ব্যক্তি বা আলেমদের মানহাজ দেখে ইলম গ্রহণ করুন শুধুমাত্র আক্বীদা দেখে নয়

ব্যক্তি/আলেমদের মানহাজ দেখে ইলম গ্রহণ করুন; শুধুমাত্র আক্বীদা দেখে নয়। কারণ, অনেকের আক্বীদা সহীহ হলেও মানহাজ সহীহ নয়। কিন্তু যার মানহাজ সহীহ, আলহামদুলিল্লাহ দেখবেন তার আক্বীদাও সহীহ।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
প্রিয় পাঠক, আক্বীদা ও মানহাজ এই দুটি ইসলামী শরীয়তের অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। একজন ব্যক্তির পরকালীন সফলতা অথবা ব্যর্থতা এই দুটি বিষয়ের বিশুদ্ধতা অথবা ভুলের উপর নির্ভরশীল। যে মুসলিম এই দুটি বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কুরআন-সুন্নাহ এবং প্রসিদ্ধ সালাফদের মানহাজের আলোকে দুনিয়াবী জীবনে যথার্থ প্রয়োগ করবেন, ইনশাআল্লাহ মৃত্যুর পর তিনি নাজাত প্রাপ্তদের দলে অন্তর্ভুক্ত হবেন। অপরদিকে যে দুনিয়াতে এই দুইটি বিষয়ের গুরুত্ব পরিহার করে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে মৃত্যুবরণ করবে,তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ ব্যাপারে কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ “যে আমার অভিমুখী হয়, তুমি তার পথ অনুসরণ করবে। তারপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে তা জানিয়ে দেব, যা তোমরা করছিলে।” [সূরাহ লুক্বমান: ১৫] অপর আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন:وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব, কতইনা মন্দ সে আবাস!” [সূরাহ নিসা: ১১৫] উক্ত আয়াতের আলোকে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, فمن أحب الكون مع السلف في الآخرة، وأن يكون موجودا بما وعدوا به من الجنات والرضوان؛ فليتبعهم بإحسان، ومن اتبع غير سبيلهم؛ دخل في عموم قوله تعالى: وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا. “যে ব্যক্তি আখিরাতে (ন্যায়নিষ্ঠ) সালাফদের সাথে থাকতে এবং তাঁদেরকে যে জান্নাত ও সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা নিজের জন্য প্রস্তুত পেতে পছন্দ করে, সে যেন যথাযথভাবে তাঁদের অনুসরণ করে। আর যে তাঁদের পথ ভিন্ন অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, সে আল্লাহ তা‘আলার এই ব্যাপক কথার মধ্যে প্রবেশ করবে, “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব; কতই না মন্দ সে আবাস!”(সূরাহ নিসা: ১১৫ ইবনু কুদামাহ যাম্মুত তা’উয়ীল, পৃষ্ঠা: ১০)।
.
কুরআন সুন্নাহ প্রমাণ করে এই উম্মতের মুসলিমরা ৭৩ দলে বিভক্ত হবে যার মধ্যে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল কেবল একটি। আর এই দলের সদস্য তো স্রেফ তারাই, যারা সালাফদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।মুক্তিপ্রাপ্ত দলের ব্যাপারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي. “বানী ইসরাঈল সম্প্রদায় ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন, ‘হে আল্লাহ’র রাসূল, সে দল কোনটি?’ তিনি বললেন, আমি ও আমার সাহাবীগণ যে আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত (তার উপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে তারা)।”(তিরমিযী, হা/২৬৪১; সনদ: হাসান] মুক্তিপ্রাপ্ত দলটিই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, আহলুল হাদীস, আহলুল আসার, সালাফিয়্যাহ।এই নামগুলো একই মানহাজের পদনির্দেশ করে, আর তা হলো সালাফদের মানহাজ। যারা এই মানহাজের অনুসরণ করে তারা সালাফী, আর যারা এই মানহাজের বিরোধিতা করে তারা বিদ‘আতী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আহলুস সুন্নাহ’র কোনো একটি মূলনীতির বিরোধিতা করে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট সে আহলুস সুন্নাহ থেকে বের হয়ে যায় তথা “বিদ‘আতী” হিসেবে পরিগণিত হয়। আর বিদ‘আতী হিসেবে পরিগণিত হওয়া মানে মুক্তিপ্রাপ্ত দল থেকে খারিজ হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। এই মর্মে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবূ ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] বলেছেন, ﻭﻣﻦ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﺍﻟﻼﺯﻣﺔ ﺍﻟﺘﻲ ﻣﻦ ﺗﺮﻙ ﻣﻨﻬﺎ ﺧﺼﻠﺔ –ﻟﻢ ﻳﻘﺒﻠﻬﺎ ﻭﻳﺆﻣﻦ ﺑﻬﺎ– ﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻣﻦ ﺃﻫﻠﻬﺎ. “আবশ্যকীয় সুন্নাহ’র (মানহাজের) মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কোনো একটি বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করবে, তা গ্রহণ করবে না এবং তার প্রতি ঈমানও আনবে না, তবে সে সুন্নাহপন্থিদের তথা আহলুস সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত নয়।” [ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ), উসূলুস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৩; ছাপা ও তারিখ বিহীন; ইমাম আল লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ৩১৭; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৮)।
.
পক্ষান্তরে মুক্তিপ্রাপ্ত দল তথা আহলুস সুন্নাহ ওয়া জামা‘আতের পরিচয় সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] বলেন, ‘তাঁরা হলেন আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তিবর্গ এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রথম সারির ছাহাবী এবং তাদের অনুসারী তাবেঈগণ যে নীতিসমূহের উপর একমত ছিলেন তার উপর যারা সুপ্রতিষ্ঠিত’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩/৩৭৫ পৃ.)। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত তারাই, যারা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে, তার উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। এ কারণেই তাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত নামে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তাঁরা সুন্নাহর ধারক ও বাহক। এছাড়া তাদেরকে আহলুল জামা‘আতও বলা হয়। কারণ তারা সুন্নাতের উপর ঐক্যবদ্ধ’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৭)। বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, তারা হলেন- নবী করীম (ﷺ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ যে নীতির উপরে ছিলেন সেই নীতির অনুসারী। তারা পৃথিবীর যেকোন স্থানে ও যেকোন যুগে নবী করীম (ﷺ) -এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে এবং ছাহাবীগণ, তাবেঈগণ, তাদের অনুসারী সৎপথপ্রাপ্ত ‘উলামায়ে কিরামকে আঁকড়ে ধরে এবং যারা (তাক্বলীদের বিপরীতে) ইত্তেবা‘ তথা আনুগত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে এবং বিদ‘আত থেকে বিরত থাকে। তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে ও সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। তারা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এবং কথায়, আমলে ও বিশ্বাসে নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাতের উপর জামা‘আতবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরে থাকার কারণে তাদেরকে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে’ (বায়ানু আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি ওয়া লুযূমিত তাবাঈহা, পৃষ্ঠা: ৫) সুতরাং মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি হবে আক্বীদা ও মানহাজে সালাফি বা আহালুল হাদীস।
.
প্রিয় বন্ধুগণ! যদিও আমাদের অনেক সালাফগন আক্বীদা ও মানহাজের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি; তাদের মতে আক্বীদা ও মানহাজ একই জিনিস,অতএব এগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উদাহরণস্বরূপ: সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণকে আক্বিদা ও মানহাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা এই মর্মে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেন:- একজন মুসলিমের আক্বিদা এবং মানহাজ একই জিনিস এবং তা হলো একজন মানুষ তার অন্তরে যা কিছুই বিশ্বাস করে, জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা তার উপর আমল করে এবং মহামহিমান্বিত আল্লাহর একাত্মতায়, রুবুবিয়্যাহতে (সমগ্র বিশ্বের কতৃত্ব), উলুহিয়্যাহতে (এককভাবে শুধুমাত্র তিনিই ইবাদাতের হকদার), এবং আসমাউস সিফাতে (তাঁর নাম ও গুণাবলী), এবং এককভাবে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদাত করা, এবং কিতাবুল্লাহ (কুরআন) ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহতে যা কিছুই এসেছে সেগুলোকে মুখে স্বীকার করা, আমল করা এবং অন্তরে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে তাঁর (আল্লাহর) শরীয়তকে মজবুত করে আঁকড়ে ধরা এবং এই উম্মতের সালাফগণ এবং ইমামগণ যেই পথের উপর ছিলেন সেই পথের উপর থাকা। এবং এসবের দ্বারা এটাই বোঝায় যে,আক্বিদা ও মানহাজে কোনো পার্থক্য নেই, বরং এই দুইটি একই জিনিস এবং একজন মুসলিমের জন্য এর উপর অটল ও অবিচল থাকা ওয়াজিব। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:৪০-৪১)। প্রিয় পাঠক! আমাদের কতিপয় সালাফগণ যে অর্থে আক্বীদা ও মানহাজের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি সে অর্থে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক। আবার যেসকল সালাফগণ আক্বীদা ও মানহাজের মধ্যে পার্থক্য করেছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সঠিক। অর্থাৎ উভয়ই স্ব স্ব চিন্তা ভাবনায় সঠিক। আমরা যদি আক্বীদা ও মানহাজ সম্পর্কে কিছু কথা বলি তাহলে বিষয়টি পরিস্কার ভাবে বুঝতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। যেমন:
.
(১). আক্বীদা আরবী (العقيدة‎‎) ইংরেজি creed বা belief system শব্দের অর্থ হলো- বিশ্বাস, আস্থা, মতাদর্শ, ধর্মমত ইত্যাদি। পরিভাষায় মানুষ যা সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে দীন হিসাবে গ্রহণ করে তাই তার আকীদা। ইবনু মুহাম্মাদ আল-ফাইঊমী (৭৭০হি) তাঁর আল-মিসবাহুল মুনীর গ্রন্থে লিখেছেন:العقيدة ما يدين الإنسان به، وله عقيدة حسنة: سالمة من الشك‘‘মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকে ‘আকীদা’ বলা হয়। বলা হয় ‘তার ভাল আকীদা আছে’, অর্থাৎ তার সন্দেহমুক্ত বিশ্বাস আছে।’(ফাইঊমী, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মিসবাহুল মুনীর: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৪২১) আধুনিক ভাষাবিদ ড. ইবরাহীম আনীস ও তাঁর সঙ্গিগণ সম্পাদিত ‘আল-মু’জামুল ওয়াসীত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:العقيدة: الحكم الذي لا يُقْبَلُ الشكُّ فيه لدى معتقده، و(في الدين) ما يقصد به الاعتقاد دون العمل‘‘আকীদা অর্থ এমন বিধান বা নির্দেশ যা বিশ্বাসীর বিশ্বাস অনুসারে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ রাখে না …. ধর্মীয় বিশ্বাস যা কর্ম থেকে পৃথক..(ড. ইবরাহীম আনীস ও সঙ্গিগণ, আল-মুজাম আল ওয়াসীত খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৬১৪)।
.
আক্বীদা শব্দটি খাস যা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আক্বীদার link বা সম্পর্ক হলো তার সাথে, যাকে বলা হয় “তাওহীদের জ্ঞান” এবং এটা ইসলামের প্রধান ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। মোটকথা আক্বীদা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঈমানের মূল বিষয় এবং শাহাদাতাইনের অর্থ দাবি ও চাহিদা। আরো সহজে বললে আক্বীদা হলো: একজন মানুষের জন্য জরুরী বিষয়; যা হলো সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর উপর এবং যা কিছুই তাঁর কাছ থেকে এসেছে তাঁর উপর এবং তাঁর রাসূলগণের উপর এবং যা কিছুই তাঁরা নিয়ে এসেছেন, সেসবের উপর ঈমান আনা। এবং পুরো ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের উপর ঈমান আনা, যেগুলো হলো- আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালাইকা বা ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রসূলগণের প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনা এবং আল-ক্বদরের উপরও ঈমান আনা এবং এর ভালো ও মন্দের প্রতি (তাক্বদীর)। অতঃপর যা কিছুই আছে যার প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং যা সত্য এবং সঠিক। যেমন: গাইব বা অদৃশ্যের বিষয়; পুনরুত্থানের ফিতনা (কঠোর দুর্দশা) যা নবী (ﷺ)-এর মাধ্যমে জানানো হয়েছে এবং নবী-রাসূলগণের (পূর্ববর্তী) বিষয়ে যা জানানো হয়েছে, তা কিতাব (কুরআন) বা সুন্নাহ (হাদীস) যেখানেই থাকুক। এবং বারযাখের অবস্থা (কবরের জীবন) এবং কবরের আযাব ও সুখ-শান্তি, এবং শেষ বিচারের দিন যা ঘটবে, যেমন: হাওজ (হাওজে কাওসার), পুলসিরাত, মিযান স্থাপন (দাঁড়িপাল্লা) এবং তার পাশাপাশি যা কিছুই আছে।
.
(২). অপরদিকে মানহাজ আরবি (مَنْهَج) ইংরেজি methodology। শব্দটির অর্থ হলো নীতি, সুস্পষ্ট পথ, পন্থা, পদ্ধতি, রাস্তা, সিলেবাস, কারিকুলাম ইত্যাদি। মানহাজ শব্দটি আক্বীদার তুলনায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ; যা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মানহাজ আক্বীদার ক্ষেত্রেও হতে পারে; আবার অন্য ক্ষেত্রেও হতে পারে। তাই দেখা যায়, আক্বীদা-বিশ্বাস, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, লেনদেন, শিষ্টাচার অর্থাৎ একজন মুসলিমের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে মানহাজের উপস্থিতি। সহজ কথা হলো দ্বীনের ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে আদর্শ, রীতি-নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করে চলে তাকেই ‘মানহাজ’ বলে। আক্বীদাসহ দ্বীনের সকল বিষয়ই মানহাজের মধ্যে শামিল। এছাড়া অন্যভাবে বলা যায় যে, যখন বলা হয় সলফে-সলিহীনগণের মানহাজ, তখন আক্বীদাসহ যা কিছু আছে সব কিছুই মানহাজের মধ্যে শামিল। আর যখন বলা হয় সলফে-সলিহীনগণের আক্বিদা-মানহাজ, তখন সেক্ষেত্রে আক্বীদার বিষয় ছাড়া বাকি সবকিছুই মানহাজের মধ্যে শামিল। আরো সহজ করে বলতে গেলে মানহাজ হলো: দ্বীন এবং এর ফুরূ (ভিত্তি এবং শাখা-প্রশাখা)-এর উসূলের সমর্থন, সংস্থাপন। মানহাজ হলো রাস্তা যার মাধ্যমে একজন মানুষ দ্বীনের ভিত্তি ও শাখা-প্রশাখা সমর্থন করে। কাজেই এই রাস্তা যদি কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাহ (হাদীস) এবং সালফে-সলিহীনগণের পদ্ধতির সাথে মিল থাকে, তাহলেই এটি সত্যিকারের মানহাজ। আর যদি তা এর বিপরীত হয় তাহলে তা বিকৃত মানহাজ। আর ইসলাম এসেছে এই দুইটি জিনিসের সাথে একত্রিত হয়ে।

(ক). সঠিক ও বিশুদ্ধ আক্বীদা এবং

(খ). সঠিক ও নিরাপদ মানহাজ।

যে কারণে, একটি আরেকটি থেকে আলাদা করা যায় না। যেই মানুষের মানহাজ বিকৃত, বিশ্বাস রাখুন যে, এই বিকৃতি তার আক্বীদাকেও অনুসরণ করে। যখন কারো মানহাজ সঠিক হয়,একইভাবে তখন তার আক্বীদাও সঠিক হয়।আক্বীদা মানহাজে বিকৃত হওয়ার কারণে খারেজীরা পথকষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারা এই বিশ্বাস পোষণ করেছিল যে কবীরা গুনাহগার ব্যক্তিদের রক্ত হালাল এবং এইজন্য তারা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে এবং তাদের হত্যা করাকে জায়েজ করেছিল এবং কবিরা গুনাহগার অবাধ্য শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তারা রক্ত ও সম্পদ নেয়াকে বৈধ করেছিল। তারা কুরআন সুন্নাহ সালাফদের মানহাজ বাদ দিয়ে নিজেদের মত বুঝতে গিয়েই পথভ্রষ্ট হয়েছে।
.
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণ হয় যে, আক্বীদা ও মানহাজের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। অনেকের আক্বীদা সহীহ হলেও মানহাজ সহীহ নয়। আমার উক্ত কথাগুলো সঠিক হওয়ার বাস্তব উদাহরণ এই যে, আমি এমন বেশ কয়েকজন সালাফি আক্বীদার দ্বীনের দাঈ সম্পর্কে জানি (অন্য দেশি বা সবার কথা বাদ দিলাম) আমি এমন দুজন প্রবাসী সালাফি দাঈ সম্পর্কে জানি যাদের আক্বীদা আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশের হাতে গোনা অল্প কয়েকজন সহীহ আক্বীদার আলেম বাদে দেশের অধিকাংশ আলেমদের চেয়েও তাদের দুজনের আক্বীদা অধিক বিশুদ্ধ। তারা আক্বীদার মাসালায় পারদর্শী। আক্বীদার বিষয়গুলো কিভাবে নিজের অন্তরে ধারণ করতে হবে সেটা তারা সহীহ ভাবেই জানে, হয়তোবা মানেও। ফালিল্লাহিল হামদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের মানহাজে কিছু সমস্যা রয়েছে, তারা মানহাজে সালফে-সালিহীনগণের পথের উপর পরিপূর্ণ ভাবে নেই। আক্বীদা সংক্রান্ত বিষয়গুলো বাদে শরীয়তের অন্যান্য যাবতীয় বিষয়গুলো কিভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে, প্রসিদ্ধ সালাফরা কিভাবে বুঝেছেন এবং তারা কিভাবে ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ করেছেন, কোন বিষয়ে কথা বলেছেন এবং কোন বিষয়ে চুপ থেকেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নম্র হতে হবে, অন্যান্য সালাফি আলেমদের কিভাবে সম্মান করতে হবে অথবা দ্বীনি ভাইদের কিভাবে স্নেহ করতে হবে, অন্য সালাফি দাঈদের মধ্যে কোন ভুল ত্রুটি দেখলে কিভাবে ভুলগুলো শুধরে দিতে হবে অথবা প্রয়োজনে অপর দ্বীনি ভাইকে কীভাবে ইসলাহ বা খণ্ডন করতে হবে! আমি গবেষণা করে দেখলাম; এই বিষয়গুলো তারাসহ অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত! কিন্তু তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন তাদের আক্বীদা মানহাজ কি? তারা বলবে আক্বীদা ও মানহাজ সালফে সালেহীন।
.
আবার অনলাইনে এমন কিছু তরুণ যুবকদের উৎপত্তি হয়েছে, যাদের প্রধান কাজ হল ইসলামের যে বিষয়গুলো জানা এবং মানার মধ্যে নিজের বা অন্যের তেমন কোন কল্যাণ নেই সেগুলোর পিছনে পড়ে থাকা, নিষিদ্ধ জিনিস গুলো অনেক সময় জায়েজ প্রমানের চেষ্টা করা যেমন: গান, দাবা, ইত্যাদি, তারা মতভেদ পূর্ণ মাসালায় উগ্রপন্থা অবলম্বন করা এবং চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি করা। তাদের বেশিরভাগ কাজ হল অন্যের সমালোচনা করা, অমুক শাইখ কে খন্ডন করা, ইমাম আবু হানিফা রহঃ কে জারাহ করা, ১৯ থেকে ২০ হলেই সম্মানিত আলেম অথবা দ্বীনি ভাইদেরকে বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে মানহাজ থেকে বের করে দেয়া এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করে অনলাইনে ফিতনা সৃষ্টি করা। এই বৈশিষ্ট্য গুলো তাদের মধ্যেই রয়েছে যারা এখনো পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারেনি মানহাজ আসলে কি? সালাফি মানহাজের সঠিক অর্থ, মর্ম এবং বিশুদ্ধ প্রয়োগ কি? পরিপূর্ণ ভাবে মানহাজ না বুঝার কারণেই তাদের মধ্যে উপরোক্ত সমস্যাগুলো বেশি বিদ্যমান রয়েছে। অথচ তারা নিজেদেরকে পিউর সালাফি-আহালুল হাদীস মনে করে। পক্ষান্তরে যে সকল আলেম বা দ্বীনি ভাইদের মানহাজ সহীহ, আলহামদুলিল্লাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখবেন তাদের অন্যান্য বিষয়গুলো সহীহ। তারা বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি দুটোর কোনটির মধ্যেই নেই। তারা সর্বদা সালাফদের মানহাজার আলোকে বক্তব্য বা ফাতওয়া দিয়ে থাকে। তারা জানে একজন ব্যক্তির মানহাজের মধ্যেই আক্বীদা প্রবেশ করে (অর্থাৎ আক্বীদা মানহাজের অন্তর্ভূক্ত)।উদাহরণস্বরূপ: আল্লাহর নাম ও সিফাতের উপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর মানহাজ হলো এই এই…..যা কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাহতে (হাদীস) এসেছে, দলীল ও প্রমাণ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর মানহাজ হলো এই এই…..,বর্ণনার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর মানহাজ হলো এই এই…..। এটাই তাদের মানহাজ। যেভাবে তারা (সলফে সলিহীনগণ) দলীল ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এবং প্রয়োগ করেছেন সেটাই হলো মানহাজ। যেভাবে তারা বর্ণনা গ্রহণ করেছেন এবং বর্ণনাটি বিবেচনা করেছেন সেটাই মানহাজ।”এজন্যই বলেছিলাম শুধু আক্বীদা দেখে নয় বরং মানহাজ দেখে আলেমদের থেকে ইলম নিন। কেননা যে আলেমের মানহাজ সহীহ নয়; তার থেকে সব বিষয়ে ইলম নেওয়া নিরাপদ নয়। কারন মানহাজে সমস্যা থাকার কারণে সে কুরআন- হাদীসের অপব্যাখ্যা করতে পারে, তার কাছে দ্বীনি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভুল মানহাজের আলোকে ফাতওয়া দিতে পারে। আর এ জন্যই পোস্টের শিরোনামে বলেছিলাম ব্যক্তি বা আলেমদের মানহাজ দেখে তার থেকে ইলম গ্রহণ করুন; শুধু আক্বীদা দেখে নয়। কারণ, অনেকের আক্বীদা সহীহ হলেও মানহাজ সহীহ নয়। কিন্তু যার মানহাজ সহীহ, আলহামদুলিল্লাহ তার আক্বীদাও সহীহ। আলেম নিয়ে বলা কথাগুলো আমার একান্তই নিজস্ব গবেষণার ফলাফল। আমি যেহেতু মানুষ আমি ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমার চিন্তা-ভাবনা ভুলও হতে পারে, অনুরোধ থাকবে ভুল হলে সংশোধন করে দিবেন উপকৃত হবো এবং ভুল শুধরে দেওয়া ব্যক্তিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালোবাসবো ইনশাআল্লাহ্। মহান আল্লাহ সকলকে সহীহ আক্বীদা- মানহাজের জ্ঞান অর্জন করা এবং মৃত্যু পর্যন্ত এর উপর অটল থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
আপনাদের দ্বীনি ভাই
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।