সাতটি অঙ্গের উপর সিজদাহ করার শারঈ হুকুম এবং পাগড়ি বা টুপির উপর সিজদাহ করা জায়েজ কী

প্রশ্ন: হাদীসের আলোকে সাতটি অঙ্গের উপর সিজদাহ করার শারঈ হুকুম কী? পাগড়ি বা টুপির উপর সিজদাহ করা জায়েজ কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সেজদাহ নামাযের একটি রুকন। যিনি সেজদাহ করতে অক্ষম তিনি ছাড়া অন্য কারো জন্য সেজদাহ ছাড়া নামায সহিহ হবে না; আর সেজদাহ সাতটি অঙ্গের উপর করা আবশ্যক। যে অঙ্গগুলোর উপর সেজদাহ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন। যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমাকে শরীরের সাতটি হাড়ের উপর সেজদাহ করার আদেশ দেয়া হয়েছে: কপালের উপর, তিনি হাত দিয়ে নাকের দিকে ইশারা করেন, দুই হাত, দুই হাঁটু ও পায়ের পাতার অগ্রভাগের উপর”।(সহিহ বুখারী হা/৮১২; সহিহ মুসলিম হা/৪৯০)
.
জমহুর (অধিকাংশ) আলেম (এদের মধ্যে ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আহমাদ ইবনে হাম্বাল রয়েছেন) এ হাদিস দিয়ে দলিল দেন যে, যদি এ সমস্ত অঙ্গগুলোর উপর সেজদা করা না হয় তাহলে সেজদা সহিহ হবে না। তাই কেউ যদি ছয়টি অঙ্গের উপর সেজদা করে তার সেজদা সহিহ হবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদিসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় বলেন:”لو أخل بعضو منها لم تصح صلاته “যদি এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি অঙ্গ দিয়ে সেজদা না করে তাহলে তার নামায সহিহ হবে না।”(শারহু সহীহ মুসলিম; খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ২০৮)

কাশশাফুল ক্বিনা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:

والسجود بالمصلي على هذه الأعضاء) السبعة: الجبهة، واليدين، والركبتين، والقدمين (مع الأنف: ركن مع القدرة) لما روى ابن عباس مرفوعا أمرت أن أسجد على سبعة أعظم، على الجبهة، وأشار بيده إلى أنفه واليدين، والركبتين، وأطراف القدمين متفق عليه، وقال إذا سجد أحدكم سجد معه سبعة آراب: وجهه، وكفاه، وركبتاه، وقدماه رواه مسلم .وحديث ” سجد وجهي ” إلى آخره: لا ينفي سجود ما عداه ، وإنما خصه لأن الجبهة هي الأصل، فمتى أخل بالسجود على عضو من هذه لم يصح.(وإن عجز) عن السجود (بالجبهة ، أومأ ما أمكنه، وسقط لزوم باقي الأعضاء) ؛ لأن الجبهة هي الأصل في السجود، وغيرها تبع لها، فإذا سقط الأصل ، سقط التبع…
(وإن قدر) على السجود (بها) أي: الجبهة (تبعها الباقي) من الأعضاء المذكورة لما تقدم”

“সক্ষমতা থাকাবস্থায় এই অঙ্গগুলোর উপর তথা সাতটি অঙ্গ: নাকসহ কপাল, হাতদ্বয়, হাঁটুদ্বয়, পাদ্বয়ের উপর সেজদা দেয়া: নামাযের রুকন। যেহেতু ইবনে আব্বাস (রাঃ) মারফু হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, আমাকে সাতটি হাড়ের উপর সেজদা দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে: কপালের উপর, তিনি হাত দিয়ে নাকের দিকে ইশারা করলেন, হাতদ্বয়ের উপর, হাঁটুদ্বয়ের উপর এবং পায়ের আঙ্গুলের অগ্রভাগের উপর।”[মুত্তাফাকুন আলাইহি] তিনি আরও বলেছেন: “যখন তোমাদের কেউ সেজদা করে তখন তার সাথে সাতটি অঙ্গ সেজদা করে: মুখমণ্ডল, কব্জিদ্বয়, হাঁটুদ্বয়, পায়ের পাতাদ্বয়।”[সহিহ মুসলিম] পক্ষান্তরে, যে হাদিসে এসেছে “আমার চেহারা সেজদা দিয়েছে…” সে হাদিস অন্য অঙ্গগুলোর সেজদা দেয়াকে নাকচ করে না। বরং সেখানে চেহারাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেহেতু সেজদা দেয়ার ক্ষেত্রে কপালই হলো প্রধান। তাই নামায আদায়কারী সেজদা দেয়াকালে যখনই এ অঙ্গগুলোর কোনটির ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটবে তার সেজদা সহিহ হবে না। “যদি কপাল দিয়ে সেজদা দিতে অক্ষম হয় তাহলে যতটুকু পারে ইশারা করবে এবং অপর অঙ্গগুলোর সেজদা দেয়া মওকুফ হয়ে যাবে। যেহেতু সেজদা দেয়ার ক্ষেত্রে কপালই হলো প্রধান। অন্য অঙ্গগুলো কপালের অনুবর্তী। তাই প্রধান অঙ্গের জন্য মওকুফ হয়ে গেলে অন্য অঙ্গের জন্যেও মওকুফ হয়ে যায়। আর যদি কপাল দিয়ে সেজদা দিতে সক্ষম হয় তাহলে পূর্বোক্ত হেতুর ভিত্তিতে অন্য অঙ্গগুলো কপালের অনুবর্তী হবে।”(কাশ্‌শাফুল ক্বিনা’ খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৫১)
.
ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত: ৭৯৫ হি:] “ফাতহুল বারী” গ্রন্থে বলেন: “ويدل على هذا القول : هذه الأحاديث الصحيحة بالأمر بالسجود على هذه الأعضاء كلها ، والأمر للوجوب “এ অভিমতের পক্ষে প্রমাণ বহন করে এ সহিহ হাদিসগুলো; যেগুলো এ সমস্ত অঙ্গগুলোর উপর সেজদা দেয়ার নির্দেশ বহন করে। নির্দেশ দেয়া হয় আবশ্যকতা বুঝানোর জন্য।”(ইবনে রজব ‘ফাতহুল বারী’: খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ১১৪-১১৫) অতএব, যে ব্যক্তি সেজদাকালীন সম্পূর্ণ সময় সেজদার কোন একটি অঙ্গ ভূমি থেকে উপরে তুলে রাখে এবং ঐ অঙ্গের উপর সেজদা না করে তার নামায শুদ্ধ নয়। আর যদি সামান্য সময়ের জন্য উপরে তোলে তাহলে ইনশা আল্লাহ তার নামায সহিহ।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: এক লোক সেজদাকালে সেজদার কোন একটি অঙ্গ উপরে তুলে রেখেছে তার নামায কি বাতিল?

জবাবে তিনি বলেন:

الظاهر أنه إن رفع في جميع السجود – أي : ما زال ساجداً وهو رافعٌ أحد الأعضاء – فسجوده باطل ، وإذا بطل السجود بطلت الصلاة ، وأما إذا كان رفعه لمدة يسيرة مثل أن يحك رجله بالأخرى ثم أعادها فأرجو ألا يكون عليه بأس”

“যে অভিমতটি অগ্রগণ্য প্রতীয়মান হয় সেটা হল: যদি সেজদার পুরো সময়টা উপরে তুলে রাখে অর্থাৎ যতক্ষণ সেজদাতে ছিল ততক্ষণই উপরে তুলে রেখেছে তাহলে তার সেজদা বাতিল। যদি তার সেজদা বাতিল হয় তাহলে তার নামাযও বাতিল। আর যদি স্বল্প সময়ের জন্য তুলে রাখে যেমন: অন্য কোন পা চুলকানোর জন্য; এরপর সস্থানে ফিরিয়ে নেয় তাহলে আশা করি এতে কোন অসুবিধা নাই।”(উসাইমীন, লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ)
.
ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:

“والسجود على هذه الأعضاء السبعة واجب في كل حال السجود ، بمعنى أنه لا يجوز أن يرفع عضوا من أعضائه حال سجوده ، لا يدا ، ولا رجلا ، ولا أنفا ، ولا جبهة ، ولا شيئا من هذه الأعضاء السبعة . فإن فعل : فإن كان في جميع حال السجود فلا شك أن سجوده لا يصح ؛ لأنه نقص عضوا من الأعضاء التي يجب أن يسجد عليها .وأما إن كان في أثناء السجود ، بمعنى أن رجلا حكته رجله مثلا فحكها بالرجل الأخرى فهذا محل نظر ، قد يقال : إنها لا تصح صلاته لأنه ترك هذا الركن في بعض السجود .وقد يقال : إنه يجزئه لأن العبرة بالأعم والأكثر ، فإذا كان الأعم والأكثر أنه ساجد على الأعضاء السبعة أجزأه ، وعلى هذا فيكون الاحتياط : ألا يرفع شيئا وليصبر حتى لو أصابته حكة في يده مثلا ، أو في فخذه ، أو في رجله ، فليصبر حتى يقوم من السجود”

“এ সাতটি অঙ্গের উপর সেজদার সম্পূর্ণ সময় সেজদা করা ওয়াজিব। অর্থাৎ সেজদাকালে এ অঙ্গগুলোর কোন একটি অঙ্গ উপরে উঠানো জায়েয নয়; হাত নয়, পা নয়, নাক নয়, কপাল নয়, এ অঙ্গগুলোর কোনটিই নয়। যদি কেউ উপরে উঠায়: তাহলে সে যদি সেজদার পুরা সময়টা উপরে তুলে রাখে তাহলে নিঃসন্দেহে তার সেজদা সহিহ নয়। কেননা সে ব্যক্তি যে অঙ্গগুলোর উপর সেজদা করা ওয়াজিব সে অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি অঙ্গের ঘাটতি করেছে। আর যদি সেজদার মাঝখানে উপরে উঠায়; উদাহরণতঃ এক লোকের পা চুলকাচ্ছে; ধরে নিই সে ব্যক্তি এক পা দিয়ে অপর পা চুলকালো; তাহলে এ ব্যাপারে ইজতিহাদের অবকাশ আছে। কেউ বলতে পারেন: তার নামায সহিহ নয়। যেহেতু সে সেজদার কিছু অংশে এ রুকনটি পালন করেনি। আবার কেউ বলতে পারেন: তার সেজদা আদায় হয়ে গেছে। যেহেতু ধর্তব্য হচ্ছে বেশিরভাগ অংশ। যদি সেজদার বেশির অংশে সে ব্যক্তি সাতটি অঙ্গের উপর সেজদা করে থাকে তাহলে সেজদা আদায় হয়ে গেছে। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে সর্তকতা হল: সেজদার কোন অঙ্গ উপরে না তুলে ধৈর্য রাখা। এমনকি তার যদি হাত চুলকায়, রানে চুলকায়, পায়ে চুলকায় তাহলে সে ব্যক্তি সেজদা থেকে দাঁড়ানো পর্যন্ত ধৈর্য রাখবে।”(উসাইমীব, আল-শারহুল মুমতি; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৭)
.
▪️পাগড়ি বা টুপির উপর সিজদাহ করা জায়েজ কী?

আলেমগণ এবিষয়ে একমত যে, কোন ওজর ব্যতীত সেজদাহ করার সময় নামাযীর কপাল ও দুই হাত সরাসরি মাটি স্পর্শ করা উত্তম। এটা ওয়াজিব কিনা তা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল। ইমাম শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মত হচ্ছে, এটা ওয়াজিব। কিন্তু অধিকাংশ আলেমদের মতে এটা শুধুমাত্র মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়।
.
এই বিষয়ে আলেমদের মতামত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

” فرع في مذاهب العلماء في السجود على كمه وذيله ويده وكور عمامته وغير ذلك مما هو متصل به ، قد ذكرنا أن مذهبنا : أنه لا يصح سجوده على شيء من ذلك ، وبه قال داود وأحمد في رواية .وقال مالك وأبو حنيفة والأوزاعي وإسحاق وأحمد في الرواية الأخرى : يصح ، قال صاحب التهذيب : وبه قال أكثر العلماء . واحتج لهم بحديث أنس رضي الله عنه قال : ( كنا نصلي مع رسول الله صلى الله عليه وسلم في شدة الحر ، فإذا لم يستطع أحدنا أن يمكن جبهته من الأرض يبسط ثوبه فيسجد عليه ) رواه البخاري ومسلم ، وعن ابن عباس رضي الله عنهما قال : ( لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم في يوم مطير وهو يتقي الطين إذا سجد بكساء عليه يجعله دون يديه ) رواه ابن حنبل في مسنده . وعن الحسن قال : ” كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم يسجدون وأيديهم في ثيابهم ويسجد الرجل على عمامته ” رواه البيهقي ” .وقال : ” العلماء مجمعون على أن المختار مباشرة الجبهة للأرض ”
মাস্ক, আঁচলা, হাত ও পাগড়ির প্যাঁচ বা ব্যক্তির সাথে সংযুক্ত অন্য কিছুর উপর সিজদা করার ব্যাপারে আলেমদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে।আর আমাদের (শাফেঈ) মাযহাবের মত আমরা উল্লেখ করেছি‌ যে, এর কোনটির উপর সিজদা করা শুদ্ধ হবে না। ইমাম আবু দাউদ এবং আহমাদ বিন হাম্বালের দুটি মতের একটি বর্ণনায় এমনটিই বলেছেন। ইমাম মালেক, আবু হানিফা, আওযায়ী, ইসহাক্ব ও আহমদ বিন হাম্বাল অন্য আরেকটি বর্ণনায় বলেছেন: সেজদাহ শুদ্ধ হবে। তাহযীব গ্রন্থের লেখক বলেন: এটি অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। তারা আনাস ইবনু মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যিনি বলেছেন: আমরা প্রচন্ড গরমের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়তাম। আমাদের কেউ (মাটিতে) তাঁর কপাল রাখতে অসমর্থ হলে তার কাপড় বিছিয়ে তার উপর সিজদা করতো।(সহীহ বুখারী হা/৩৮৫, মুসলিম ৬২০, তিরমিযী ৫৮৪, নাসায়ী ১১১৬, আবূ দাঊদ ৬৬০) আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে বৃষ্টির দিনে দেখেছি, তিনি কাদা এড়িয়ে চলতেন যখন তিনি তার হাতের নিচে একটি কাপড় রেখে সিজদা করতেন। এটি আব্দুল্লাহ বিন হাম্বাল তার মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, রাসূলের সাহাবীগণ পাগড়ী ও টুপির উপর সিজদা করতেন আর তাঁদের হাত থাকতো আস্তিনের ভিতর। (বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/২৬৬৭; তিনি আরো বলেন: আলেমগণ একমত যে, পছন্দনীয় মত হল সরাসরি মাটিতে কপাল স্পর্শ করা। (নববী আল-মাজমু: খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৯৭-৪০০)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,

” ولا تجب مباشرة المصلي بشيء من هذه الأعضاء . قال القاضي : إذا سجد على كور العمامة أو كمه أو ذيله ، فالصلاة صحيحة رواية واحدة . وهذا مذهب مالك وأبي حنيفة . وممن رخص في السجود على الثوب في الحر والبرد : عطاء وطاوس والنخعي والشعبي والأوزاعي ومالك وإسحاق وأصحاب الرأي .
ورخص في السجود على كور العمامة : الحسن ومكحول وعبد الرحمن بن يزيد . وسجد شريح على برنسه ” انتهى من ”

“এ অঙ্গগুলোর কোন অংশ সরাসরি (জমিন) স্পর্শ করা ওয়াজিব নয়।” কাযী বলেন: “যদি কেউ পাগড়ীর প্যাঁচ, পাগড়ীর আঁচল কিংবা শামলার উপর সেজদা করে তাহলে তার নামায শুদ্ধ হবে। এ ব্যাপারে একটাই রেওয়ায়েত আছে। এটি ইমাম মালেক ও ইমাম আবু হানিফারও মাযহাব। এ ছাড়া গরমের দিনে ও শীতের দিনে কাপড়ের উপর সেজদা দেয়ার অবকাশ আছে মর্মে মত দিয়েছেন: আতা, তাউস, নাখাঈ, শাবী, আওযাঈ, মালেক, ইসহাক ও কিয়াসপন্থীগণ। পাগড়ীর প্যাঁচের উপর সেজদা দেয়ার মত দিয়েছেন: হাসান বসরী, মাকহুল, আব্দুর রহমান বিন ইয়াযিদ। শুরাইহ তাঁর টুপির উপর সেজদা দিয়েছেন।”(ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী: খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩০৫)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: মুসাল্লি যখন সিজদা করে এবং তার পাগড়ী দিয়ে তার মাঝে ও জমিনের মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা/ঢাল তৈরি করে তাহলে তার সলাতের বিধান কী?

তিনি উত্তর দিয়েছেন:

” صلاة ذلك المصلي صحيحة ، ولكن لا ينبغي أن يتخذ العمامة وقاية بينه وبين الأرض إلا من حاجة ، مثل : أن تكون الأرض صلبة جدا ، أو فيه حجارة تؤذيه ، أو شوك ففي هذه الحال لا بأس أن يتقي الأرض بما هو متصل به من عمامة ، أو ثوب لقول أنس بن مالك رضي الله عنه : ( كنا نصلي مع النبي صلى الله عليه وسلم في شدة الحر فإذا لم يستطع أحدنا أن يمكن جبهته من الأرض بسط ثوبه فسجد عليه ) . فهذا دليل على أن الأولى أن تباشر الجبهة مكان السجود ، وأنه لا بأس أن يتقي الإنسان الأرض بشيء متصل به من ثوب ، أو عمامة إذا كان محتاجا لذلك لحرارة الأرض ، أو لبرودتها ، أو لشدتها ، إلا أنه يجب أن يلاحظ أنه لابد أن يضع أنفه على الأرض في هذه الحال ، لحديث ابن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ( أمرت أن أسجد على سبعة أعظم : على الجبهة وأشار بيده إلى أنفه ، والكفين ، والركبتين ، وأطراف القدمين ) ”

“ঐ নামাযীর নামায সহীহ। তবে কারো জন্য তার মাঝে ও জমিনের মাঝে কোন প্রয়োজন ছাড়া পাগড়ীকে ঢালস্বরূপ গ্রহণ করা উচিত নয়। যেমন জমিন খুব শক্ত হওয়া অথবা সেখানে কোন পাথর রয়েছে যার দ্বারা তিনি কষ্ট অনুভব করতে পারেন। অথবা সেখানে যেকোনো ধরনের কাটা থাকার কারণে এরুপ কাজ করা যায়। সুতরাং এই সকল অবস্থায় পাগড়ী অথবা পোশাক ইত্যাদি তার সাথে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে জমিন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। কারণ আনাস বিন মালেক (রাদিয়াল্লাহু) তা’আলা আনহু বলেন: আমরা প্রচন্ড গরমের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়তাম। আমাদের কেউ (মাটিতে) তাঁর কপাল রাখতে অসমর্থ হলে তার কাপড় বিছিয়ে তার উপর সিজদা করতো। সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, সিজদার স্থানে সরাসরি কপাল স্পর্শ করাই উত্তম, তবে একজন মানুষ মাটি থেকে নিজেকে রক্ষা করে এমন কোনো জিনিস যেমন: তার পোশাক অথবা পাগড়ির কোন কিছু দ্বারা জমিন থেকে পৃথক করে দেওয়াতে সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো এটি কোন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন: জমিন খুব গরম থাকা, অথবা ঠান্ডা থাকা, অথবা শক্ত থাকা ইত্যাদি। তবে এদিকে লক্ষ্য রাখা ওয়াজিব যে, এ সকল অবস্থায় মাটিতে নাক স্পর্শ রাখা আবশ্যক। কারণ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আমি সাতটি অঙ্গের দ্বারা সিজদা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। কপাল দ্বারা এবং তিনি হাত দিয়ে নাকের প্রতি ইশারা করে এর অন্তর্ভুক্ত করেন, আর দু’ হাত, দু’ হাঁটু, দু’ পায়ের আঙ্গুলসমূহ দ্বারা।(ফাতওয়া শায়খ ইবনে উসাইমিন: ১৩/প্রশ্ন নং ৫১৯)।
.
ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে এমন ব্যক্তির সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যিনি খুব বড় চশমা পরেন এবং তার পক্ষে সাতটি অঙ্গের উপর পরিপূর্ণভাবে সেজদা করা সম্ভব হয় না। কখনও নাক রাখার বিপত্তি ঘটে।

জবাবে তিনি বলেন:

” إن كانت تمنع من وصول طرف الأنف إلى الأرض فإن السجود لا يجزئ ، وذلك لأن الذي يحمل الوجه هما النظارتان ، وهما ليستا على طرف الأنف بل هما بحذاء العينين وعلى هذا فلا يصح السجود ، ويجب على من عليه نظارة تمنعه من وصول أنفه إلى مكان السجود أن ينزعها في حال السجود ”

“যদি নাকের অগ্রভাগ ভূমিতে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় তাহলে এমন সেজদা চলবে না। যেহেতু এক্ষেত্রে চশমাটাই চেহারাকে বহন করে। যেহেতু চশমাটা নাকের অগ্রভাগের উপরে থাকে না। বরং চশমাটা থাকে চক্ষুদ্বয়ের সমান্তরালে। তাই সেজদা সহিহ হবে না। যে ব্যক্তি এমন কোন চশমা পরে আছেন যার কারণে তার নাক সেজদার স্থানে পৌঁছা বাধাগ্রস্ত হয় তার উচিত হবে সেজদার সময় চশমা খুলে ফেলা।”(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড, ১৩পৃষ্ঠা: ১৮৬)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, নামাজের অবস্থায় সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করা অপরিহার্য বা ওয়াজিব। আর এই সাতটি অঙ্গ হলো: নাক সহ কপাল, দুই হাতের তালু, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের আঙ্গুলসমূহ। সুতরাং নামাজ পড়ার সময় কেউ যদি সিজদা অবস্থায় এক পা বা উভয় পা জমিন থেকে উপরে উঠিয়ে রাখে, তাহলে তার নামাজ পূর্ণ এবং সঠিক হবে না। অনুরূপভাবে কেউ যদি সিজদার সাতটি অঙ্গের মধ্যে থেকে কোন একটি অঙ্গ ব্যতীত বা ব্যতিরেকে সিজদা করে, তাহলে তারও নামাজ সঠিক হবে না। আর এই বিধানটি নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই নারী-পুরুষ সমস্ত মুসলিম ব্যক্তির উপর অপরিহার্য যে, তারা যেন সবাই উল্লিখিত সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করে। এবং এই বিষয়ে কোনো প্রকারের অবহেলা করা বৈধ নয়। পাশাপাশি মাটি খুব গরম থাকলে, অথবা খুব ঠান্ডা থাকলে, অথবা খুব শক্ত থাকলে কিংবা মাটিতে পাথর, কাটা অথবা অন্য কোন ক্ষতিকর বস্তু থাকলে নামাজী তার পাগড়ী অথবা পোশাক ইত্যাদি তার সাথে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে জমিন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়াতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। তবে এদিকে লক্ষ্য রাখা ওয়াজিব যে, এ সকল অবস্থায় মাটিতে নাঁক স্পর্শ রাখা আবশ্যক। কেননা ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আমি সাতটি অঙ্গের দ্বারা সিজদা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। কপাল দ্বারা এবং তিনি হাত দিয়ে নাকের প্রতি ইশারা করে এর অন্তর্ভুক্ত করেন, আর দু’ হাত, দু’ হাঁটু, দু’ পায়ের আঙ্গুলসমূহ।(সহীহ বুখারী ই: ফা: হা/৭৭৫) অপরদিকে যিনি সেজদাহ করতে অক্ষম তিনি তার সামর্থ্য সুবিধা অনুযায়ী সালাতের কার্যক্রমগুলো সম্পাদন করবেন। (বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৯৯৮৮, ৫০৬৮৪) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।