মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে তিন দিন পর্যন্ত সম্পর্কচ্ছেদ রাখা অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এটার বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা

প্রশ্ন:”মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে তিন দিন পর্যন্ত সম্পর্কচ্ছেদ রাখা অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (আবু দাউদ ৪৯১৪) হাদিসটির বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামী শরিয়ার মহান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের মাঝে সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং তাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ও মেল-বন্ধন টিকিয়ে রাখা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: وَ الَّذِیۡنَ یَصِلُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ وَ یَخَافُوۡنَ سُوۡٓءَ الۡحِسَابِ
“এবং যারা আল্লাহ্‌ যা সংযুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা সংযুক্ত রাখে (আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখে), নিজেদের প্রভুকে ভয় করে ও কঠিন হিসাবের আশংকায় থাকে।”[সূরা আর-রাদ, আয়াত: ২১] সুতরাং কোন মুসলিমের জন্য জায়েজ নয় তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করা। কেননা এটি কবিরা গুনাহ এবং এ ব্যাপারে শরীয়তে কঠিন হুশিয়ারী এসেছে এ সম্পর্কে দুটি হাদীস হচ্ছে:
.
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ যে,রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “‏ لاَ تَبَاغَضُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا، وَلاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ
‏”‏‏ তোমরা পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষ করো না, পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। কোন মুসলিমের জন্য তিন দিনের অধিক তার ভাইকে ত্যাগ করে থাকা বৈধ নয়।(সহীহ বুখারী হা/৬০৬৫; সহীহ মুসলিম হা/২৫৫৯)

অপর বর্ননায়,আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‏ “‏ لاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَنْ هَجَرَ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَاتَ دَخَلَ النَّارَ ‏”‏ ‏.‏ “কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের তিন দিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকা হালাল নয়। অতঃপর যে ব্যক্তি তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন থাকা অবস্থায় মারা গেলো, সে জাহান্নামে প্রবেশ করলো।(মুসনাদে আহমেদ হা ৯০৯২ আবু দাউদ হা/৪৯১৪)

হাদিসটির মর্মার্থ হচ্ছে: ঝগড়া করা কিংবা কারো সাথে কথা না বলার ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান খুব কঠোর। যে ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের সাথে কথা না বলে তিন দিন অতিবাহিত করবে এবং এই অবস্থায় সে যদি তওবা না করেই মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে যেন জাহান্নামের শাস্তি তার উপর আবশ্যক করে নিল। তবে সে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র ইচ্ছার অধীন থাকবে। তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর তিনি চাইলে তাকে উপর্যুপরি লিপ্ত কবিরা গুনাহটির জন্য শাস্তি দিবেন। তবে তার শেষ পরিণতি হবে জান্নাত। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শির্কের গুনাহ ক্ষমা করবেন না; এর চেয়ে লঘু গুনাহ তিনি যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।”[সূরা নিসা, আয়াত: ৪৮] তবে হা!কোন ব্যক্তি যদি এটাকে অর্থাৎ অপর ভাইয়ের সাথে তিনদিন কথা না বলা হারাম এই হুকুম জানা সত্বেও অন্তরের স্বীকৃতি তথা বিশ্বাসের সাথে এটাকে হালাল হিসেবে গ্রহণ করে এবং এ বিষয়ে আল্লাহর হারামকৃত বিধানকে হারাম বলে মনে না করে তাহলে সেই ব্যক্তি মুরতাদ হিসেবে গণ্য হবে।
.
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আল্লান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

” (فمن هجر فوق ثلاث فمات) مصراً على الهجر والقطيعة (دخل النار) إن شاء الله تعذيبه مع عصاة الموحدين ، أو دخل النار خالداً مؤبداً ، إن استحل ذلك ، مع علمه بحرمته والإِجماع عليها ”
(যে ব্যক্তি তিন দিনের বেশি কথা বলা বিচ্ছিন্ন রেখে মৃত্যুবরণ করল) অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে জেদ করে সম্পর্ক ছিন্ন করলো বা কথা বলা পরিত্যাগ করল। (সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে) সে যদি এটাকে হারামজাদা সত্ত্বেও হালাল মনে করে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে আল্লাহ চাইলে তাকে নাস্তিকের শাস্তি দিতে পারেন অথবা চিরস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করাতে পারেন। (দালিলুল ফালিহিন: খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৪৩৫)
.
মোল্লা আলী ক্বারী হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

” ( فَمَاتَ) أَيْ : عَلَى تِلْكَ الْحَالَةِ مِنْ غَيْرِ تَوْبَةٍ ( دَخَلَ النَّارَ) : قَالَ التُّورِبِشْتِيُّ : أَيِ اسْتَوْجَبَ دُخُولَ النَّارِ، فَالْوَاقِعُ فِي الْإِثْمِ ، كَالْوَاقِعِ فِي الْعُقُوبَةِ : إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ ”

(সে মৃত্যুবরণ করল) অর্থাৎ তওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করল। (সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে) আল্লামা তূরিবিশতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: সে জাহান্নাম আবশ্যক করে নিল।এটা এভাবে যে, পাপে পতিত হওয়া যেন শাস্তিতে পতিত হওয়া। যদি আল্লাহ চান তবে তাকে ক্ষমা করতে পারেন আর যদি তিনি চান তবে তাকে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।(আওনুল মা’বুদ: খন্ড: ১৩ পৃষ্ঠা: ১৭৬)
.
পাশাপাশি একটি বিষয় জেনে রাখা ভাল যে, কারো সাথে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আপনি কষ্ট পান ও ক্ষতিগ্রস্ত হন তাহলে আপনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে কোন গুনাহ হবে না; ইনশা আল্লাহ্‌; যতটুকু সম্পর্ক ছিন্ন করলে আপনি নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন এবং তার অনিষ্ট থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন।
.
আল ইমামুল ‘আল্লামাহ আবু ‘উমার ইউসুফ ইবনু ‘আব্দিল বার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৬৩ হি.] বলেছেন,

” وأجمع العلماء على أنه لا يجوز للمسلم أن يهجر أخاه فوق ثلاث إلا أن يكون يخاف من مكالمته وصلته ما يفسد عليه دينه ، أو يولد به على نفسه مضرة في دينه أو دنياه ، فإن كان ذلك فقد رخص له في مجانبته وبعده ، ورب صرم [أي : مقاطعة وهجر] جميل خير من مخالطة مؤذية .قال الشاعر:إذا ما تقضي الود إلا تكاشرا … فهجر جميل للفريقين صالح ”

“আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, কোন মুসলিমের জন্য তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে তিনদিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করা নাজায়েয। তবে যদি তার সাথে কথা বললে ও সম্পর্ক রাখলে ব্যক্তির দ্বীনদারি নষ্টের ভয় করে কিংবা তার দুনিয়া ও আখিরাতের কোন ক্ষতি হয়; যদি এমনটি হয় তাহলে তার জন্য তার থেকে দূরে থাকা ও তাকে বর্জন করার অবকাশ রয়েছে। অনেক সুন্দর সম্পর্কচ্ছেদ কষ্টদায়ক মেলামেশার চেয়ে উত্তম। কবি বলেছেন:“যদি সম্প্রীতি রক্ষা অবজ্ঞাকে অনিবার্য করে তবে উত্তম সম্পর্কচ্ছেদ উভয় পক্ষের জন্যই কল্যাণকর।”(আত তামহীদ: খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১২৭) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________
জুয়েল মাহমুদ সালাফি