দাঁড়িয়ে পান করা সম্পর্কিত দুই রকম হাদীসের ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: কিছু হাদীসে রাসূল ﷺ দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন আবার কিছু হাদীসে এসেছে রাসূল ﷺ দাঁড়িয়ে পান করেছেন দুই রকম হাদীসের ব্যাখ্যা কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কুরআন সুন্নার আলোকে যেটি প্রমানিত হয় তা হল: বসে পানাহার করাই সুন্নাহ সম্মত। বিনা কারণে দাঁড়িয়ে পান করা উচিত নয়, কারন রাসূল ﷺ একাধিক হাদীসে দাড়িয়ে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন। তবে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পানাহার করা জায়েজ। আর উভয় মতের পক্ষে দলিল রয়েছে। যেমন: আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোককে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। কাতাদাহ বলেন, আমরা আনাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম,‘আর (দাঁড়িয়ে) খাওয়া?’ তিনি বললেন, ‘তা তো আরো মন্দ বা আরো জঘন্য কাজ। (সহীহ মুসলিম হা/২০২৪ তিরমিযী হা/১৮৭৯, আবূ দাউদ হা/৩৭১৭, ইবনু মাজাহ ৩৪২৩, ৩৪২৪ মুসনাদে আহমাদ হা/১১৭৭৫)
.
অপর বর্ননায় আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউই যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। যদি কেউ ভুলবশতঃ এরূপ করে, সে যেন বমি করে ফেলে (সহীহ মুসলিম, হা/২০২৬-১১৬, সিলসিলা সহীহাহ, হা/৭৭১৮ আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/১৫০৩৭)
.
উপরোক্ত বমি করা সংক্রান্ত হাদীসটির হুকুম সম্পর্কে অধিকাংশ আহালুল আলেমগন বলেছেন, এই হাদীসটি মানসূখ হয়ে গেছে। কারন একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমানিত রাসূল ﷺ দাড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন আবার কিছু হাদীস থেকে বুঝা যায় রাসূল ﷺ দাঁড়িয়ে পান করেছেন। দুই রকম হাদীসের মধ্যে সমন্বয় হল বিনা ওজরে দাঁড়িয়ে পান করা জায়েয নয় বরং সুন্নাহ পরিপন্থী। তবে ওজর বসত বসে পান করার জায়গা না থাকলে দাঁড়িয়ে পান করা যায়। (সিলসিলা সহিহাহ হা/১৭৫)
.
অপরদিকে যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৬৮ হি.] এর হাদীসের মধ্যে যমযমের পানি এবং ওযূর অবশিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন: আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি এক বালতি যমযমের পানি নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হলাম, তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন(সহীহ বুখারী হা/ ১৬৩৭ সহীহ মুসলিম হা/২০২৭)-১১৭, মুসনাদে আহমাদ হা/ ২২৪৪, নাসায়ী ২৯৬৫, তিরমিযী হা/১৮৮২, ইবনু মাজাহ হা/ ৩৪২২)
.
প্রখ্যাত সাহাবী আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৪০ হি.] হতে বর্ণিত: একদিন তিনি যুহরের সালাত আদায় করলেন, অতঃপর জনগণের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ সমাধানের জন্য কূফার (মসজিদের) আঙ্গিনায় বসলেন। এমনকি ‘আসর সালাতের ওয়াক্ত হয়ে গেল। তারপর পানি আনা হল। তিনি তার কিছুটা পান করলেন এবং নিজের হস্তদ্বয় ও মুখ ধুইলেন।বর্ণনাকারী তাঁর মাথা ও পদদ্বয়ের কথাও উল্লেখ করেছেন (অর্থাৎ- উযূ করলেন)। অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন এবং দাঁড়ানো অবস্থায় পাত্রের অবশিষ্ট পানি পান করলেন। পরে বললেন, লোকেরা দাঁড়িয়ে পানি পান করাকে মাকরূহ মনে করে, অথচ আমি যেরূপ করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও অনুরূপ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/৫৬১৬ মুসনাদে আহমাদ হা/৯৭০,মিশকাত হা/৪২৬৯)
.
দুই রকম হাদীসের এ বিরোধের সমাধানে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, দাঁড়িয়ে পান করা নিষেধের হাদীস মাকরূহে তানযীহীর উপর প্রযোজ্য, আর দাঁড়িয়ে পান করা (সম্পর্কিত হাদীস) হচ্ছে জায়িযের উপর প্রযোজ্য।(فَمَنْ نَسِيَ مِنْكُمْ فَلْيَسْتَقِئْ) এখানে ভুলে দাঁড়িয়ে পান করলে বমি করে ফেলার নির্দেশ ওয়াজিব নয়, বরং মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পান করল তার ওপর মুস্তাহাব হল বমি করে ফেলা। দলীল স্বরূপ এ সহীহ হাদীসটি। কেননা হাদীসটি কোন ওযরে ওয়াজিব না হলে মুস্তাহাব হবেই। (শারহুন নাবাবী ১৩শ খন্ড, হাঃ ২০২৪)
.
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করা যে জায়েয, সেটা বুঝানোর জন্যই রাসূল (ﷺ) এরূপ করেছেন (ফাৎহুল বারী হা/২৬১৫-১৬-এর আলোচনা)। ইমাম নববীও একই মন্তব্য করেছেন (শরহ নববী হা/২০২৭-এর আলোচনা)।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, দাঁড়িয়ে পানকারী একজন লোককে বমি করার হুকুম দিয়েছেন। তবে সহীহ সূত্রে এও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দাড়িয়ে পান করেছেন। এ জন্যই কোন কোন আলেম বলেন- দাঁড়িয়ে পান করার নিষিদ্ধতা রহিত হয়ে গেছে। আরও বলা হয় যে, নিষিদ্ধতা দ্বারা দাঁড়িয়ে পান করা হারাম বুঝা যায়নি (বরং তা ভদ্রতার খেলাফ)। আরও বলা হয়েছে যে, তিনি প্রয়োজন বশতঃ দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন।(যাদুল মা‘আদ ১/১৪৩-৪৪) অপর বর্ননায় ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পান করার নেতিবাচক প্রভাব এবং বসে থাকা অবস্থায় পান করার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পান করার অনেক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যার মধ্যে একটি হল এটি তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে নিবারণ করে না এবং পেটে স্থির হয় না যাতে লিভার শরীরের অন্যান্য অংশে পুষ্টি বিতরণ করতে পারে। বরং তা দ্রুত ও বল সহকারে পেটে আসে ফলে এতে ঠাণ্ডা বা অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে যা ধীরে ধীরে নড়াচড়া না করে দ্রুত শরীরের নিচের অংশে চলে যেতে পারে। এ সবই পানকারীর জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু যদি সে মাঝে মাঝে বা প্রয়োজনের সময় তা করে তবে তা তার ক্ষতি করবে না… জাদ আল-মাআদ,খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:২২৯)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন, মূলনীতি হল: বসে থাকা অবস্থায় পান করা উচিত,এটিই উত্তম, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পান করা যেতে পারে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উভয়টিই প্রমান করার জন্য করেছেন যে এ ব্যাপারে কৌশলের অনেক অবকাশ রয়েছে।(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ২২/১৩৩)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,বসা অবস্থায় পান করা উত্তম এবং দাঁড়িয়ে পান করা জায়েয আর যে হাদিসে বমি করার কথা এসেছে তা মানসুখ (রহিত)। কারণ সহীহ হাদিসগুলো ইঙ্গিত করে যে,রাসূল (ﷺ) দাঁড়িয়ে ও বসে উভয় অবস্থায় পান করতেন। (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব ইবনে বায,অফিসিয়াল ওয়েবসাইট,ফাতওয়া নং-১৫৯৬৫)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, বিনা প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে খাওয়া-দাওয়া করা মাকরূহ। (আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা,৫/৪৭৭ ফাতাওয়া ইবনে বায”২৫/২৭৬)
.
পরিশেষে আমরা বলবো, যেকোন ধরনের পানাহার বসে করাই সুন্নাহ সম্মত। (সহীহ মুসলিম হা/২০২৪, মিশকাত হা/৪২৬৬, ৬৭)।কারন রাসূল (ﷺ) একাধিক হাদীসে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। যেমন: আনাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা/২০২৫-২৬, তিরমিযী হা/১৮৮০) তবে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করাও জায়েয (আহমাদ হা/৭৯৫, বুখারী হা/৫৬১৫, ইবনু মাজাহ হা/৩৩০১, মিশকাত হা/৪২৭৫ ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ২২/১৩৩)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।