অযু ভঙ্গের কারনগুলো কি কি

প্রশ্ন: অযু ভঙ্গের কারনগুলো কি কি? অর্থাৎ যে সকল কারনে ওজু ভঙ্গ হয় এবং যে সকল কারনে অযু ভঙ্গ হবেনা, বিস্তারিত বর্ননাসহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: অযু বা পবিত্রতা সালাত আদায়ের জন্য ফরজ ইবাদত। ইতোপূর্বে আমাদের অযুর শর্ত, ফরজ, সুন্নাত,এবং অযু করার সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কি কি কারণে অযু ভঙ্গ হয় এবং কি কি কারনে অযু ভঙ্গ হয়না,তা জানা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।ইসলামী শরীয়তে বিশুদ্ধ দলিলের আলোকে ওযু নষ্ট হওয়ার কারণসমূহ ৭ টি।যেমন:

➤১- পেশাব ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে কিছু বের হওয়া।যেমন বায়ু,কৃমি, নুড়ি, চুল, গোশতের টুকরা বা অনুরূপ কিছু সবই অপবিত্র হিসাবে গণ্য হবে। ([সূরা নিসা ৪৩বুখারী,১৩৫ মুসলিম, হা/২২৫।মিশকাত, হা/২৮০ বায়ু নির্গত ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে স্পষ্ট দলীল না থাকলেও বিদ্বানগণ একমত যে, পায়ুপথ দিয়ে যা কিছু বের হবে তাতে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ১/২৩০) এর উপরেই ফৎওয়া দিয়েছেন সুফিয়ান ছওরী, ইসহাক, আত্বা, হাসান বছরী প্রমুখ, যদিও ইমাম মালেকসহ কতিপয় বিদ্বান ভিন্নমত পোষণ করেছেন (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ১৭/১১২)রাসূল (ﷺ)বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সে (বায়ু বের হবার) কোন শব্দ না শুনে বা গন্ধ না পায়’ (বুখারী হা/১৩৭, মুসলিম হা/৩৬২, মিশকাত হা/৩০৬)। অর্থাৎ বায়ু বের হওয়ার কারণে যখন ওযূ নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে কৃমি বের হ’লে ওযূ ভঙ্গ হওয়া অধিক যৌক্তিক (ইবনে উসাইমীন, তা‘লীক্বাত ‘আলাল কাফী লি ইবনে কুদামাহ ১/১২৮)।
.
➤২- পেশাব-পায়খানার রাস্তা ব্যতীত শরীরের অন্য কোন জায়গা দিয়ে মল-মূত্র অথবা বায়ু নির্গত হওয়া।[মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উসাইমীন,রহ শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৭৪ পৃঃ, মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ফাওযান, আল-মুলাক্ষাছুল ফিক্বহী ১/৬১ পৃঃ]
.
➤৩- ওযু অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।[সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/৪৭৮।সুনানু আবু দাউদ, হা/২০৩, সুনানু ইবনু মাজাহ, হা/৪৭৭, হাদীস হাসান। দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল ১/১৪৮ পৃঃ। মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২১/২৩০ পৃঃ মুসলিম, হা/৩৭৬, আবূ দাঊদ, হা/২০০]
.
➤৪-গোসল ফরয হয় এমন কিছু ঘটে যাওয়া। অর্থাৎ যেসব কারণে গোসল ফরয হয় সেসব ঘটনায় ওযুও ভঙ্গ হয়ে যায়।[সূরা মায়েদাহ ৫/৬]
.
➤৫- ওযু অবস্থায় উটের গোশত খাওয়া।[সহীহ মুসলিম, হা/৩৬০] মিশকাত, হা/৩০৫ মাজাহ্‌, সুনান, জামে ৩০০৬]
.
➤৬-উত্তেজনা বশত লজ্জাস্থান সরাসরি স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে।[আহমাদ, ইরওয়া হা/১১৬, ১১৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/১১১৮, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৩, মিশকাত হা/৩৯০] টীকা দ্রঃ মিশকাত হা/৩২০; উছায়মীন, শারহুল মুমতে‘ ১/২৮৪ পৃঃ, আলবানী, তামামুল মিন্নাহ ১০৩ পৃ.)।
.
➤৭- ইসলাম ত্যাগ করা।[সূরা মায়েদাহ৫/৫ কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে ইসলামী ফিকাহ ১/৮৬৮]
.
⛔আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত বা বানায়াট কারণ যার পক্ষে কোন দলিল নেই এবং তা করলে ওযু ভঙ্গ হয়নাঃ
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
❂১) আয়নাতে নিজের চেহারা দেখলে ওযু ভঙ্গ হবেনা।
.
❂২) অশ্লীল কথা বললে, হাঁটুর উপর কাপড় উঠে এলে, মহিলার মাথার কাপড় খুলে গেলে,কাউকে বা নিজেকে উলঙ্গ দেখলে ওযু নষ্ট হয় না।কিন্ত বেপর্দা হওয়ার কারনে গুনাহগার হবে।[সূরা নূর২৪/৩০-৩১]
.
❂৩).গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলালে অযু ভঙ্গ হবেনা। তবে পুরুষের জন্য অহংকার বসত গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলানো হারাম এবং কাবীরা গুনাহ।[সহীহ বুখারী
৫৭৮৪, মুসলিম, সহীহ ২০৮৫]।উল্লেখ্য যে,এক ব্যক্তি ঐরুপ কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে মহানবী (ﷺ) তাকে পুনরায় ওযু করে নামায পড়তে হুকুম দিয়েছিলেন বলে যে হাদীস আবু দাঊদে বর্ণিত হয়েছে, তা যয়ীফ এবং দলীলের যোগ্য নয়।[যয়ীফ আবূদাঊদ, সুনান ১২৪, ৮৮৪ন]

❂৩) বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে ওযু ভঙ্গ হবেনা।কেননা এটি অযু ভঙ্গের কারন নয়।
.
❂৪) নারীরা মাথায় কাপড় না দিয়েও ওযু করতে পারবে,তবে পরপুরুষের সামনে হলে ঢেকে রাখতে হবে।তবে এতে অযু ভঙ্গ হবেনা। কেননা এগুলো অযু ভঙ্গের কারন নয়।
.
❂ ৫)নারীদের স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবেনা।[সহীহ বুখারী ৫১৩, মুসলিম, ৫১২ আবূদাঊদ, সুনান
১৭৮-১৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ ৬/২১০, দি: ৮৬,
নাসাঈ, সুনান ১৭০, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৫০২ সুনান ১/১৩৮, বায়হাকী ১/১২৫)মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক, ১/১১৭-১২১ পৃঃ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ১/১৬৪-১৬৫ পৃঃ। শারহুল মুমতে, ১/২৯১ পৃঃ; আত-তারজীহু ফী মাসায়েলিত ত্বাহারাহ ওয়াছ ছালাত, ৬১-৬৭ পৃঃ।সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/৫০২, হাদীছটি সহীহ।ইমাম ইবনে তাইমিয়া, হাক্বীকাতুছ ছিয়াম, ৪৪ পৃঃ]
.
❂৬).সাধারণভাবে লজ্জাস্থানে স্পর্শে ওযু ও সালাত নষ্ট হয় না।[আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩২০]
.
❂৭).হাতের কব্জির উপরের অংশ দ্বারা লজ্জাস্থান স্পর্শ হলে ওযু ভাঙ্গবে না।[আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/২২৯]
.
❂৮).হাল্কা ঘুম বা ঢুল (তন্দ্রা) এলে ওযু ভঙ্গ হবে না।[মুসলিম, সহীহ ৩৭৬ আবূদাঊদ, সুনান ১৯৯-২০১]
.
❂৯).টিভি দেখলে বা নারীরা পরপুরুষকে বা পরুপুরুষ নারীকে দেখলে ওযু ভঙ্গ হবেনা।তবে হারাম কোনো কিছু দেখলে বা দৃষ্টিপাত হয়ে থাকলে অবশ্যই
গুনাহ হবে,কিন্তু এতে ওযু ভঙ্গ হবে না।[সহীহ মুসলিম,২৬৫৭ মিশকাত,৮৬]
.
❂১০).শরীরের যেকোনো স্থান থেকে কম হোক আর বেশি হোক রক্ত বের হলে ওযু নষ্ট হবেনা। নাক থেকে রক্ত পড়লে;এতে ওযু নষ্ট হয় বলে হাদীস ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে,তা যয়ীফ।[যয়ীফ ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ২৫২,যয়ীফ জামে ৫৪২৬]
.
❂১১).বমি হলে অযু ভঙ্গ হবেনা।[ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১৪৮, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/২২৪-২২৫]। উল্লেখ্য যে,একদা নবী (ﷺ) বমি করলে রোযা ভেঙ্গে ফেললেন। তারপর তিনি ওযু করলেন। মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪৪৯,এই হাদীসে তাঁর কর্মের পরস্পর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। বমি করলেন বলে ওযু ভেঙ্গে গিয়েছিল,তাই তিনি ওযু করেছিলেন -তা প্রমাণ হয় না। [ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১৪৮, আলমুমতে’,শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন (রহ) ১/২২৪-২২৫]
.
❂১২).সালাতের ভেতরে বা বাইরে উচ্চস্বরে হাসলে,
অযু ভঙ্গ হবেনা।[ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১/৫০-৫১,সহীহ বুখারী, ফাতহুল বারী,ইবনে হাজার ১/৩৩৬]
.
❂১৩).গীবত করা হারাম এবং মারাত্মক কবীরা গুনাহ। [সূরা হুযরাতঃ১২ আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৬]।কিন্তু গীবত করলে অযু ভঙ্গ হয়,এই বক্তব্য সঠিক নয়।কেননা কুরআন-সুন্নাহতে এই মর্মে কোন দলিল নেই।
.
❂১৪).মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিলে বা বহন করলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।[মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক, হা/৬১০১। শারহুল মুমতে, ১/২৯৬ পৃঃ]।উল্লেখ্য যে,মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি মুর্দা কে গোসল দেবে, সে যেন নিজে গোসল করে নেয়। আর যে ব্যক্তি জানাযা বহন করবে, সে যেন ওযু করে নেয়।”[আবূদাঊদ,তিরমিযী,
আহমাদ,মুসনাদ ২/২৮০]।কিন্তু এই নির্দেশটি মুস্তাহাব। অর্থাৎ না করলেও চলে,করা বাধ্যতামূলক নয় ।তবে করা উত্তম। কারণ,গোসলদাতার দেহে নাপাকী লেগে যাওয়ার সন্দেহ্‌ থাকে। তাই তো অন্য এক বর্ণনায় আছে; তিনি বলেন, “মুর্দাকে গোসল দিলে তোমাদের জন্য গোসল করা জরুরী নয়। কারণ তোমাদের মুর্দা তো আর নাপাক নয়। অতএব তোমাদের হাত ধুয়ে নেওয়াই যথেষ্ট।”(হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩৮৬, বায়হাকী ৩/৩৯৮)।অবশ্য মাইয়্যেতকে গোসল দেওয়ার সময় তার শরমগাহে হাত লেগে থাকলে ওযু অবশ্যই নষ্ট হবে। আর জানাযা বহন করাতে ওযু নষ্ট হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/৯৬)
.
❂১৫).মৃতদেহের পোষ্টমর্টেম করাতেও ওযু ভঙ্গ হয়না।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/৯৬)
.
❂১৬).ওযু করার পর ধূমপান করলে ওযু নষ্ট হয় না। তবে ধূমপান করা অবশ্যই হারাম।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৮/৯২-৯৩)
.
❂১৭).চুল, নখ ইত্যাদি সাফ করলে ওযু ভঙ্গ হয় না। [ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন (রহঃ)১/২৯২, সহীহ বুখারী ১/৩৩৬)
.
❂১৮).কোলন, কোহল বা স্পিরিট-মিশ্রিত আতর বা সেন্ট ব্যবহার করলে ওযুর কোন ক্ষতি হয় না। তবে তা ব্যবহার বৈধ নয়।(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২০৩)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।