পরকীয়া

পরকীয়া কাকে বলে এবং মানুষের পরকীয়ায় জড়িত হওয়ার কারণ ও প্রতিকার গুলো কি কি এবং ইসলামে পরকীয়ার শাস্তি কি।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
পরকীয়ার পরিচয়: ‘পরকীয়া’ বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দ। পরকীয়া হলো বিবাহিত কোন নারী বা পুরুষ নিজ স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া। সমাজে এটি নেতিবাচক হিসাবে গণ্য। মূলত: পরকীয়া হলো বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর নিজ স্বামী বা স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে পর পুরুষ বা পর নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। পরকীয়া’র পরিণতি খুবই মর্মান্তিক এবং ধ্বংসাত্মক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا ‘ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কর্ম এবং অত্যন্ত খারাপ পন্থা।’(সূরা বানী- ইসরাঈল: ৩২)। গোপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় অশ্লীলতাকে আল্লাহ হারাম করেছেন। (সূরা-আরাফ: ৩৩)। রাসূল (ﷺ) স্বীয় উম্মতের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়াকে অধিক ভয় পেতেন। কারণ যখন কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন তার মধ্যে ঈমান থাকে না। (সহীহ বুখারী, হা/২৪৭৫)। অপর হাদীসে এসেছে, যে নারী ব্যভিচারে লিপ্ত তার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন না।’ (ত্বাবারাণী আওসাত্ব, হা/২৭৬৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১০৭৩, সনদ সহীহ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِذَا ظَهَرَ الزِّنَا وَالرِّبَا فِي قَرْيَةٍ فَقَدْ أَحَلُّوا بِأَنْفُسِهِمْ عَذَابَ اللهِ ‘যখন কোন গ্রামে ব্যভিচার ও সূদ প্রসার লাভ করে, তখন তারা নিজেদের উপর আল্লাহর আযাবকে হালাল করে নেয়।’(মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২২৬১; সহীহ আত-তারগীব, হা/২৪০১, সনদ সহীহ)। আর বৃদ্ধ বয়সের পরকীয়া ও ব্যভিচারের শাস্তি আরো জঘন্য। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সাথে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের প্রতি তাকাবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এরা হলো বুড়ো ব্যভিচারী, মিথ্যুক শাসক এবং অহংকারী দরিদ্র।’(সহীহ মুসলিম, হা/১০৭)।

🔸পরকীয়ায় জড়িত হওয়ার কারণ ও প্রতিকার:
_______________________________________
বর্তমানে সমাজে পরকীয়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেলজিয়ামের মনস্তাত্ত্বিক এস্থার পেরেল তাঁর ‘দ্য স্টেট অব অ্যাফেয়ার’ গ্রন্থে পরকীয়াকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিবাহিত নারী-পুরুষের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার অনেক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

(১). ইসলামী শিক্ষার অভাব: ইসলাম মানব জাতির চরিত্রের হিফাযতের জন্য নারী-পুরুষকে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছে এবং বিবাহ বহির্ভূত যাবতীয় সম্পর্ককে হারাম ঘোষণা করেছে। (সূরা-আন‘আম; ৬/১৫১)। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক হারাম ও এর ভয়াবহ শাস্তি না জানার কারণে মানুষ পরকীয়ার মত নিকৃষ্ট কাজে জড়িয়ে পড়ে।

(২). সামাজিক কারণ: ইসলাম সামর্থ্যবান পুরুষকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিলেও (নিসা; ৪/৩) অনেক পুরুষ সামাজিক কারণে একাধিক বিয়ে করতে পারেন না। কারণ সমাজ বহু বিবাহকে ভাল চোখে দেখে না। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন চাহিদার অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। অপরদিকে দুর্বল ও অসুস্থ পুরুষের ক্ষেত্রেও নারী সামাজিক ভয়ে তালাক না নিয়ে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

(৩). পর্দাহীনতা: পরকীয়ার অন্যতম কারণ হলো পর্দাহীনতা। এর ফলে নারী-পুরুষ একে অপরের দেখা-সাক্ষাৎ করার ও কথা বলার সুযোগ পায়। এতে তারা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর শয়তান এটাকে আরো সুশোভিত করে উপস্থান করে এবং পরকীয়ার দিকে নিয়ে যায়। এজন্য ইসলাম পর্দাহীনতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। (তিরমিযী হা/১১৭৩; সহীহাহ হা/২৬৮৮; সহীহুল জামে হা/৬৬৯০)

(৪). নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা: পুরুষ-নারীর অবাধ মেলামেশার সুযোগে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরপর আলাপচারিতা ও পরবর্তীতে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। মহিলারা আজকাল চাকুরী, ব্যবসা, লেখাপড়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে ইসলামী বিধান উপেক্ষা করে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। আর পর পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা ও ঠাট্টা-মশকরার মধ্য দিয়ে একে অপরের প্রতি ঝুকে পড়ছে। অথচ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (বুখারী হা/৫২৩২; মুসলিম হা/২১৭২; তিরমিযী হা/১১৭১)

(৫). গায়রে মাহরামের সাথে সফর করা: মেয়েদের মাহরাম ছাড়া একাকী অথবা গায়র মাহরামের সাথে সফর করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন। কেননা এতে পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্ক সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। অপরদিকে পরকীয়ার কারণেও নারী-পুরুষ নিজেদের কামনা-বাসনা পূরণের জন্য অনেক স্থানে সফর করে থাকে। সেকারণ ইসলাম মাহরাম ব্যতীত মহিলাদের সফর কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এমনকি হজ্জের মত ফযীলতপূর্ণ সফরও মাহরাম ব্যতীত জায়েয নয়। (বুখারী হা/১৮৬২; মুসলিম হা/১৩৪১ সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ হা/১৭২৬; সহীহুল জামে হা/৭৬৫০)

(৬). মাহরাম ব্যতীত নারী-পুরুষের নির্জনবাস করা: পর্দাহীনতার আরেকটি স্তর হলো গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত হওয়া। ইসলাম একে হারাম ঘোষণা করেছে। বর্তমানে এটাকে অনেকে পাপই মনে করে না। দেবর-ভাবী, শালী-দুলাভাই, ড্রাইভার-মহিলা গৃহকত্রী, ডাক্তার-নার্স, অফিসের বস-মহিলা পিএ, শিক্ষক-ছাত্রী, পীর-মহিলা মুরীদ ইত্যাদি বেগানা নারী-পুরুষ প্রতিনিয়ত নির্জনে একত্রিত হয়ে কাজ করছে। ফলে সমাজে পরকীয়ার ঘটনা তীব্রতর হচ্ছে। (তিরমিযী হা/১১৭২; মুসনাদ আহমাদ হা/১৪৩২৪। তিরমিযী হা/২১৬৫; হহীহুল জামে হা/২৫৬৪, বুখারী হা/১৮৬২, ৩০০৬, ৩০৬১, ৫২৩৩; মুসলিম হা/৩৪১)

(৭). ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া: পরকীয়ার আকেরটি কারণ হলো, ছেলে-মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের অমতে বিয়ে দেওয়া। অভিভাবকরা নিজেদের কথা ভাবেন এবং অনেক তাড়াহুড়া করে তাদের সন্তানদের বিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের পছন্দ বা মতামতকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেন না। ফলে এসব ছেলে-মেয়েদের বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। ছেলে-মেয়ে প্রথমে মেনে নিলেও পরে তাদের মধ্যে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। পরিবারের ভয়ে কিছু না বললেও এক সময়য়ে তারা উভয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

(৮). দৈহিক অক্ষমতা: নারী-পুরুষ জৈবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই চাহিদা পূরণ না হলে নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলালুদ্দীন আহমাদ বলেন, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। প্রথমে আসে দৈহিক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়।

(৯). পশ্চিমা সংস্কৃতি: পশ্চিমাদের নিকট খোলামেলা পোষাকে চলা, বেপর্দায় নিজেকে প্রদর্শন করা অন্যায় নয়। অনেক মুসলিম ছেলে-মেয়ে পশ্চিমাদের অনুকরণে পোষাক পরিধান, তাদের স্টাইলে চলা এবং তাদের মত বেশ ধারণ করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণে ছেলে-মেয়েরা খোলামেলা পোষাক পরা এবং নারী-পুরুষ অবাধে মেলা-মেশা করার কারণে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।

(১০). প্রযুক্তির সহজলভ্যতা: প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিময় করেছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে এর অপকারিতা জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। হাতের নাগালে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত অনেকের সাথে পরিচয় হচ্ছে। এ পরিচয় থেকে অনেকে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে।

(১১). আইনের দুর্বলতা: আধুনিক সমাজে পরকীয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলেও এটি আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কারো স্ত্রী যদি পরকীয়ায় লিপ্ত হয় তাহলে স্বামীর কোন আইনগত প্রতিকার নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে পারে। পরকীয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে স্ত্রীর কোন শাস্তির বিধান নেই। কিন্তু দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুসারে স্ত্রীর প্রেমিকের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাকে আইনের মুখোমুখি করানো যাবে। কিন্তু স্ত্রীকে আইনে সোপর্দ করা যাবে না। এমনকি স্ত্রীকে অপরাধের সাহায্যকারী হিসাবেও গণ্য করা যাবে না।

▪️পরকীয়া থেকে বাচাঁর উপায়:
_______________________________
ইসলাম মানব জাতির পরিপূর্ণ জীবন বিধান। সকল সমস্যার সুন্দর সমাধান রয়েছে ইসলামে। তাই পরিবার বিধ্বংসী পরকীয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামে রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করার মাধ্যমে একজন মুসলিম নিজেকে পরকীয়া থেকে বাঁচাতে পারেন:-

(১). আল্লাহকে ভয় করা: প্রকৃত আল্লাহভীতি মানুষকে সকল প্রকার পাপাচার থেকে বিরত রাখতে পারে। আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন, তুমি যখন যেভাবে থাকবে, আল্লাহকে ভয় করবে। কোন পাপ কাজ হয়ে গেলে সাথে সাথেই ভালো কাজ করবে। কারণ ভালো কাজ পাপকে মুছে দিবে। আর মানুষের সাথে সদাচরণ করবে। (তিরমিযী হা/১৯৮৭; সহীহুত তারগীব হা/২৬৫৫; মিশকাত হা/৫০৮৩)

(২). ছেলে-মেয়ের সম্মতিতে বিয়ের ব্যবস্থা করা: বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর সম্মতি থাকা জরুরী। আর পরকীয়া থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে বিয়ের পরে তাদের মধ্যে মহব্বত পয়দা হবে। অনেক পরিবার এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না বা তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না। অথচ এটা ইসলাম বিরোধী। মহান আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে।’ (নিসা; ৪/১৯)

(৩). অশ্লীল বিনোদন পরিহার করা: পরকীয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অশ্লীল নাটক, সিনেমা, গান-বাজনা, টিভি, ইন্টারনেট, বিজ্ঞাপন, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস ও অসৎসঙ্গ তথা যৌন উত্তেজক সব মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ যৌন উত্তেজক এসব বিষয়গুলো মানুষের কু-প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনাকে বাড়িয়ে দেয়।

(৪). পরিবারে ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা: পরিপূর্ণ ইসলামী পরিবেশ ও ইসলামী শিক্ষা পরকীয়ার মত পরিবার বিধ্বংসী পাপ থেকে নারী-পুরষকে রক্ষা করতে পারে। ইসলামী শিক্ষা, পর্দা প্রথা, দৃষ্টি নিম্নগামী রাখার নির্দেশ, বিনা প্রয়োজনে মাহরাম থেকে দূরে থাকার বাস্তবধর্মী আমলগুলোই মানুষকে পরকীয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।

(৫). গায়র মাহরাম থেকে দূরে থাকা: মাহরাম নয়, এমন পরপুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ না রাখা। কেননা চারিত্রিক নির্মলতা ও মানসিক পবিত্রতা রক্ষায় এটি খুবই জরুরী। শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় চলাচল করে। (আবু দাউদ; হা/৪৭১৯)। কোন গায়রে মাহরাম মহিলার সাথে একাকী অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অশ্লীল কাজে লিপ্ত করা শয়তানেরই কাজ। এজন্যই শরী‘আত উক্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, কোন পুরুষ একজন মহিলার সাথে নির্জনে মিলিত হলে তাদের তৃতীয় সঙ্গী হয় শয়তান।’(তিরমিযী হা/১১৭১; মিশকাত হা/৩১১৮)

(৬). হঠাৎ দৃষ্টি চলে গেলে ফিরিয়ে নেওয়া: পরকীয়া থেকে বাঁচতে চোখের হিফাযতের কোন বিকল্প নেই। এজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও কারো দিকে দৃষ্টি চলে গেলে সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির চক্ষু জাহান্নাম দর্শন করবে না। ক. যে চক্ষু আল্লাহর পথে পাহারা দিয়ে রাত্রি যাপন করে, খ. যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং গ. যে চক্ষু আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্ত্ত দর্শন করা থেকে বিরত থাকে।'(ত্ববরানী কাবীর, হা/১০০৩)

(৭). মাহরাম ব্যতীত নারী-পুরুষ একত্রিত না হওয়া: পরকীয়ার আরেকটি মাধ্যম হলো গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষ একত্রিত হওয়া। চাকুরী, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি কারণে দূরে কোথাও যাতায়াতকালে গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষ একসাথে চলাফেরা করে, পরস্পর কথা-বার্তা বলে থাকে। ইসলাম এটাকে হারাম করেছে। (বিস্তারিত দেখুন, তিরমিযী হা/১১৭২; মুসনাদ আহমাদ হা/১৪৩২৪, তিরমিযী হা/২১৬৫; সহীহুল জামে হা/২৫৬৪, বুখারী হা/১৮৬২)

(৮). স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের আমানত রক্ষা করা: স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কের ব্যাপারে সাবধান থাকবে ও নিজের সতীত্ব হেফাযতের মাধ্যমে আমানত রক্ষা করবে। তারা কোনভাবেই খেয়ানত করবে না। তাই সে কোন পরপুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। সে পরপুরুষের সাথে সম্মোহনী কথা বলবে না এবং অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত হবে না। বস্ত্তত এসব কাজ তার দ্বীন-ধর্ম ও ইয্যত-আব্রুকে কদর্য করে দেয়। সুতরাং স্বীয় চোখের দৃষ্টি অবনমিত করা, গলার আওয়াজ নীচু করা এবং স্বীয় যবান ও হাতকে অন্যায়, অশ্লীলতা ও কদর্যতা থেকে হেফাযত করা অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন, فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَاحَفِظَ اللهُ ‘অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত করেছেন, আড়ালেও (সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে।’(সূরা নিসা; ৪/৩৪)।

(৯). ঝগড়া-বিবাধ থেকে দূরে থাকা: ঝগড়া-বিবাদ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একজন অন্যজনকে পর ভাবতে থাকে। আর শয়তান এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরকীয়ার দিকে ধাবিত করে। শয়তানের কাজ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়া। (বিস্তারিত দেখুন, মুসলিম হা/২৮১৩; সহীহাহ হা/৩২৬১, সহীহুত তারগীব হা/২০১৭; আহমাদ হা/১৪৩৭৭)

🔸ইসলামে পরকীয়ার শাস্তি:
______________________________
ইসলামে যেসব অপরাধের দন্ড উল্লেখিত হয়েছে, তন্মধ্যে পরকীয়ার মাধ্যমে সংঘটিত যেনা-ব্যভিচারের শাস্তিই সবচেয়ে কঠিন। ইসলামে ব্যভিচারের সকল উপায়-উপকরণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেউ ব্যভিচার করলে তাকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে যেনা-ব্যভিচার প্রমাণিত হলে এর দু’ধরণের শাস্তি রয়েছে। যথা:

(১). অবিবাহিত নারী-পুরুষের শাস্তি: পরকীয়ার দুই জনের একজন যদি অবিবাহিত হয় তাহলে তার শাস্তি হলো- ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য নির্বাসন দেওয়া। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘ব্যভিচারী অবিবাহিত নারী-পুরুষকে একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন করতে হবে। আর বিবাহিত নারী-পুরুষকে রজম করতে হবে অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে।’(সূরা-নূর; ২৪/২, সহীহ মুসলিম, হা/১৬৯০)

(২). বিবাহিত নারী-পুরুষের শাস্তি: বিবাহিত নারী-পুরুষ যারা এই পরকীয়া অপকর্মের সাথে জড়িত শাস্তি হলো, পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা, যা প্রশাসন কর্তৃক কার্যকর করা হবে। (সহীহ বুখারী, হা/৬৮৭৮)।

(৩). যেনা-ব্যভিচারের পরকালীন শাস্তি: ব্যভিচারী নারী-পুরুষ কবরে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে এবং তাদের পরকীয়ার শাস্তি হলো জাহান্নাম। ফাযালা বিন ওবায়দ (রাঃ) বলেন, তিন প্রকার ধ্বংসে নিপতিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে না- (ক). যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং তার ইমামের (নেতার) অবাধ্য হলো এবং অবাধ্য অবস্থায় মারা গেল। (খ). যে ক্রীতদাসী বা ক্রীতদাস তার মনিবের নিকট থেকে পালিয়ে গেল। (গ). যে নারীর স্বামী বহির্দেশে গিয়েছে, সে যদি তার অনুপস্থিতিতে তার রূপ যৌবনের পসরা করে বেড়ায় এবং ভ্রষ্টা হয়। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯০; সহীহুল জামে হা/৩০৫৮)
.
অপর বর্ননায়, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারা হলো, বৃদ্ধ/বিবাহিত ব্যভিচারী, মিথ্যুক শাসক ও অহংকারী ফকীর।’(সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪১৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৬১, সনদ সহীহ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন ফজর সালাতের পর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি লম্বা ঘটনার এক অংশে বললেন, আমরা একটি গর্তের নিকট এসে পৌঁছলাম, যা তন্দুরের মত ছিল। তার উপর অংশ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশটি ছিল প্রশস্ত। তার তলদেশে আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা যখন উপরের দিকে উঠছে, তখন তার ভিতরে যারা রয়েছে তারাও উপরে উঠে আসছে এবং উক্ত গর্ত হতে বাইরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। আর যখন অগ্নিশিখা কিছুটা শিথিল হচ্ছে, তখন তারাও পুনরায় ভিতরের দিকে চলে যাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তারা উভয়ে বলল, এরা হচ্ছে- ব্যভিচারী নারী-পুরুষ। এভাবে তাদের আযাব চলতে থাকবে। (সহীহ বুখারী, হা/১৩৮৬, ২০৮৫)। অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- ‘আমি একদা ঘুমিয়ে ছিলাম আমার পাশে দু’জন লোক আসল, তারা আমার বাহু ধরে নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখি আমি কিছু লোকের পাশে যারা খুব ফুলে আছে, তাদের গন্ধ এতবেশি যেন মনে হচ্ছে ভাগাড়। আমি বললাম, এরা কারা? নবী করীম (ﷺ) বললেন, এরা ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণী।’
(মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২৮৩৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৯৫১, সনদ সহীহ)। উল্লেখ্য যে, যেনা-ব্যভিচারের এই শাস্তি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কেবলমাত্র দেশের শাসক বা তার প্রতিনিধির। কোন ব্যক্তি বা সামাজিক দায়িত্বশীল তা বাস্তবায়ন করবে না। [ফাতাওয়া লাজনা দায়িমাহ , ২২/৩৫](বেশকিছু তথ্য আত তাহরীক থেকে সংকলিত)
.
পরিশেষে, দু’আ করছি মহান আল্লাহ তা‘আলা পরকীয়ার মত সমাজ বিধ্বংসী ভাইরাস থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন। আমীন!!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।