সূর্য দেখে, তাহলে তার জন্য পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং পুনরায় রোযায় থাকার নিয়ত করা জরুরী নয়। কারণ, পূর্বে বিমানবন্দরে থাকা অবস্থায় সে তার রোযার পূর্ণ একটি দিন অতিবাহিত করে ফেলেছে। অতএব ইবাদত করার উদ্দেশ্যে তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় শুরু করার কোন পথ নেই। আর তাকে ঐ দিনের সিয়াম কাযাও করতে হবে না। কেননা, তার রোযা শুদ্ধ হয়ে গেছে। (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ১/২৭৫)। ইমাম ইবনু হায্ম, ইবনু আব্দিল বার্র ও ইমাম নববী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, আলিমদের ঐকমত্যানুসারে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই সিয়ামের পরিসমাপ্তি ঘটে। কেননা সিয়ামের সময় হলো, ফজর উদিত হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। (মারাতিবুল ইজমা‘, পৃ. ৩৯; আত-তামহীদ, ১০/৬২; আল-মাজমূঊ, ৬/৩১০ পৃ.)।
.
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি, বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]শায়খ আল-উসাইমীন ও শায়খ আব্দুর রাযযাক আফিফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের শহরে সূর্যাস্তের পর ইফতার করে বিমানে উঠলো, অথবা বিমানের উঠার পর উড্ডয়নের পূর্বে ইফতার করল, অতঃপর বিমান বায়ুতে উঠার পর সূর্য দেখতে পেল, এমতাবস্থায় তার সিয়াম বিশুদ্ধ বলে পরিগণিত হবে। কেননা সে সূর্যাস্তের পর ইফতার করেছে। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/১৩৬-১৩৭ পৃ.; মাজাল্লাতুল বুহূছিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪/১২৫ ও ১৬/১৩০ পৃ.; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৬/৩৯৭; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু উসাইমীন, ১৯/৩৩১-৩৩৪; ফাতাওয়া শায়খ আব্দুর রাযযাক আফীফী, পৃ. ১৬৮)।
.
পক্ষান্তরে সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে প্লেনে উড়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করলে এবং মুসাফির ঐ দিনের রোযা পূর্ণ করতে চাইলে সে নিজের দেশের সময় অনুযায়ী ইফতার করতে পারবে না। বরং শূন্যে থাকা অবস্থায় যতক্ষণ না সূর্য অস্তমিত হতে দেখবে, ততক্ষণ সে রোযায় থাকতে বাধ্য; যদিও তাতে দিন অনেক লম্বা হবে। অনুরূপ ইফতার করার জন্য আকাশের যে লেভেলে এসে সূর্য দেখা যায় না সে লেভেলে প্লেনে নামিয়ে আনা পাইলটের জন্য বৈধ নয়। কারণ, তা এক প্রকার ছল-বাহানা। অবশ্য যদি উড্ডয়নের কোন স্বার্থে বিমান নিচের লেভেলে নামাতে হয় এবং সেখানে এসে সূর্য অদৃশ্য হয়, তাহলে ইফতার করা যাবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ১৪/১২৫, ১৬/১৩০, ৩০/১২৩, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ১৯)
.
▪️এক নজরে ইফতার সংক্রান্ত যে প্রশ্নগুলো জেনে রাখা ভালো;
____________________________

(১). কেউ যদি এমন দেশে পৌঁছে যেখানে তার দেশের চেয়ে ইফতারের সময় কয়েক ঘণ্টা দেরীতে। তাহলে করণীয় হলো সাধ্য থাকলে ঐ দেশের সূর্যাস্ত অনুযায়ী ইফতার করবে। অন্যথা সিয়াম ছেড়ে দিবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৮৫)। কারণ, সফর অবস্থায় সিয়াম তার উপর ফরয নয়। পরে ক্বাযা আদায় করে নিবে। (বাক্বারাহ ১৮৪)। তবে কোন দেশে যদি দীর্ঘস্থায়ী দিন বা রাত হয়, তাহলে নিকটবর্তী বা নিজ দেশের সময় হিসাব করে সিয়াম রাখবে ও ছাড়বে। (বুখারী, মিশকাত হা/৫৪৭৫)
.
(২). অনেকে রামাযান মাসে ইফতারির পূর্বে সম্মিলিতভাবে বা একাকী হাত তুলে দু‘আ করে অথচ একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা দু‘আ করার বিষয়টি প্রমাণিত হলেও ইফতারির পূর্বে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দু‘আ করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তা সুস্পষ্ট বিদআত বা সমাজে প্রচলিত নব আবিষ্কৃত আমল। দ্বিতীয়ত নির্দিষ্টভাবে ইফতারির সময় দু‘আ কবুল হয় মর্মে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (যঈফ ইবনু মাজাহ, হা/১৭৫৩; মিশকাত, হা/২২৪৯)
.
(৩). অনেকে রমাদান মাসে মৃত পিতা-মাতার নামে ইফতার পার্টির আয়োজন করে অথচ তা শরীআতসম্মত নয়। কারণ মৃত ব্যক্তির নামে যেটা প্রদান করা হয়, তা সাদাক্বা। আর সাদাক্বা সবাই খেতে পারে না। বরং এই ধরনের বিদআতী অনুষ্ঠান না করে মৃত পিতা-মাতার নামে টাকা-পয়সা দান করতে হবে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন। আমার ধারণা যে, তিনি কথা বলার সুযোগ পেলে দান করে যেতেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান করি, তবে কি তিনি নেকী পাবেন? নবী করীম (হাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৩৮৮; সহীহ মুসলিম, হা/১০০৪; মিশকাত, হা/১৯৫০)।
.
(৪). পূর্বেই বলেছি, ইফতারের সময় পড়তে হয় এমন কোন নিদিষ্ট দু’আ নেই। সেই সাথে একজন দু‘আ পড়বে আর অন্যরা আমীন আমীন বলবে এরও কোন দলীল নেই। ইফতারের পূর্বমুহূর্তে দু‘আ কবুল হয় মর্মে যে হাদীসটি প্রচলিত আছে, তা যঈফ। তবে এই অল্প সময় নয়, বরং সুবহে সাদিক্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরো সময়টাই সিয়াম পালনকারীর জন্য দু‘আ কবুলের সময়।তাই শুধু ইফতারের পূর্বমুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। সারাদিনই আল্লাহ কাছে দু‘আ করতে পারেন (বায়হাক্বী,সুনানুল কুবরা, হা/৬৬১৯; সিলসিলা সহীহাহা, হা/১৭৯৭; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৫২)।
.
(৫). আমাদের দেশের অধিকাংশ ক্যালেন্ডারের সময়সূচীতে সূর্যাস্তের মূল সময়ের সাথে আরো অতিরিক্ত ৩ কিংবা ৪/৫ মিনিট বৃদ্ধি করা হয়। মূলত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই কাজটি করে আবহাওয়া বিভাগের মাধ্যমে সারা দেশে প্রচার করে। আর সেই ত্রুটিপূর্ণ সময়ই রেডিও, টিভি, পেপার-
পত্রিকা ও দেশের মসজিদগুলো অনুসরণ করে থাকে। এ জন্য পত্রিকাগুলোতে ইফতারের সময় আর সূর্যাস্তের সময় পৃথকভাবে দেয়া থাকে। অথচ সূর্যাস্তের সময়ই ইফতারের সময়। তাই সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করবেন এবং ত্রুটিপূর্ণ সময়সূচী বর্জন করবেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।