যার চরিত্র যেমন তাঁর সাথে সেরকম ছেলে/মেয়ের বিবাহ হবে এই কথাটি কতটুকু সঠিক

অনেকে সূরা আন-নূরের ২৬ নং আয়াতের আলোকে বলেন, যার চরিত্র যেমন তাঁর সাথে সেরকম ছেলে/মেয়ের বিবাহ হবে, এই কথাটি কতটুকু সঠিক এবং উক্ত আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
যার চরিত্র যেমন তার জীবনসঙ্গীও তেমন হবে’
কথাটি স্বাভাবিক ভাবে কুরআনুল কারীমের আয়াত ও গ্রহণযোগ্য তাফসীরের ভিত্তিতে সঠিক হিসাবে বিবেচিত হলেও চূড়ান্তভাবে সঠিক নয়। কারণ পাপী ব্যক্তি যদি একনিষ্ঠ ভাবে তওবা করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তার ভাগ্যে ভাল কোন স্বামী/স্ত্রী রাখতে পারেন,সেটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তবে স্বাভাবিক ভাবে যে কোনো ঈমানদার পবিত্র পুরুষের জন্য কোনো ব্যভিচারিণী মেয়েকে বিবাহ করা হারাম। তেমনিভাবে যে কোনো ঈমানদার সতী মেয়ের জন্যও কোনো ব্যভিচারী পুরুষকে বিবাহ করা হারাম। মূলত: যে আয়াতের আলোকে উপরোক্ত কথা বলা হয় সে আয়াতটি হলো- আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য, আর সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য (উপযুক্ত)। এ (সচ্চরিত্র)দের সম্বন্ধে লোকে যা বলে এরা তা হতে পবিত্র। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।’ (সূরা আন-নূর; ২৪/২৬)। এই সূরার ৩নং আয়াতটিও এই আয়াতের অর্থকে সমর্থন করে অর্থাৎ যেখানে বলা হয়েছে- ‘ব্যভিচারী শুধুমাত্র ব্যভিচারিণীকে বিবাহ করবে।’(সূরা আন-নূর; ২৪/৩)।উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে, আম্মাজান আয়েশা রাযি.-এর প্রতি মুনাফিকদের অপবাদের ঘটনাকে (ইফক) কেন্দ্র করে। সূরা নূরের ২৬নং উক্ত আয়াতের তাফসিরে বিখ্যাত তাফসির কারক ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম জারীর আত্ব-ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই আয়াত সম্পর্কে মুফাসসিরগণের ব্যাখ্যা থেকে দু’টি অর্থ প্রকাশিত হয়।
.
(১). আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, অপবিত্র নারীর কথাবার্তা অপবিত্র পুরুষদের জন্যই শোভা পায়, অনুরূপভাবে অপবিত্র পুরুষের কথাবার্তা অপবিত্র নারীর জন্য শোভনীয়। পক্ষান্তরে পবিত্র নারীর কথাবার্তা পবিত্র পুরুষদের জন্য, অনুরূপভাবে পবিত্র পুরুষের কথাবার্তা পবিত্র নারীর জন্য। অর্থাৎ অপবিত্র ও অশালীন কথাবার্তা সেই নর-নারী বলে থাকে, যারা নিজেরাই অপবিত্র ও নোংরা। আর পবিত্র ও উত্তম কথাবার্তা বলা পবিত্র ও উত্তম নর-নারীর অভ্যাস। আর মুনাফিক্বরা আয়েশা সিদ্দীকা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর উপর যে অপবাদ আরোপ করেছিল এবং তাঁর সম্পর্কে যে জঘন্য কথা উচ্চারণ করেছিল তার যোগ্য তো তারাই। কেননা তারাই অশ্লীল ও পাপিষ্ঠ ছিল। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সচ্চরিত্রা ও পবিত্র বলে তিনি পবিত্র কথারই যোগ্য। এ আয়াতটি মূলত তাঁর ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়।
.
(২). আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আয়াতটির পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যেহেতু সবদিক থেকেই পবিত্র ছিলেন, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বিবাহ কোন অসতী ও অপবিত্র নারীর সঙ্গে ঘটাবেন এটা অসম্ভব। কেননা কলুষিতা নারীরা শুধু কলুষিত পুরুষের জন্যই শোভনীয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মত উত্তম ও উন্নত চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মত সচ্চরিত্রা ও পবিত্র নারীর বিবাহ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এ আয়াতে একটি নীতিগত কথা বুঝানো হয়েছে। তা হলো, আল্লাহ তা‘আলা মানবচরিত্রে স্বাভাবিকভাবে যোগসূত্র রেখেছেন। দুশ্চরিত্রা, ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষের প্রতি এবং দুশ্চরিত্র ও ব্যভিচারী পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে সচ্চরিত্রা নারীদের আগ্রহ সচ্চরিত্র পুরুষদের প্রতি এবং সচ্চরিত্র পুরুষদের আগ্রহ সচ্চরিত্রা নারীদের প্রতি হয়ে থাকে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আগ্রহ অনুযায়ী জীবনসঙ্গী খোঁজ করে নেয় এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সে সেরূপই পায়। (তাফসীরে ইবনু কাসীর, ৬/৩৪-৩৫ পৃ.; তাফসীরে ত্বাবারী, ৯/২৯৩ পৃ.; এছাড়াও তাফসীরে সা‘দী, কুরতুবী ও বাগাভী দ্র.নোট আল ইখলাস থেকে আরো বিস্তারিত জানতে ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া-১০৩৮৪৫)।
.
উপরোক্ত তাফসীর থেকে বোঝা যায়, উক্ত আয়াতটিতে মানবচরিত্রের একটি স্বাভাবিক রুচিবোধের কথা বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ আগ্রহ এবং রুচিবোধ অনুসারে জীবন সঙ্গী খোঁজ করে নেয়। সেজন্যই তো প্রবাদে বলা হয় ‘যেইছা কু তেইছা মিলে’ অর্থাৎ, যেমনের তেমন মিলে। আল্লাহও তাই বলেন, দুশ্চরিত্রা নারীকূল দুশ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্যে এবং দুশ্চরিত্র পুরুষকুল দুশ্চরিত্রা নারীকুলের জন্যে। সচ্চরিত্রা নারীকুল সচ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষকুল সচ্চরিত্রা নারীকুলের জন্যে। সুতরাং আয়াতটিতে এটা বলা হয় নি যে, কারো পক্ষ থেকে উক্ত নৈতিক অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর যদি সে লজ্জিত হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে তওবা করে, তাহলে চরিত্রবান জীবনসঙ্গী পাবে না। বরং উক্ত আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কোন সৎকর্মশীল পুরুষের জন্য কোন ব্যভিচারিণী নারীকে বিবাহ করা বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে একনিষ্ঠ ভাবে তওবা করে। অনুরূপ এর বিপরীত। অর্থাৎ তওবা করলে বিবাহ করা জায়েয। ইমাম আহমাদ বলেছেন, কোন সৎকর্মশীল পুরুষের সাথে কোন ব্যভিচারিণী নারীর বিবাহ শুদ্ধ হবে না, যতক্ষণ না সে তওবা করে। অনুরূপ কোন সতী নারীর সাথে কোন ব্যভিচারী পুরুষের বিবাহ শুদ্ধ হবে না, যতক্ষণ না সে তওবা করে। শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ.-কে ব্যভিচারিণী নারীর সাথে বিবাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন:তাওবা না করা পর্যন্ত ব্যভিচারিণীর সাথে বিবাহ বৈধ নয়। যদি কোনো পুরুষ তাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বিবাহের পূর্বে একটি ঋতুস্রাব অতিক্রম হতে দেবে। পেটে বাচ্চা আছে বলে প্রমাণিত হলে প্রসবের আগ পর্যন্ত বিবাহ বৈধ হবে না। (দেখুন: আল ফাতওয়া ওয়াল জামেয়া লিল মারআতিল মুসলিমা: ২/৫৮৪)
.
অতএব, যদি ব্যভিচারী সত্যিকার অর্থে দৃঢ়চিত্তে তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। ব্যভিচারকারীর পরকালীন শাস্তির ওয়াদার কথা উল্লেখের পর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“তবে যে তাওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর যে তাওবা করে এবং সৎকাজ করে তবে নিশ্চয় সে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে।”(সূরা আল-ফুরকান; ২৫/ ৬৯-৭০)। হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক তাবারকা ওয়া তা‘আলা প্রত্যেক রাতের তিন ভাগের শেষ ভাগে (একতৃতীয়াংশ বাকী থাকতে) প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন কে আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আমার কাছে কিছু চায় আমি তাকে তা দিব। কে আমার কাছে ক্ষমা চায় আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (সহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৮; আবু দাউদ, হা/১৩১৫; তিরমিযী, হা/৩৪৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৬৬)। অপর বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, যে গুনাহ থেকে তওবা করে সে এমন হয়ে যায়, যেন সে গুনাহটি করেই নি। (ইবনে মাজাহ হা/৪২৫০)
.
▪️তওবা বিশুদ্ধ হবার পদ্ধতি ও শর্তাবলী:
______________________________________
তওবা-ইস্তিগফার পাপ থেকে মুক্তির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করার জন্য দিবা-রাত্রিই প্রস্তুত থাকেন। ক্ষমা চাইলে তিনি রাগ করেন না; বরং অত্যধিক খুশি হন। তাই কোন গুনাহগার ব্যক্তি তওবা করতে চাইলে, প্রথমে যে পাপে লিপ্ত ছিল সেটা ছাড়তে হবে এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ে ও পরকালে জান্নাত পাওয়ার আশায় তওবার নিয়ত করতে হবে। আর মনে মনে ঐ পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে তাতে আর ফিরে না আসার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। সেই সাথে যে যন্ত্রের মাধ্যমে পাপ সংঘটিত হয়েছিল সেটাও ধ্বংস বা সরিয়ে ফেলতে হবে মহান আল্লাহ বলেন, ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর; বিশুদ্ধ ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ তওবা।’(সূরা আত-তাহরীম; ৬৬/৮)
.
তওবা শুদ্ধ হবার শর্তাবলী: আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার বিষয় হলে তওবা শুদ্ধ হওয়ার শর্ত হলো তিনটি। যেমন: (১). ঐ পাপ থেকে বিরত থাকবে। (২). কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হবে। (৩). ঐ পাপ পুনরায় না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবে। আর যদি পাপটি বান্দার সাথে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে তাকে ৪র্থ শর্ত হিসাবে বান্দার নিকটে ক্ষমা চাইতে হবে। কোন হক বা কিছু পাওনা থাকলে তাকে তা বুঝে দিতে হবে। নইলে তার তওবা শুদ্ধ হবে না।’(সূরা তওবা-৮২; ফুরকান-৬৮-৭০, ইমাম নববী, রিয়াযুস সালেহীন ‘তওবা’ অনুচ্ছেদ) অতএব, যেনাকার নারী-পুরুষ যদি একনিষ্ঠভাবে তাওবা করে; তবে এ পাপ থেকে সরে আসার পর তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েজ রয়েছে। পরিশেষে দোয়া করি,মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে জিনা-ব্যভিচারের মত ভয়াবহ গুনাহ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।