আমি এটি করব এবং বাকিটা আল্লাহর হাতে এই বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রসূল এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর। আমি এটা ওটা করবো বাকিটা আল্লাহর হাতে এই বাক্যটি ব্যবহারের দুটি উদেশ্য হতে পারে। যার একটি বৈধ অপরটি অবৈধ। যেমন:

(১). আমি অমুক-অমুক-কাজ করব, বাকিটা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। এই বাক্যটি ব্যবহার করা সঠিক নয়। কারণ এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের উপর ভরসা করেছে আগে আর আল্লাহর ওপর ভরসা করাটা এসেছে নিজের ওপর ভরসা করার পর। অথচ মুমিনদের সর্বাবস্থায় প্রথমেই আল্লাহ্‌র উপর পরিপূর্ণ নির্ভর করা আবশ্যক। কারন মানুষ তার লক্ষ্য পূরণে যত প্রকারের উপায় উপকরণই ব্যবহার করুক না কেন তাতে এমন কিছু ফাঁক-ফোঁকর থেকেই যাবে যা সে বন্ধ করতে পারেনি। যে কারণে তার মনে ভয় থাকে- হয়তো ব্যর্থতা এসে তাকে ঘিরে ধরবে এবং তার আশা পূরণ হবে না। কিন্তু যখনই সে পরিপূর্ণ ভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে এবং বিশ্বাস করবে যে, তার যাবতীয় কাজে আল্লাহই তার পক্ষে যথেষ্ট তখন আর তার ঐ সকল ফাঁক-ফোঁকরের ভয় থাকবে না। তখন সে এক ধরনের আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি ও আরাম উপভোগ করবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে মানুষ মানসিক ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। বান্দা তার প্রভুকে চেনা এবং এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে, সবকিছু তাঁর হাতে। তিনিই এককভাবে সবকিছু পরিচালনা করেন। এককভাবে তিনিই উপরে উঠান ও নীচে নামান। তিনিই সম্মানিত করেন ও লাঞ্ছিত করেন। তিনি যা দেন তা প্রতিরোধ করার কেউ নেই। তিনি যা দেন না তা দেয়ার কেউ নেই। সকল মানুষ আল্লাহ্‌র জন্য বা তাদের নিজেদের জন্য কোন উপকার বা ক্ষতির মালিক নয়; মৃত্যু বা জীবনের বা অন্য কিছুর মালিক নয়। যদি বান্দা এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পারে তাহলে তার অন্তর তার প্রভুর সাথে সম্পৃক্ত হয়। এ ঈমানের কারণে যে, মানুষ তার প্রভুর অনুমতি ছাড়া তার উপকার করতে পারবে না এবং তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যেমনটি ইবনে আববাস থেকে হাদীস এসেছে (দেখুন তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৩০২)।
.
মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেছেন: যদি আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেন তবে তোমাদের উপর বিজয়ী কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেন তবে কে এমন আছে যে, তোমাদেরকে এর পরে সাহায্য করবে? আর আল্লাহর উপরই যেন মুমিনগণ তাওয়াক্কুল করে’ (আলে ইমরান ১২০)।অপর আয়াতে বলেন, তুমি বলে দাও, আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা ছাড়া অন্য কোন বিপদ আমাদের উপর আসতে পারে না, তিনিই আমাদের কর্মবিধায়ক এবং অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরই মু’মিনদের ভরসা রাখা উচিৎ’ (তাওবা ৫১)। তিনি আরো বলেন, কানাঘুষা তো শয়তানের কাজ যা মুমিনদের দুঃখ দেয়ার জন্য তৈরী করা হয়; তবে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত সে তাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। মুমিনদের কর্তব্য আল্লাহর উপর নির্ভর করা’ (সূরা মুজাদালাহ ১০) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, কর্মভার আল্লাহর নিকট সমর্পণ সংক্রান্ত আল্লাহর কিতাবে সবচেয়ে বড় আয়াত আল্লাহর বাণী ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য বেরোনোর উপায় করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না’ (সূরা তালাক্ব ৬৫/২-৩ আল-মু‘জামুল কাবীর, ৯/১৩৩, হা/৮৬৫৯)।
.
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাওয়াক্কুল ঈমানের শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ বলেন, আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখো যদি তোমরা বিশ্বাসী (মুমিন) হও। [সূরা আল-মায়িদাহ:২৩] ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)
এই আয়াতের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ এখানে ঈমানদার হওয়ার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করার শর্তারোপ করেছেন। এতে বুঝা গেলো আল্লাহর উপর ভরসা না থাকলে ঈমান থাকে না। বান্দার ঈমান যতই বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর উপর তার ভরসাও ততো মজবুত হবে। ঈমান যখন দুর্বল হবে, তখন ভরসাও দুর্বল হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসার দুর্বলতা বান্দার ঈমান দুর্বল হওয়ার প্রমাণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের অনেক জায়গায় তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও ইবাদতকে একসাথে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল ও ঈমানকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং তাকওয়াকে একসাথে মিলিয়ে, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং ইসলামকে একসাথে মিলিয়ে আবার কোথাও তাওয়াক্কুল এবং হিদায়াতকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা গেলো, ঈমানের সকল স্তরের মধ্যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল হলো মূল আর ইহসান বা ইখলাস হলো ইসলামের সমস্ত আমলের মূল। আর ঈমানের মধ্যে তাওয়াক্কুলের মর্যাদা দেহের মধ্যে মাথার মর্যাদার মতোই। দেহ ছাড়া যেমন মাথার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি তাওয়াক্কুলের ভিত্তি ছাড়া অন্য কিছুর উপর ঈমান, ঈমানের শাখাসমূহ ও ঈমানের আমলসমূহ ঠিক হয় না।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে,আমি আমার সেরাটা দিয়েছি এবং বাকিটা আল্লাহর উপর নির্ভর করছে” বলাটা কতটা সঠিক?
.
উত্তরে শাইখ বলেন, এই বাক্যাংশটি সঠিক নয়, কারণ এর অর্থ হল যে এটি বলছে সে প্রথমে নিজের উপর আস্থা রাখছে। বরং তাকে যা বলা উচিত তা হল, “ আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং আমি আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। “এটাই সঠিক। সম্ভবত যখন একজন ব্যক্তি বলে “আমি আমার সেরাটা করেছি এবং বাকিটা আল্লাহর উপর নির্ভর করে”, তখন সে যা বোঝায় তা হল আমি এখানে যা পরামর্শ দিয়েছি, অর্থাৎ আমি যা করতে পারতাম, আমি করেছি এবং যা করতে পারি না তা আল্লাহর উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাক্যাংশটি মূলত ভুল। বরং তার বলা উচিত, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং আমি আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি।”(মাজাল্লাত আল-হিবাহ-এ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে উসাইমীন (রহ.)-এর ফাতওয়া পৃষ্ঠা:১৭ ফাতওয়া নং-৫০ এবং ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৭৪৩)
.
(২). আমি সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি এবং বাকিটা আল্লাহর কাছে। নিয়ত ঠিক রেখে এই বাক্যটি ব্যবহার করা সঠিক। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,মানুষ যা চেষ্টা করে তাই পায়। তার চেষ্টার ফল অচিরেই প্রকাশ পাবে। (সূরা নাজম, আয়াত: ৩৯-৪০) চেষ্টা করার পরও কখনো কখনো সফল হওয়া যায় না। কেননা সফলতা আল্লাহর হাতে। তাই বান্দা বলে, আমরা চেষ্টা করতে পারি, বাকিটা আল্লাহর হাতে। সুতরাং এভাবে বলা দোষনীয় নয়। কারণ এই বাক্যের উদ্দেশ্য কখনোই এটা নয় যে, অর্ধেক আল্লাহর হাতে আর অর্ধেক বান্দার হাতে। বরং উদ্দেশ্য হলো, বান্দা তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে। বাকি সফল হওয়া না হওয়াটা আল্লাহর ফয়সালার উপর।মূলত আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে দারুল আসবাব বা উপকরণ নির্ভর বানিয়েছেন। যদিও আল্লাহ উপকরণ ছাড়াও দিতে পারেন- এটাই মুমিনের বিশ্বাস। ফলে দুনিয়াতে যে বীজ বুনবে, সে ফসল পাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু বীজ বুনলেই যে ফসল ফলবে তার কোন গ্যারান্টি নাই। বান্দার কাজ বীজ বপন করা ও ক্ষেতের পরিচর্যা করা। বাকিটুকু আল্লাহর ওপর। অর্থাৎ, সেই বীজ থেকে ঠিক মতো চারা গজানো, তারপর সেই চারা বড় হয়ে তাতে ফসল ফলা ইত্যাদি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। তবে ভুলেও এমন চিন্তা করা যাবেনা যে, আল্লাহর ইচ্ছে বা সাহায্য ছাড়া নিজের কিছু করার ক্ষমতা আছে অথবা কোন কাজ করতে গিয়ে অর্ধেক নিজের উপর আর অর্ধেক আল্লাহর উপর তাহলে উক্ত বক্তব্য শরীয়ত বিরোধী হয়ে যাবে। কারন মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই ইচ্ছা করতে পারো না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞ’’। (সূরা দাহার: ৩১) আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাকবীরের আরো বলেন,وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ‘‘তোমরা আল্লাহ রাববুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে কোনোই ইচ্ছা করতে পারো না’।(সূরা তাকবীর,আয়াত,২৯)
.
সৌদি আরবের বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ মুহাম্মদ বিন সাউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আল বাররাক [জন্ম:১৯৩৩ খ্রি:] (হাফিযাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞেস করা হয় প্রশ্ন:“আমার যতটুকু করার তা আমি করেছি- বাকিটা আল্লাহর উপর।” এ কথা বলার হুকুম কী?
.
উত্তরে শাইখ বলেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসুলের উপর। অত:পর যে কেউ এই বাক্যটি বলে তার মানে হল যে, আমি যে বিষয়টি অর্জন করতে চাই তার জন্য আমি সাধ্যানুযায়ী কারণটা করেছি (অর্থাৎ আমার যেটা করণীয় তা আমি করেছি)। কিন্তু লক্ষ্য হাসিল বা ফলাফল অর্জনের জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করছি। আর এ অর্থটি সত্য। কারণ আল্লাহর রহমত ও তওফিক ছাড়া বান্দা তার লক্ষ্য অর্জন এবং প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। সুতরাং উক্ত বাক্যাংশটির অর্থ হল, হাদিসে যা এসেছে: اعقلها وتوكل “আগে উঁট বাধো, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর।” (অর্থাৎ উটকে না বেঁধে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থেকো না। অন্যথায় উট পালিয়ে যাবে)। এটি তিরমিযী (২৫১৭) এবং ইবনে হিব্বান (৭৩১) বর্ণনা করেছেন। এটি‌ একজন মুসলিমের জন্য উপযুক্ত যে, সে যা চায় তা অর্জনের জন্য তার প্রতিপালকের উপর ভরসা করবে। ফলে সে বৈধ কারণগুলো করার জন্য চেষ্টা করার পাশাপাশি তার প্রতিপালকের সাহায্য প্রার্থনা করবে যাতে সে যা চায়, সেভাবে তা পেতে পারে। যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,احرص على ما ينفعك، واستعن بالله ولا تعجِز “যা তোমার জন্য কল্যাণকর তা গুরুত্ব সহকারে করো এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম হয়ো না।”[সহীহ মুসলিম হা/২৬৬৪] তবে যে এ জাতীয় কথা বলবে, তার “বাকিটা আল্লাহর উপর” না বলে বলা উচিৎ “বাকিটা আল্লাহর কাছে।”(আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।(https: www.islamtoday.net ফাতওয়া নং ৬০-৯৬২০৬) মহান আল্লাহ সবাইকে সালাফদের মানহাজ অনুযায়ী দ্বীনের বিধি বিধান পালন করার তৌফিক দান করুক আমিন।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।