যেসকল আমলের মাধ্যমে ফেরেশতাদের দোআয় শামিল হওয়া যায়

ভূমিকা: ফেরেশতাগণ নূরের তৈরী অত্যন্ত শক্তিশালী মহান আল্লাহর এক অন্যতম মহা সৃষ্টির নাম। যা মানুষ স্থূল দৃষ্টিতে দেখতে পায় না। তবে মানুষ তার অস্তিত্বের সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি অনুভব করে। আল্লাহর হুকুমে তারা সর্বক্ষণ সৃষ্টজীবের সেবায় নিয়োজিত। কা‘ব আল-আহবার (রাঃ) বলেন, যদি আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে মানুষকে হেফাযত না করতেন, তাহ’লে এ পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারত না। ইতিপূর্বে এখানে বসবাসকারী জিনেরা তাদের ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে যেত (ইবনু কাসীর) তারা সব সময় আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন করে থাকেন। তারা নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছুই বলেন না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতামন্ডলী, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে।’ (সূরা তাহরীম ৬)। ফেরেশতাগণের অবস্থান মূলত আসমানে। (সূরা আশ-শূরা: ৫; সূরা ফুসসিলাত: ৩৮)। তবে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে আল্লাহর নির্দেশক্রমে আসমান থেকে পৃথিবীর দিকে অবতরণ করেন। (সূরা মারিয়াম: ৬৪; আল-ক্বদর: ৩-৫; তিরমিযী, হা/২৩১২; হাকেম, হা/৩৮৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৫৫৫; মিশকাত, হা/৫৩৪৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭২২)। সর্বোপরি প্রত্যেক মানুষের প্রতি মুহূর্তের নিরাপত্তার জন্য একজন ফেরেশতাকে সার্বক্ষণিক প্রহরী হিসাবে নিয়োজিত রাখা হয়েছে (সূরা ত্বারেক: ৪)। ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম (সূরদ নিসা ১৩৬; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২)। এটি বাদ দিলে মুমিন ঈমানের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। বস্ত্ততঃ ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস আমাদের আত্মিক জগতকে নিয়ন্ত্রিত রাখে এবং এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা ও তাঁর মহান কুদরত সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। যা তার মধ্যে পরকালীন জবাবদিহিতা সৃষ্টি করে। পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ফেরেশতামন্ডলী বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের জন্য দোআ করে থাকেন। আজ আমরা ফেরেশতাদের দোয়ায় কিভাবে শামিল হওয়া যায় সেগুলো জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
(১). মুমিন ও তাদের সৎ আত্মীয়দের জন্য: কিছু এমন সৌভাগ্যবান লোক আছে, যাদের জন্য সম্মানিত ফেরেশতাগণ দোআ করে থাকেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ বহনে রত এবং যারা তার চতুষ্পার্শ্বে ঘিরে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের রব! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তওবা করে এবং তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় এবং তুমি তাদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা কর। সেদিন তুমি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে, তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এটাই তো মহা সাফল্য।’ (সূরা গাফের/মুমিন ৭-৯)।
.
(২). রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি ফেরেশতাগণের দরূদ: ফেরেশতাগণ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর প্রতি দরূদ পাঠ করেন ও তাঁর জন্য দোআ করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। (সূরা আহযাব ৫৬)।
.
(৩). রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর উপর দরূদ পাঠকারীর জন্য :
যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তাদের জন্য দোআ করেন।(বিস্তারিত দেখুন সহীহ আত-তারগীব হা/১৬৬২; মিশকাত হা/৯২৭ ইবনু মাজাহ হা/৯০৭; সহীহুল জামে হা/৫৭৪৪, হাদীস হাসান)
.
(৪). ওযু অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি: যেসব সৌভাগ্যবান মানুষের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দোআ করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ওযু অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে, ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের এই শরীরকে পবিত্র রাখ। আল্লাহ তোমাদেরকে পবিত্র করবেন। যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (ওযু অবস্থায়) রাত অতিবাহিত করবে, অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সঙ্গে রাত অতিবাহিত করবেন। রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই সে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় (ওযু অবস্থায়) ঘুমিয়েছে।’ (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪০১), পৃঃ ৪০৮-৪০৯; হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী হাদীসটি কে জাইয়িদ বলেছেন। দ্রঃ ফাতহুল বারী, ১১তম খন্ড (সঊদী আরব: রিয়াসাতু ইদারাতিল বুহুছিল ইলমিয়্যাহ), পৃঃ ১০৯।
আরো দেখুন সহীহ ইবনে হিব্বান, ৩য় খন্ড (বৈরুত: মুয়াস্সাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ৩২৮-২২৯; হাদীস সহীহ। দ্রঃ সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খন্ড (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মাআরিফ, ১৪০৯ হিঃ) পৃঃ ৩১৭)
.
৫). সালাতের জন্য অপেক্ষারত মুসল্লীবৃন্দ: ওযু অবস্থায় সালাতের জন্য অপেক্ষারত মুসল্লীদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। হাদীসে এসেছে (দেখুন সহীহ মুসলিম ১৩৯৫; তিরমিযী ৩৩০, ৪৯১; নাসায়ী ১৪৩০; আবু দাঊদ ১০৪৬; মুওয়াত্ত্বা মালিক ২৪৩। তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: সহীহ তারগীব ৪৪২, সহীহ আবূ দাউদ ৪৮৯)
.
(৬). প্রথম কাতারের মুসল্লীবৃন্দ: প্রথম কাতারের মুসল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দোআ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, প্রথম কাতারের মুসল্লীদেরকে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করবেন ও ফেরেশতামন্ডলী তাদের জন্য দোআ করবেন।’ (আল-ইহসান ফী তাক্বরীবি সহীহ ইবনে হিব্বান, ৫ম খন্ড, পৃঃ ৫৩০-৫৩১; হাদীস সহীহ, দ্রঃ সহীহুল জামে‘ হা/১৮৩৯ নাসায়ী ৮১১, আবু দাঊদ ৬৬৪, আহমাদ ১৮০৪৫, ১৮১৪২, ১৮১৪৭, ১৮১৬৬, ১৮১৭২; দারিমী ১২৬৪। মিশকাত ১১০১ ইবনে মাজাহ, ৯৯৭)
.
(৭). কাতারের ডান পার্শ্বের মুসল্লীবৃন্দ: কাতারের ডান পার্শ্বের মুসল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দোআ করেন। রাসূল (ﷺ) বলেন,‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়া করেন ও ফেরেশতামন্ডলী দোআ করেন ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের উপর।’ (আল-ইহসান ফী তাক্বরীবি সহীহ ইবনে হিব্বান, ৫ম খন্ড, পৃঃ ৫৩৩-৫৩৪; সুনানু আবী দাঊদ আওনুল মাবুদসহ, ২য় খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হিঃ), পৃঃ ২৬৩; হাদীস হাসান, দ্রঃ আবু দাউদ হা/৬৮০ যদিও অনেকে সনদ জয়ীফ বলেছেন)
.
(৮). কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুসল্লীবৃন্দ: কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুসল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করে থাকেন। আয়েশা (রায্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রমুখাৎ থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “অবশ্যই মহান আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করেন এবং ফিরিশতাবর্গ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন, যারা কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায়।” (আহমাদ ২৪৩৮১, ইবনে মাজাহ ৯৯৫, ইবনে খুযাইমাহ ১৫৫০, ইবনে হিব্বান ২১৬৩, হাকেম)। ইবনে মাজাহ এই উক্তি অধিক বর্ণনা করেছেন, “আর যে ব্যক্তি (কাতারের মাঝে) কোন ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে সেই ব্যক্তিকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (সহীহ তারগীব ৫০১ হাদীস সম্ভার,৭১৩)। কারণে সাহাবীগণ জামাআতে সালাত আদায়কালীন পরস্পর মিলিত হয়ে দাঁড়ানোতে গুরুত্ব দিতেন। বিশিষ্ট সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, অর্থাৎ ‘আমাদের সবাই সালাতে একে অপরের কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাতাম।’ (সহীহুল বুখারী ৪১৯, ৭১৮, ৭১৯, ৭২৩, ৭২৪, ৭২৫, ৭৪২, ৭৪৯, ৬৪৬৮, ৬৬৪৪; মুসলিম ৪২৫; নাসায়ী ৮১৩, ৮১৫, ৮১৮, ৮৪৫, ১০৫৪, ১১১৭; আবূ দাঊদ ৬৬৭, ৬৬৮, ৬৬৯, ৬৭১; ইবনু মাজাহ ৯৯৩)
.
(৯). ইমামের সূরা ফাতিহা শেষে আমীন পাঠকারীবৃন্দ: ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ করলে আমীন বলা শরী‘আত সম্মত। এ সময় ফেরেশতামন্ডলীও আমীন বলে থাকেন। ইমাম ও মুসল্লীদের আমীন এবং ফেরেশতাদের আমীন মিলে গেলে গোনাহ মাফ হয়। এ মর্মে রাসূল (ﷺ) বলেন, ইমাম যখন ‘গাইরিল মাগযুবি আলাইহিম ওয়ালায যল্লীন’ বলবে, তখন তোমরা আমীন বল। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে, তার অতীত জীবনের গোনাহগুলিকে ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৮২; আহমাদ ৭১৮৭; মালেক ১৯৫; বুখারী ৭৮২; মুসলিম ৯৪৭; আবূ দাউদ ৯৩৬; নাসাঈ ৯২৭; ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ১৮০৪; ইবনে খুযাইমা ৫৭৫; দারেমী ১২৪৬; বাইহাক্বী ২২৬৪; হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ৬৫৮)। উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম সূরা ফাতিহা সমাপ্ত করার পর ফেরেশতাগণ সমবেত মুসল্লীদের জন্য আমীন বলে আল্লাহর সমীপে সুপারিশ করে থাকেন, যার অর্থ হলো, হে আল্লাহ! আপনি ইমাম ও মুসল্লীদের সূরা ফাতিহায় বর্ণিত দোআ সমূহ কবুল করুন। কারণ আমীন অর্থ হলো আপনি কবুল করুন।’ (ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬২)
.
(১০). সালাত শেষে ওযুসহ স্বস্থানে অবস্থানকারীবৃন্দ: সালাত শেষে ওযুসহ যেসব মুসল্লী স্বীয় স্থানে বসে থাকে তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা সালাতের পর স্বস্থানে বসে থাকে, তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওযু ভঙ্গ না হবে, (তারা বলেন,) হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং হে আল্লাহ! আপনি তাদের উপর দয়া করুন। (বুখারী ৪৪৫, ৪৭৭, ৬৪৭, ৬৪৯, ২১১৯, ৩২২৯, ৪৭১৭; মুসলিম ৬৪৯; তিরমিযী ২১৫, ২১৬; নাসায়ী ৭৩৩, ৭৩৮; আবূ দাঊদ ৪৬৯, ৪৭০, ৪৭১, ৫৫৬; ইবনু মাজাহ ৭৮৭; আহমাদ ৭১৪৫, ৭৩৬৭, ৭৩৮২, ৭৪৯৮, ৭৫৩০, ৭৫৫৭, ৭৫৫৯, ৭৮৩২; মুওয়াত্তা মালিক ২৯১, ৩৮২, ৩৮৩, ৩৮৫; দারেমী ১২৭৬; রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১০৬৯)
.
(১১). জামাআতে ফজর ও আসর সালাত আদায়কারীর জন্য: যারা ফজর ও আসর সালাত জামাআতে আদায় করে, তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমাদের কাছে রাতে একদল ও দিনে একদল মালায়িকাহ্ আসতে থাকেন। তারা ফাজর ও আসরের ওয়াক্তে মিলিত হন। যারা তোমাদের কাছে থাকেন তারা আকাশে উঠে গেলে আল্লাহ তা’আলা তাদের কাছে (বান্দার) অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তিনি তাদের সম্পর্কে অধিক অবগত। বলেন, তোমরা আমার বান্দাদেরকে কী অবস্থায় ছেড়ে এসেছো? উত্তরে মালায়িকাহ্ বলেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার বান্দাদেরকে সলাত আদায়ে রত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। আর যে সময় আমরা তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছেছি তখনও তারা সলাত আদায় করছিল। (সহীহ বুখারী ৫৫৫; মুসলিম ৬৩২; নাসায়ী ৪৮৫; মালিক ১৮০/৫৯০; আহমাদ ১০৩০৯; সহীহ ইবনু হিব্বান ১৭৩৭; সহীহ আল জামি‘ ৮০১৯। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৬২৬)
.
(১২). মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণের জন্য প্রার্থনাকারী: সাফওয়ান (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সন্ধ্যা উপনীত হলে আমি আবুদ দারদার ঘরে উপস্থিত হলাম, কিন্তু আমি তাকে ঘরে পেলাম না। উম্মুদ দারদা (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, এ বছর তোমার কি হজ্জ করার ইচ্ছা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমাদের মঙ্গলের জন্য দোআ করবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন, কোন মুসলিম তার ভাইয়ের অবর্তমানে তার জন্য নেক দুআ করলে তা কবুল হয়। তার মাথার নিকট একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকেন, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য নেক দুআ করে, তখনই ফেরেশতা বলেন, আমীন এবং তোমার জন্যও অনুরূপ। (মুসলিম ২৭৩২, ২৭৩৩; আবূ দাউদ ১৫৩৪; ইবনু মাজাহ ২৮৯৫; আহমাদ ২১২০০, ২৭০১০; রিয়াদুস সলেহিন ১৫০৩; মিশকাত ২২২৮)
.
(১৩). কল্যাণের পথে ব্যয়কারীদের জন্য: সেসকল লোক যারা কল্যাণের পথে ব্যয় করে থাকেন, তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। নিম্নের হাদীস তার উজ্জ্বল প্রমাণ। আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফিরিশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের বিনিময় দিন।’ আর অপরজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস দিন।’ (সহীহুল বুখারী ১৪৪২; মুসলিম ১০১০; আহমাদ ২৭২৯৪; রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৫৫৩)
.
(১৪). সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য: যারা সিয়াম রাখার নিয়তে সাহরী খায় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَي المُتَسَحِّرِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য দয়া করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন।’ (ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৬৪৩৪; ইবনে হিব্বান ৩৬৬৭; সহীহ তারগীব ১০৫৩; হাদিস সম্ভার হাদিস নং ১০৫৭)
.
(১৫). রোগী দর্শনকারীর জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা: যারা কোন মুসলিম রোগীকে দেখতে যায় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। এ মর্মে হাদীসে এসেছে, আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘যে কোন মুসলিম অন্য কোন (অসুস্থ) মুসলিমকে সকাল বেলায় কুশল জিজ্ঞাসা করতে যাবে, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশ্‌তা কল্যাণ কামনা করবেন। আর যদি সে সন্ধ্যা বেলায় তাকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে যায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশ্‌তা তার মঙ্গল কামনা করে। আর তার জন্য জান্নাতের মধ্যে পাড়া ফল নির্ধারিত হবে।(সহীহ মুসলিম ২৫৬৮; তিরমিযী ৯৬৭; আহমাদ ২১৮৬৮, ২১৮৮৪, ২১৮৯৮, ২১৯১৬, ২১৯৩৩, ২১৯৩৮; রিয়াদুস সলেহিন হাদিস নং ৯০৪)
.
(১৬). রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট উক্তির উপর ফেরেশতাদের আমীন বলা: রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট যা বলা হয় তা কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোন রোগী বা মৃত ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হবে, তখন ভাল কথা বলবে। কেননা ফেরেশতাগণ তা কবুল হওয়ার জন্য আমীন বলে থাকেন।’ (সহীহ মুসলিম ৯১৯; আত্ তিরমিযী ৯৭৭; আবূ দাঊদ ৩১১৫; নাসায়ী ১৮২৫; ইবনু মাজাহ্ ১৪৪৭; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক্ব ৬০৬৬; ইবনু আবী শায়বাহ্ ১০৮৪৭; আহমাদ ২৬৪৯৭; ইবনু হিব্বান ৩০০৫; মুসতাদরাক লিল হাকিম ৬৭৫৮; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭১২৪; শারহুস্ সুন্নাহ্ ১৪৬১; সহীহ আত্ তারগীব ৩৪৮৯; সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৪৯১; মিশকাতুল মাসাবিহ ১৬১৭)। রোগীর নিকটে গেলে আল্লাহ তাআলার নিকটে তার রোগ মুক্তির জন্য দোআ কর এবং মৃত ব্যক্তির নিকট গেলে তার ক্ষমার জন্য আল্লাহর নিকট দোআ করবে। অনুরূপ যে জায়গায় যাও নিজের জন্য ভাল কথাই বলবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/৮৪)
.
(১৭). সৎকাজের শিক্ষা প্রদানকারীর জন্য: যারা মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা দেয় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দোআ করেন। যেমন- রাসূল (ﷺ) বললেন,‘নিশ্চয়ই মানুষকে ভাল কথা শিক্ষাদানকারীর প্রতি আল্লাহ তাআলা দয়া করে থাকেন এবং ফেরেশতাগণ, আসমান ও যমীনের অধিবাসীরা এমনকি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মৎসও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে।’(সহীহ লিগয়রিহী: তিরমিযী ২৬৭৫; সহীহুত্ তারগীব ৮১; দারিমী ১/৯৭-৯৮; মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২১৩)। হাদীসে মানুষকে উত্তম কথা শিক্ষা দেওয়ার অর্থ সম্পর্কে মোল্লা আলী কারী (রাঃ) বলেন, সেটা এমন শিক্ষা যার সাথে মানুষের মুক্তি জড়িত। রাসূল (ﷺ) প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ক্ষমার উল্লেখ করেননি; বরং مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ অর্থাৎ মানুষের উত্তম শিক্ষা দাতার কথা বলেছেন। যেন এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমার উপযুক্ত ঐ শিক্ষক যিনি মানুষকে কল্যাণের পথে পৌছার জন্য ইলম শিক্ষা দান করে থাকেন।
.
পরিশেষে আমরা যেন ফেরেশতাগণ যাদের প্রতি অভিশাপ করে থাকেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে দূরে থাকি এবং যেসব গুনাবলী সম্পন্ন মানব জাতির জন্য দোআ করে থাকেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।