মানুষের গোপন বিষয় যা প্রকাশিত হলে তিনি অপমানবোধ করবেন এবং মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হবেন তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান

প্রশ্ন: কোনো দ্বীনি ভাই-বোনদের গোপন এমন কিছু তথ্যাবলী; যা প্রকাশিত হলে তিনি অপমানবোধ করবেন এবং মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হবেন। এমন কিছু প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মূলনীতি হলো- কারও ব্যক্তিগত দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করা, গীবত করা, সম্মানহানি করা, গোপনীয় বিষয় খোঁজ করা, গোপন পাপ জনসম্মুখে প্রকাশ করা ইত্যাদি জায়েয নয়। কেননা এটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন: وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না,এবং একে অন্যের গীবত করো না। (সূরা হুযুরাত, ৪৯/১২)। তিনি আরো বলেছেন: لَا یُحِبُّ اللّٰهُ الۡجَهۡرَ بِالسُّوۡٓءِ مِنَ الۡقَوۡلِ اِلَّا مَنۡ ظُلِمَ মন্দ কথার প্রচার আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে কারো উপর যুলম করা হলে ভিন্ন কথা। (সূরা নিসা; ৪/১৪৮) যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৬৮ হি.] এই আয়াতের তাফসীরে বলেন: “আল্লাহ্ পছন্দ করেন না যে, আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বদ্‌দোয়া বা মন্দ বিষয় প্রকাশ করি, যদি না আমাদের উপর অন্যায় করা হয়। তবে যদি কারো উপর জূলূম করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এই ব্যাপারে আল্লাহ্‌র অনুমতি রয়েছে। তারপরও এই ব্যপারে ধৈর্য ধারন করাই উত্তম।” [তফসীর ইবনে কাসীর সূরা নিসা: ১৪৮]।
.
রাসূল (ﷺ) বলেন: আমার সকল উম্মাতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয় এ বড়ই অন্যায় যে, কোন লোক রাতের বেলা অপরাধ করল যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে সকাল হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ তার কর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর দেয়া আবরণ খুলে ফেলল। (সহীহ বুখারী হা/৬০৬৯; মুসলিম হা/২৯৯০; সহীহুল জামে‘ হা/৪৫১২) হাদীসটি ব্যক্তিগত পাপ সম্পর্কে বর্ণিত হলেও আমভাবে অন্যদের গুনাহ প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইমাম ইবনে বাত্তাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:- في الجهرِ بالمعصية استخفافٌ بحقِّ الله ورسوله، وبصالحي المؤمنين، وفيه ضرْبٌ مِن العناد لهم، وفي الستر بها السلامة من الاستخفاف “পাপাচার প্রকাশ করার মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের অধিকারকে এবং নেককার ও সৎলোকদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এটা এক প্রকার ধৃষ্টতা প্রদর্শন। অথচ তা গোপন রাখা হলে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে রক্ষা পেত।” (ফাতহুল বারী: খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ৪৮৭-৪৮৮)। সুতরাং কারো মধ্যে যদি কোন ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তার প্রকাশ্যে সমালোচনা না করার প্রতি শরীয়তে কঠোর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছ এবং তাকে নির্জনে বুঝাতে বলা হয়েছে। কিন্তু যদি অপরাধীর অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রকাশে ধর্মীয় কোন কল্যাণ থাকে, তাহলে কারো দোষ-ত্রুটি জনসম্মুখে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি অবস্থা হতে পারে। যথা:
.
▪️(১). প্রথমত: কোন যদি ব্যক্তি সমাজে মন্দ ও অনৈতিক কাজের জন্য বেশ পরিচিত হয় এবং সে তাতে সর্বদা অবিরত থাকে, তার গোনাহ দ্বারা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন: প্রকাশ্যে গান-বাদ্য বাজানো, প্রকাশ্যে মদ্যপান করা, প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ও পাপাচার করে বেড়ানো ইত্যাদি। এমন ব্যক্তিকে বারবার সচেতন করার পরেও তার মধ্যে অনুতপ্ত হওয়ার বা অনুশোচনার কোনো আলামত লক্ষ করা না যায় তাহলে নিঃসন্দেহে এমন ব্যক্তির অন্যায় অপকর্মগুলোর প্রকাশ্যেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে। এটি কখনো কখনো ওয়াজিব। কারণ তার এই পাপগুলো দ্বারা সে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি তার মাধ্যমে সমাজের ক্ষতি হয় এবং সমাজের লোকেরা পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার মোটিভেশান পায়। সুতরাং তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য এবং তার পাপ গুলো বন্ধ করার জন্য তাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে হবে; যাতে সে আর কখনও এমন কাজ করার চিন্তা ভাবনা না করে এবং সমাজের মানুষ যেন তার অনিষ্ট থেকে হেফাজতে থাকতে পারে। এই মর্মে দলিল:
.
মহান আল্লাহ বলেন, کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে। (সূরা আলে ইমরান: ১১০)। اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা নূর; ২৪/১৯)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; مَنْ رَأى مِنْكُمْ مُنْكَراً فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أضْعَفُ الإيمَانِ رواه مسلم“তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন খারাপ কাজ দেখবে, সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এটাই ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।” অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এর পরে সরিষা পরিমাণ ঈমানও বাকী নেই। (সহীহ মুসলিম: ৪৯, হাদীস সম্ভার: হা/১১৫০)। অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা অচিরেই আল্লাহ তোমাদের উপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি নাযিল করবেন। তারপর তোমরা অবশ্যই তার কাছে দোআ করবে, কিন্তু তোমাদের দোআ কবুল করা হবে না। (তিরমিযী: ২১৬৯, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৯১)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, ইমাম ইবনু রজব আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯৫ হি.] বলেছেন: من كان مشتهراً بالمعاصي ، معلناً بها ، لا يُبالي بما ارتكبَ منها، ولا بما قيل له ، فهذا هو الفاجرُ المُعلِنُ ، وليس له غيبة ، كما نصَّ على ذلك الحسنُ البصريُّ وغيره .ومثلُ هذا لا بأس بالبحث عن أمره ، لِتُقامَ عليه الحدودُ ، صرَّح بذلك بعضُ أصحابنا، واستدلَّ بقولِ النَّبيِّ – صلى الله عليه وسلم – : ( واغدُ يا أُنيس على امرأةِ هذا ، فإنِ اعترفت ، فارجُمها ). ومثلُ هذا لا يُشفَعُ له إذا أُخِذَ ، ولو لم يبلغِ السُّلطان ، بل يُترك حتّى يُقامَ عليه الحدُّ لينكفَّ شرُّه ، ويرتدعَ به أمثالُه .قال مالك : من لم يُعْرَفْ منه أذى للناس ، وإنَّما كانت منه زلَّةٌ ، فلا بأس أنْ يُشفع له ، ما لم يبلغ الإمام ، وأمَّا من عُرِفَ بشرٍّ أو فسادٍ ، فلا أحبُّ أنْ يشفعَ له أحدٌ ، ولكن يترك حتى يُقام عليه الحدُّ ، حكاه ابن المنذر وغيره…” انتهى من অর্থাৎ যে ব্যক্তি খারাপ কর্মের জন্য বিখ্যাত সবাই জানে সে খারাপ কাজ করে, সে কাবিরা গুনাহ করতে পরোয়া করে না, মানুষ তাকে কি বলছে কি করছে এ বিষয়ে সে কোন কিছুই মনে করে না, তাহলে সেই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডগুলো প্রকাশ করাটা উচিত। এজন্য গীবত হবে না। হাসান বসরী এবং অন্যান্যরাও এমনটি বলেছেন। এমতাবস্থায় তার কর্মকান্ড গুলো আলোচনা করা, ঘোষণা করাতে কোন দোষ নেই; যাতে করে তার ওপর হদ প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এমনটি বলেছেন- কিছু সাহাবীগণ। তারা দলিল হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসটি গ্রহণ করে থাকেন; হে উনাইস! তুমি এই মহিলাটির কাছে আগামীকাল যাও, যদি সে স্বীকার করে তাহলে তাকে রজম করবে। তার জন্য সুপারিশ চলবে না যদিও সেটা বিচারকের কাছে না পৌঁছে বরং তার ওপরে হদ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে করে খারাপ কাজ বন্ধ হয়, অন্যরা সাহস না পায়। ইমাম মালেক রহ. বলেন; তার খারাপ কাজ, বিশৃঙ্খলা মানুষকে কষ্ট দেওয়া যদি প্রসিদ্ধ না হয় তাহলে তার ব্যাপারে সুপারিশ করাতে কোন অসুবিধা নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারকের কাছে না পৌঁছবে। যে ব্যক্তি তার মন্দ ও দুষ্টতার জন্য সুপরিচিত, আমি তার জন্য কারো সুপারিশ পছন্দ করি না; বরং তাকে আটকে রাখা উচিত যতক্ষণ না তার উপর হদের শাস্তি কার্যকর হয়।যাতে করে সে ভবিষ্যতে আর এরূপ খারাপ কাজ না করে এবং তাকে দেখে অন্যরাও যাতে করে এ বিষয়ে থেকে বিরত থাকে।এটি ইবনুল মুনযির এবং অন্যরা বর্ণনা করেছেন। (জামিউল উলুম ওয়াল হুকুম: খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৩৪১ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩২১৭৩১)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন:যদি কোনো ব্যক্তি তার খারাপ আচরণের জন্য পরিচিত (প্রসিদ্ধ) হয় এবং সে প্রকাশ্যে মদ পান বা অন্যান্য জিনিসের মতো বড় কোনো পাপ করে থাকে, আমরা অন্যদেরকে তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিলে তা কি জায়েয হবে?

উত্তরে স্থায়ী কমিটির আলেমগন বলেন: التحذير من عمل الفاسق ومرتكبي الكبائر واجب ، فإذا خشي المسلم على إخوانه من عمل أولئك وجب نصحهم وكشف أحوال الفساق ؛ حتى لا يقع أحد في شراكهم . ويجب أيضاً مناصحة الفساق ومرتكبي الكبائر لعل الله أن يهديهم ، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : :الدين النصيحة ” قالوا : لمن يا رسول الله ؟ قال : ” لله ولكتابه ولرسوله ولأئمة المسلمين وعامتهم ” رواه مسلم من حديث تميم بن أوس الداري رضي الله عنه।অর্থাৎ ফাসেকের কাজ থেকে এবং কাবিরা গুনাহকারীর কর্ম থেকে মানুষকে সতর্ক করা ওয়াজিব। যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি তার ভাইয়ের খারাপ আমলের বিষয় ভয় পাবে যে, হয়তো এটা অন্যান্য ভাইদের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে, তাহলে খারাপ আমলকারী ব্যক্তিকে পরামর্শ দিতে হবে, তার খারাপ কাজের অবস্থাগুলো প্রকাশ করতে হবে যাতে করে অন্যান্য ভাইয়েরা তার খারাপ কাজের থেকে বিরত থাকতে পারে। ফাসেক ব্যক্তিকে এবং কাবীরা গুনাহকারী ব্যক্তিকে উপদেশ দেওয়া আবশ্যক যাতে করে তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সঠিক পথ দেখান। তামীম আদ-দারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন: দ্বীন হল নসীহত। আমরা বললাম কাদের জন্য হে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য। (সহীহ মুসলিম হা/৫৫; মিশকাত হা/৪৯৬৬ ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ৩৮৫-৩৮৬)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কারো অপরাধ প্রকাশ এবং গোপন সংক্রান্ত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:، فمثلاً : المجرم ؛ إذا أجرم : لا نستر عليه إذا كان معروفاً بالشر والفساد ، ولكن الرجل الذي يكون مستقيماً في ظاهره ، ثم فعل ما لا يحل فهنا قد يكون الستر مطلوباً ؛ فالستر ينظر فيه إلى المصلحة ، فالإنسان المعروف بالشر والفساد لا ينبغي ستره ، والإنسان المستقيم في ظاهره ، ولكن جرى منه ما جرى : هذا هو الذي يسن ستره ” انتهى من شرح অর্থাৎ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে একজন পাপী ব্যক্তি পাপ করল এবং সে পাপ কাজ করাতেই প্রসিদ্ধ হয়ে আছে তাহলে আমরা তার কর্মকাণ্ডগুলো গোপন করব না কিন্তু যদি এমন ব্যক্তি হয় যে ব্যক্তি ভালো কাজের ব্যাপারে সর্বজনবিদিত এবং সে কোন কারণবশত খারাপ কাজটি করে ফেলেছে তাহলে তার গোপন কর্মকাণ্ড টি প্রকাশ না করাই উচিত। (শরহু আরবাউনান নবুওয়াত: ১/১৭২ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩২১৭৩১)।
.
▪️(২). দ্বিতীয়ত: যদি কোন ব্যক্তি সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত হয় এবং সে পাপী ব্যক্তি বলে জানা যায় না। এমন ব্যক্তি যদি শয়তানের ধোকায় পড়ে গোপনে গোনাহ করে, যে গোনাহের ফলে সে একাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যরা হয় না বরং এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং তার পক্ষ থেকে একটি ত্রুটি, তাহলে তার ভুলের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করা জায়েয হবে না, কারণ জনসম্মুখে বিষয়গুলো প্রকাশ করা তিরস্কার ও নিন্দা করার শামিল; যা একপ্রকার গীবত। অথচ গীবত করা ইসলামে হারাম। যেমন: কেউ বিবাহবহির্ভূত হারাম সম্পর্কে থাকে; সে এটিকে গোপন রাখে, কাউকে না জানায়। এমন ক্ষেত্রে তার এই গোনাহের কথা বাইরে বলে বেড়ানো যাবে না, বরং তাকে পার্সোনালি সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। ইনি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের গ্রন্থগুলি অসংখ্য দলিল বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
.
আল্লাহ বলেছেন, وَ لۡیَعۡفُوۡا وَ لۡیَصۡفَحُوۡا ؕ اَلَا تُحِبُّوۡنَ اَنۡ یَّغۡفِرَ اللّٰهُ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ “তারা যেন তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাওনা, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সুরা নুর; ২৪/২২)। এ আয়াতের প্রেক্ষাপট যদিও ভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট, কিন্তু এই বাণী সকলের জন্যই ব্যাপক। অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন: اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। (সূরা নূর; ২৪/১৯)। এর অর্থ হলো একজন মুমিনের পক্ষ থেকে লজ্জাজনক কাজের খবর প্রচার করা যে তার ভুল গোপন করছিল, বা যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল যখন সে তার থেকে নির্দোষ ছিল, যেমন: ইফকের ঘটনা। হাদীসে এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেন, হে ঐ জামা‘আত, যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে- আল্লাহ তা‘আলা তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভিতরে অবস্থান করে থাকলেও। (বিস্তারিত দেখুন- তিরমিযী হা/২০৩২; সহীহুত তারগীব হা/২৩৩৯, সহীহ বুখারী হা/২৪৪২, ৬৯৫১; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮, সহীহ মুসলিম হা/২৫৯০; সহীহুল জামে‘ হা/৭৭১২)।
.
এক্ষেত্রে তার পাপ জনসম্মুখে প্রকাশ না করে, করনীয় হচ্ছে তাকে গোপনে তাকে উপদেশ দেওয়া, তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, তাকে আল্লাহর কাছে তওবা করার নসিহা করা এবং সে যা করেছে, এর ফলে কী নেতিবাচক পরিণতি হতে পারে তার গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে ব্যাখ্যা করা। যদি সে অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আবার এমন কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তার ভুল গোপন করে তাকে কাছে টেনে নেয়া সালাফদের বৈশিষ্ট্য। ইমাম ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,‘সালাফগণ যখন কাউকে নসিহত করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তাকে গোপনে বা একান্তে নসিহত করতেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কোন ভাইকে একান্তে নিজেদের মধ্যে হিতোপদেশ দেয়, বস্তুত সেটাই নসিহত। আর যে ব্যক্তি মানুষের সামনে কাউকে উপদেশ দেয়, মূলত সে যেন তাকে তিরস্কার করল। ফুযাইল ইবনু ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الْمُؤْمِنُ يَسْتُرُ وَيَنْصَحُ، وَالْفَاجِرُ يَهْتِكُ وَيُعَيِّرُ ‘মুমিন ব্যক্তি দোষ-ত্রুটি গোপন রেখে নসিহত করে। আর লম্পট ব্যক্তি ফাঁস করে বেড়ায় ও অপদস্ত করে। (ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম ১/২২৫)।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন,‘বলা হয় তোমার সৎ কাজের আদেশ প্রদান যেন সৎ মাধ্যমে হয় এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান যেন অসৎ পন্থায় না হয়। সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তির মাঝে তিনটি গুণ নাই সে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে না।

(ক). যে বিষয়ের আদেশ প্রদান করবে এবং যে বিষয় থেকে বারণ করবে উক্ত বিষয়ে আন্তরিক হবে।

(খ). যে বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করবে এবং যা থেকে বারণ করবে উক্ত বিষয়ে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।

(গ). যে বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করবে এবং যা থেকে বারণ করবে উক্ত বিষয় সম্পর্কে আলিম হতে হবে। (ইবনু তাইমীয়া, রিসালাতুল আমরি বিল মা‘রুফ ওয়ান নাহয়্যি আনিল মুনকার,পৃষ্ঠা: ৭, ১৯)।
.
তাছাড়া অপর দ্বীনি ভাইয়ের পাপ গোপন করার বিরাট ফজিলত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির দোষ গোপন করলো, সে যেন জীবন্ত পুঁতে ফেলা কোনো কন্যাকে কবর থেকে উঠিয়ে জীবন দান করল।’’ (মুসতাদরাক হাকিম: ৪/৪২৬, সহিহ ইবনু হিব্বান: ২/২৭৫, হাদিসটি সহিহ)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে, দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। (সহীহ মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪)। হাদিসটির ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, فِيهِ إِشَارَةٌ إِلَى تَرْكِ الْغِيبَةِ ‌لِأَنَّ ‌مَنْ ‌أَظْهَرَ ‌مَسَاوِئَ ‌أَخِيهِ ‌لَمْ ‌يَسْتُرْهُ، ‘অত্র হাদীসে গীবত পরিত্যাগের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে দেয়, তার দোষ-ত্রুটিও আর গোপন রাখা হয় না। (ফাৎহুল বারী,খন্ড: ৫পৃষ্ঠা: ৯৭)। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের মান-সম্মান বিনষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করে, ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার মুখমন্ডল হতে জাহান্নামের আগুন প্রতিরোধ করবেন। (তিরমিযী হা/১৯৩১; সহীহুল জামে‘ হা/৬২৬২; সহীহুত তারগীব হা/২৮৪৮)। এই হাদীসের ব্যাখায় ইমাম মানাবী (রহঃ) বলেন, والسبب في ذلك أن عِرض المؤمن كدَمِه، فمَن هتك عرضه فكأنه سفك دمه، ومَن عمل على صون عرضه، فكأنه صان دمه، فيُجازى على ذلك بصونه عن النار يوم القيامة، ‘এর কারণ হচ্ছে মুমিনের সম্মান তার রক্তের মতো পবিত্র। যে ব্যক্তি (পরনিন্দা বা অন্য কোন মাধ্যমে) তার সম্মান নষ্ট করে, সে যেন ঐ মুমিনের রক্তপাত ঘটিয়ে ফেলে বা হত্যা করে ফেলে। সুতরাং যে ব্যক্তি মুমিনের সম্মান রক্ষা করল, সে যেন তার জীবনটাই রক্ষা করল। ফলে এর বিনিময়ে ক্বিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে পুরস্কৃত করা হবে। (মানাবী, ফায়যুল ক্বাদীর, খন্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ১৩৫)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে- দ্বীনি ভাই-বোনদের ব্যক্তিগত গোপন বিষয় যা তার নিজের সাথে সম্পৃক্ত,যার প্রভাব অন্যদের উপর পড়বে না।কিন্তু সেগুলো অন্যের কাছে বা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে তিনি অপমানবোধ করবেন এবং মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হবেন এবং তার মান-সম্মান নষ্ট হবে, তাহলে এ-সব পাপ জনসম্মুখে প্রকাশ করা গীবত যা হারাম এবং কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে এটা ব্যাপকভাবে চলছে। এটাকে কারো কাছে অপরাধই মনে করছেনা, বরং এগুলো নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে, নিজের মতো করে প্রচার-প্রসার করছে। (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)। একজন মনীষী তার সাথীদের বলেছেন, আচ্ছা! তোমাদের কোন ঘুমন্ত ভাইয়ের কাপড় যদি বাতাসে উড়ে সতর আলগা হয়ে যায়, তবে কি তোমরা তার সতর ঢেকে দিবে, না আরো উন্মোচন করে দিবে? তারা বলল, অবশ্যই আমরা তার সতর ঢেকে দিব। তখন তিনি বললেন, ‘না! বরং তোমরা তার সতর আরো উন্মুক্ত করে দিবে। সাথীরা বলল, সুবহানাল্লাহ! কিভাবে আমরা আমাদের ভাইয়ের সতর উন্মুক্ত করে দেব। তখন তিনি বললেন, ‘যদি তা-ই হয়, তাহলে তোমাদের সামনে যখন কোন লোকের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়, তবে তার গীবতে লিপ্ত হও কেন? তখন তো তোমরা তার সতর থেকে বাকী কাপড়টুকু নির্মমভাবে সরিয়ে দিলে। (তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃষ্ঠা: ১৬৫)। যাইহোক জেনে রাখুন, হে ভাই-বোন! দোষ-ত্রুটি নিয়েই মানুষ। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন:كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءٌ অর্থাৎ প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী।(তিরমিযী হা/২৪৯৯, ইবনু মাজাহ হা/ ৪২৫১) অতএব, আমাদের অনেকেরই এমন এমন অপরাধ আছে, যা মানুষ জানলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ সেগুলো ঢেকে রেখেছেন। আমরা মানুষের গোপন গোনাহ নিয়ে তাকে অপদস্থ করি, অথচ আল্লাহ চাইলে মুহূর্তেই আমাদের নাজেহাল করে দিতে পারেন। হ্যাঁ, আখিরাতে আল্লাহর ইচ্ছায় সবই প্রকাশিত হয়ে যাবে। এজন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে যেন নিজেদের অপরাধ আল্লাহ ঢেকে রাখেন, সেজন্য অন্যের পাপগুলোও ঢেকে রাখুন। আল্লাহ্ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।