বিপদ বা কষ্টের সময় ধৈর্য্য ধারণ করুন এবং আল্লাহর উপর রাজী-খুশি থাকুন।

মহান আল্লাহ বলেন,وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ، ‘আর আমরা তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (সূরা আম্বিয়া ২১/৩৫)। কল্যাণ দ্বারা পরীক্ষিত হ’লে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা এবং মুসিবত দ্বারা পরীক্ষিত হ’লে ধৈর্যধারণ করা মমিনের কর্তব্য। কারন এই দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার সদৃশ আর কাফিরের জন্য জান্নাত সদৃশ।(সহীহ মুসলিম হা/২৯৫৬; মিশকাত হা/৫১৫৮) সুতরাং বিভিন্নমুখী বিপদাপদ মুকাবিলা করতে করতে মুমিন এক সময় যখন মৃত্যুবরণ করবে, তখন তার আর কোন গোনাহ থাকবে না। যেমন:রাসূল ﷺ বলেছেন, মুমিন নর-নারীর নিজ জীবন, সন্তানাদি ও মাল-সম্পদে সর্বদা বালা-মুছীবত লেগে থাকবে। অতঃপর সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে এমন অবস্থায় যে, তার উপরে কোন গোনাহ থাকবে না। (তিরমিযী হা/২৩৯৯; সহীহ ইবনু হিববান হা/২৯২৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/২২৮০)
.
এ দুনিয়াতে সর্বাধিক বিপদ গ্রস্থ কারা এমন একটি প্রশ্নের জওয়াবে রাসূল ﷺ বলেন, দুনিয়ায় সবচেয়ে কঠিন বিপদগ্রস্থ হ’লেন নবীগণ। তারপর ক্রমানুযায়ী সর্বোচ্চ নেককারগণ। মুমিন পরীক্ষিত হবে তার দ্বীন অনুযায়ী। যদি সে দ্বীনের বিষয়ে কঠিন হয়, তবে তার পরীক্ষা সেই অনুযায়ী কঠিন হবে। আর যদি সে দ্বীনের ব্যাপারে ঢিলা হয়, তার পরীক্ষা অনুরূপ হালকা হবে। মুমিনের উপরে এইভাবে পরীক্ষা চলতে থাকবে। এমন এক সময় আসবে যে, সে যমীনের উপরে চলাফেরা করবে এমন অবস্থায় যে, তার কোন গোনাহ থাকবে না। (তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩; সহীহ ইবনু হিববান হা/২৯০১; মিশকাত হা/১৫৬২; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৪৩)
.
দুনিয়ায় নবীগন সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত হয়েছেন তার বাস্তব উদাহরণ নবী ইবরাহীম (আঃ)। কেননা কুরআন সুন্নাহ থেকে আমরা জানাতে পেরেছি তিনি চরম বিপদ-আপদ ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রী ও পুত্র ব্যতীত জীবদ্দশায় তার কোন সাথী জোটেনি। তথাপি তিনি ছিলেন, একাই একটি উম্মত ও অনাগত ভবিষ্যতের সকল তাওহীদবাদীর একচ্ছত্র নেতা। এ নেতৃত্ব স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত। এই নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্বে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষার পরে পরীক্ষা করেছেন।মহান আল্লাহ বলেন,আর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কতগুলি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল, তখন তার প্রতিপালক বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব’(সূরা বাক্বারাহ ২/১২৪)। ইবরাহীমের এই নেতৃত্ব ছিল তাওহীদ ভিত্তিক জীবন যাপনের নেতৃত্ব। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সমূহ মেনে চলার ক্ষেত্রে এক অতুলনীয় নেতৃত্ব। আর এই নেতৃত্বের সনদ তিনি লাভ করেন স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হ’তে। নইলে মানুষ তো তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। স্বীয় জীবদ্দশায় সমর্থকের সংখ্যা বিচারে তিনি ছিলেন ব্যর্থ। কিন্তু সত্যিকারের বিচারক মহান আল্লাহর সূক্ষ বিচারে তিনি ছিলেন মানবজাতির সত্যিকারের নেতা। এজন্য অন্যত্র আল্লাহ বলেন,নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিল একাই একটি উম্মত। যে ছিল আল্লাহর প্রতি বিনীত ও একনিষ্ঠ এবং সে কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’ (সূরা নাহল ১৬/১২০)।সুতরাং বিপদের সময় দীর্ঘ হ’লে সাবধান থাকা এবং অধিক পরিমাণে দো‘আ করা উচিত। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
.
রাসূল (ﷺ) ধৈর্যশীল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারো জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। (সহীহ মুসলিম হা/২৯৯৯; মিশকাত হা/৫২৯৭)
.
অপর বর্ননায় আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই বড় পুরস্কার বড় পরীক্ষার ফলে হয়ে থাকে। আল্লাহপাক যখন কোন কওমকে ভালবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। যে ব্যক্তি সেই পরীক্ষায় সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য থাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিযী হা/২৩৯৬, মিশকাত হা/১৫৬৬ সনদ হাসান)
.
আরেক বর্ননায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু!’। আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি। (সহীহ মুসলিম হা/ ২৮০৭, মুসনাদে আহমাদ হা/ ১২৬৯৯, ১৩২৪৮; রিয়াদুস সলেহিন হা/৪৬৬)।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,“আল্লাহ তাঁর প্রিয় ঈমানদার বান্দাকে, যাকে তিনি ভালবাসেন, তাকে সামান্য ভুল ভুল-ত্রুটির কারণেই পাকড়াও করেন, শুধুমাত্র তাকে সতর্ক আর সংশোধন করার জন্য। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর চোখে নগন্য এবং তাঁর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত, তাকে তিনি ইচ্ছামত পাপ করার সুযোগ দেন। বরং, যখনই সে একটা পাপ কিংবা অবাধ্যতার কাজ করে, তিনি তাকে (দুনিয়াবি সাফল্য দিয়ে) পুরস্কৃত করেন। ধোঁকা খেয়ে যাওয়া মানুষেরা ভাবে এইসব (সাফল্য) বুঝি সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার কারনেই পাচ্ছে! অথচ এটাই হচ্ছে ব্যর্থতার চূড়ান্ত পর্যায়, আর তিনি তার জন্য (পরকালে) ভয়াবহ আর চিরন্তন শাস্তি নির্ধারন করে রেখেছেন।” (যাদুল মাআ’দ খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৫০৬)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেছেন,“যখন কোন বান্দা আল্লাহর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার এটা জানা উচিত যে, আল্লাহ শুধুমাত্র তাকেই পরীক্ষা করেন নি। বরং, ইতিঃপূর্বে আল্লাহ তাঁর আওলিয়াদেরকেও পরীক্ষা করেছেন। সুতরাং বান্দার উচিত আল্লাহর পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা, পরীক্ষার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বস্তি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। (চারটি মূলনীতির ব্যাখ্যাঃ পৃষ্ঠা ৭)
.
ইমাম ইবনু রজব আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯৫ হি.] বলেছেন“মুসীবত থেকে মুক্তির জন্য ধৈর্য ধারণ করা ইবাদত, কেননা মুসীবত কখনো চিরস্থায়ী হয়না। (মাজমু রাসায়েল ইবনে রজবঃ খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৫৫)
.
পরিশেষে, দু’আ করছি মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বালা-মুছীবত থেকে বিশেষ করে চলমান বিদ্যুৎবিহীন তীব্র গরম থেকে বাংলাদেশের মানুষদেরকে হেফাজত করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।