মোযা এবং মাসাহ নিয়ে বিস্তারিত

প্রশ্ন: মোযা এবং মাসাহ কাকে বলে? মোযার উপর মাসাহ করার হুকুম কি? মোযার উপর মাসাহ করার শর্তাবলী কী? মোযার উপর মাসাহ ভঙ্গের কারণ সমূহ কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:

মোযা: দুই টাখনুকে ঢেঁকে রাখে এমন চামড়ার জুতাকে خف) মোযা বলা হয়। (নাসলুল আওতার (১/২৪১)। পায়ে বেড়ে থাকা দুই হাড্ডিকে কা’ব বলা হয়।

মাসাহ: কোন বস্ত্তর উপর মৃদু হাত বুলানোকে মাসাহ বলা হয়। আর মোজার উপর মাসাহ করা বলতে বুঝায়, ওযুতে দু’পা ধোয়ার বিকল্প হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট মোজার উপর ভিজা হাত বুলানো। (আদ-দুররুল মুখতার (১/১৭৪)।

মোযার উপর মাসাহ করার হুকুম:
________________________________
মোযা দুই প্রকার। যথা- ১- اَلْخُفُّ অর্থাৎ চামড়ার তৈরী মোযা। ২- اَلْجَوْرَبُ অর্থাৎ কাপড়ের তৈরী মোযা। এই উভয় প্রকার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয এবং সুন্নাত। (সহীহ বুখারী হা/১০৬; মুসলিম হা/২৭৪; মিশকাত হা/৫১৮)। বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কোন ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে পবিত্রতা অর্জন করে মোজা পরিধান করার পর ওযু নষ্ট হয়ে গেলে সে মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করতে পারবে।(আল-ইজমা’ (২০) ইবনে মুনযির প্রণীত। আল-আওসাত্বব (১/৪৩৪)।
.
ইবনুল মুবারাক বলেন,মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই,বরং তা বৈধ। এক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করা মাকরূহ ও জায়েয উভয়টিই বর্ণিত আছে। (আওসাত্বব (১/৪৩৪), সুনানুল বাইহাক্বী (১/২৭২), আল-ফাতহ্ (১/৩০৫)।
.
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, মোযার উপরে মাসাহ করা জায়েয, এতে আমার অন্তরে সামান্যতম সন্দেহ নেই। মোযার উপর মাসাহ করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে ৪০টি হাদীস রয়েছে।(ইবনে কুদামা (রহঃ), মুগনী, ১/৩৬০ পৃঃ ইবনে উসাইমীন, বুহূছুন ওয়া ফাতাওয়া ফিল মাসাহ আলাল খুফফাইন, পৃঃ ২৫)।

মোযার উপর মাসাহ করার শর্ত কী?
________________________________
মোযার উপর মাসাহ করার ৪টি শর্ত রয়েছে।

▪️(১)পবিত্র অবস্থায় অর্থাৎ ওযু অবস্থায় মোযা পরিধান করা। অতএব ওযু বিহীন অবস্থায় মোযা পরিধান করলে তার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। (সহীহ বুখারী হা/২০৬,সহীহ মুসলিম ৭৯, ২৭৪ বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ৫৮)।

▪️(২) মোযা পবিত্র হ’তে হবে। অপবিত্রতা থাকলে তার উপর মাসাহ জায়েয নয়। যেমন কুকুর অথবা গাধার চামড়া দ্বারা তৈরীকৃত মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। আবুদাঊদ হা/৬৫০ সালাত’ অধ্যায়)।

▪️(৩) মাসাহ করতে হবে হালকা অপবিত্রতা হ’তে, গোসল ওয়াজিবকারী অপবিত্রতা হ’তে নয়।(তিরমিযী হা/৯৬)।

▪️(৪) মাসাহ হ’তে হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। মুক্বীম (বাড়ীতে অবস্থানকারী) একদিন এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত।তাবি’ঈ শুরায়াহ্ ইবনু হানী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) কে মোজার উপর মাসাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আলী (রাঃ) উত্তরে বললেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিনরাত এবং মুক্বিমের জন্য একদিন একরাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম ২৭৬, নাসায়ী ১২৯, ইবনু মাজাহ্ ৫৫২,মিশকাত ৫১৭ ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন ইবনে উসাইমন প্রশ্ন নং ৩)।

মোযার উপর মাসাহ করার নিয়ম:
__________________________________
দু’টি হাতকে ভিজিয়ে ডানহাতের আঙ্গুলগুলিকে ডান পায়ের আঙ্গুলের উপর থেকে শুরু করে পায়ের পাতার উপর দিকে বুলিয়ে নিয়ে গিয়ে পায়ের রলার শুরু পর্যন্ত মাসাহ্‌ করতে হবে। আর ঐ একই সাথে একই নিয়মে বামহাতের আঙ্গুল দিয়ে বাম পায়ের পাতার উপর মাসাহ্‌ করবে। উভয় কানের মাসাহ্‌ যেমন একই সঙ্গে হয়, ঠিক তেমনিই উভয় পায়ের মাসাহ্‌ একই সঙ্গে হবে। দুই হাত জুড়ে প্রথমে ডান পা, তারপর বাম পা পৃথক করে মাসাহ্‌ করা ঠিক না (আবুদাঊদ,মিশকাত হা/৫২২, ৫২৫,সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৮)। ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন ১৩নং) মুক্বীম অবস্থায় একদিন একরাত ও মুসাফির অবস্থায় তিনদিন তিনরাত একটানা মোযার উপরে মাসাহ করা চলবে, যতক্ষণ না গোসল ফরয হয়। অথবা খুলে ফেলা হয়।(মুসলিম হা/২৭৬;তিরমিযী মিশকাত হা/৫১৭, ৫২০)।

পায়ের তালুতে ধুলো-বালি থাকলেও মোযার নিম্নভাগ ও পেছনের দিকে মাসাহ করা বৈধ নয়।উপরে-নীচে উভয় দিকে মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে,তার সনদ যঈফ এবং সহীহ হাদীসের বিরোধী।(যঈফ তিরমিযী হা/৯৭, ১/২৮ পৃঃ যঈফ আবুদাঊদ হা/১৬৫, ১/২২ পৃঃ)।আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,দ্বীন যদি (মানুষের বুদ্ধি) অনুসারেই হত, তাহলে মোজার উপরের চেয়ে নীচের দিকে মাসাহ করাই উত্তম হত। আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দেখেছি, তিনি মোজার উপরের দিকে মাসাহ করেছেন। (আবু দাউদ,১৬২মিশকাত,৫২৫)।

মোযার উপর মাসাহ ভঙ্গের কারণ সমূহ:
____________________________________
(ক) গোসল ফরয হ’লে:অর্থাৎ মোযার উপরে মাসাহ করার পরে স্ত্রী মিলন করলে অথবা স্বপ্নদোষ হলে তা ভঙ্গ হয়ে যাবে। ছফওয়ান ইবনু আস্সাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেেন, অর্থাৎ আমরা যখন সফরে থাকতাম তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, আমরা যেন আমাদের মোযা না খুলি তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।(তিরমিযী, হা/৯৬, নাছিরুদ্দীন আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন। দ্র. ইরওয়াউল গালীল, হা/১০৪)।

(খ) মোযা খুলে ফেললে মাসাহ ভঙ্গ হয়ে যাবে।অর্থাৎ পবিত্র অবস্থায় মোযা পরিধান করার পরে তা খুলে পুনরায় পরিধান করলে উক্ত মোযার উপরে মাসাহ করা বৈধ নয়।

(গ) নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে: ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পরে মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। আর তা হ’ল, মুক্বীমের জন্য এক দিন ও এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন ও তিন রাত।(মুসলিম, হা/৬৬১; মিশকাত, ‘মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৮২; বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৯)।

◾সফর অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই মুক্বীম হলে তার হুকুম :
_________________________________________
সফর অবস্থায় মোযার উপর তিন দিন,তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। কিন্তু সফরকারী এক দিন অথবা দুই দিন পরে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসলে সে মুক্বীম হয়ে গেল। এ অবস্থায় তার জন্য এক দিন,এক রাতের বেশী মাসাহ করা বৈধ নয়। এমতাবস্থায় তার করণীয় হ’ল,সে মুক্বীমের হুকুম পালন করবে। অর্থাৎ যদি এক দিন,এক রাত অতিক্রম হয়ে থাকে তাহ’লে মাসাহ ত্যাগ করবে। আর যদি এক দিন, এক রাতের কিছু অংশ বাকী থাকে তাহ’লে তা পূর্ণ করবে।(মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫১)।

◾মুক্বীম অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই সফরে বের হ’লে তার হুকুম:
___________________________________________
কেউ মুক্বীম অবস্থায় মোযার উপর মাসাহ করে এক দিন অতিক্রম হলে এবং এক রাত বাকী থাকতেই সফরে বের হল। এখন যেহেতু সে মুসাফির সেহেতু তার জন্য তিন দিন, তিন রাত মাসাহ করা বৈধ। এমতাবস্থায় তার করণীয় হ’ল, সে মুক্বীমের হুকুম বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ সে তার মুক্বীম অবস্থার বাকী এক রাত মাসাহ করে মাসাহ ত্যাগ করবে। কেননা এক্ষেত্রে মুসাফিরের হুকুম পালন করলে মাসাহ সহীহ হবে কি-না এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। অতএব যে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে তা থেকে দূরে থাকাই উচিত। (মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫২)।কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যা তোমার কাছে সন্দেহযুক্ত মনে হয়,তা পরিত্যাগ করে সন্দেহমুক্ত কাজ কর।’( সুনানে তিরমিযী হা,২৫১৮)।

পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হুকুম:
____________________________________
পাগড়ীর উপর মাসাহ করা জায়েয। তবে পাগড়ীর বেশী অংশ মাসাহ করতে হবে। সামান্য কিছু অংশ মাসাহ করলে সহীহ হবে না।(মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫৯)।জা‘ফর ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন,অর্থাৎ আমি নবী করীম (ﷺ)-কে তাঁর পাগড়ীর উপর এবং উভয় মোযার উপর মাসাহ করতে দেখেছি। (সহীহ বুখারী, হা/২০৫ মিশকাত,৫২২)।

অতএব পাগড়ীর উপর মাসাহ করা জায়েয। কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে টুপির উপর মাসাহ করা বৈধ নয়। কেননা হাদীসে টুপির উপর মাসাহ করার কথা বর্ণিত হয়নি। তাছাড়াও পাগড়ী খুলে পুনরায় বাঁধতে যে কষ্ট অনুভূত হয়,টুপিতে তা হয় না। (মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছাইমীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫৩-২৫৪)।

ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার হুকুম: শরীরের কোন অঙ্গ ভেঙ্গে গেলে বা কেটে গেলে সেই অঙ্গে ব্যান্ডেজ করা হয়। ওযু করার সময় সেই ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করা জায়েয। এক্ষেত্রে কোন সময় সীমা নির্ধারিত নয়। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত ব্যান্ডেজ থাকবে ততদিন পর্যন্ত মাসাহ করা জায়েয। (ফিকহুল মুয়াস্সার, মুজাম্মা মালিক ফাহ্দ, পৃঃ ২৭) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।