ফরয সালাতের পর বিভিন্ন দু‘আর সাথে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব, নাস ইত্যাদি পড়ার পর বুকে ফুঁ দিয়ে এবং হাতে ফুঁ দিয়ে গোটা শরীর মাসাহ করা কি ঠিক

প্রশ্ন: পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পর বিভিন্ন দু‘আর সাথে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব, নাস ইত্যাদি পড়ার পর বুকে ফুঁ দিয়ে এবং হাতে ফুঁ দিয়ে গোটা শরীর মাসাহ করা কি ঠিক?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হল ইসলাম। (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)। আর এই দ্বীন পরিচালিত হবে একমাত্র আল্লাহর বিধান অনুযায়ী। এবং তা বাস্তবায়িত হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে। আমরা জানি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবদ্দশাতেই আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন-ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। (সূরা মায়েদা: ৩)। যার মধ্যে সামান্যতম সংযোজন-বিয়োজন করার অধিকার পৃথিবীর কোন মানুষকে দেওয়া হয়নি। দুঃখের বিষয় হ’ল বর্তমানে ইসলামের মধ্যে এমন কতগুলি কাজ ইবাদত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে যার কোন ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে না থাকলেও মানুষ সেগুলিকে ইসলামের বিধান হিসাবেই গ্রহণ করেছে এমনি একটি আমল পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর দেশের বিভিন্ন মসজিদে কোন কোন মুসুল্লিকে নিয়মিত সূরা আল-ইখলাছ সহ সূরা আল-ফালাক্ব পড়ে সারা শরীর মাসাহ করতে দেখা যায় অথচ উক্ত আমলের কোন সহীহ দলিল আছে কিনা সেটা যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজনও মনে করেনা।
.
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পর যিকির, তাসবীহ ও আয়াতুল কুরসীসহ বিভিন্ন সূরা পড়ার কথা বিভিন্ন সহীহ হাদীসে স্পষ্ট এসেছে। কিন্তু সেগুলো পড়ে শরীর মাসাহ করার বিষয়ে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না। তাই এগুলো পরিহার করাই উচিত। বিশেষ করে কেউ যদি তা নিয়মিত করে তাহলে বিদ‘আতে পরিণত হবে। তবে রুকইয়া তথা ঝাড়ফুঁকের উদ্দেশ্যে যদি কেউ করে থাকে তাহলে তাতে বাধা নেই। (সহীহ বুখারী, হা/৪৪৩৯, ৫৭৩৫; সহীহ মুসলিম, হা/২১৯২)।
.
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর হাদীস অনুযায়ী সুন্নত সম্মত আমল হলো যোহর, আসর ও এশার সালাতের পর সূরা আল-ইখলাছ সহ সূরা আল-ফালাক্ব ও সূরা আন-নাস একবার করে পাঠ করা। উক্ববাহ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রত্যেক সালাতের পর মুআওয়াযাত তথা আশ্রয় প্রার্থনার সূরাগুলো পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ, হা/১৫২৩, সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, “উক্ত হাদীসে ‘মুআওয়াযাত তথা আশ্রয় প্রার্থনার সূরাগুলো’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তিনটি সূরা। সূরা নাস ও ফালাকের সাথে সূরা ইখলাসকেও শামিল করা হয়েছে তাগলীব এর ভিত্তিতে। কেননা, এতে আল্লাহ তাআলা গুনাগুণ বর্ণিত হয়েছে। যদিও তাতে আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়টি স্পষ্টভাবে আসে নি।
..
আর ফজর ও মাগরিব সালাতের পর অথবা সকাল বিকালে সূরা আল-ইখলাছ, সূরা আল-ফালাক্ব ও সূরা আন-নাস তিনবার করে পাঠ করা। একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুল্লাহ ইবনু খুবাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কে বলেন, ‘তুমি প্রতিদিন বিকালে ও সকালে উপনীত হয়ে তিনবার করে সূরা কুল হুআল্লাহু আহাদ অর্থাৎ সূরা আল-ইখলাছ এবং আল-মুআওবিযাতাইন অর্থাৎ সূরা আল-ফালাক্ব ও সূরা আন-নাস পাঠ করবে, তাহলে তা তোমার প্রত্যেক বিষয়ের জন্য যথেষ্ট হবে।’ (তিরমিযী, হা/৩৫৭৫; তা‘লীকুর রাগীব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২৪, সনদ হাসান; ফাতাওয়া শায়খ বিন বায ২৬/২৪ পৃঃ)।
.
ঘুমানের পূর্বে হাত দ্বারা মাসাহ করার কথা হাদীসে এসেছে; সালাতের পরে নয়। যেমন: ‘আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বিছানায় আসতেন, তখন তিনি তাঁর দু’হাতের তালুতে সূরা ইখলাস এবং মুআওব্বিযাতায়ন পড়ে ফুঁক দিতেন। তারপর উভয় তালু দ্বারা আপন চেহারা ও দু’হাত শরীর যতদুর পৌছায় মাসাহ্‌ করতেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন অসুস্থ হন, তখন তিনি আমাকে ঐ রকম করার নির্দেশ দিতেন।ইউনুস (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু শিহাব (রহঃ)-কে, যখন তিনি তাঁর বিছানায় শুতে যেতেন, তখন ঐ রকম করতে দেখেছি। (সহিহ বুখারী: ৫৭৪৮, আধুনিক প্রকাশনী: ৫৩২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৫২২৪)।
.
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ প্রতি রাতে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিছানায় যাওয়ার প্রাক্কালে সূরা ইখ্লাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে দু’হাত একত্র করে হাতে ফুঁক দিয়ে যতদূর সম্ভব সমস্ত শরীরে হাত বুলাতেন। মাথা ও মুখ থেকে আরম্ভ করে তাঁর দেহের সম্মুখ ভাগের উপর হাত বুলাতেন এবং তিনবার এরূপ করতেন। (সহিহ বুখারী: ৫০১৭ আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৪৪, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৪৮)।

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃযখনই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ হতেন তখনই তিনি ‘সূরায়ে মু’আব্বিযাত’ পড়ে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন রোগ কঠিন হয়ে গেল, তখন বারাকাত অর্জনের জন্য আমি এই সূরা পাঠ করে তাঁর হাত দিয়ে শরীর মাসহ্ করিয়ে দিতাম। (সহিহ বুখারী: ৫০১৬ আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৪৩, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৪৭)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ‘কোন রোগ বা যাদু-টোনা থেকে মুক্তির জন্য যেকোন সময় পড়ে রুকইয়ার জন্য মাসাহ করা যেতে পারে, সালাতের পর সময়কে নির্দিষ্ট করা যাবে না। (ইবনু বায, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৮৮)। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীন বুঝার তওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।